জীবনানন্দ বলতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস-চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। কবি সমাজকে বুঝবেন, কবি কালজ্ঞানে পরিচ্ছন্ন হবেন, কবি-চেতন হয়েই ‘মহাবিশ্বের ইশারা’ থেকে উৎসারিত আলোক বার্তা নিয়েই জীবনের গান গাইবেন। জীবনানন্দও তাই গেয়েছেন। গেয়েছেন তিমির হননের গান। এই তিমির হননের গানের একতারার সুরে বেজে উঠেছে রোমাঞ্চকতার আবেশ জড়িত ব্যক্তি প্রেমের ছন্দ, বেজে উঠেছে জীবনের মূলমন্ত্র। একই সঙ্গে ধ্বণিত হয়েছে রূপকথা, ইতিহাস, প্রকৃতি ও মৃত্যুচেতনার রূপঐশ্বর্য্যপূর্ণ সুরও। তাই বোধির সঙ্গে আবেগের রূপের সঙ্গে রসের, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের রাষ্ট্রের ভাবনা গভীর উপস্থিতি ঘটেছে জীবনানন্দের কাব্যদেহে।
কবির চতুর্থ কাব্য ‘বনলতা সেন’ কাব্যের অন্যতম বহুমাত্রিক কবিতা ‘সুচেতনা’ । কবিতাটি একক নায়িকা নামাঙ্কিত শ্যামলী, শঙ্খমালা, সবিতা, সুরঞ্জনার ন্যায় ব্যঞ্জনায় বহুমুখী। কবির আবেগের যন্ত্রণাজাত বিশেষ ভাবের বাহন নায়িকা ‘সুচেতনা’।
কবিতার প্রথম স্তবকে স্বপ্ন পুরীর রাজকন্যা সুচেতনাকে সম্বোধন করে কবি যে কথা উচ্চারণ করলেন, তা তাঁর ব্যক্তিমনের স্পর্শে রক্তিম। এই সুচেতনা নাম্নী নাবী অচিন নগরের নির্জন পুরীতে একাকী। এ যেন বনলতার বাসরাজ্য। সেই দারুচিনি দ্বীপ। সেই মানস প্রিয়ার একান্ত চেনা স্থান। এখানেই ‘বনানীর ফাঁকে’ তাকে স্পর্শ করা চলে। নির্জন দ্বীপের দূরতম স্থানে যেখানে বিকেলের নক্ষত্রের অবস্থান সেখানে সুচেতনাকে আপন করা যায়। কবির কথায়—
“সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে,
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।”
প্রেমের গাঢ়ত্বে এই সুচেতনা সুন্দরী। তবুও তো সে একা। কবি কাছে সে ‘এক দুরতর দ্বীপ’ হলেও ক্লান্ত কবি দুদণ্ড শান্তির আশ্রয় খোঁজেন সুচেতনার কাছেই।
কেননা পৃথিবীর তখন দারুণ অসুখ। কবির আবাস দ্বীপেও সে অসুখের বাড়বাড়ন্ত। তাই দারুচিনির নির্জন বনানীতেই আশ্রয় ভালো। কবি দেখেছেন—
“পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু–
দেখেছি, আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে…”
‘অদ্ভুত আঁধার এক’ পৃথিবীতে এসেছে, যেখানে ‘রণ-রক্ত সফলতা সত্য’। দুই বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা যেখানে সুস্থ প্রাণকে ক্লান্ত করে। যেখানে মৃত্যুর বোধ রক্তনদীতে হাবুডুবু খায়; সেখানে সু-চেতনার আশ্রয় কোথায়? কলকাতা কোনো একদিন যদি ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ও হয়ে ওঠে তখনও কি Nostalgic সু-চেতনা তিমির বিলাসী হতে পারবে? না, তার পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়। কেননা সে জানে ‘রণ রক্ত সফলতা’ শেষ সত্য নয়। সে জানে যতই সর্বগ্রাসী যন্ত্রসভ্যতা জীবনের মূলধনগুলো গিলতে চায় না কেন, বাণিজ্যের ঔদ্ধত্য খেটে খাওয়া জীবনে তছনছ করুক না কেন—‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে।’
কবি জানেন বর্তমান অসুস্থ পৃথিবীতে মানুষের লালসার শেষ নেই’, শেষ নেই ‘শঠতা রিরংসা মৃত্যুরও। এ সমস্ত ‘কেমন প্রকাণ্ড কালো গণিকার উল্লোল সংগীত’ বলেই মনে হয়। ধ্বংসের দামামা তাই ভিতরে ভিতরে গুমরে গুমরে বেজে চলে। পৃথিবীটা কালো ধোঁয়া বলে মনে হয়, মনে হয় এ পৃথিবী প্রেমহীনা বন্ধ্যা। পৃথিবী তখন ‘বাণিজ্যবায়ুর গল্পে মুখর’। বন্দরে যে জাহাজ রাশি রাশি ফসল আনে, তা ‘অগণন মানুষের শব; শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়’। [কবি জীবনানন্দ অনুভবে, অন্ধধানে–তরুন মুখোঃ] বীতশোক ভট্টাচার্যের মতে—“রেনেসেন্সের দেশকালের পটপ্রেক্ষিতে আলো আর জাহাজ এক হয়েছে।
অগণিত মানুষের শ্রম-রক্ত জল করা শস্য পুঁজিবাদীদের কাছে ‘স্বর্ণের বিস্ময়’। অথচ এ ফসল যারা ফলায় তারা বিস্ময় চোখে দেখেই যায় তাদের জানুয়ারের জীবনকে। কবির কাছে এ অসহ্য। তাই তাঁকে আলোর নিশানা খুঁজতে যেতে হয় ‘বুদ্ধ কনফুসিয়াসের কাছে। কবি বলেছেন—
“শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়”
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুসিয়াসের মতো আমাদেরো প্রাণ মূক করে রাখে ; ‘তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।’
বীথশোক ভট্টাচার্যের মতে—‘আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরো প্রাণ নিহত মানুষের শরীর বা শবই সভ্যতার পরিণতি হতে পারে না। মৃত্যু উত্তীর্ণ প্রেমের ও উজ্জীবনের প্রসঙ্গটি শেষ পর্যন্তই ফিরে আসে। দয়িতের এই সর্বসমর্পণ তার একদিক :
‘তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।’
তৃতীয় স্তবকের প্রেম ও উজ্জীবনের মন্ত্রোচ্চারণ এবং বুদ্ধ-কনফুসিয়াসের উল্লেখ করে যে ‘মানবতার বাণীর আভাস তথা’ কাজের আহ্বানের সচল বাণী কথা কবি শোনালেন, তারই সূত্রেই পরবর্তী স্তবকের মুখবন্ধ।
যে বুদ্ধ জগতে প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন, যে কনফুসি মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্রে বাঁধবার মহান আহ্বান জানান; সেই বুদ্ধ ও কনফুসির পৃথিবীতে ক্লেদাক্ত রক্তের ছড়াছড়ি। রণ-রক্ত সফলতাই শেষ কথা। কিন্তু রণ-রক্ততাই কি চিরন্তন সত্য ? এর বাইরে কি আলোর সন্ধান মিলবে না? কবিকে তাই সেই আলোর সন্ধানে যেতে হয় সুচেতনার আশ্রয়ে, যেতে হয় দুদণ্ড শান্তির জন্য। কবির ভাষায়— “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে ; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ :”
কবির মনে হয়—
‘এ-বাতাস কি পরম সূর্য-করোজ্জ্বল ;
প্রায় ততদূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত শাস্তিহীন নাবিকের হাতে গড়ে দেবো,
আজ নয় ঢের দূর অস্তিম প্রভাতে।’
‘সূর্য-করোজ্জ্বল’ এক কান্তিহীন কর্মমুখর প্রভাতে মানবতার উদ্বর্তন ঘটবে, আলোর দিকে গমন করবে মানুষ এ কবি জীবনানন্দের চিরকেলে বাণী। তাই মাটি-পৃথিবীর টানে পাওয়া মানবজন্ম ভালো না মন্দ। এ প্রশ্ন যতটা না কবিকে দোলা দেয়, তার চেয়ে বড়ো হয়ে দেখা দেয় ‘সমুজ্জ্বল ভোর’। শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয় দেখবার আকাঙ্ক্ষাই কবিকে বারংবার টেনে নিয়ে যায় কোনো এক বিধর্ব নগরে। আর সেখানে মুক্ত হাসির বন্যায় সুচেতনারা পৃথিবীতে আনন্দ আনে। আনে সুন্দরের বার্তা। ব্যথা-যন্ত্রণা-অন্ধকার থাকলেও তারা পৃথিবীকে সন্তানের মতো ভালোবাসতে শেখায়। এভাবেই সুচেতনারা একক থেকে বহুমাত্রিক হয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরের চিরন্তন সত্ত্বা।
সমালোচক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের মতে—‘জীবনানন্দ নারীরূপে নয়, সুচেতনাকে আলোকিত চেতনা রূপেই দেখেছেন। যে চেতনা সহজলভ্য নয়। এই আলোকিত চেতনা সুন্দরের চেতনা-এ চেতনা শুভবোধের চেতনা। এই সু-চেতনা চেতনার গান শুনিয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষকে সু-চেতনার স্পর্শ পৃথিবীকে ‘স্বর্ণের বিস্ময়’ জাগিয়েছে। তাই সুচেতনা শাশ্বতবাণী বহনকারী এক সত্ত্বা হিসেবেই কবিতাটিকে এক অন্যমাত্রা দান করেছে।
Leave a comment