দাস-সমাজের আভ্যন্তরীণ শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও দাস সমাজের পতন:
মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় প্রথম শ্রেণীবিভক্ত ও দ্বন্দ্বশীল সমাজ হল দাস-সমাজ। পরশ্রমভোগী দাস-মালিক ও ক্রীতদাস হল এই সমাজের দু’টি মূল দ্বন্দ্বশীল সমাজ। এই শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ক্রীতদাসদের শ্রমই ছিল দাস-সমাজের অস্তিত্বের মৌল উপাদান। কিন্তু শোষিত নিপীড়িত ক্রীতদাসগণ অভিশপ্ত জীবনের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির জন্য ক্রমশ সংগঠিত বিক্ষোভ-বিদ্রোহের সামিল হয়েছে। তারফলে দাস-মালিকদের উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সময় দাস সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির সঙ্গে উৎপাদন-সম্পর্কের বিরোধ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে অসংগতি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনকে অপরিহার্য করে তোলে। এই অসংগতি দাস-মালিক ও ক্রীতদাসের মধ্যে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে ব্যক্ত হতে থাকে। প্রচলিত শোষণমূলক উৎপাদন ব্যবস্থা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দাস-মালিকগণ সচেষ্ট হয়। অল্প ব্যয়ে অধিক সম্পদের জন্য দাস-মালিকগণ দাসদের উপর শোষণ-পীড়নকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সতত সক্রিয় থাকে। অমানুষিক অত্যাচারের শিকার দাসগণ উৎপাদন কার্যে উৎসাহ হারায়। দাস-সমাজব্যবস্থার এই আভ্যন্তরীণ শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসাবে দাস-সমাজের পতন ঘটে।
দাস সমাজের অবসান ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব:
দাস-সমাজব্যবস্থার উৎপাদন-শক্তির উন্নতি, উন্নত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে দাস সমাজের অবসান এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। প্রকৃত প্রস্তাবে দাস-সমাজব্যবস্থার অবসানের মধ্যেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাবের বীজ বর্তমান ছিল। দাস সমাজে অসাম্য, অত্যাচার ও শোষণ অব্যাহত ছিল। এ কথা ঠিক। কিন্তু মানবসমাজের সামগ্রিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দাস-সমাজের পর্যায়টি হল একটি অগ্রবর্তী পদক্ষেপ। দাস-সমাজব্যবস্থায় কৃষি এবং হস্ত-চালিত বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে। শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম-বিভাজন ব্যবস্থা প্রসারিত হয়। বস্তুত এই সময় সামাজিক শ্রম-বিভাজন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। শ্রম-বিভাজনের সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষীকরণের সৃষ্টি হয়। তার ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়, দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদনের সাজ-সরঞ্জাম বা হাতিয়ারের মানোন্নয়ন ঘটে, নতুন নতুন হাতিয়ারের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া দাস সমাজে ক্রীতদাসদের, কায়িক শ্রমের মাধ্যমে নতুন নতুন রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, সমুদ্রপাড়ী দেওয়ার জন্য জাহাজ প্রভৃতি গড়ে উঠে। সংক্ষেপে উৎপাদন শক্তি বিকশিত ও উন্নত হয়। উৎপাদন-শক্তির এই অগ্রগতির পথে প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্ক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দাস-মালিকরা নিজেদের আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য উৎপাদন শক্তির উন্নতিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কারণ দাস-মালিকদের উদ্দেশ্য হল বহু ক্রীতদাসের শ্রম শোষণের মাধ্যমে নিজেদের আর্থনীতিক স্বার্থকে অধিকতর সমৃদ্ধ করা। তাই তারা উৎপাদনের সাজ-সরঞ্জামের উন্নয়নের ব্যাপারে উদ্যোগী হয় না। দাস-সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধ কালক্রমে চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। ক্রীতদাসদের মধ্যে উত্থান ঘটে। দাস-মালিকদের সঙ্গে তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই সময় দাস-মালিকদের মধ্যে অন্তর্কলহ এবং অসভ্য উপজাতিসমূহের আক্রমণের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত এই অবস্থায় সামাজিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়। এবং দাস-সমাজব্যবস্থার উৎপাদন সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও উন্নয়নের পথ বাধাহীন হয়। দাস-সমাজের অবসান এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব ঘটে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা ড. দত্তগুপ্ত-র একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “দাস সমাজ’-এর কিছু কিছু ‘দাস’দের মুক্তির ব্যবস্থা ছিল। এই ব্যবস্থাকে বলা হত ‘Manumission’ এবং এই মুক্তি পাওয়া দাস ও কিছু স্বাধীন মানুষ মিলে ছোট ছোট ভূমি নিয়ে Coloni বা ভূমিদাস প্রথা গড়ে তোলে। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে রোম সাম্রাজ্যে এই ধরনের Coloni-র উদ্ভব হয়েছিল। জমির মালিক জমি বিক্রির সময় ঐ ভূমিদাস সহ জমি বিক্রি করত। ‘দাস সমাজ’ থেকে ‘সামন্ত সমাজ’-এ পৌঁছতে এটি একটি অত্যন্ত অনুকূল অবস্থা ছিল।”
সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব:
দাসব্যবস্থার পরিণতি হিসাবেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে। লেনিনের কথায় “এই স্তরের পর ইতিহাসে দেখা যায় আর একটি স্তর–সামন্ততন্ত্র।” বেশীর ভাগ দেশেই ক্রমবিকাশের ধারায় ক্রীতদাসত্ব ভূমিদাসত্বে পরিণত হল। এখন সমাজে মূল বিভাগ হল সামত্ত জমিদার ও কৃষক-ভূমিদাস। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে, দাস-মালিক ও দাস এই দুই পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে দাস-সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া ইতিমধ্যে উৎপাদন ধারার অভূতপূর্ব উন্নতির জন্য দাস-সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। দাসদের বিদ্রোহ, উৎপাদন ব্যবস্থায় দাস ব্যবহারে লোকসান, সামন্ত জমিদারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতির মুখে দাসব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল। সমাজে এই সময় কৃষিকার্য প্রধান উপজীবিকা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। আর সমাজের অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগণ জমির মালিকে পরিণত হয় এবং দুর্বল শ্রেণীর লোকেদের নিজেদের জমিতে কৃষিকার্যের জন্য নিযুক্ত করে। এইভাবেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। অধ্যাপিকা ড. দত্তগুপ্ত মন্তব্য করেছেন: “ সামন্ততন্ত্র বা Feudalism শব্দটি কোন একশিলা বা monolithic অভিধা নয়। ‘দাস সমাজ’-এর আভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং যে সব উপজাতীয় সমাজে সামরিক কর্তৃত্ব প্রবল ছিল, সামত্ত সমাজ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইউরোপের সামন্ত সমাজ, ইংল্যান্ডের সামন্ত সমাজ এবং জাপানের সামন্ত সমাজ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিকশিত হয়।”
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি:
সামন্ততন্ত্রের ইংরাজী প্রতিশব্দ হল ‘Feudalism’। এই ইংরাজী শব্দটির উৎপত্তিস্থল হল ল্যাটিন শব্দ ‘Feodum’। এদিক থেকে ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সামন্ততন্ত্রের অর্থ হল ভূ-স্বামীর সপক্ষে যুদ্ধে সামিল হওয়ার শর্তসাপেক্ষে যে ব্যক্তি বা প্রজা জমি ভোগ করে। দাস-ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা হল সংখ্যাগত ও গুণগত বিচারে সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের সমাজব্যবস্থা। কৃষকই হল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান উৎপাদন শক্তি এবং সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রধানত জমির মালিকানার দ্বারাই উৎপাদন সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। সামন্ত-সমাজে উৎপাদনের উপাদানের মালিক হল সামন্তপ্রভুরা। কৃষকদের শ্রম কাজে লাগানোর অধিকার সামন্তপ্রভুদের হাতেই ছিল। কৃষকগণ ভূস্বামী বা সামস্ত-প্রভুর উপর নির্ভরশীল ছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষকগণ দাস সমাজের দাসদের তুলনায় কিছুটা স্বাধীন ছিল। তাদের নিজেদের ঘর, সরঞ্জাম এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু জমিও ছিল। কিন্তু কৃষকগণ স্বাধীন ব্যক্তি ছিল না। বস্তুত, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে দাস-সমাজের দাসগণ ভূমিদাসে পরিণত হল। এবং দাস-মালিকগণ ভূস্বামী বা সামন্ত-প্রভুর স্থান দখল করল। ভূস্বামিগণ কৃষক-ভূমিদাসকে চুক্তির ভিত্তিতে যে সামান্য জমি দিত সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন কাজ করার পর বাকী সময় কৃষককে মালিকের জমিতে কাজ করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই পর্বে সামস্ত-প্রভুরাই ছিল উৎপাদন ও উৎপন্ন ফসলের মালিক। কিন্তু কৃষক ভূমিদাসের উপর পুরো মালিকানা ছিল না এবং উৎপন্ন সামগ্রীর উপরও কৃষকদের আংশিক অধিকার স্বীকৃত ছিল। তবে সামন্তপ্রভুদের হুকুম তামিল করা এবং প্রায় বেগার খাটাই ছিল কৃষকদের অদৃষ্ট। সামন্ত সমাজে মুষ্টিমেয় ভূ-স্বামী বিপুল সংখ্যক কৃষি-শ্রমিককে শোষণ করে। বস্তুত এই পর্যায়ে সামন্তপ্রভুদের প্রায় ক্ষেত্রেই কিছু ক্রীতদাসও থাকত। যাইহোক, পরশ্রম-ভোগী ভূ-স্বামিগণ কৃষক-ভূমিদাসের শ্রমের উৎপাদনে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদের ভাণ্ডার স্ফীত করত। লেনিন (Lenin) বলেছেন: “…in feudal society the peasant is tied to the soil. The chief token of serfdom was that the peasants were considered attached to the land-hence the very concept of serfdom.”
রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে শাসন ও শোষণ:
মূলত কৃষিব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই সামন্তব্যবস্থার উৎপত্তি হলেও কিছু ক্ষুদ্রায়তন হস্তশিল্পও সামন্তব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সকল শিল্পে শিল্পপতিগণ কারিগরদের শ্রমে নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করত এবং উপযুক্ত মজুরি থেকে বঞ্চিত করে কারিগরদের শোষণ করত। সামন্তব্যবস্থায় সর্বদা একটি শ্রেণী তাদের শ্রম-লব্ধ উৎপন্নের উপযুক্ত অংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং অপর শ্রেণী তা ভোগ করেছে ও শোষণ কায়েম করেছে। সামাজিক প্রগতির এই পর্বে সামন্তপ্রভুরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ভূমিদাস শ্রেণীর উপর শোষণকে অব্যাহত রেখেছে। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল ভূমিদাসদের উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম করা। সামত্ত শ্রেণীর এই শোষণ অব্যাহত রাখার একটি হাতিয়ার হল এই রাষ্ট্র। অনুরূপভাবে সামন্ততান্ত্রিক আইনের মাধ্যমে সামস্ত-শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও শাসন-শোষণকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হত। দাস-সমাজের শোষণের তুলনায় সামত্ততান্ত্রিক সমাজে শোষণ ছিল কম। তবে সামন্তপ্রভুদের সেবাতেই জীবনের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে ভূমিদাসরা বাধ্য হত। ভূ-স্বামীদের শোষণও ছিল হৃদয়হীন ও অমানুষিক। মুষ্টিমেয় সামন্তপ্রভু গরিষ্ঠ-সংখ্যক ভূমিদাসকে শোষণ করত এবং ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করত। সামন্তপ্রভুরা ক্রমে কৃষকদের কাছ থেকে শস্যের পরিবর্তে মুদ্রা দাবি করতে শুরু করে। এইভাবে মুদ্রায় খাজনা দেওয়ার রীতি চালু হয়। ভূ-স্বামীরা অনেক সময় নগদ অর্থের বিনিময়ে ভূমিদাসকে স্বাধীনতা দিত। তবুও সংগতিহীন ভূমিদাস স্বাধীনভাবে চাষ-আবাদ করতে পারত না। বাধ্য হয়ে ভূমিদাসকে ভূস্বামীর জমিতে সামান্য মজুরীতে ভাড়াটিয়া শ্রমিক হিসাবে মেহনত করতে হত। অধ্যাপিকা ড. দত্তগুপ্ত এ বিষয়ে বলেছেন : “ ‘সামন্ত সমাজ’ এ গ্রামকে বলা হত ‘ম্যানর’ (Manor)। আর ‘ম্যানর’-এর গঠন ছিল ত্রিস্তরীয়; ভূমিব্যবস্থা, সামাজিক শ্রেণী ব্যবস্থা এবং এক জবরদস্ত অনুশাসন ব্যবস্থা বা Social Control। গ্রামের জমির শ্রেণীকরণ হত কার ভোগ দখলে সেই জমি আছে। এই নীতি অনুযায়ী আমরা সামন্ত সমাজে গ্রামের জমিতে নিম্নরূপ ভাগগুলি দেখতে পাই। যথা— (১) ডেমেন ল্যান্ড (Demesne land) : যে জমি একান্তভাবেই সামন্তপ্রভুদের জন্য নির্দিষ্ট, (২) গ্লিব (The Glebe) অর্থাৎ গ্রাম বা ‘ম্যানর’-এর যে জমি চার্চের জন্য চিহ্নিত, (৩) ভিলেনেজ -এর জমি (Land in Villeinage) অর্থাৎ যে সমস্ত জমি সামন্তপ্রভুদের ভাড়াটেদের কাজে ইজারা দেওয়া। এই মোটা দাগের ভাগচিহ্ন ছাড়াও অসংখ্য সূক্ষ্ম ও মিহি ধরনের জমির ভাগ ছিল। ……ম্যানর বা গ্রামের প্রভু ছিলেন জমিদার।”
এই সময় ভূস্বামীদের সঙ্গে যাজক সম্প্রদায় স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। এই দুই গোষ্ঠী রাজনীতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবাধ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দু’টি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হল রাষ্ট্র এবং যাজকতন্ত্র। উভয় প্রতিষ্ঠানই মুষ্টিমেয় শাসক-শ্রেণীর সম্পত্তি-স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় আত্মনিয়োগ করে। অধ্যাপিকা ড. দত্তগুপ্ত মন্তব্য করেছেন “ নবম শতক থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ-ছ’শ বছর পর্যন্ত ইউরোপে এই সামস্তসাহী বা সামন্ত শাসন ব্যবস্থার যুগ চলে।” এই বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও দক্ষিণ আমেরিকা ও আরব রাষ্ট্রগুলিতে এবং কিছু অনুন্নত ও অ-সমাজতান্ত্রিক দেশে সামন্তব্যবস্থার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
আবার দাস-বিদ্রোহের মত কৃষক-বিদ্রোহের নজিরও ইতিহাসে বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে ইংল্যাণ্ডে টাইলার (Tyler)-এর নেতৃত্বে, রাশিয়ায় রেজিন (Rajin)-এর নেতৃত্বে ভূমিদাসদের বিদ্রোহের উল্লেখ করা যায়। ফ্রান্স এবং জার্মানিতেও কৃষক-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
সামন্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য:
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
-
(১) সামস্ত সমাজে কৃষকই হল প্রধান উৎপাদন শক্তি। কিন্তু কৃষকগণ সামত্ত-প্রভুদের উপর নির্ভরশীল।
-
(২) এই পর্বে সমাজ ভূ-স্বামী ও ভূমিদাস—এই দুই পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত। বিপুল সংখ্যক কৃষক-ভূমিদাস মুষ্টিমেয় সামন্ত প্রভুদের দ্বারা শোষিত হয়।
-
(৩) ধর্ম এবং চার্চ সামস্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সহায়তা করে।
-
(৪) সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী-সংগ্রামের তীব্রতা এবং ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।
-
(৫) উৎপাদনের উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর মালিকানা সামন্তপ্রভুদের হাতেই থাকে। তবে কৃষক ভূমিদাসের সম্পূর্ণ মালিকানা ছিল না এবং উৎপাদনের উপরও কৃষকদের আংশিক অধিকার স্বীকৃত ছিল।
-
(৬) কৃষক ভূমিদাসের উপর শাসন ও শোষণ বজায় রাখার জন্য সামন্তপ্রভুরা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে।
Leave a comment