সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা (Obstacles or Problems of Good Governance): বর্তমান সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রই ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রের’ (Welfare State ) রূপ পরিগ্রহ করছে। এরূপ কল্যাণকর রাষ্ট্রে জনগণের কল্যাণ ও ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। দমন ও নিপীড়নের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করার দিন বদলে গেছে। শাসনের সাথে সেবা প্রদানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব লাভ করেছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা কখনো আকস্মিকভাবে ঘটানো যায় না। একে অর্জন করতে হয় ধাপে ধাপে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও রয়েছে বহু সমস্যা। এগুলো নিম্নরূপঃ
১. বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপঃ অধিকাংশ রাষ্ট্রেই, বিশেষ করে অনুন্নত, উন্নয়নশীল, ও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও দেখা যায় যে, জনগণের বাক স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীন সরকার হস্তক্ষেপ করে থাকে। জনগণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে না। সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার ওপর সরকার সেন্সরশীপ আরোপ করে। সরকার সব সময় মুক্ত আলোচনাকে ভয় পায় এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে জনগণ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে পারে না। এর ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সহিংসতা (Lack of Political Stability and Violence): সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব লক্ষ করা যায়। নির্বাচিত সরকার নির্ধারিত মেয়াদ শেষের আগেই বিরোধী দলগুলো সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। এসব আন্দোলন হয়ে ওঠে সহিংস। অকারণে ‘হরতাল’ বা ‘বন্ধ’ ঘোষণা এবং পিকেটিং, জ্বালাও-পোড়াও করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। ফলে সময়ের আগেই সরকারের পতন ঘটে কিংবা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এর ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। প্রশাসন ভেঙে পড়ে বা স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়।
৩. সরকারের জবাবদিহিতার অভাব (Lack of Accountability of the Govt.): অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে এমনকি কোনো কোনো উন্নত রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার অভাব লক্ষ করা যায়। লক্ষ করা যায় যে, সরকারের শাসনবিভাগ তাদের কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট জবাবদিহি করে না । মন্ত্রী ও আইন সভার সদস্যগণ একই দলের হওয়ায় এবং দলীয় শৃঙ্খলার কারণে জবাবদিহিতার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে সুশাসন বিঘ্নিত হয়।
৪. আমলাদের জবাবদিহিতার অভাব (Lack of Accountability of the Bureancrats): সাধারণত আমলারা নিজেদেরকে জনগণের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবেন। তারা নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণি বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার মানসিকতা গড়ে না ওঠায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত হয়ে ওঠে। এজন্যই রিচার্ড ক্রসম্যান বলেছেন যে, “অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের জন্য হুমকীস্বরূপ” (An uncontrolled bureancracy is a threat to democracy’)।
৫. আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা (Inefficiency of the Bureancracy): আমলাতন্ত্রে পূর্বের মতো দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মেধাবী মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, আমলাদের কাজে অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, রাজনীতিকরণ ইত্যাদি কারণে আমলারা ক্রমশ অযোগ্য ও অদক্ষ হয়ে পড়ছে। ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
৬. আইনের শাসনের অভাব (Absence of Rule of Law): অধ্যাপক ডাইসি-এর মতে, আইনের শাসনের মৌলিক তিনটি শর্ত রয়েছে। এগুলো হলো ক. আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, খ. আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান থাকা, গ. শুনানী গ্রহণ ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। এই শর্ত তিনটি মেনে চললেই তবে বলা যাবে যে, আইনের শাসন কার্যকর রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়ন মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ ও নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হয়। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রেই এরূপ অবস্থা বিদ্যমান নেই।
৭. সরকারের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা (Inefficiency and Mismanagement of Govt.): অনেক রাষ্ট্রেই দক্ষ ও যোগ্য সরকার সব সময় দেখতে পাওয়া যায় না। সরকারের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশে অরাজকতা চলতে দেখা যায়। এর ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়। যথার্থ নীতি প্রণয়নে সরকারের দক্ষতা, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা’ শক্ত হাতে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, সমান সেবা বিতরণ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তৎপর হওয়া, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা ইত্যাদি হলো কার্যকর সরকার বা দক্ষ সরকারের বৈশিষ্ট্য। এগুলোর অভাব ঘটলেই ধরে নিতে হবে সে দেশের সরকার অকার্যকর।
৮. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা (Failure to Control Corruption): বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সুশাসনের বড় অন্তরায় হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির রাহুগ্রাস এসব রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলছে। দুর্নীতির কারণে সম্পদের অপচয় হয়, বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হয় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। UNCAC-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে যে, “দুর্নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। কারণ এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা বিনষ্ট হয়, ন্যায়বিচার ও সবার সমান অধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হুমকির মুখে পড়ে।” অধিকাংশ রাষ্ট্রেই দুর্নীতি দমন কমিশন বা ব্যুরো নামক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো স্বাধীন ও কর্মতৎপর নয়।
৯. রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব (Lack of Political Commitment): সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল .. রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিক নেতাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকে না, দলীয় ইশতেহারে যা লেখা থাকে তা বাস্তবায়িত করা হয় না, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা হয় তা’ পূরণ করার সদিচ্ছা থাকে না, রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে চরম উদাসীনতা দেখানো হয়। যুক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে পেশি শক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা, শাসক ও বিরোধী দলসমূহের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং এর পরে দেশজুড়ে সৃষ্ট সহিংসতা সমগ্র রাষ্ট্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট হয়।
১০. রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং ব্যক্তিপূজা (Lack of Democratic Culture in the Political Party): উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অনেক দলে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই ৷ নেতা যা বলেন অধস্তন নেতা-কর্মীরা তা’ মেনে নিতে বাধ্য হন। কেননা তা’ না হলে তাকে দলের মধ্যেই কোণঠাসা করে রাখা হয়, পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করা হয় এমনকি দল থেকেই যেনতেন কারণ দেখিয়ে বহিষ্কার করা হয়। দলগুলোতে নিয়মিত কাউন্সিল করা হয় না অথবা করা হলেও নির্বাচনের পরিবর্তে দলীয় নেতার ওপরই পদপদবি বণ্টনের একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এর ফলে ব্যক্তিপূজা অর্থাৎ একক ব্যক্তির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দলে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । নেতা স্বৈরাচারী মনোভাবের অধিকারী হন। এরূপ স্বৈরাচারী নেতা ক্ষমতায় গিয়ে যে আচরণ করেন, যেভাবে দেশ পরিচালনা করেন তার ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকে না।
১১. রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ (Military intervention in Politics): অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রেই রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ-এর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয় বা অকার্যকর করে রাখা হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে।
১২. স্বজনপ্রীতি-(Napotism): বিশ্বের অনেক দেশেই স্বজনপ্রীতির ব্যাপক বিস্তার লক্ষ করা যায়। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, সুযোগ-সুবিধা বণ্টন, সম্মান-পদবি-খেতাব প্রদান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকার বা গোষ্ঠী স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিদের সেবা ও সহযোগিতা থেকে রাষ্ট্র তথা প্রশাসক বঞ্চিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
১৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকা (Absence of Independence of judiciary): স্বাধীন বিচার বিভাগ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক। স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকায় বা বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুযোগ বিনষ্ট হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শেষ সুযোগটুকুও হাতছাড়া হয়।
১৪. জনঅংশগ্রহণের অভাব (Lack of People’s Participation): প্রশাসনে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের বা মতামত প্রদানের সুযোগের অভাব, জনগণের সাথে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের অভাব, গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার অভাব, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর না করা প্রভৃতির ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।
১৫. অকার্যকর জাতীয় সংসদ (Disfunctional Parliament): গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভার গুরুত্ব অপরিসীম। আইনসভা প্রণীত আইনের আলোকেই একটি দেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তারা জাতীয় সংসদে তুলে ধরবেন, সরকারের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করবেন এবং সমাধান নির্দেশ করবেন। কিন্তু অনেক দেশে আইনসভা দুর্বল। অনেক দেশে শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক দেশে বিরোধী দলীয় সদস্যগণ আইনসভা বয়কট করে রাজপথে আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্যগণ সংসদ বর্জন করে চলেছেন। যখনই যে দল বিরোধী দলের আসনে বসেন—সে দল বা জোটই সংসদ বর্জন করে রাজপথে মিছিল-মিটিং-হরতাল এমনকি জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস পথে অগ্রসর হন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে সংসদে বসে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ফলে জাতীয় সংসদ অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথও প্রশস্ত হচ্ছে না।
১৬. দারিদ্র্য (Poverty ): দারিদ্র্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর্থিক কারণে দরিদ্র জনগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। দরিদ্র ও অসচেতন জনগণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন থাকে। সুতরাং দারিদ্র্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা।
১৭. স্থানীয় সরকার কাঠামোর দুর্বলতা (Weakness of Local Government): সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হলো শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রেই, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে স্থানীয় সরকার কাঠামো খুবই দুর্বল ও অকার্যকর। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
১৮. জনসচেতনতার অভাব (Absence of Peoples awareness): জনগণের সচেতনতাই গণতন্ত্রের সফলতার মূল শক্তি। জনগণের সজাগ দৃষ্টি নাগরিক অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। এজন্যই জনসচেতনতা সুশাসনেরও চাবিকাঠি। জনগণ সচেতন না হলে সরকার, প্রশাসনযন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এর ফলে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
১৯: ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব (Absence of Balance of Power): সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারের এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এর ফলে সরকারের কোনো বিভাগের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করার প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রই এরূপ ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি কার্যকর রয়েছে। এর ফলে অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘সুশাসন’ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২০. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অভাব (Absence of Free & Neutral Election Commission): অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্বাচন কমিশন থাকলেও তা স্বাধীন বা প্রভাবমুক্ত এবং নিরপেক্ষ নয়। অনেক সময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও পারেন না। এর ফলে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বাধাগ্রস্ত হয়।
২১. সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব (Absence of Freedom of Press): সুশাসনের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা, মৌলিক অধিকার উপভোগের অনুকূল পরিবেশ রক্ষা, জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর করা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।
২২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব (Lack of Communal Harmony): সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা সফল করা সম্ভব নয়। কেননা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে জঙ্গীবাদ, উগ্রতা, হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবে জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
Leave a comment