আরনেস্ট বার্কারের তাত্ত্বিক অবস্থান অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। তিনি আদর্শবাদী গ্রীণের মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আবার হ্যারল্ড ল্যাস্কির উদারনীতিক মতবাদের প্রভাবকেও তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বার্কারের ধারণা বিচার-বিশ্লেষণ করলে বার্কারের উপরই এই দ্বিবিধ প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। অধ্যাপক বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে ‘স্বাধীনতার নীতি’ শিরোনামে স্বাধীনতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
স্বাধীনতা একটি দায়িত্ব ও নীতি: বার্কার স্বাধীনতাকে একটি অন্যতম অধিকার হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর মতানুসারে স্বাধীনতা সর্বদাই দায়িত্বের সূচক হিসাবে প্রতীয়মান হয়। যেমন কোন কাজ করার স্বাধীনতা দাবী করার অর্থ হল সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করা। বার্কার বলেছেন: “…liberty is always also responsibility, and to be free to act is also to be responsible for action.” বার্কার স্বাধীনতাকে একটি নীতি হিসাবে দেখেছেন। এবং ব্যক্তি মানুষের সামর্থ্যের সর্বাধিক বিকাশ সাধন করাই হল এই নীতির মূল লক্ষ্য। এই নীতি অনুসারে রাষ্ট্রের কাজে প্রত্যেক নৈতিক ব্যক্তি (moral person) হল স্বাধীন সত্তাযুক্ত। এ রকম প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের সামর্থ্যসমূহকে নিজের মত করে বিকশিত করতে সমর্থ। এবং এই বিকাশের জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসাবে যে সমস্ত অধিকারের কথা বলা হয় সেগুলি অনুশীলন ও ভোগ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সক্ষম। বার্কার বলেছেন: “The principle means that the state treats each and every moral person as a free agent, capable of developing his own capacities in his own way…capable of enjoying and exercising the rights which are the conditions of such development.”
আইনগত ধারণা: বার্কারের মতানুসারে স্বাধীনতা হল একটি আইনগত ধারণা। আর স্বাধীনতার দাবী হল সম্পূর্ণভাবে আইনসঙ্গত। স্বাধীনতা পরিমাণগতভাবে আইনবদ্ধতার বা বৈধতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতার অর্থ হল ব্যক্তির আইনসম্মতভাবে স্বীকৃত অধিকার ভোগের ক্ষমতা। বার্কার বলেছেন: “It is also true that liberty is also in its measure, legality, since the liberty of each is his legally recognised power of enjoying the rights which are his part and portion of law.” এই সমস্ত অধিকার আইনের মধ্যেই নিহিত থাকে। রাষ্ট্র হল একটি বৈধ সংগঠন। এবং ব্যক্তি হল রাষ্ট্রের বৈধ ও স্বাধীন সদস্য বা এজেন্ট। রাষ্ট্রের আইনানুগ ব্যবস্থার মধ্যে স্বাধীনতা অনুশীলন করার অধিকার ব্যক্তির আছে। বার্কার বলেছেন: “The state is….association of free legal agents… under its system of law, there is room for…the liberty of the free legal agents.” বার্কারের মতে স্বাধীনতাও হল একটি আইন; অন্তত আইনের একটি অংশ। তিনি বলেছেন: “…liberty is also law, or at any rate a part of law. “
সামাজিক ধারণা: আইনগত স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়। এই কারণে স্বাধীনতাকে অধ্যাপক বার্কার কেবলমাত্র একটি আইনগত ধারণা হিসাবে গণ্য করেননি। বার্কার স্বাধীনতাকে একটি সামাজিক ধারণা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যক্তি-মানুষের অন্তর্নিহিত সামর্থ্যের বিকাশ সাধনের ব্যাপারে বিভিন্নভাবে সমাজ সাহায্য করে। সমাজের সদস্য হিসাবে ব্যক্তি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি স্বাধীনতা ভোগ করে। তাই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক গভীর। এবং এই কারণে রাষ্ট্রের মত সমাজের কাছেও ব্যক্তির বাধ্যতা বর্তমান। বার্কারের মতানুসারে রাষ্ট্রের আইনগত এক্তিয়ারের বাইরে সামাজিক স্বাধীনতা অবস্থান করে। তবে সামাজিক স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে তারা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সামাজিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে সক্ষম। বার্কারের আরও অভিমত হল যে, অনেক ক্ষেত্রে সমাজ নিজেই সামাজিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। যেমন ধর্মের দোহাই দিয়ে সামাজিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। অনেক সময় অন্যায়ভাবে সমাজ ব্যক্তিবর্গের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে সামাজিক স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে এগিয়ে আসে। বার্কার বলেছেন: “…social liberty…. may also be menaced by the society itself…In such a case the state may invade the area of society not as a conqueror but as a genuine liberation.”
স্বাধীনতা চরম বা নিঃশর্ত নয়: রাষ্ট্রাধীন স্বাধীনতা বা আইনগত স্বাধীনতা বলতে কারুর চরম বা অবাধ স্বাধীনতাকে বোঝায় না। এ হল সকলের জন্য সবসময় সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা। অর্থাৎ রাষ্ট্রাধীন স্বাধীনতা হল আপেক্ষিক এবং নিয়ন্ত্রিত। এই স্বাধীনতা হল সর্বজনীন। এবং এই হল স্বাধীনতার সর্বাধিক পরিমাণ যা সকলকে দেওয়া যায়। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বার্কারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করা দরকার। বার্কার স্বাধীনতার এই দিকটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে আইনগত স্বাধীনতা হল আইনানুগ বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এর কারণে এই স্বাধীনতা চরম বা নিঃশর্ত স্বাধীনতা হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনিবার্যভাবে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও শর্তাধীন। প্রত্যেক মানুষেরই স্বাধীন হওয়া উচিত। এই কারণে কোন মানুষই চূড়ান্তভাবে বা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হতে পারে না। অন্য সকলের অনুরূপ ও সমপরিমাণ স্বাধীনতার সঙ্গে মিলিতভাবে প্রত্যেককে তার নিজের স্বাধীনতা ভোগ করতে হবে। বার্কার বলেছেন: “….legal liberty: just because it is legal, is not an absolute or unconditional liberty. The truth that every man ought to be free has for its other side complementary and consequential truth that no man can be absolutely free. The need of liberty for each is necessarily qualified and conditional by the need of liberty for all.”
স্বাধীনতা আপেক্ষিক: সুতরাং স্বাধীনতা চরম বা চূড়ান্ত নয়। কারুর স্বাধীনতা কখনই চরম বা চূড়ান্ত হতে পারে না। স্বাধীনতা হল সব সময় শর্তসাপেক্ষ। কেউই এককভাবে নিজের বিষয়ে বা সমাজ সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। অন্যান্যদের বিষয়েও ভাবতে হয়। এই ভাবনা কোনভাবেই এড়ান যায় না এবং এইভাবে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতা এসে যেতে বাধ্য। স্বাধীনতা হল সব সময়েই আপেক্ষিক। প্রত্যেকের স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য এবং অন্যের স্বাধীনতার আপেক্ষিক। এই কারণে বার্কার স্বাধীনতাকে আপেক্ষিক অর্থে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন: “…liberty in the state, or legal liberty, is never the absolute liberty of each, but always the qualified liberty of all.”
স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত: সুতরাং স্বাধীনতা হল আপেক্ষিক। এবং আপেক্ষিক বলেই স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য। প্রকৃত প্রস্তাবে অনিয়ন্ত্রিত হলে স্বাধীনতার অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যেত। নিয়ন্ত্রিত না হলে স্বাধীনতার যথেচ্ছ ব্যবহার ঘটবে। যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হবে। অর্থাৎ তখন যথার্থ স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। একজনের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা অন্যান্যদের স্বাধীনতা ভোগকে বিপন্ন করে তুলবে। সমাজের সকলকেই যদি পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিতে হয়, তা হলে স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ না করে উপায় নেই। একজনের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার জন্য সকলের আপেক্ষিক ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করা যায় না। এই কারণে রাষ্ট্রাধীন স্বাধীনতা হল সব সময়ই আপেক্ষিক ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা। বার্কার বলেছেন: “Liberty within the State is thus a relative and regulated liberty.” বার্কার আরও বলেছেন: “Because the liberty of each is thus relative to that of others, and has to be adjusted to that of others, it must always be regulated; and indeed it would not exist unless it were regulated.”
নৈতিক স্বাধীনতা: স্বাধীনতা নির্ণীত ও স্থিরীকৃত হয় মূলত দুটি শর্তের দ্বারা। অধ্যাপক বার্কার এই দুটি শর্তের কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট শর্ত দুটি হল: (১) অন্যের অভিন্ন ও সমপরিমাণ স্বাধীনতার সঙ্গে সকলের স্বাধীনতা ভোগের প্রয়োজনীয়তা এবং (২) বিশেষ কিছু সামর্থ্য উপলব্ধির উদ্দেশ্যে সকলের নির্দিষ্ট কিছু স্বাধীনতা ভোগের প্রয়োজনীয়তা। বার্কারের মতানুসারে সকলের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেই একটি নৈতিক ভিত্তি বর্তমান থাকে। তদনুসারে স্বাধীনতা অতি অবশ্যই ‘নৈতিক স্বাধীনতা’ (moral liberty) হিসাবে প্রতীয়মান হওয়া দরকার। বার্কার বলেছেন: “…the liberty of all has a moral basis and must accordingly be what Burker calls ‘moral liberty.”
তিন ধরনের স্বাধীনতার মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা: সাধারণভাবেই এই ধারণা প্রচলিত দেখা যায় যে, স্বাধীনতাকে আইন নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই কারণে আইন ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক হল বিরোধিতার। তবে বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত পোষণ করেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে আইনের মাধ্যমে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয় এবং কিছু মানুষের অবাধ স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ আইনের সঙ্গে প্রকৃত স্বাধীনতার কোন বিরোধ নেই বা থাকতে পারে না। তবে বার্কারের মতানুসারে আইনের সঙ্গে বিরোধ না বাধলেও, নিজের সঙ্গেই স্বাধীনতার বিরোধের কারণ বর্তমান। বার্কার বলেছেন: “If liberty and law do not quarrel, liberty may quarrel with itself.” তাঁর মতে স্বাধীনতা হল বরাবরই বহুত্ববাচক (liberty is plural)। আইনগত স্বাধীনতার মধ্যে একাধিক গঠনাকৃতি পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনতার এই গঠনাকৃতিগুলির পরস্পরের মধ্যে বিরোধ বাধার আশঙ্কা আছে। অধ্যাপক বার্কারের অভিমত অনুসারে স্বাধীনতার আকৃতিগত বিভিন্নতা বর্তমান। এই সমস্ত স্বাধীনতার মধ্যে সহাবস্থান থাকে। তবে এদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতের সম্ভাবনাও থাকে। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যেই এই সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। বার্কার মূলত তিন ধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। স্বাধীনতার এই তিনটি ধরন হল পৌর স্বাধীনতা, রাজনীতিক স্বাধীনতা এবং আর্থনীতিক স্বাধীনতা। বার্কারের মতে স্বাধীনতার এই তিনটি রূপের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ থাকে। কোন বিষয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা দিতে পারে। তখন সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। এই বিভেদের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতাও ভিন্নমুখী হয়ে পড়তে পারে। সেই অবস্থায় ঐক্যসাধনের ক্ষমতা স্বাধীনতার থাকে না। অধ্যাপক বার্কারের অভিমত হল, স্বাধীনতা হল প্রকৃত প্রস্তাবে একটি জটিল ধারণা। এবং এই স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্যের কারণেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়।
Leave a comment