সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্তের পরিচয়
উনবিংশ শতকে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, আদর্শবানই যাদের জীবনের ব্রত ছিল- সে সব চিন্তানায়কদের অন্যতম ছিলেন সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্ত [১৮১২-৫৯)। ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) এর নিবেদিত প্রাণ এই সাংবাদিক কবি তার সহজাত কবি প্রতিভাকে পাঠকদের মনোরঞ্জনের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তাই তার পার মাসিক বিষয়ে রচিত কবিতাগুলো ছাড়া প্রায় সমস্ত কবিতাই ছিল সাংবাদিকতার লক্ষণাক্রান্ত ও ফরমায়েশধর্মী।
বাংলা সাহিত্যে সাময়িক পত্র নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। সাময়িক পত্রের ওপর নির্ভর করে গদ্যের সাথে পদ্যও নতুন সম্ভাবনার পথে অগ্রসর হয়েছিল। গুপ্ত কবি ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় শ্রুতিনির্ভর কবিতাকে চক্ষু-নির্ভর করেছিলেন। তার হাতেই প্রথম বাংলা কবিতা সংবাদপত্রে স্থান করে নেয়। কবির ছেলেবেলা কেটেছিল কবি সংগীতের আবহাওয়ায়। নিজেও একজন উৎকৃষ্ট বাঁধন দার ছিলেন এবং কবির লড়াইয়েও অভ্যস্ত ছিলেন। ছেলেবেলার ঐ অভ্যাস নিয়েই ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ সাংবাদিকে নতুন ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তার। বাংলা সংবাদপত্রের জগতে ‘সংবাদ প্রভাকর’ নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবার যোগ্য। কারণ সংবাদপত্রের জগতে তো বটেই, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাধারণ বাঙালির জীবনচর্চা ও মননে এই পত্রিকার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ঈশ্বরগুপ্তের সাংবাদিক ভূমিকার স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেন- “এই প্রভাকর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অদ্বিতীয় কীর্তি।”
“একদিন প্রভাকর বাংঙ্গালা সাহিত্যের হর্তা-কর্তা-বিধাতা ছিলেন, প্রভাকর বাংলা রচনার রীতিও অনেক পরিবর্তন করিয়া যান।… নিত্য নৈমিত্তিকের ব্যাপার, রাজকীয় ঘটনা, সামাজিক ঘটনা, এ সকল যে রসময়ী রচনার বিষয় হইতে পারে ইহা প্রভাকরই প্রথম দেখায়। আজ শিখের যুদ্ধ, কাল পৌষপার্বণ, আজ মিশনারী, কাল উমেদারি, এ সকল যে সাহিত্যের অধীন, সাহিত্যের সামগ্রী, তাহা প্রভাকরই দেখিয়েছিলেন।” (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন চরিত ও কবিত্ব)।
সাংবাদিকতা ঈশ্বরগুপ্তের জীবনের সকল কীর্তির মূল প্রেরণা। তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনবোধের অন্বেষণ তীব্র হলেও বাস্তব জীবনের প্রতি সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, কৌতূহল ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে তা কোথাও অন্তরায় সৃষ্টি করেনি।। সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্তের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি সেকালের বাঙালি পাঠককে জীবনাভিমুখী করে তুলতে সাহায্য করেছিল। তিনি যা দেখেছেন, সরাসরি তাই তুলে ধরেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় সাহিত্যমূল নিরূপণ প্রসঙ্গে সঙ্গত কারণেই সাংবাদিকতার প্রসঙ্গটি এসে যায়।
যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরগুপ্ত একাধারে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। একদিকে তিনি প্রাচীন কবিত্বের পুনরুজ্জীবন করতে চেষ্টা করেছিলেন; অন্যদিকে তিনি নবীন কবিদের তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এখনেই তিনি সম্পূর্ণ যুগসন্ধির কবি। নতুন পুরাতন দুই যুগকে তিনি একই সাথে ধরতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিকতার কারণে সমসাময়িক চিন্তাধারার সাথে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। ফলে সমকালীন যুদ্ধ, দেশপ্রেম, ইতিহাস, সামাজিক সমস্যা, নৈতিক অবক্ষয়, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ,
নীলকরদের অত্যাচার প্রভৃতি তার কবিতায় স্থান পেয়েছে, যা তার সাংবাদিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ।
একদিকে দেশীয় ঐতিহ্য চেতনা, অপর দিকে নবাগত পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি- এই উভয় চেতনার ভাব মিশ্রণে জ্ঞান চর্চার ভিতর দিয়ে সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্ত তার ভাবীকালের সমাজ তথা জাতি গঠন করার কথা চিন্তা করেছিলেন। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত সেকালের নব্যযুবা ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায়কে স্বদেশাভিমুখী করে তোলার জন্য নিরন্তর চেষ্টাও চালিয়েছেন। তার সংবাদ প্রভাকর এর পৃষ্ঠায় এর সত্যতা প্রমাণ রয়েছে। যেমন- ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায়ের ইংরেজ সভ্যতা প্রীতির ব্যঙ্গ করে বলেছেন,
“ধন্যরে বোতল বামি ধন্য লাল জলে।
ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতার বলা।
…………………………………
কাটা ছুরি কাজ নাই কেটে যাবে বাবা।
দুই হাতে পেট ভরে খাব থাবা থাবা।” [ইংরেজি নববর্ষ]
সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্তের সমস্ত সম্পাদকীয় রচনায় তার স্বদেশপ্রীতি ছড়ানো। স্বজাতি প্রীতির সূত্রেই কবি দেশের সার্বিক মঙ্গল ও উন্নতির আকাঙ্ক্ষা তাঁর দেশবাসীর মনে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। দেশের নব্য শিক্ষিত তরুণদের তিনি মাতৃভাষা চর্চায় যেমন প্রচুর উৎসাহ দিয়েছিলেন, তেমনি বাংলা ভাষায় পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশকেও সাদর অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। গুপ্ত কবির কাছে স্বদেশ কোনো কল্পনার সামগ্রী ছিল না। তা ছিল তার কাছে প্রত্যক্ষ- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব। এ বিষয়ে কবি তার ‘স্বদেশ’ কবিতায় লিখেছেন,
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন দেখিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া ।’
স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলনে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে ঈশ্বরগুপ্তের যে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে তৎকালীন প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’ এর সম্পাদকীয় উক্তির মধ্যেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। গুপ্ত কবি নারী শিক্ষার প্রতি বিরূপ ছিলেন না। তবে তিনি বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন। কিন্তু সমাজ সচেতন এই সাংবাদিক কবি জানতেন সেকালের জনমত বিধবা বিবাহের পক্ষে।
গুপ্ত কবির সাংবাদিক সত্তার কারণে সমকালীন সমাজও পরিবেশের প্রতি তার সচেতন দৃষ্টি ছিল। সাংবাদিক কবির অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নীলকরদের প্রতি তার কঠিন মনোভাবের অবাধ প্রকাশ। গদ্য ও পদ্য এই উভয় ক্ষেত্রে কবি তার নীলকর বিষয়ক মনোভাবের অবাধ প্রকাশ করে গিয়েছেন। নীলকরদের অত্যাচারে সেকালের নিরন্ন মানুষের দুঃখের কথা কবি তার কবিতার মধ্যে তুলে ধরেছেন-
“নামেতে নীলের কুঠী, হতেছে কুটি কুটি
দুখীলোক প্রাণে মারা যায়।
পেটে খেতে নাহি পায় ।” (ঐ)
এভাবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে কবি সেকালের পাঠকদের কাছে শিক্ষিত সাধারণের কাছে, দূর মফস্বলের অত্যাচারী নীলকরদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরগুপ্তকে সংবাদিক কবি বলা হয় আরেকটি কারণে তা হলো, তার সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার কলরোলকে তিনি সত্যনিষ্ঠভাবে কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। ‘শিখ যুদ্ধ’, ‘নানা সাহেব’, ‘কানপুরের যুদ্ধ’, ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’, ‘দিল্লীর যুদ্ধ’, ‘ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ’, ‘এলাবাদের যুদ্ধ’, ‘পিরোজপুরের যুদ্ধ’ প্রভৃতি কবিতা একদিকে যেমন ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট, অন্যদিকে সাংবাদিক কবির রাজনৈতিক চেতনার সূক্ষ্ম পরিচয়বাহী।
ঈশ্বরগুপ্ত ছিলেন জার্নালিস্ট। তিনি চারদিকে যা দেখেছেন, তা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই তার কবিতায় কখনো কখনো সাংবাদিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সাংবাদিকতার কারণে তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলির কবি এবং সামাজিক পরিচিতির কবি। চারপাশের তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর বিষয়সমূহ তার কাব্যে মহিমা লাভ করেছে। ‘আসারস’, ‘এন্ডওয়ালা তপসে মাছ’, ‘পাঁঠা’, ‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’,’ পৌষপার্বণ’ প্রভৃতি কবিতায় কবি তুচ্ছাতিতুচ্ছ সাধারণ বিষয়ে বাঙালির যে মনোভাব সেটি প্রকাশ করেছেন। সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে গিয়ে রঙ্গব্যঙ্গের আশ্রয়ে যে চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে কিছু হালকা দৃশ্য চটুল ভঙ্গিতে ভেসে উঠেছে। তিনি যা দেখেছেন কৌতুক সহকারে তাই ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে তার প্রতিভা সাংবাদিকতার প্রভাবজাত। কবিতাগুলোর প্রতিটি ছত্রই যেন সংবাদপ্রধান হয়ে উঠেছে।
ঈশ্বরগুপ্তের কবি সত্তায় প্রাচীনতার ছাপ থাকলেও তাতে আধুনিকতা দুর্লক্ষ্য নয়। পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা ও সমসাময়িক চিন্তাধারা তাকে আধুনিকতার অনুসারী করেছে। অন্যদিকে রক্ষণশীল মনোভাব তাকে প্রাচীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করিয়েছেন। ফলে তার কবি মানসে দ্বৈততার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ‘যুগ সন্ধির কবি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সেই সাথে দীর্ঘ দিন সংবাদপত্র সম্পদনা করেছিলেন বিধায় তাকে ‘সাংবাদিক কবি’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংবাদ প্রচার করলেও তাঁর মাঝে সাহিত্য গুণ ছিল, যা তাকে সাহিত্যিক পদে উন্নীত করেছে। তার কবি সত্তার উপর সাংবাদিক সত্তার প্রভাব কিছুটা বেশি পড়েছিল বলে তার রচনা অতটা জীবন-গভীরতা লাভ করেনি। কিন্তু তাই বলে তার কবিতার মূল্য অকিঞ্চিৎকর নয়।
ঈশ্বরগুপ্তের কবিসত্তা ও সাংবাদিক সত্তা কোনোটাই ঠিক তার একক পরিচয় নয়। এই দুটি সত্তার সমন্বয়েই তার কবি মানস সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই ঈশ্বরগুপ্ত সম্বন্ধে আমরা বলতে পারি, তিনি একই সাথে কবি ও সাংবাদিক। অর্থাৎ, “ঈশ্বরগুপ্ত সাংবাদিক কবি এবং তার কবিতা হলো কাব্যে সাংবাদিকতা।”
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment