জাতীয় শিক্ষানীতির চতুর্থ অংশে সাম্যের জন্য শিক্ষা প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষায় সমসুযােগের নীতি গ্রহণ করা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষা ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ দান।
জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রি.)-র অন্যতম উদ্দেশ্য হল অসাম্য দূর করা। যায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তাদের শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ, প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের যে-সমস্ত অসুবিধা গুলো রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। সাম্যের জন্য শিক্ষা প্রসঙ্গে যে-সমস্ত সুপারিশগুলি করা হয়েছে সেগুলি হল—
(A) নারী সমাজের সাম্যের জন্য শিক্ষা:
(১) নারী সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।
(২) অতীতের পুঞ্জীভূত বঞ্চনা দূর করতে মহিলাদের শিক্ষার জন্য উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে হবে।
(৩) নারীশিক্ষার পুনর্গঠনের জন্য পাঠক্রম, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক-শিক্ষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নারী শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
(৪) মেয়েদের নিরক্ষরতা, প্রাথমিক শিক্ষালাভের বাধা, শিক্ষার শেষস্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসুবিধা দূর করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
(৫) মেয়েরা যাতে বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণ করে তার উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
(B) তপশিলি জাতির জন্য শিক্ষা :
জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রি.)-তে এই প্রসঙ্গে যে-সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তা হল –
(১) আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত স্কুলে যেন যেতে পারে তার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
(২) আবর্জনা পরিষ্কার ও ট্যাপিং পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সন্তানরা প্রথম শ্রেণি থেকে প্রি-ম্যাট্রিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়ার জন্য যাতে বৃত্তি পায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) Dropout তপশিলি ভুক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা এবং বয়স্কদের জন্য বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
(৪) তপশিলিদের শিক্ষার মান উন্নয়নে ক্ষুদ্র পরিকল্পনা প্রথা, তত্ত্বাবধান এবং নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ও চাকুরির জন্য বিভিন্ন সংশোধনী কোর্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৫) শিক্ষক নিয়োগের সময় তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন দের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
(৬) তপশিলি ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটি জেলা সদরে Hostel-এ থাকার সুযোগ করে দিতে হবে।
(৭) তপশিলি সম্প্রদায়ের সবাই যাতে শিক্ষা নিতে পারে সেজন্য স্কুল, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র গুলি সব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(৮) তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কারের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
(৯) তপশিলিদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিতে NAEP এবং RLEGP-র সম্পদ ব্যবহার করা হবে।
(C) তপশিলি উপজাতির জন্য শিক্ষা :
(১) উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় খেলার উপর অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
(২) উপজাতিদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করে কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষার পাঠক্রম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৩) উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষিত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের উপজাতি অণ্ডলে শিক্ষকতা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা হবে।
(৪) আশ্ৰমজাতীয় স্কুল-সহ প্রচুর আবাসিক স্কুল তৈরি করতে হবে।
(৫) তপশিলি উপজাতি বিশেষ চাহিদা এবং জীবনযাপনের উপর ভিত্তি করে নানারকম প্রেরণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
(৬) তপশিলি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অঙ্গনওয়াড়ি, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা কেন্দ্র এবং বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
(৭) শিক্ষার সর্বস্তরে তপশিলি উপজাতি ভুক্ত শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিমূলক প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য উপযুক্ত পাঠক্রম তৈরি করা হবে।
(৮) বিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণের জন্য NREP, RLEGP থেকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
(D) সংখ্যালঘুদের শিক্ষা :
(১) ভারতে এমন অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে যারা প্রচলিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, তাদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
(২) তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব দিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) এদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উপর জোর দিতে হবে।
(৪) এগুলো পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা সক্রিয় হতে হবে।
(৫) এদের জন্য নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রম রচনা করা প্রয়োজন। তবে সর্বভারতীয় মূল পাঠক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করা উচিত।
(৬) এদের জন্য অনুকূল শিক্ষা পরিবেশ রচনা করার জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে হবে।
(E) প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা :
দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা যাতে নিজেদের সাধারণ সমাজের অংশ হিসেবে মনে করতে পারে, সেজন্য সাধারণের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এজন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে—
- সম্ভাব্যতা চলন সংক্রান্ত প্রতিবন্ধী এবং অর্ধ পরিমাণের অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার সুযােগ করে দিতে হবে।
- মারাত্মকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য জেলা সদরে হোস্টেল-সহ বিশেষ বিশেষ বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
- প্রতিবন্ধীদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
- প্রতিবন্ধী শিশুদের অসুবিধা মনে রেখে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের কর্মসূচিকে পুনর্গঠন করা হবে।
- প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।
- দৃষ্টি ও শ্রবণ জনিত প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(F) বয়স্কশিক্ষা :
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষাকে লেখাপড়ার সামর্থ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কারণ এর দ্বারা শিখন সম্ভব। বয়স্ক শিক্ষা ও বয়স্ক সাক্ষরতার গুরুত্ব এখানেই। তাই নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে বয়স্ক শিক্ষা ও প্রবহমান শিক্ষার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে—
- গ্রামাণ্ডলে প্রবহমান শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন।
- সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে কর্মচারীদের শিক্ষা।
- মাধ্যমিক পরবর্তী স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন।
- এদের জন্য পুস্তক প্রকাশ, লাইব্রেরি স্থাপন ও পাঠক্রম নির্ধারণ ও তার প্রসার।
- রেডিয়ো, টিভি, সিনেমা ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলির ব্যবহার।
- শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দল ও সংগঠন তৈরি।
- দূরাগত শিক্ষা লাভের কর্মসূচি প্রসার।
- বৃত্তিশিক্ষার কর্মসূচি প্রণয়ন ইত্যাদি।
‘সাম্যের জন্য শিক্ষা’ তখনই সম্ভব হবে যখন উপরোক্ত প্রত্যেক শ্রেণির (নারী, তপশিলি জাতি, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, বয়স্কদের প্রভৃতি) জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হবে। বর্তমানে এইসকল কর্মসূচিগুলো কার্যকর করা অনেকটা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে আশা করা যায়, আরও ভালোভাবে সকলকে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
Leave a comment