দুটি কবিতারই বিষয় এক প্রকাশভঙ্গি এক; তবু রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতার সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটির ভাবগত পার্থক্য অনেকখানি- কবিতাদুটির বিষয় ও মর্মকথা অবলম্বনে বক্তব্যটি বিচার করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটি স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত সমনামের (অর্থাৎ ‘বধূ’ নামেরই) কবিতাটিকে অনুসরণ করে রচিত। অর্থাৎ কবিতাটি রচনার সময় সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মরণে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিকে। অবশ্য রবীন্দ্র কবিতার অনুসরণ না বলে একে রবীন্দ্র-কবিতার প্রতিক্রিয়া বলা অধিকতর সঙ্গত। মনে রাখতে হবে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটি তাঁর ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ; অর্থাৎ ইংরাজি ১৯৩৯। তাঁর ‘বধূ’ কবিতাটির রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও একথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে, ১৯৩৯-এর নিকটপূর্ব কালেই কবিতাটি রচিত। সেদিক থেকে কবিতাটি নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রচনা।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল সমগ্র বিশ্বের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই এক ক্রান্তিকাল। এই দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে মানুষের রোম্যান্টিক স্বপ্নকল্পনার জগৎ যেন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। যুদ্ধের ফলে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, সেইসঙ্গে ভারতীয় ক্ষেত্রে কালোবাজারী ও নেতৃবর্গের আত্মস্বার্থ রক্ষার লোলুপতা ও ক্ষমতার নগ্ন রাজনীতি সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থাকে এক সর্বনাশের পথে দাঁড় করিয়ে দিল। গুঁড়িয়ে গেল মূল্যবোধ, নষ্ট হল প্রেম প্রীতি ভালোবাসার মূল্য। আধুনিক কবিদের কবিতায় এই স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস বিধৃত। তিনের-চারের দশকের কবিরা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রোমান্সের স্বপ্ন-স্বর্গকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁরা মনে করলেন, অন্তত এই যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ঔপনিবেশিক শোষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, কালোবাজারিতে বিপর্যস্ত—নষ্ট—রোগগ্রস্ত পৃথিবীতে আজ আর কোকিলের গান বা মধুর প্রেমের স্বপ্ন দেখা অর্থহীন। সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ এখন অপচিত। তাই এ যুগের কবিরা ‘জন্মরোমান্টিক’ রবীন্দ্রনাথকে প্রায় উচ্চ-ঘোষণায় প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেন। এই রবীন্দ্র-বিরোধিতা এসেছে ভাবে-ভাষায়-মননে-চিত্রকল্পনির্মাণে ছন্দে-উপমায় সর্বত্র। কখনো কখনো আধুনিক কবিরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথকেই ব্যবহার করে। এই ধারার বিশিষ্ট কবি বিষ্ণু দে। তিনিই স্পষ্টত রবীন্দ্র-পঙ্ক্তিকেই ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটিতেও রবীন্দ্রযুগের থেকে আধুনিক যুগের চূড়ান্ত নাগরিকতার সুবিশাল পার্থক্যটি তুলে ধরা হয়েছে খুব সচেতনভাবেই একটি বিশিষ্ট রবীন্দ্র কবিতার অনুষঙ্গ ব্যবহার করে।

রবীন্দ্রনাথ আশৈশব মুক্তিসন্ধানী। যা কিছু খণ্ড বা যা কিছু বন্ধন, তাকে অস্বীকার করে মুক্ত আত্মার বিকাশকেই তিনি প্রার্থনা করেছেন—সাধনা করেছেন তাঁর কাব্যে ও সাহিত্যে, তাঁর দর্শন ও জীবনভাবনার প্রতি পদক্ষেপে। পল্লীপ্রকৃতির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে রবীন্দ্র সাহিত্যের পাত্র-পাত্রীদের নাগরিক জীবন থেকে মুক্তির জন্য আকুলতা আমরা দেখেছি ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রে। কিংবা দাম্পত্য জীবনের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসে গ্রামের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মুক্ত জীবন কাটানোর জন্য আকুলতা দেখেছি ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী চরিত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘বন্ধু’ কবিতাতেও সেই প্রকৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ প্রতিফলিত গ্রামের বধূটির আর্তির মধ্য দিয়ে। গ্রাম-প্রকৃতির বৈপরীত্যে নাগরিক জীবন তার কাছে যন্ত্রণাময় মনে হয়েছিল। ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে যে নগর গড়ে উঠেছে, সেখানে দলিত হয়ে গেছে তার প্রাণের সহজ আনন্দ। আশৈশব প্রকৃতিলালিত বধূর প্রাণ নগরের পাঁচিল-ঘেরা আয়তনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল শ্বাসরুদ্ধ। এই মমত্বহীন নগরে বধূটির প্রাণের আর্তি কেউ বোঝেনি। তাই দীঘির কালো জলের শীতল স্পর্শে বধূটি যন্ত্রণার অবসান চেয়েছিল—

“দিঘির সেই জল শীতল কালো, 

তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।”

আসলে যান্ত্রিক নগরায়ণের পরিবর্তে প্রকৃতির সহজ প্রাণময় মুক্ত সাহচর্যই রবীন্দ্রনাথের অধিকতর কাম্য এবং সেই মর্মকথাটিই ‘বধূ’ কবিতার কাহিনীর মধ্যে রূপ নিয়েছে। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই ‘বধূ’টি তাঁর ছোটোগল্পের ফটিক, তারাপদ কিংবা মৃন্ময়ীর সমগোত্রভুক্ত।

রবীন্দ্রনাথের ‘বধু’ কবিতাটি ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। মানসী কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। বিশেষভাবে ‘বধূ’ কবিতাটির রচনাকাল ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিকে স্মরণে রেখে একই নামে কবিতাটি রচনা করেছেন। নাম এক রাখার কারণও সম্ভবত পাঠকের মনে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির অনুষঙ্গটি স্পষ্টভাবে জাগিয়ে তোলা। আগেই বলা হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটির রচনাকাল ১৯৩৮ বা ১৮৩৯ নাগাদ। অর্থাৎ দুটি কবিতার কালগত দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক। দুটি সমনামের কবিতা রচনার মধ্যপর্বে পৃথিবীকে সহ্য করতে হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাত, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সংকট, পুঁজিবাদের ক্রমবিস্তার, ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা, এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্র মারণযজ্ঞ। মাত্র দুটি দশকের মধ্যে দু-দুটি মহাযুদ্ধ সমগ্র বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ভিত্তিই কম্পিত করে দিয়েছে। পরিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের ন্যায়-নীতি প্রেম-প্রীতি সম্পর্কিত ধারণা নড়ে গেছে মূল্যবোধের সাবেক ভূমি, বদলে গেছে জীবনসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতায় উঠে এসেছে অন্যতর সময়, অন্যতর ভাবনা। তাই রবীন্দ্রনাথের বিশেষ একটি কবিতা সুভাষের এই কবিতার প্রেরণাভূমি হলেও সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেন সেই রাবীন্দ্রিক কাব্য-ভাবনার এক নব-রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর সমনামের কবিতাটিতে।

দুটি কবিতারই বিষয় এক, প্রকাশভঙ্গি এক। দুটি ক্ষেত্রেই গ্রামের সরল প্রাণময় এক নারী বিবাহসূত্রে তার স্বামী বা প্রণয়ীর সঙ্গে এসে পড়েছে কলকাতা নগরের ইঁট-কাঠ পাথরের বন্দিশালায়। নগরের যান্ত্রিকতা, প্রাণহীন মমত্বহীন জীবন, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা উভয়ক্ষেত্রেই তাদের মানস-যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। সেই বেদনা ও জীবন-সংকটের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে উভয় কবিতাতেই উত্তম পুরুষে। ছন্দের বিন্যাসে কিছুটা পরিবর্তন থাকলেও বস্তুত উভয়তই সুরগত মেজাজ একই। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সুভাষ রবীন্দ্র ছন্দটিকেই যেন বিপরীত বিন্যাসে প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ আপাতভাবে কবিতাদুটিকে একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়।

কিন্তু কালগত প্রভেদে কবিতাদুটির মধ্যে ভাবনার ও জীবনবোধের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার সূচনাতেই একদিকে যেমন রবীন্দ্র-পত্তির অংশ ব্যবহার করে কবিতার বিষয় সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছেন পাঠককে, তেমনি পাশাপাশি স্বকাল-সচেতনভাবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতার পরিবেশটিকেও ধরেছেন অব্যর্থভাবে। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও নাগরিক কলকাতায় বিগত শতকের সেইসব পুরোনো ফেরিওয়ালাদের ডাক শুনতে পাওয়া যেত। এখানে কবি ‘পুরোনো সুর ফেরিওয়ালর ডাকে’—এই উচ্চারণে যুগগত ক্রান্তিলগ্নটিকে চিহ্নিত করেছেন। দিনের আলো নিভে আসার প্রসঙ্গে পুরোনো ফেরিওয়ালার ডাকের প্রসঙ্গ এনে কবি বোঝাতে চান যে, উনিশ শতক ফুরিয়ে যাচ্ছে নিঃশেষে নতুন বিশ শতক এসেছে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে। এসেছে বেতার যন্ত্র তথা রেডিয়ো নামক মনোরঞ্জনের উপকরণটি। কিন্তু তখনও গ্যাসের আলোয় আলোকিত হয় নগর কলকাতার রাজপথ। কলকাতার পথে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা তখনও হয়নি।

কিন্তু এ তো কলকাতার বাহ্য চেহারা। আসলে ভিতরে ভিতরে কলকাতার বুকের গভীরে সজ্জিত হয়ে গেছে পুঁজিবাদী নগরের ব্যাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা ধরা পড়েছে এই কবিতায়। তৎকালীন বাংলারও আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে পড়েছে যুদ্ধকালীন বিপর্যয়ের ছাপ। এই নাগরিক জীবনে হৃদয়ের ভালোবাসা মূল্যহীন। কেবল কদর্য কুসীদজীবীর মতো কেবল দ্বিগুণ বা তারও বেশি মুনাফাই লক্ষ এই নাগরিক জীবনের। তাই কবিতার বধূটির কণ্ঠে মূল্যবোধহীন হৃদয়হীন মুনাফাসর্বস্ব নাগরিক জীবনযাপনের বেদনা ও অর্থহীনতা প্রকাশিত হয়েছে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটির মধ্য দিয়ে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটিতে যুদ্ধ-সমকালীন নাগরিক জীবনের যে মানসিকতা প্রতিফলিত, সেখানে আত্মনাশের পরিবর্তে অস্তিত্ব রক্ষার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’টি যেখানে আত্মহননের মধ্য দিয়ে এই যান্ত্রিকতার ও মমত্বহীনতার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিল, সেখানে সুভাষের ‘বধূ’টি একবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করলেও শেষপর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেয়নি। আধুনিক যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অস্তিত্বরক্ষাকেই সে প্রাধান্য দিয়েছে। তবে এই অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে নাগরিক জীবনের ক্লেশ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি বধূটি। যে শুধু হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা চেয়েছিল, প্রবঞ্চিত হয়ে ও কঠিন জীবন-বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সে এখন বুঝেছে, এখানে ক্রন্দনের কোনো দাম নেই। গ্রাম থেকে যে প্রণয়ীর সঙ্গে সে ভালোবাসার তাগিদে গেরুয়ার ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল, সেই প্রণয়ীও যখন ঋণভারে জর্জরিত হয়ে প্রেম ভুলে–অসহায় বধূটির প্রতি দায়িত্ব ভুলে উধাও হয়, তখন ক্রন্দন বৃথা জেনে বেদনা বুকে চেপে নাগরিক জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে চায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নায়িকা। সন্ধ্যায় গলির মোড়ে জলের কলের থেকে জল আনার সময় কোনো পরিচিত বা অপরিচিত পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ‘সখা’ সম্বোধনে বিশ্রস্তালাপের মধ্যে যেন ইঙ্গিত পাই তার বর্তমান জৈবিক অস্তিত্বরক্ষার কদর্য উপায়টির। কবি যেন ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিতে চান, অসুস্থ যুগের প্রকোপে, নাগরিক জীবনের পঙ্কিলতায় কেমন করে গ্রামের প্রাণময়ী এক সত্ত্বাও হারিয়ে যায় কদর্য অন্ধকারে। ফলে কবিতাটি আর রবীন্দ্র কবিতার নিছক অনুসরণ বা একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থাকে না, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধূ কবিতাটি হয়ে ওঠে আধুনিক বিশ্বযুদ্ধোত্তর মুনাফা-সন্ধানী মমতাহীন বঙ্গ-নগরের অসহায়তা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের সাংকেতিক দলিল। অতএব সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতটিকে আর রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতার অনুসরণে রচিত বলা চলে না। কবিতাটি হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের পুরোনো কাব্যভাবনাটিরই যুগোপযোগী পুনর্নির্মাণ।