কাব্যের সংজ্ঞা বিষয়ে কবিদের মধ্যে নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলেও একথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’, অর্থাৎ কাব্য হল রসাত্মক বাক্য। মনের মধ্যে যে ভাব অন্তঃসলীলা রূপে বয়ে চলে তাকে ভাষার মধ্যে সঞ্চারিত করাই হল কবিতার উদ্দেশ্য। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন— ‘যে অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা কবিতার ভাব ও ভাষার সম্পূর্ণ একীকরণ সম্পন্ন হয় তাহাই কবিতার আত্মা’।

কবিতার শৈলী হল সেই অন্তর্নিহিত শক্তি যার দ্বারা কবিরা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠেন। আর শৈলীচর্চার উদ্দেশ্য হল সেই পদ্ধতিটিকে বুঝে নেওয়া যার দ্বারা কবি কবিতায় সার্বজনীন রসাবেদন সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছেন।

বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত সুচেতনা কবিতা জীবনানন্দের সচেতন প্রজ্ঞা সম্ভৃত। জীবনানন্দই বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন এক ঘরানা সৃষ্টি করেছেন, যা রবীন্দ্র পরবর্তী যুগভাবনাকে আত্মস্থ করে স্বকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ ঘটেছে। কবিমানস সৃষ্টিতে সমকালীন যুগসংকট প্রভাব বিস্তার করেছে ; ফলত তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আত্মসংক্রমের, নয়তো শাশ্বত চেতনার দলিলে। সমাজের বীভৎস অসামাঞ্জস্য কবিকে এই দুই ভাবনার বোধে উদ্দীপ্ত করেছে। বনলতা সেন যেন তাঁর প্রেমিকা রমণী আর সুচেতনার প্রেম তাঁর ব্যক্তিগত হয়েও সমষ্টির কাছে ধরা দেয়।

সুচেতনা এই ‘সু’ উপসর্গ এবং ‘চেতনা’ ধ্বনিদুটিকে পাশাপাশি অনল এক নারীর ছবি ভেসে ওঠে। এ নারীর পাখির নীড়ের মতো চোখ আছে কিনা তা জানা নেই, কিন্তু কবি বনলতার মতো সুচেতনাকেও দারুচিনি বনানীর ফাঁকেই স্পর্শসুখ অনুভব করেছেন। সুচেতনা একটা গুণবাচক বিশেষ্য হলেও তার পরেই এসেছে কমা (,) অর্থাৎ অল্পবিরতি নিয়ে যখন তিনি তুমি উচ্চারণ করলেন তখন বোঝা যায় সুচেতনা নারী। সুচেতনার শরীরে নারীদেহের প্রাণ সঞ্চার করার পর বললেন তা দূরতর দ্বীপ। এসে গেল সজীব পদার্থের ওপর অচেতন বস্তুর ধর্মের আরোপ। আর সেই দ্বীপ নির্জনতা দিয়ে ঘেরা, যা দূর নক্ষত্রের কাছে আরও দূরতর। শক্ত ইমারতের প্রাচীরে যে যান্ত্রিক সভ্যতা বদ্ধ তার মুক্তি কামনাতেই। সেই নির্জন দ্বীপের খোঁজ যেখানে মানুষ থাকবে, আর থাকবে মানবিক বোধ। দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় বাক্যে পৃথিবীর গভীরতর অসুখের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ অসুখ ব্যক্তির স্তরে সীমাবদ্ধ নয় তা বুঝিয়ে দেওয়া হল পরের স্তবকে। সেখানে আমাদের কথা এল। এখানে বলা হল যারা ফসল ফলায় তারাই শোষিত হতে থাকে বারবার, ‘আগণন মানুষের শব’ সেই কথাই আমাদের বুঝিয়ে দেয়। আবার বুদ্ধ, কনফুসিয়াস শব্দ প্রয়োগ করে সেই প্রাচীন পটভূমিতে তুলে আনলেন। বুঝিয়ে দিলেন প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন যারা তাঁদের পৃথিবীতে এখন প্রেম মিথ্যা। বললেন—আমাদের পিতা বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের মতো আমাদের প্রাণ। সুমুক করে রাখে এছাড়াও এখানে বৈপরীত্য নজরে আসে। একদিকে ‘শস্য’ যা জীবনের প্রতীক, আর অপরদিকে ‘শব’ যা মৃত্যু। আবার ‘স্বর্গের বিস্ময়’ শব্দটিতে পুনর্বার বাঁচার আসা। শস্য ক্ষণিকতাকে ধারণ করে ‘কিন্তু তা স্বর্গও’ বটে এখানেই তার স্থায়িত্ব। বারবার ‘তবু’ অব্যয় ব্যবহার করে—যান্ত্রিক সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করেছেন। চতুর্থ স্তবকে নাবিক ‘অস্তিম প্রভাতের’ উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আবার শেষ স্তবকেও এল বৈপরীত্য—

কখনও বললেন- ‘না এলেই ভালো হত আবার পরক্ষণেই- ‘এসেই যে গভীরতর লাভ হল’

এইভাবে নানা বৈপরীত্যের সমন্বয়ে কবিতাটি সামগ্রিক রসাবেদন সৃষ্টি করেছে। আর সুচেতনা সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে অনন্ত সূর্যোদয়ের চেতনা আনে; শেষ হল তাই আশাবাদের ঘোষণা করে।

শব্দচয়নে জীবনানন্দ প্রায় সব কবিতাতেই বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। শব্দ বিন্যাসের সৌন্দর্য্য জীবনানন্দের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। তার সঙ্গে অনেক কবিতায় ফিরে আসে অতীতকে টেনে আনার বাসনা। কখনও তিনি ‘চাঁদ চম্পার কথা বলেন কখনও হাজার বছর পথ হাঁটা কিংবা এই কবিতায় বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের কথা।

জীবনানন্দ দাশের সুচেতনা কবিতায় ধ্বনি মিলের সাম্য সৃষ্টি করার জন্য অনুপ্রাস আছে কিন্তু এর পাশাপাশি উপমা যমকের মতো অর্থালংকারের প্রয়োগও দেখা যায় যেমন—

অনুপ্রাস ১। ‘আমাদের মতো ক্লাস্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে’ 

যমক ২। ‘এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’

উপমা ৩। আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুসিয়াসের মতো আমাদের/প্রাণ/মৃক করে।

অলংকারের পাশাপাশি চিত্রকল্প সৃষ্টিতে স্বাচ্ছান্দ্য দেখিয়েছেন। যেমন— 

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে 

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়; 

সেই শস্য অগণন মানুষের শব ; 

শব থেকে উৎসারিত স্বর্গের বিস্ময় 

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুসিয়াসের মতো আমাদের প্রাণ 

মৃক করে রাখে ; তবু চারিদিকে কাজের আহ্বান

সুচেতনা কবিতার সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে এটা বোঝা গেল সুচেতনা কোনো বিশেষ নারী নয়। আমাদের সত্তার ভেতরে যে সু-চেতনার বোধ জন্ম দেয় সেই সুচেতনা নারী হতে পারে। তবে সেই সুচেতনা অবশ্যই শুভ প্রবৃত্তির প্রতীক। ‘সুচেতনা’ শব্দটি দুইবার মাত্র উচ্চারিত হলেও কবি সমগ্র কবিতার পাদপ্রদীপে তাকে শাশ্বত জীবনবোধে উন্নীত করে দিয়েছেন।