সামাজিক অবস্থা:

অষ্টম শতকের প্রারম্ভে ভারতীয় সমাজের ভিত্তি ছিল বর্ণবিভাগ। তৎকালীন হিন্দুসমাজ মূলত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চার বর্ণে (শ্রেণি) বিভক্ত ছিল। সাধারণভাবে সর্বোচ্চ দুটি বর্ণের সাথে সর্ব নিম্নবর্ণের প্রকাশ্য মেলামেশা নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় ছিল। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারেও সমকালীন স্মৃতিশাস্ত্রগুলি কঠোর বিধিবিষেধ আরোপ করেছেন। ফলে অসবর্ণ বিবাহের দৃষ্টান্ত তখন ছিল বিরল। তবে বর্ণভেদের কঠোরতা সম্পর্কে কিংবা প্রথম দুটি বর্ণের বৃত্তি প্রসঙ্গে স্মৃতিকারগণ যতই সোচ্চার হন না কেন, বাস্তবে তা সম্পূর্ণ অনুসৃত হত না। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র লিখেছেন : “ব্যক্তি বা দল উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে পারত, আবার তাদের পতনেরও সম্ভাবনা ছিল।”

অধ্যাপক রায়চৌধুরী (S. C. Roy Chowdhury) লিখেছেন: “in actual practice the members of different varna did not strictly adhere to their own profession and there is ample evidence to show that often the Brahmins acted as warriors and the Kshatriyas performed the functions of Merchants.” ব্রাহ্মণ বা বৈশ্যরা ক্ষত্রিয়দের সহযোগী হিসেবে রাজত্ব পরিচালনাও করতেন। সমকালীন লেখকরা এমন কিছু জাতির উল্লেখ করেছেন, যার বিভাজন ঘটেছে পেশাভিত্তিক। কুমোর, তাঁতি, নাপিত, মুচি, জেলে, শিকারি ইত্যাদি ‘জাতি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, বিভিন্ন কর্মীসংঘ তাদের পেশার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আবার তখন ‘কায়স্থ’ জাতির উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু এই জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র উভয় বর্ণের ব্যক্তিই ছিল।

অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, সম্ভবত রাজকর্মে নিয়োজিত ব্রাহ্মণ ও শূদ্রদের স্বতন্ত্রভাবে ‘কায়স্থ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্রমে এরা একটি জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জাতি-তত্ত্বের প্রথম ক্ষেত্রে কেবল নিম্নশ্রেণির মানুষ পেশার ভিত্তিতে চিহ্নিত হয়েছে; কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ মিলিতভাবে স্বতন্ত্র জাতির অভিধা পেয়েছে এবং এক্ষেত্রেও স্বতন্ত্রীকরণের মাপকাঠি তাদের পেশা। আলোচ্য পর্বে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম তার অতীত গরিমা হারিয়েছিল। ফলে বহু বৌদ্ধ ও জৈন প্রত্যাবর্তন করেছিল হিন্দুধর্মে। বহিরাগত বহু জাতি, যেমন হন এবং স্থানীয় কোনো কোনো উপজাতি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিল। এই সকল নবাগতরা হিন্দুধর্মের রীতিনীতির সাথে তাদের নিজস্ব কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান বা দেবদেবীকে সংযুক্ত করে ফেলে। ফলে সমাজ ও ধর্ম ক্রমশ জটিলতর হয়ে ওঠে।

বর্ণ ব্যবস্থা :

ভারতে তুর্কী অভিযানের প্রাক্পর্বে ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় ও বৌদ্ধির প্রাধান্যই ছিল ভারতীয় সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। বিদ্যাচর্চার সুযোগ উচ্চতর দুটি শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। অলবেরুনী লিখেছেন যে, প্রার্থনার মন্ত্র, বেদপাঠ, যজ্ঞক্রিয়া ইত্যাদি ছিল ব্রাহ্মণ শ্রেণির কুক্ষিগত এবং অন্য কোনো বর্ণের মানুষ যেমন শূদ্র বা বৈশ্যদের বেদ পাঠের ঘটনা প্রমাণিত হলে তাদের জিহ্বা ছেদন করা হতো। এমনকি সরকার সেই শাস্তি দেওয়ার আগেই ব্রাহ্মণরা এমন শাস্তি দিতে পারতেন। নিম্নতর শ্রেণির কেউ যেমন একজন চণ্ডাল এমন অপরাধ করলে তাকে আরো কঠোর শাস্তি পেতে হত। পুরাণভিত্তিক কিছু কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্য বা শূদ্ররা কিছু সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়েছিলেন। যেমন এই দু’টি শ্রেণির মানুষেরা ঈশ্বর উপাসনা করা এবং প্রাকারবেষ্টিত গ্রাম বা শহরে বসবাস করার অধিকার পেয়েছিলেন। আরবীয় পণ্ডিতদের লেখায় ভারতীয় যোদ্ধৃশ্রেণিকে ‘ঠাকুর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ক্ষত্রিয়’ শব্দটির ব্যবহার তখন দ্রুত লোপ পাচ্ছিল। অন্যদিকে ‘রাজপুত’ শব্দটির প্রচলন তখনও ঘটেনি। যাইহোক, ঠাকুর বা রাজনৈতিক কর্তৃত্বকারী শ্রেণিকে একাদশ শতকীয় রচনাবলীতে ‘রাই’, ‘রায়ান’ (রানা) ‘রায়ৎ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত শহরে ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর নামক উচ্চশ্রেণির বসতি ছিল। ‘বর্ণচ্যুত’ নয় এমন নিম্নবর্গীয়দের জন্য ছিল প্রকার বেষ্টিত গ্রাম বা ‘মওয়া’। দেশের সমস্ত ভূমির অধিকারী ছিলেন ব্রাহ্মর ও ঠাকুর শ্রেণি। কিন্তু শ্রমজীবি বা উৎপাদক শ্রেণির লোকেরা ছিলেন সম্পূর্ণ অবহেলিত এবং পোষিত।

অলবেরুণীর মতে, বর্ণচ্যুত উৎপাদক শ্রেণির লোকেদের বাস করতে হত নগর-প্রাকার কিংবা প্রাকারবেষ্টিত ‘মওয়া’র বাইরে। বৃত্তিভিত্তিক এমন আটটি গোষ্ঠী ছিল ধোপা, মুচি, নারিক, জেলে, তাঁতি, পশুশিকারী, ঝুড়ি ও ঢাল নির্মাতা এবং ঐন্দ্রজালিক। এদের ‘অন্ত্যজ’ বলা হত। এদের নিচুস্তরে ছিল হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল ও বধতু। এদের সকলে একটি নিম্নতর শ্রেণি বলে বিবেচিত হতেন। এদের জন্মগত বৈধতা গ্রাহ্য করা হত না। তাই এঁরা ছিলেন সামাজিকভাবে অদ্ভুত। এই সকল নিম্নশ্রেণির মানুষ বিশেষ অনুমতি সহ উচ্চশ্রেণির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে প্রাকার বেষ্টিত বসতি অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারতেন। কাজ শেষে এদের বেরিয়ে যেতে হত। মহম্মদ হাবিব লিখেছেন যে, ‘ভারতবর্ষে বর্ণাশ্রম প্রথার প্রকৃতি কালে কালে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে, কিন্তু ঘুরীর আক্রমণের সময়ে ভারতীয় বর্ণভেদপ্রথা যে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম’।

মনুর বিধান ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থেও সামাজিক ভেদাভেদ ও প্রখর শ্রেণি বৈষম্যের কথা স্বীকৃত হয়েছে। তৃতীয় বা চতুর্থ শতকে সংকলিত এই স্মৃতিশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের বলা হয়েছে ‘সমস্ত সৃষ্টির প্রভু, জগত সংসারের অস্তিত্বের রক্ষক। ব্রাহ্মণ ইহজাগতিক সকল বস্তুর প্রভু। সম্পদ ও আইনের রক্ষাকর্তা। জন্মের শ্রেষ্ঠত্ব ব্রাহ্মণকে এই সকল অধিকার দান করেছে। একইভাবে মনু নিম্নবর্ণের মানুষ ও উৎপাদক শ্রেণিকে সমাজ জীবনে অপাংক্তেয় করে রেখেছেন। তাঁর বিধানে একজন শুদ্র, তার প্রভু মুক্তি দিলেও, আমৃত্যু দাসত্বমুক্ত হওয়ার অধিকারী নয়। কারণ জন্মসূত্রেই সে দাসত্ব লাভ করেছে। বর্ণবিচ্যুত তথা শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য তাঁর বিধান হল যে, এরা রাতের বেলা নগর-প্রাকারের মধ্যে আদৌ অবস্থান করতে পারবে না। ভাঙ্গা থালায় খাদ্য গ্রহণ করবে এবং তাদের পরিচ্ছদ হবে শবদেহের পোষাকের অনুরূপ। মনু স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, একমাত্র মৃত্যুই বর্ণ-বহির্ভূতদের মুক্তির উপায়’। গজনীর মামুদ এবং মহম্মদ ঘোরীর আক্রমণের সময় বর্ণ-ব্যবস্থার কঠোরতার অন্যতম অঙ্গ ছিল শারীরিক ছোঁয়াছুঁয়ি অর্থাৎ ছুৎমার্গীয় কঠোরতা। আন্তঃবিবাহ, পতি ভোজন, নিম্নবর্গীয়দের ছোয়া জল বা আগুন গ্রহণ না করা, এমনকি রণক্ষেত্রেও নিম্নবর্ণের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চবর্ণের সেনাদের যুদ্ধ না-করার নিয়ম ইত্যাদি দশম-দ্বাদশ শতকীয় ভারতীয় সমাজকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করে তুলেছিল।

মহম্মদ হাবিব লিখেছেন, যে ভারতীয় সমাজ একদা বৌদ্ধধর্মের প্রচারক হিসেবে মধ্য-এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানবতা ও উদারতাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সেই সমাজ দশম-দ্বাদশ শতকে বহু বর্ণ ও উপবর্ণে বিভাজিত হয়ে নিজেকেই অন্তঃসারশূন্য করে তুলেছিল।

নারীর অবস্থা :

আলোচ্য কালেও সমাজে নারীর মর্যাদা বাড়েনি। স্বামী তথা পরিবারের সেবাদানই ছিল নারীর প্রাথমিক কর্তব্য। বেদপাঠে নারীর অধিকার স্বীকৃত ছিল না। বাল্য বিবাহ ছিল জনপ্রিয়। সাধারণভাবে একটি বিবাহ কাম্য ছিল। তবে কারও স্ত্রী সন্তানের জন্মদানে অক্ষম হলে, তার স্বামী ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে পুনর্বিবাহ করতে পারত। ভূস্বামী বা সামন্ত-প্রভুদের মধ্যে বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রচলন ছিল। অবশ্য নারীর অধিকার রক্ষার ব্যাপারেও সমকালীন গ্রন্থে কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন স্ত্রীর প্রতি সৎ-আচরণ এবং ন্যায়পথে জীবনযাপন স্বামীর প্রধান কর্তব্য হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেও তার ভরণপোষণের ভার স্বামীকে গ্রহণ করতে হত। সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থায় অপুত্রক অবস্থায় স্বামীর মৃত্যু হলে, স্ত্রী ওই সম্পত্তির অধিকারিণী হত। অবিবাহিতা কন্যা তার বিধবা মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হতে পারত। সাধারণভাবে বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল না। তবে স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে, পুরুষত্বহীন হলে, কিংবা জাতিচ্যুত হলে বিবাহিতা নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারত। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের একই চিতায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার রীতি (সতীদাহ) তখনও ছিল, তবে এই রীতির প্রয়োগ কতটা কঠোরভাবে করা হত— সে বিষয়ে মতভেদ আছে। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র লিখেছেন : “সমকালীন কোনো কোনো লেখক সতীদাহ প্রথার নিন্দা করেছেন।”

আরবীয় লেখক সুলেমান লিখেছেন, “সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল, তবে এই কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হত।” সম্ভবত প্রথা হিসেবে সতীদাহের প্রচলন থাকলেও ষষ্ঠ শতক ও অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী কালে তার ততটা প্রয়োগ ছিল না। তবে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিকাশের ফলে সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি এবং মৃত স্বামীর সম্পত্তির ওপর অপুত্রক স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত হলে জমির অধিকারকে কেন্দ্র করে গৃহবিবাদের সূত্রপাত হয় এবং তখন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক সতীদাহ ব্যবস্থা প্রসারের ঝোঁক দেখা যায়। সামাজিক মর্যাদা বা কর্তৃত্বের বিচারে অবহেলিত হলেও সে যুগের কোনো কোনো রমণী ললিতকলায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এমন উল্লেখ পাওয়া যায়। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র লিখেছেন যে, “রাজদরবারের নারী এমনকি রানির পরিচারিকাও সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় অতি চমৎকার কবিতা রচনা করেছেন। অভিজাত-কন্যা বা ধনী ব্যক্তির উপপত্নীরা ললিতকলার নানা ক্ষেত্রে পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। রাজকুমারীগণ সংগীত ও চিত্রাঙ্কনে যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তার প্রমাণও পাওয়া যায়।” যাই হোক্, এগুলিকে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তরূপে বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ সমাজের উঁচুতলার অসংখ্য নারীর মধ্যে সীমিত কয়েকজন যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তাকে সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।