সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬-‘৪০ খ্রিঃ):

রাজিয়ার সিংহাসনারোহণের ঘটনা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। যেমন, (১) দিল্লির সরকারি কর্মী এবং সাধারণ মানুষ রাজিয়াকে সিংহাসনে বসিয়ে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত কাজে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। রাজিয়ার মূল রাজনৈতিক শক্তি ছিল দিল্লির এই গণসমর্থন। (২) ‘ফতুহ-উস্-সালাতিন’ থেকে জানা যায়, রাজিয়া এক ঘোষণা দ্বারা অঙ্গীকার করেন যে, তিনি জনস্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হলে জনগণের ইচ্ছায় তিনি এই পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য থাকবেন। ফলে রাজার ‘দৈবস্বত্ব’ তত্ত্ব খণ্ডিত হয়। (৩) এই ঘটনা দ্বারা ইলতুৎমিসের ইচ্ছা,—যা কতিপয় আমিরের ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়েছিল, তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ, সুলতান জীবিতাবস্থায় রাজিয়াকেই তাঁর উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করেছিলেন। (৪) সিংহাসনে নারীর বসার অধিকার নেই—গোঁড়া উলেমাদের এই বক্তব্যকে তিনি ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিলেন। (৫) ইতিপূর্বে দিল্লির কর্তৃত্ব-দখলের প্রশ্নে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। রাজিয়ার মনোনয়নের বিরুদ্ধেও এরা সোচ্চার ছিল। কিন্তু রাজিয়া সিংহাসন দখল করে প্রমাণ করে দেন যে, এক্ষেত্রে প্রাদেশিক শাসকদের সম্মতি আবশ্যিক নয়।

রাজিয়ার শাসনকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, মাত্র তিন বছরের। কিন্তু প্রশাসিকা হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই যোগ্য। মিনহাজ-উস্-সিরাজ লিখেছেন : “একজন শাসিকার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমস্ত গুণাবলি ও যোগ্যতা তাঁর চরিত্রে ছিল” (“She was endowed with all the admirable attributes and qualifications necessary for kings.”)। কিন্তু তিনি ছিলেন নারী, তাই পুরুষশাসিত সমাজে তাঁর অন্য সকল গুণ মূল্যহীন হয়ে গিয়েছিল। রাজিয়া সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে। অবশ্য নারীশাসনের বিরুদ্ধে পুরুষের হুঙ্কার রাজিয়াকে বিব্রত করলেও, এটিই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রীদের প্রধান অভিযোগ ছিল না। রাজিয়ার ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতাস্পৃহা এবং তুর্কি অভিজাতদের একাধিপত্য নাশ করার উদ্দেশ্যে অ-তুর্কি ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি অভিজাতদের শংকিত করে এবং রাজিয়ার ক্ষমতাসীন হওয়াকে তারা অস্তিত্বের সংকট বলেই বিবেচনা করে। অধ্যাপক নিজামীর ভাষায় : “It was her attempt to offset the power of the Turkish nobles by creating a counter-nobility of the non-Turks which excited opposition against her” বদাউন, মুলতান, হান্‌সি ও লাহোরের প্রাদেশিক শাসকগণ রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার প্রথম উদ্যোগ নেন। এঁদের নেতৃত্ব দেন রুকন্‌উদ্দিন ফিরোজের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মালিক মহম্মদ জুনাইদি। বুদ্ধিমতী রাজিয়া শত্রুপক্ষের শক্তির প্রাধান্য বিবেচনা করে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পরিবর্তে কূটকৌশল প্রয়োগ করে পরিস্থিতির সামাল দিতে সচেষ্ট হন। মালিক মহম্মদ সালারী, মালিক কবির খান প্রমুখ বিরোধী অভিজাতকে তিনি স্বপক্ষে এনে বিরোধী জোটে ভাঙন ধরিয়ে দেন। পলাতক অবস্থায় বিরোধীচক্রের পাণ্ডা জুনাইদি নিহত হন।

প্রাথমিক বিদ্রোহ দমন করার পরে রাজিয়া নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। খাজা মুহজাবউদ্দিনকে উজির পদে নিয়োগ করেন এবং প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন মালিক সইফউদ্দিন। সইফউদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে ‘মালিক-ই-লস্কর’ পদে নিযুক্ত হন মালিক কুতুবউদ্দিন হাসান ঘুরি। কবীর খাঁকে লাহোরের ইক্তাদার নিযুক্ত করা হয়। মিন্হাজ লিখেছেন : “রাজিয়ার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির সূক্ষ্ম প্রয়োগের ফলে লক্ষ্মণাবতী থেকে দেবল পর্যন্ত সমস্ত মালিক এবং আমিরগণ রাজিয়ার আনুগত্য স্বীকার করে নেন।” ঐতিহাসিক নিজামী লিখেছেন : “Raziya gave exceptional proof of her political sagacity in dealing with the recalcitrant elements. “

রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করার পর রাজিয়া স্বাধীনতাকামী রাজপুত রাজ্য রণথম্ভোরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁর এই অভিযান সফল তো হয়নি, পরস্তু এই সময় থেকে চৌহানরা মেওয়াটিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে বারবার দিল্লির উপকণ্ঠে হানা দিয়ে সুলতানি প্রশাসনকে বিব্রত করতে থাকে। গোয়ালিয়রের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানটিও নিষ্ফলা থেকে যায়।

রাজিয়ার মধ্যে বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতা, রাষ্ট্রপ্রজ্ঞা ইত্যাদি রাজকীয় গুণের সমাবেশ ঘটলেও তাঁর শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিল মাত্র তিন বছর ছয় মাস ছয় দিন। প্রতিভাময়ী এই শাসিকার ব্যর্থতার প্রধান কারণ ছিল ক্ষমতাবান তুর্কি-মালিক ও আমিরদের বিরূপতা ও ষড়যন্ত্র। তবে এই বিরূপতার মূল কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। ইসামীর ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন’এর বিবরণ থেকে মনে হয় যে, রাজিয়া নারীসুলভ আচরণ ত্যাগ করে মৌলানা ও তুর্কি অভিজাতদের ক্ষোভ সঞ্চার করেছিলেন। প্রথমে রাজিয়া লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। দরবারে তাঁর সিংহাসন এবং সভাসদদের মাঝে একটা পর্দা রেখে আড়াল সৃষ্টি করা হত। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকরী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অসুবিধাজনক বিবেচনা করে রাজিয়া তা তুলে দেন। এখন তিনি প্রকাশ্যে দরবারে বসে রাজকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। হাতির পিঠে বসে রাজ্যভ্রমণ কিংবা পুরুষের মতো পোশাক পরে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। নিজ মুদ্রায় ‘সুলতানা’র পরিবর্তে নিজেকে ‘সুলতান’ হিসেবে জাহির করেন। এই সকল কাজ তুর্কি অভিজাতবর্গ এবং উলেমাদের কাছে ব্যভিচারের নামান্তর রূপে পরিগণিত হয় এবং তারা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অধ্যাপক নিজামী (K. A. Nizami) মনে করেন, রাজিয়ার বিরুদ্ধে তুর্কি অভিজাতদের ক্ষোভের প্রধান কারণ তাঁর পুরুষসুলভ আচরণ নয়। রাজিয়ার ব্যক্তিত্ব, কর্তৃত্ব এবং দক্ষতা ইত্যাদি গুণ অভিজাতদের ঈর্ষান্বিত করেছিল এবং ষড়যন্ত্রী মালিকরা জনৈক হাবসি ক্রীতদাস জামালউদ্দিন ইয়াকুৎ-এর উচ্চপদে নিয়োগের ঘটনাকে বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। রাজিয়া ইয়াকুৎকে আস্তাবলের প্রধান পদে উন্নীত করলে তুর্কি অভিজাতদের মর্যাদা আহত হয়। মিনহাজউদ্দিনের মতে, ইয়াকুৎ-এর সাথে রাজিয়ার প্রণয় ছিল। ইবন বতুতাও এই মত সমর্থন করেছেন।

রাজিয়া-বিরোধী জোটের মধ্যমণি ছিলেন ‘আমির-ই-হাজিব’ ইখতিয়ারউদ্দিন আইতিগীন। আইতিগীনের পাশে ছিলেন রাজিয়ার অন্য দুই তথাকথিত বিশ্বস্ত আমির আলতুনিয়া এবং কবীর খাঁ। এঁরা ছিলেন যথাক্রমে লাহোর ও ভাতিণ্ডার (তরবারহিন্দা) শাসক। বিদ্রোহীরা জানতেন যে, দিল্লির বুকে বসে রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনকে সফল করা যাবে না। তাই তাঁরা রাজিয়াকে দিল্লির বাইরে এনে তাঁর কর্তৃত্বনাশের পরিকল্পনা করেন। গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কবীর খাঁ লাহোরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজিয়া সসৈন্যে লাহোরে উপস্থিত হয়ে কবীর খাঁকে পরাজিত করেন। কবীর খাঁ বশ্যতা স্বীকার করে রক্ষা পান। এই ঘটনার পক্ষকালের মধ্যে আলতুনিয়া ভাতিণ্ডায় বিদ্রোহী হন। এবারেও রাজিয়া ইয়াকুৎ-সহ বিদ্রোহদমনে অগ্রসর হন। কিন্তু ষড়যন্ত্রী তুর্কি-মালিকরা পথিমধ্যে ইয়াকুৎকে হত্যা করে এবং রাজিয়াকে বন্দি করে ভাতিণ্ডার দুর্গে আটকে রাখেন।

রাজিয়াকে বন্দি করে বিদ্রোহী তুর্কি-আমিরগণ ইলতুৎমিসের তৃতীয় পুত্র বাহরাম শাহকে ‘দিল্লির সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন (মে, ১২৪০ খ্রিঃ)। কিন্তু নতুন সুলতানের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ পদের দখলকারীর প্রশ্নে অচিরেই অভিজাতদের মনান্তর তীব্র হয়ে ওঠে। আলতুনিয়া প্রত্যাশামতো পদ না পেয়ে প্রতিবিপ্লবের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাজিয়াকে মুক্ত করে দেন এবং তাঁকে বিবাহ করে দিল্লির মসনদ পুনর্দখলের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু বাহরাম শাহের অগ্রবর্তী বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে রাজিয়া ও আলতুনিয়া ভাতিণ্ডা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পথিমথ্যে কাইথাল নামক স্থানে এসে রাজিয়ার সেনাবাহিনী এঁদের পরিত্যাগ করে। সম্ভবত হিন্দু উপজাতিদের হাতে এঁরা নিহত হন। (অক্টোবর, ১২৪০ খ্রিঃ)।

দিল্লির সুলতানি সিংহাসনের একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন রাজিয়া। তাঁর রাজত্বের সময়কাল সংক্ষিপ্ত হলেও, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি ছিলেন যোগ্য এবং অসাধারণ শাসিকা। তাঁর সাহস এবং উদ্যোগেরও কোনো অভাব ছিল না। রাজিয়ার কৃতিত্ব বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘মিন্হাজ-উস্-সিরাজ লিখেছেন : “She was a great sovereign and sagcious just beneficent, the patron of the learned, a dispenser of justice, the cherisher of her subjects and of warlike talent.” রাজতন্ত্রের ওপর আমির মালিক বা উলেমাদের অশুভ প্রভাবকে তিনি দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন। আদিপর্বের সুলতানদের মধ্যে রাজিয়া ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র শাসক যিনি অভিজাতদের প্রভাবমুক্ত থেকে শাসন পরিচালনা করার মতো দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব লিখেছেনঃ “She was the first Turkish ruler of Delhi to have imposed the royal will upon the Amirs and Maliks.” রাজিয়ার প্রশাসনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক দুরদর্শিতার দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল—(১) কূটকৌশলে বিদ্রোহী অভিজাতদের জোটে ভাঙন ধরিয়ে ষড়যন্ত্রের বিনাশ ঘটানো এবং (২) খারিজম শাহের সামরিক চুক্তির প্রস্তাবকে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করা। সমস্ত দক্ষতা এবং রাজকীয় গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও রাজিয়া ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছিলেন। কারণ স্বার্থান্বেষী তুর্কি আমিরদের সর্বময় কর্তৃত্ব অস্বীকার করে তিনি মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন—যা বাঞ্ছিত হলেও সহজসাধ্য ছিল না।

সুশাসিকা ও দক্ষ রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও রাজিয়ার শাসনকাল স্থায়ী বা দীর্ঘতর হয়নি। এই ঘটনা ইতিহাসের পরিহাসের অন্যতম দৃষ্টান্ত। রাজিয়ার পতন বা ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল সমকালীন মুসলিম অভিজাততন্ত্রের রক্ষণশীল কর্তৃত্ববাদ ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবস্থান-সংক্রান্ত গতিহীন ধারণা। একজন মহিলাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখতে সমাজ অভ্যস্ত ছিল না। পর্দাপ্রথার প্রতি একান্ত আস্থাশীল সমাজ এই ঘটনাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। উপরন্তু রাজিয়ার পুরুষ-সুলভ আচরণ এবং রাজকীয় কর্তৃত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের ক্ষুব্ধ করেছিল। রাজিয়া নমনীয় হলে এবং ক্ষমতাসীন আমিরদের কর্তৃত্ব মেনে নিলে হয়তো তাঁকে এত দ্রুত ষড়যন্ত্রের বলি হতে হত না। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার অধিকারী রাজিয়ার পক্ষে সংকীর্ণমনা, স্বার্থান্বেষী ও ক্ষমতালোভী অভিজাতদের কর্মধারা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান সংস্কৃতির বিরোধী হিসেবে তাঁরা রাজিয়ার জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করেন এবং নিজেদের মতবিরোধ চেপে রেখে সম্মিলিত ষড়যন্ত্র দ্বারা রাজিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে প্রয়াসী হন। বলা বাহুল্য, এককভাবে রাজিয়া তাদের প্রতিহত করতে পারেননি।

বাহরাম শাহ (১২৪০-৪২ খ্রিঃ) :

ইলতুৎমিসের তৃতীয় পুত্র বাহরাম শাহ তুর্কি আমির ও মালিকদের আনুকূল্যে দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ফলে প্রাথমিকভাবে তিনি ক্ষমতালোভী অভিজাতদের সমস্ত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। সমস্ত ক্ষমতা তুর্কি অভিজাতদের কুক্ষিগত হয়। অভিজাতদের ইচ্ছানুযায়ী তিনি নায়েব ই-মাম্‌লিকত্‍’ নামক একটি পদ সৃষ্টি করেন। মর্যাদার দিক থেকে এই পদাধিকারী ছিলেন সুলতানের ঠিক পরেই। আইতিগীন এই পদে প্রথম মনোনীত হন। উজির-পদে পূর্ববৎ মুহজাবউদ্দিন থেকে যান। ফলে আইতিগীনের সাথে উজিরের ব্যক্তিগত সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে আইতিগীন নানাক্ষেত্রে সুলতানকে আড়ালে রেখে রাজকীয় কর্তৃত্ব ভোগ করতে শুরু করলে বাহরামও তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন। আইতিগীনের ক্ষমতায় উত্তরণে অন্যান্য তুর্কি-মালিক ও আমিররাও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই সুযোগে বাহরাম আইতিগীনকে হত্যা করে কণ্টকমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। অতঃপর ‘নায়েব-ই মাম্‌লিকৎ’ পদটি শূন্যই রাখা হয়। কিন্তু এই সময় প্রধান কঞ্চুকি (নায়েব-ই-হাজিব) বদরুদ্দিন শাংকর রুমি দ্রুত ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসেন। সুলতান বাহরাম শাহ অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে শাংকরকে পদচ্যুত করে বদাউনের ইক্তাদার করে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বদরুদ্দিন গোপনে দিল্লির রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করলে বাহরাম তাকে হত্যা করেন।

আইতিগীন, বদরুদ্দিন, তাজউদ্দিন মুসাভী প্রমুখ ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী তুর্কি আমিরদের হত্যাকাণ্ড, বাহরাম সম্পর্কে অন্যান্য আমির মালিকদের শংকিত করে তোলে। বাহরাম কিছু ধর্মীয় নেতাকে কঠোর দণ্ড দেবার ফলে উলেমারাও তাঁর বিরুদ্ধে তুর্কি অভিজাতদের সাথে হাত মেলান।

এই সময় মোঙ্গলগণ পাঞ্জাব আক্রমণ করলে উজির মুহজাবউদ্দিন তাঁর সুলতানবিরোধী ষড়যন্ত্রকে চূড়ান্ত রূপ দেবার সুযোগ পান। লাহোরের শাসনকর্তা মালিক কারাকাশ-এর সাহায্যার্থে বাহরাম সুলতানি-বাহিনী পাঞ্জাবে প্রেরণ করেন। এই দলে উজির মুহজাবউদ্দিনও ছিলেন। ধূর্ত এবং অকৃতজ্ঞ উজিরের পরামর্শে বাহরাম এক আদেশনামা জারি করে বিদ্রোহী তুর্কি-আমিরদের পাঞ্জাবের মাটিতেই চরম শাস্তিদানের নির্দেশ দেন। কুচক্রী মুহজাবউদ্দিন এই আদেশনামা তুর্কি-আমির ও মালিকদের সামনে প্রকাশ করে তাদের সুলতানের চরম শত্রুতে পরিণত করেন এবং সবাই জোটবদ্ধ হয়ে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করে বাহরাম শাহকে বন্দি ও হত্যা করেন (১২৪২ খ্রিঃ)।