বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্যের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এতদসত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়।

(১) সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক মতাদর্শ সরকারীভাবে স্বীকার করা হয় এবং তা অনুসরণ করা হয়। অধ্যাপক বল বলেছেন: “There is an official socialist ideology.” 

(২) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি মাত্র শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণী হল শ্রমিক ও কৃষকের সর্বহার শ্রেণী। এই সর্বহারার একনায়কত্বই (dictatorship of the proletariat) হল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

(৩) এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় একাধিক শ্রেণী থাকে না বলে শ্রেণীশোষণ বা শ্রেণী-দ্বন্দ্বও থাকে না। সমাজে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব না থাকার দরুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে একটি মাত্র রাজনীতিক দল থাকে। সমাজে একাধিক শ্রেণী ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব না থাকায় একাধিক রাজনীতিক দলের প্রয়োজন থাকে না। দেশের সকল শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতী মানুষ একটি মাত্র সাম্যবাদী দলের মাধ্যমে নিজেদের পরিচালিত করে। একে কমিউনিস্ট দল বলা হয়।

(৪) এই কমিউনিস্ট দলই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে পরিচালনা করে। সর্বক্ষেত্রেই এই দলের অপ্রতিহত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বল বলেছেন: “Political power is monopolised by one political party.” 

(৫) উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার শোষণের সূত্রপাত করে। তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একরকম অধিকার স্বীকার করা হয় না। সমাজের ধন-সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ও পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার অস্বীকৃত হওয়ায় শোষণের কোন সুযোগ থাকে না।

(৬) অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থার মত এখানে সরকারী ও বে-সরকারী উদ্যোগের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বে-সরকারী সংগঠনসমূহ সরকারের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। বল বলেছেন: ‘There is less distinction between public and private spheres of activity than one finds in other types of political System, Private associations are subject to a large degree of state power than in liberal democracies.”

(৭) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থের পরিবর্তে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে ব্যক্তির বদলে সামগ্রিকভাবে সমাজকে বড় করে দেখা হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধ্যান-ধারণাকে স্বীকার করা হয় না। সকল কাজ সমষ্টিগত নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সমষ্টিগতভাবে সামাজিক ও রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন হয়। ব্যক্তিপূজা বা নেতৃপূজার স্থান এখানে নেই। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সকল স্তরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসৃত হয়।

(৮) অর্থনৈতিক সাম্য, সর্বপ্রকার শোষণের অবসান, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুপন্থী শিক্ষাসংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

(৯) সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক সাম্য ও স্বাধীনতা থাকে। তাই জনসাধারণ সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগের প্রকৃত ও পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। সেইজন্য সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার যথার্থ উপলব্ধি সম্ভবপর হয়। কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই নাগরিকের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় অধিকার ভোগের সঙ্গে কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

(১০) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। 

(১১) এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর একটি মাত্র রাজনীতিক দলের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

(১২) ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার মত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভীতি প্রদর্শন, হিংসা, সন্ত্রাস, প্রভৃতির প্রয়োজন হয় না। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্বীকৃত। তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও পুঁজিবাদী, প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে। তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই বলপ্রয়োগ হল মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষীর সংকীর্ণ স্বার্থের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ব্যাপক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বলপ্রয়োগ।

(১৩) সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের গণতন্ত্রের মূলকথা হল আইনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজকর্মে জনসাধারণের ব্যাপক ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। সমাজতান্ত্রিক সমাজে সর্বহারার একনায়কত্বে এই সর্বহারার গণতন্ত্র হল প্রকৃত গণতন্ত্র। লেনিন বলেছেন: “Proletarian democracy is a million times more democratic than any bourgeois democracy.” 

(১৪) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতিক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতিতে বিশ্বাসী। এই ব্যবস্থা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর বিরোধী। 

(১৫) সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে স্বীকার করা হয় না। এবং এই কারণের জন্য এখানে বিচার বিভাগের কোন স্বতন্ত্র স্বাধীনতার নীতিকেও স্বীকার করা হয় না। বল বলেছেন: “The concept of separation of powers is not accepted and the judiciary, therefore, has no distinct independence.”