“সে আর লালন একখানে রয় তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।”
উত্তর: বাউলসাধক লালন শাহ্ তাঁর মতাদর্শ সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সাধনার গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশে তিনি যুগপৎ হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের শব্দাদি ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রচারিত মতাদর্শে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের কথা রূপক আকারে স্থান লাভ করেছে। এছাড়াও তিনি দেহতত্ত্বের নানা বিষয়াদি প্রকাশে তান্ত্রিক ও যোগসাধনের কথাও উল্লেখ করেছেন। বাউল লালন শাহের সাধনা মূলসুর দেহতত্ত্বমূলক এবং তিনিও আত্মার যথার্থ উপলব্ধির মাধ্যমে পরম জ্ঞান লাভের কথা বলেছেন। এজন্য তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন-
“আজব কারখানা বোঝা সাধ্য কার,
সাঁই করে লীলা ভবের পার।
এই মানুষে রঙ্গ রসে বিরাজ করে সাঁই আমার।।”
যে পড়শী বহুকাল থেকে বাস করে মানবদেহে, এত কাছে থাকার পরও সেই পড়শীর সন্ধান মানুষ পায় না। সেই পড়শীকে একদিনও দেখা গেল না। পড়শীকে কাছে পেতে হলে দরকার সাধনা। কিন্তু সে পড়শী বহুরূপী। সে একস্থানে বাস করে না। তার অবস্থান কখনো শূন্যের ওপরে, আবার কখনো ভাসে পানিতে। বাউলতত্ত্বের আজীবন সাধনা পড়শীকে একান্ত আপন | করে পাবার সাধনা। তাকে একবার পেলে সমস্ত জানা ঘুচে যেত। জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যেত। তাই বাউল কবির উচ্চারণ:
“ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে ৷
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো
আমার সব-যাতনা যেতো দূরে।”
লালনের ব্যাপক জনপ্রিয়। দার্শনিক সক্রেটিসেরকে নিজেকেল জানেমাত্রেই বিখ্যাত উক্তির প্রতিফলন দেখতে পাই লালনের গানে। লালন বলেন-
‘আমার আপন খবর আপনার হয় না।
একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।’
আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমেই পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভ করা যায়। ঈশ্বর বা স্রষ্টা মানুষের খুব কাছেই বিরাজ করে, কিন্তু দিব্যদৃষ্টির অভাবে তাকে আমরা দেখতে পাই না। কাছের মূল্যবান জিনিসকে পদদলিত করে আমরা দূরের জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণে লালন বলেছেন:
সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষযোজন ফাঁক রে।
বাউলদর্শনের অমিত বাণী মানবহৃদয়ে প্রবেশ করলে স্রষ্টাকে সহজেই পাওয়া যাবে। সে কারণে স্রষ্টাকে খুঁজতে দূরে কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই। নিজের মধ্যেই সে বিরাজ করে।
Leave a comment