প্রশ্নঃ সামাজিক গবেষণার মূল স্তরগুলাে কী কী?

অথবা, সামাজিক গবেষণার মূল স্তরগুলাের বিবরণ দাও?

ভূমিকাঃ গবেষণা হলাে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তথ্যানুসন্ধানের একটি কলা বা আর্ট। আর সামাজিক গবেষণা হলাে বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি সামাজিক সংস্করণ মাত্র। সামাজিক গবেষণা নামক বুদ্ধিদীপ্ত প্রক্রিয়াটি শত শত বছরে বিকাশ লাভ করেছে। সামাজিক গবেষণা, তত্ত্ব, বাস্তব সমস্যার সমাধান, উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ণ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। এটা একটি সমস্যা নিয়ে শুরু হয়। উপাত্ত বা তথ্য সগ্রহ করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের পন্থা উদ্ভাবন এবং সহজাত অনুসন্ধান প্রবণতাই সামাজিক গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।

সামাজিক গবেষণার স্তরসমূহঃ স্বাভাবিকভাবে সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগের মাধ্যমে কোনাে সাধারণ নিয়ম পরিস্ফুটনের জন্যে পরিচালিত অনুসন্ধান কাজই সামাজিক গবেষণা। ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, সামর্থ্য ও সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে গবেষক তার গবেষণার বিষয়, পদ্ধতি, উপকরণ ইত্যাদি নির্বাচন করে থাকেন। এ কারণে একই বিষয়ে অনুসন্ধান কাজে গবেষকদের নির্বাচন ভিন্নতর হয়ে থাকে। ভিন্নতার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা ছাড়াও সমাজ ও সামাজিক বিষয়। যেমনঃ সদা পরিবর্তনশীল ও বিবর্তনশীল তেমনি সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি ও কৌশলও নানাবিধ। নতুন নতুন সামাজিক বিষয়ের ওপর গবেষণা করার ক্ষেত্রে গবেষককে নিত্যনতুন কৌশল ও পর্যায়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। এতদসত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে প্রকল্প পরীক্ষা করার জন্য সকল গবেষককেই সাধারণ কিছু পর্যায় বা স্তর অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়। যেমনঃ সামাজিক সাধারণ নিয়ম আবিষ্কারের জন্য প্রত্যেক সমাজ গবেষকই প্রকল্প আকারে তার নির্ধারিত গবেষণা সমস্যা বা বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করেন। এর ভিত্তিতে তিনি অনুসন্ধান কাজের একটি প্রাসঙ্গিক নকশা বা পরিকল্পনা তৈরি করেন যাতে প্রয়ােজনীয় তথ্য সহজভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়।

George J. Mouly, T. S. Wilkinsson, Walter R. Borg, P.V. Young, Norman A. Polansky, Roy G. Francis, Kenneth D. Bailey, Claire Seltic প্রমুখ সামাজিক গবেষণার যেসমস্ত স্তরের কথা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে নিম্নলিখিত স্তরগুলাে সাধারণ স্তর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

(১) গবেষণা সমস্যা বা বিষয় চিহ্নিতকরণ ও নির্বাচনঃ সামাজিক পরিবেশের প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্র নির্বাচন করে তার সংবেদনশীল বিষয়কে গবেষণার সমস্যা বা বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যেমনঃ জনসংখ্যা সমস্যাকে ক্ষেত্র চিহ্নিত করে পরিবার পরিকল্পনায় শিশুমৃত্যুর প্রভাব বিষয়টিকে গবেষণা সমস্যা হিসেবে নির্বাচন করা।

(২) প্রচলিত জ্ঞানের সাথে পরিচিতি লাভঃ নির্বাচিত গবেষণা সমস্যার প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন রচনা, লেখা, বই পুস্তক, গবেষণা রিপাের্ট ইত্যাদি খুঁজে বের করে সেগুলাের সাথে সম্যক পরিচিতি লাভের চেষ্টা এ স্তরে করা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে গবেষণা সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত জ্ঞান গবেষককে সঠিক ও মিতব্যয়ী পথে এগিয়ে যেতে সাহয্য করে।

(৩) গবেষণা সমস্যাকে অনুসন্ধান উপযােগী করে তোলাঃ গবেষণার বিষয় বা সমস্যাকে বাস্তব অনুসন্ধান উপযােগী করে তােলা হয় এ স্তরে। অর্থাৎ গবেষণার বিষয়টিকে প্রশ্নাকারে এখানে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয় যাতে করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলােকে চিহ্নিত ও পর্যবেক্ষণযােগ্য করে তােলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, “জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অধিক শিশুমৃত্যুধারী দম্পতির কেঁক/প্রবণতা কোন দিকে?” এ প্রশ্নটি জনসংখ্যা সমস্যা মােকাবিলার ক্ষেত্রে একটি গবেষণার উপযুক্ত বিষয়।

(৪) উপযুক্ত গবেষণা প্রকল্প বা উদ্দেশ্য প্রণয়ন করাঃ “গবেষণা সমস্যা মধ্যকার ধারণাগুলাের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের মাধ্যমে গবেষণা সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের একটি আনুমানিক বিবৃতিই হলাে প্রকল্প।” উদাহরণস্বরূপ, এখানে অধিক শিশুমৃত্যুধারী দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কম ব্যবহার করবে। এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলাে। যে কেউই এ প্রকল্প মধ্যস্থ ধারণাগুলােকে চলকে পরিণত করে তা পরিমাপের মাধ্যমে প্রকল্পের সঠিকতা প্রমাণ করতে পারবে। কিছু কিছু বিবৃতিমূলক ও তথ্য উদঘাটনমূলক সামাজিক গবেষণায় প্রকল্পের পরিবর্তে কেবল উদ্দেশ্য প্রণয়ন করে অনুসন্ধান করাই যুক্তিযুক্ত বলে Walter R. Borg উল্লেখ করেছেন।

(৫) প্রাসঙ্গিক সুস্পষ্ট চলক নির্বাচনঃ গবেষণা সমস্যা ও প্রকল্প মধ্যস্থ ধারণাগুলাের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপনা উপযােগী সংশ্লিষ্ট চলকগুলাে এখানে চিহ্নিত করা হয়। চিহ্নিত চলকের ভিত্তিতেই প্রয়ােজনীয় তথ্যাবলি সংগ্রহ করা হয়। এতে করে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা থাকে, প্রকল্পের সত্যতা যাচাই করা যায় এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়।

(৬) তথ্য সংগ্রহের উৎস খুঁজে বের করাঃ গবেষণা সমস্যা, প্রকল্প, উদ্দেশ্য ও চলকের প্রকৃতি বিবেচনা করে যাদের কাছ থেকে উল্লিখিত তথ্যাবলি সংগ্রহ করা যাবে তা এ স্তরে নির্ধারণ করা হয়। এ উৎস কোনাে ব্যক্তি, পরিবার প্রধান, সংস্থা-কর্মী, নেতা ইত্যাদি যে কেউই হতে পারে।

(৭) তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার গঠন ও ছক-নকশা প্রণয়নঃ গবেষণা প্রকৃতি, তথ্য সংগ্রহের উৎসের অবস্থান এবং সামর্থ্যের ভিত্তিতে উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম তৈরি করা হয় যাতে করে সংশ্লিষ্ট উৎস হতে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জন করা সম্ভবপর হয়। সাক্ষাৎকার, সিডিউল, ডাক-প্রশ্নপত্র ইত্যাদি সামাজিক গবেষণার মানসম্মত তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার। সাথে সাথে এ পর্যায়ে সংগৃহিত তথ্যের উপস্থাপনযােগ্য ছকসমূহের নকশাও তৈরি করা হয়। এতে করে তথ্যের পরিমাপযােগ্যতার বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং তথ্য সংগ্রহের অব্যবহিত পরেই সুশৃঙ্খলভাবে তথ্য বিশ্লেষণ সম্ভব হয়ে ওঠে।

(৮) তথ্য সংগ্রহ মাধ্যমের পূর্বপরীক্ষণ ও পরিমার্জনঃ তথ্য সংগ্রহ মাধ্যম যথােপযুক্তকরণ, মানসম্মতকরণ এবং প্রাসঙ্গিককরণের উদ্দেশ্যে এ পর্যায়ে সামান্য সংখ্যক হাতিয়ারকে বাস্তবভিত্তিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। হাতিয়ার, যেমনঃ সিডিউল, প্রশ্নপত্র ইত্যাদির যদি কোনাে পরিবর্তন, পরিমার্জন প্রয়ােজন হয় তবে তা এ স্তরেই সমাধান করে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়।

(৯) তথ্য সংগ্রহঃ উদ্ভাবিত তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার নিয়ে সংশ্লিষ্ট উৎস হতে প্রয়ােজনীয় তথ্যাবলি। সরেজমিনে সংগ্রহ করাই এ স্তরের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে গবেষক নিজে অথবা পূবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তার বেতনভােগী মাঠকর্মীদের দ্বারা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।

(১০) তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণঃ মাঠ পর্যায় হতে সংগৃহিত তথ্যাবলি যথাযথভাবে সম্পাদনার পর তা শ্রেণিবদ্ধভাবে নানা প্রকার ছকে উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি ও কৌশলের আশ্রয়ে ঐ তথ্যগুলােকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং গবেষণা প্রকল্পের সঠিকতা যাচাই করার চেষ্টা করা হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যেকোনাে সামাজিক গবেষণা সফলতার মূল চাবিকাঠি হলাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নকশা ও ধারাবাহিকভাবে গবেষণার স্তরগুলাে সম্পাদন করা। গবেষণার স্তরগুলােকে যদি সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদন করা যায়, তাহলেই সামাজিক গবেষণা সার্থক হবে। অন্যথায় ত্রুটিযুক্ত গবেষণা সমাজের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। তাই সামাজিক গবেষণার স্তরগুলাে খুব সতর্কতার সাথে সম্পাদন করার ওপরই গবেষণার সার্থকতা নির্ধারিত হয়ে থাকে যা সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।