সূচনা: ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্যের সম্প্রসারণ। এক্ষেত্রে নানা কারণগুলি উঠে আসে। যেমন রাজনৈতিক কারণ, অর্থনৈতিক কারণ, সামরিক কারণ, সামাজিক কারণ, ধর্মীয় কারণ এবং প্রযুক্তিগত কারণ।
[1] রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক কারণের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে যা ইউরােপের নানা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরপরই ছিল ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। ইটালি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে কেবলমাত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়।
[2] অর্থনৈতিক কারণ: অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে পণ্য বিক্রির বাজার, কাঁচামাল সংগ্রহ, পুঁজি বিনিয়ােগ, শ্রমিক সংগ্রহ প্রভৃতি বােঝায়। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডে এবং পরে ইউরােপের অন্যান্য দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটলে ইউরােপের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। শিল্পোন্নত দেশগুলির কলকারখানায় শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন শুরু হলে সেসব কারখানায় নিয়মিত প্রচুর পরিমাণ কাঁচামালের প্রয়ােজন হয়। এই কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হত।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়ােগ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের পথ প্রশস্ত করে। শিল্পোৎপাদনের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং ইউরােপের কলকারখানাগুলিতে কায়িক শ্রমদানের জন্য সস্তায় প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়ােজন ছিল। তাই শ্রমিকের জোগান অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালাত বিভিন্ন দেশগুলি।
[3] সামরিক কারণ: আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের সামরিক কারণগুলি হল নিরাপত্তাবৃদ্ধির চেষ্টা, সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি প্রভৃতি। সাম্রাজ্যবাদের যুগে ইউরােপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরােপীয় দেশগুলি নিরাপত্তার অভাব বােধ করে। ইউরােপের নানা দেশ নিজেদের সামরিক শক্তি ও মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উপনিবেশ স্থাপনের পথ বেছে নেয়।
[4] সামাজিক কারণ: উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি সামাজিক কারণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার প্রসার। উনবিংশ শতকের শেষদিকে ইউরােপের প্রায় প্রতিটি দেশেই জনসংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তাদের বাড়তি লােকজনের বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ করে।
প্রখ্যাত ফরাসি লেখক জুলি ফেরি (Jules Ferry) বলেন যে, অনুন্নত জাতিগুলিকে সভ্য করে তােলা উন্নত জাতিগুলির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং সাদা চামড়ার মানুষকে অনুন্নত জাতিগুলির উন্নতির দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান।
[5] ধর্মীয় কারণ: আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে ডেভিড টমসন উল্লেখ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ধর্মপ্রচার ও মানবকল্যাণ। ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিগুলিকে আলোর জগতে আনার উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে ফরাসি মিশনারি স্ট্যানলি এবং কার্ডিনাল লেভিজেরির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরােপের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ মানবকল্যাণ এবং নিপীড়িত জনগণের মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে যাত্রা করে। ফরাসি মিশনারিগণ ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যথার্থ মানবকল্যাণে ব্রতী হন।
[6] প্রযুক্তিগত কারণ: আধুনিক কয়েকজন লেখক সাম্রাজ্যবাদের উপাদান হিসেবে প্রযুক্তিবিদ্যার ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফিলিপ কার্টিন, লিওনার্ড থম্পসন, ড্যানিয়েল হেনরিক প্রমুখ। উন্নত প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ নেভি লিগ, জার্মান নেভি লিগ প্রভৃতি নৌসংগঠনগুলি উপনিবেশ দখলের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করত।
উপসংহার: ইউরােপের সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন রাষ্ট্র এশিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে, সেসব স্থানে দীর্ঘকাল ধরে নির্বিচারে অর্থনৈতিক শােষণ ও লুণ্ঠন চালায়। তবে শেষপর্যন্ত নানা প্রতিরােধ ও আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচ শতকব্যাপী উপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটে।
Leave a comment