জীবনানন্দীর ভাবনায় কবিতায় বাস্তবতার এক নতুন দিসারির সন্ধান পাওয়া যায়। জীবন বলতে আমাদের যে চিরপরিচিত ধারণা, আমরা যা প্রতিনিয়ত চোখে সামনে দেখি—তার সম্পূর্ণ পূনধারণ আমরা যা প্রতিনিয়ত চোখে সামনে দেখি—তার সম্পূর্ণ পূণধারণ কাব্যের মধ্যে থাকে না। কবি সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর কল্পনার অমর্ত্য লোকে পাঠককে নিয়ে যেতে চান। যাকে কাব্য বলা যায়—কবিতা অনুভূতি সঞ্জাত এক অভিজ্ঞতা। জীবনের সাথে যায়—কবিতা অনুভূতি সঞ্জাত এক অভিজ্ঞতা। জীবনের সাথে তার সুড়ঙ্গ লালিত সম্পর্ক। সে সম্পর্ক সামাজিক জীবনের সম্পর্ক অথচ নতুনতর যাকে কবি বলেছেন সম্বন্ধের ধূসরতা। এখানেই আমরা জীবনানন্দের জীবন দর্শন সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান লাভ করতে পারি।

জীবনানন্দের কবিতায় সামাজিক সত্যের এক নিজস্ব বিশ্বাসের ভূমি আছে। কবি জীবনকে যেমন দেখেছেন—তেমন করেই কবিতায় তুলে আনেননি। বাস্তবের জীবন যন্ত্রণায় কবির মন অগ্নিদাহে জ্বলে জ্বলে একশুদ্ধতম উপলব্ধিতে পৌঁছোতে পেরেছিল বলেই তাঁর কবিতা অন্য সকলের চেয়ে ভিন্নতর আবেদনে পাঠকের কাছে বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনের যে বার্তা ; বিশেষ করে সাংসারিক মানুষ হিসেবে কবি ছিলেন একটু অযোগ্য। হয়তো তাঁর জন্যে কবির সাময়িক বেকারত্ব দায়ী ছিল। হয়তো তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো কর্মক্ষম ছিলেন না। ছিলেন আত্মমুখীন। সংসারে ঝুট ঝামেলায় সম্পূর্ণ বেমানান কবিকে ঘরে বাইরে সে তীব্র গঞ্জনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল—তা যতই গোপন থাক না কেন ; কবির ভিতরে একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের খেলা চলত অবিরত। কবি তার সঙ্গে লড়াই করেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। বোধ করি এই বিষয়ই তাঁর অজান্তে যে সকল কবিতায় আত্মপ্রকাশ করেছে তার মধ্যে অন্যতম—’সুচেতনা।

সমাজের ক্রম অবক্ষয় কবিকে পীড়িত করেছে। মানুষ একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব গড়ে সামাজিক জীবনে যে ভাঙন সৃষ্টি করেছে—তা কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে। কবি বুঝতে পেরেছেন মানুষের মধ্যে ব্যক্তি চেতনা বড়ো হয়ে উঠেছে। জীবনের সাফল্য লাভের জন্য অন্যায় ভাবে প্রাপ্য পেতে চায় তারা। সেই প্রাপ্তিতেই গড়ে তুলতে চায় নিজের দেশকে—যা কিছুর ওপরে সত্য হয়ে উঠবে। হয়তো মানুষের সে অভিসন্ধি সফল হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু মৃত্যু হবে মনুষ্যত্বের। সামাজিক একতার মৃত্যু মানেই মানব সমাজের ধ্বংসের পথ তৈরি করা এ চেতনা কবির মধ্যে সবসময়ই ছিল। তবে পৃথিবীর ক্রম মুক্তির সে শুভ লগ্ন এখনো বহুদূর। তবুও কবি মনে মনে সেই আশা বুকে নিয়ে উচ্চারণ করেছেন—

“সুচেতনা-এই পথে আলো জ্বেলে-এপথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে 

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ ; 

এ বাতাস কি পরম সূর্য করোজ্জ্বল ; 

প্রায় অতদূর ভালো মানব সমাজ

আমাদের মত ক্লান্ত ক্লান্তিহীনশা কীসের হাতে

ভাহে দেব আজ নয়, ঢের দূর অস্তিম প্রভাতে।”

কবি আশাবাদী । মানব সমাজকে তার মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পৃথিবীকে গ্লানীমুক্ত করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন কবি। যদিও দূর-অস্তিম প্রভাতে হয়তো সফল হবে। তবুও মানুষের হৃদয়হীনতা আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্মম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করা কবিকে মর্মাহত করেছে। তাই তিনি বলেছেন—

“এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা 

সত্য তবু শেষ সত্য নয়।”

এ বিশ্বাস নিয়েও কবি বুঝতে পারেন বিশ্বযুদ্ধের সরীসৃপ সমস্ত মানবজাতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সংঘাতে তারা ক্ষত বিক্ষত হয়ে এক ভয়ংকর পরিণতিকে ডেকে এনে বিশ্বকে কলুষিত করতে চাইছে। কবি সেই মানবিকতার অপমৃত্যু প্রত্যক্ষ করে ভিতরে ভিতরে এক অস্থিরতার দিন কাটাচ্ছেন।

কবি চেতনা এখানে বিশ্ব জাগতিক, তিনি সমগ্র বিশ্বের ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনায় আশাঙ্কিত। দূর দৃষ্টি না হলে এভাবে বিশ্ব মানবিক হওয়া যায় না। যুদ্ধ মানুষের কাম্য নয়—জেনেও মানুষ সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। প্রতিদানে তাকে হারাতে হয় অনেক কিছু। করে সঙ্গে মানবের এই লড়াই। কবির অনুভূতিতে তার প্রকাশ ঘটেছে—

“দেখেছি আমারই হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন পঙ্গু পরিজন পড়ে আছে,

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন ;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”

পৃথিবীর প্রতি কবির গভীর আস্থাই তাঁকে আশান্বিত করে তোলে। হানাহানি করে প্রকৃত জীবন সত্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানবিকতার অধর পতনে সাময়িক যে অবক্ষয় সমাজকে ক্লেদাক্ত করে তা চিরস্থায়ী নয়। পৃথিবীর সেই গভীরতর অসুস্থতা কাটিয়ে একদিন মুক্ত হয়ে ভরে উঠবে পৃথিবী। সেটাই চিরন্তন সত্য।

অবশ্য কবিতায় বাস্তব জীবনের কথা লেখা হলেও তা হুবহু বাস্তবের প্রতিলিপি হয় না। কবিতা হয়ে ওঠে অর্থবহ ধ্রুপদী শিল্প। জীবনানন্দের কাব্য চেতনায় যে জীবনবোধের প্রকাশ তার কবির গভীর অন্তদৃষ্টিতে হয়ে উঠেছে সুষমামণ্ডিত এবং অর্থবহ। তিনি যেমন কবি, তেমনি একজন সচেতন মানুষ। সমাজের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সচেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারেন না বলেই আমরা তাঁর কণ্ঠে শুনতে পাই মানবের কল্যাণকামী সম্ভাবনার আশ্বাসে উচ্চকিত স্বর—

“মাটি-পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি 

না এলেই ভালো হত অনুভব করে ; 

এসে যে গভীর তর লাভ হল সে সব বুঝেছি 

শিশির শরী ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে 

দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়- 

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয় ৷৷

অর্থাৎ কবির প্রতীক্ষ সেই অবস্থ সূর্যোদয়ের—যা মানবতাকে পৌঁছে দিতে পারে প্রকৃত আলোর বৃত্তে। জীবনের বিশ্বাসহীনতা প্রেমহীনতার মধ্যে যে নারকীয় জগতকে দেখেছিলেন তিনি—তা তাঁকে করে তুলছিল ব্যথিত। বিমর্ষ। তিনি সেই গভীর অসুখের মুক্তি কামনা করেছেন মাঝে মাঝেই। ‘সুচেতনা’ কবিতাটি তারই বিশেষ সাক্ষরবাহী।