মানবসমাজের ইতিহাসে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা ও ঘটনা বেশী দিনের নয়। এর আগেও সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এবং এই সমস্ত বিপ্লবও বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেছে। কিন্তু এই সমস্ত বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা যায় না।

আপাত সাদৃশ্য: বস্তুত ইতিহাসগত বিচারে মূলত দু’ধরনের বিপ্লবের কথা বলা হয়। বিপ্লবের এই দু’টি ধরন হল: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যগত বিচারে এই দু’ধরনের মধ্যে কিছু আপাত সাদৃশ্যও আছে। এই সাদৃশ্যগুলি নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। 

  • (১) উভয় ধরনের বিপ্লবই ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে সংঘটিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে বিকশিত উৎপাদা-শক্তির বিরোধের ফলেই বিপ্লব ঘটে। 

  • (২) উভয় ধরনের বিপ্লবের পরিণতিতে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এক নবজাগ্রত শ্রেণীর হাতে আসে। 

  • (৩) শক্তি বা বলপ্রয়োগের ঘটনা উভয় প্রকার বিপ্লবের ক্ষেত্রেই ঘটে। 

  • (৪) উভয় প্রকার বিপ্লবের সফল পরিণতিতে অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উভয় ধরনের বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য

সমাজতন্ত্রের উদ্ভবের আগে সংঘটিত বিভিন্ন বিপ্লব ও পরিবর্তন বিভিন্ন দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে পৃথক প্রকৃতির। পূর্ববর্তী সকল বিপ্লবের থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংখ্যাগত ও গুণগত বিচারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক ও অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। হার্বার্ট আপথেকারের আলোচনা থেকে সমাজতান্ত্রিক ও অ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্যসমূহের কথা বলা যায়।

(১) ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্নে পার্থক্য: দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন বিরাট পরিবর্তন প্রাক-সমাজতান্ত্রিক ইতিহাসকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু সেই সমস্ত পরিবর্তনের সবকটিতেই উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অব্যাহত ধারাটি বজায় থেকেছে। দাসব্যবস্থাকে ভেঙে সামন্ততন্ত্রের প্রবর্তন, আবার তাকে ভেঙে ধনতন্ত্রের উদ্ভব— সবই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে ঘটেছে। তবে এইসব বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী-শোষণ, উৎপাদন-উপকরণগুলির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমেও বিভিন্ন দেশে সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বহু পরিবর্তন ঘটলেই ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যাপারটি অপরিবর্তিত থেকে গেছে। আপথেকারের অভিমত অনুসারে: “…despite all the great changes that have marked pre-socialist history for thousands of years, there remained the constancy of the private possession of the means of production.”

এদিক থেকে গুণগত বিচারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল পৃথক প্রকৃতির। এই বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ও সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণকে চিরতরে বিদায় জানান। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ফলে যে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয় তা দাসপ্রথা থেকে সামস্তপ্রথায় বা সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের দ্বারা সাধিত গুণগত পরিবর্তন থেকে অনেক বেশী গভীর ও মৌলিক। সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীন শ্রেণীর মধ্যে নিরন্তর সংগ্রাম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয়। এই বিপ্লবের অন্যতম উদ্দেশ্য হল পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপ সাধন এবং এক নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ও শোষণের সমাপ্তি ঘটে; উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সংঘাত দূরীভূত হয়। তার ফলে ব্যক্তি মানুষের গুণগত যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী পরিবেশ গড়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানাকে দূর করে কিন্তু অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহ এই ধরনের মালিকানার রূপকে সংস্কার করে মাত্র। আপথেকার সমাজতান্ত্রিক ও অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কিত আলোচনার শেষে যা বলেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর দীর্ঘ মন্তব্যটি হল: “Certainly, the basic distinction between socialist and non-socialist revolution, is that imbeded in the impact each has upon the private ownership of the means of production. One eliminates such ownership, the other modifies the kind of such ownership….”

(২) ক্ষমতাচ্যুত শ্রেণীর সঙ্গে আপসের ব্যাপারে পার্থক্য: আগেকার সকল বিপ্লবের পরিণতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর একবার কায়েম হয়ে গেলেও তারপর আপসই ছিল রীতি। পুরাতন শাসকগোষ্ঠী বর্তমানে অধীনস্থ হলেও গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদামণ্ডিত স্থানে অধিষ্ঠিত এবং বিত্তহীনদের মৌলিক বিরোধিতার ক্ষেত্রে যারা সংঘবদ্ধ তাদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আপথেকার বলেছেন: “In such revolutions, compromise was the rule, once the shift in power had been consolidated, and coalitions developed, with the erstwhile rulers now in a subordinate but important and respected position, and united in fundamental opposition to the non-propertied.” বস্তুত ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে আপসমূলক অবস্থানের ব্যাপারে অসুবিধা হয় না।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর কিন্তু ক্ষমতার যে হস্তান্তর ঘটে তাতে কোন আপসের অবকাশ নেই। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর ধনতান্ত্রিক কাঠামোর যাবতীয় ধ্বংসাবশেষকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর কোন রকম কোয়ালিশনের অবকাশ থাকে না।

(৩) শ্রেণী-শোধনের অস্তিত্বের প্রশ্নে পার্থক্য: দাস সমাজ থেকে শুরু করে পুঁজিবাদী সমাজ পর্যন্ত শ্রেণী-শোষণ অব্যাহত থাকে। পুঁজিবাদী সমাজ শ্রেণী-বিরোধকে সরলীকৃত করে এবং বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত—এই দু’টি পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীতে সমাজকে বিভক্ত করে ফেলে। শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজে আর্থনীতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিন্যাস ক্ষমতাসীন শোষকশ্রেণীর উপযোগী হয়।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হল শোষকশ্রেণীর হাত থেকে শোষিত মানুষের স্থায়ী মুক্তিসাধনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রথম বিপ্লব। এই বিপ্লবই হল প্রথম ঐতিহাসিক বিপ্লব যা প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রামের সৃষ্টি করে। এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হল শাসনের হাতিয়ার হিসাবে পরিচিত পূর্বতন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভূমিকার অবসান ঘটানো এবং সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ন্যস্ত করা।

(৪) বিপ্লবীদের সংখ্যাগত পার্থক্য: আগেকার সকল বিপ্লবই ছিল সংখ্যালঘুর স্বার্থে এবং সংখ্যালঘুর দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন। অ-সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবগুলির মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা একটি সংখ্যালঘু শ্রেণীর হাত থেকে আর একটি সংখ্যালঘু শ্রেণীর হাতে যায়। এবং সব সময়ই একটি সংখ্যালঘু শ্রেণীর হাতেই উৎপাদন-উপাদানের মালিকানা থেকে যায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে এবং তাদেরই দ্বারা পরিচালিত এক আত্মসচেতন ও আত্মনির্ভরশীল বিপ্লব। সেজন্য সংখ্যাগত দিক থেকে এই প্রলেতারীয় আন্দোলনই হল প্রথম আন্দোলন যেখানে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষ সংখ্যালঘু শোষকগোষ্ঠীর উচ্ছেদ সাধনের চেষ্টা করে।

(৫) বিপ্লবের উৎস সম্পর্কে পার্থক্য: অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে পুরাতন সমাজের মধ্যেই নতুন সমাজের অস্তিত্ব বর্তমান থাকে। পুরাতন সমাজের মধ্যেই বিকাশমান নতুন ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ক্রমশ এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয় যখন সে পুরাতন ব্যবস্থাকে প্রভুত্বের আসন থেকে হটিয়ে দেয় এবং নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করে। সামন্তবাদের উচ্ছেদের পূর্বেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম থাকে এবং তা সেই মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হয় যেখানে সামন্তবাদকে তা উৎখাত করতে পারে।

কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে মেহনতী মানুষ ও তাদের নেতৃত্বদানকারী প্রলেতারিয়েতের দ্বারা গঠিত দল প্রথমে বুর্জোয়াদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এবং তারপর এই ক্ষমতাকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে প্রয়োগ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিণতিতে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়। এ রকম পরিবর্তন আগেকার কোন বিপ্লবের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি।

(৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতির ক্ষেত্রে পার্থক্য: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব রাষ্ট্রের প্রকৃতির ক্ষেত্রেও মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করে। এই বিপ্লবের পর রাষ্ট্রক্ষমতাকে শোষক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত প্রতি-বিপ্লবী চক্রান্তকে পর্যুদস্ত করার জন্য এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিকে প্রস্তুত ও দৃঢ় করার জন্য প্রয়োগ করা হয়।

(৭) দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বিজ্ঞানসম্মত। এই বিপ্লব উচ্চতর শ্রেণীচেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রগতিশীল উন্নততর সমাজ গঠনের পথে পরিচালিত। পূর্ববর্তী অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়াস অনুপস্থিত।

(৮) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চূড়ান্ত নয়: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পূর্বতন বিপ্লবগুলির মতো নিজেকে চূড়ান্ত বা শেষ বলে মনে করে না। এই বিপ্লব তার পূর্বসূরীদের মত নয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখানে গতিশীলতা এবং পরিবর্তনশীলতা, পরিবর্তনের অতীত এক বিধান হিসাবে সক্রিয় থেকে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়।

(৯) অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর যে শ্রেণী রাজনীতিক ক্ষমতা অধিকার করে তারা সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়; তারা কোন রকম আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী নয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মেহনতী মানুষ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক ও আমূল পরিবর্তনে আত্মনিয়োগ করে।

(১০) শ্রেষ্ঠতাবাদের প্রশ্নে পার্থক্য: অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহ শ্রেষ্ঠতবাদের বিরোধী নয়, বরং শ্রেষ্ঠতাবাদের ভিত্তিতে সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সৃষ্ট সমাজব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠতাবাদকে স্বীকার করা হয় না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কোন ক্ষেত্রেই মুষ্টিমেয় বাছাই করা ব্যক্তির প্রাধান্যকে স্বীকার করে না। এই বিপ্লব সর্বসাধারণের শিক্ষার অধিকারকে স্বীকার করে, প্রগতিশীল গণসংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করে এবং জনগণের সৃজনশীল বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তারফলে মানবজাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানভাণ্ডার একটা সর্বজনীন রূপ লাভ করে।

(১১) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সফল পরিণতিতে গণ-সার্বভৌমত্বের সার্থক প্রতিষ্ঠা ঘটে। প্রাচুর্য ও শান্তির মাধ্যমে জনসাধারণ যথার্থ ও সক্রিয় সার্বভৌমিকতার অধিকারী হয়। মানুষের জ্ঞান ও কৃষ্টিকে সক্রিয়ভাবে সর্বজনীন করা হয়। অপরদিকে অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এ সবের বিরোধী।

(১২) অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী শোষণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য যুদ্ধের আশংকা ও আতঙ্ককে জীইয়ে রাখে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় সব রকম যুদ্ধের বিরোধিতা করা হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে।

(১৩) স্থায়িত্বের প্রশ্নে পার্থক্য: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে সংঘটিত সকল বিপ্লবকে বুর্জোয়া বিপ্লব বলা হয়। এই সমস্ত বিপ্লবের মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যার উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা। এই সীমিত উদ্দেশ্যটুকু পূরণ হয়ে গেলে বুর্জোয়া বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটে। তাই এই বিপ্লব অস্থায়ী প্রকৃতির। মার্কস-এঙ্গেলস্-এর অভিমত অনুসারে অ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অস্থায়ী, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব স্থায়ী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধন, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি এবং বুর্জোয়া শ্রেণীকে নিশ্চিহ্নকরণ। এই লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অব্যাহত থাকে। বস্তুত শ্রেণীহীন, শোষণহীন এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত এই বিপ্লব চলতে থাকবে।

(১৪) আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পার্থক্য: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আর্থনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং অন্য সকল অধিকার ও স্বাধীনতার ভিত্তি হিসাবে আর্থনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল সর্বসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণসাধন ও আর্থনীতিক অভাব-অভিযোগের নিরসন। তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয় এবং অপচয় প্রতিরোধ, বেকার সমস্যার সমাধান ও আর্থনীতিক সংকট নিবারণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পূর্ববর্তী সকল অ-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে এই আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত দেখা যায়।

উন্নততর সমাজ

হার্বটি আপথেকার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এক উন্নততর সমাজব্যবস্থার রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। এই সমাজ হবে উন্নততর এবং সমৃদ্ধশালী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবসঞ্জাত এই উন্নততর সমাজের চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে হার্বার্ট আপথেকার বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

(১) পরিবর্তনশীলতা ও গতিশীলতা: আপথেকারের অভিমত অনুসারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির মত নয়। এই বিপ্লব গড়ে উঠেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে। এ হল এক বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষ্যা (scientific world outlook) । সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করে। এ হবে এমন এক ব্যবস্থা যেখানে পরিবর্তনশীলতা ও গতিশীলতা পরিবর্তনের অতীত নিয়ম হিসাবে কার্যকর থাকবে। আপথেকারের কথায় “Socialist revolution concerns of itself an instituting a system wherein dynamics, change, being an immutable law, continues to function.”

(২) শ্রেণীবৈরিতা ও শ্রেণী-শোষণের ব্যভিচার থেকে মুক্ত: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শ্রেণীবৈরিতা ও শ্রেণী-শোষণের ব্যভিচারমুক্ত এক সমাজের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এই সমাজ হবে আগেকার সকল সমাজের প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত। আপথেকার বলেছেন: “The socialist revolution does lay the groundwork of the appearance of a social order without class antagonisms.” সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত যাবতীয় পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে শ্রেণীবৈরিতার সমাধানই প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একে হটিয়ে দেওয়া হয়। তার জায়গায় প্রকৃতির উপরে পরিপূর্ণ বিজয় অর্জনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। এইভাবে সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ সুনিশ্চিত হয়। আপথেকারের অভিমত অনুসারে ইতিহাসে প্রকৃত মানবযুগ (Human epoch) তখন সৃষ্টি হবে, যখন উৎপাদন-উপাদানের উপর থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটবে এবং একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হবে। এই সমাজে শোষণ-বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণী নেতৃত্ব দেবে। আপৃথেকার বলেছেন: “But the elimination of the private possession of the means of production and the commitment to building of a socialist society, with the working class itself leading the construction of an anti exploitative order, constitute the prerequisite for the development of the truly human epoch of history.”

(৩) শ্রেষ্ঠতাবাদের বিরোধী: সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করে যা শ্রেষ্ঠতাবাদের সকল ধারণার বিরোধী। জাতি, ধর্ম, পেশা প্রভৃতি যারই ভিত্তিতে এই শ্রেষ্ঠতাবাদের সৃষ্টি হোক না কেন এই সমাজ হল নীতিগতভাবে তার বিরোধী। আপথেকার বলেছেন: “The socialist revolution brings into being for the first time, a society opposed in principle to all concepts of elitism…..” যোগ্যতা ও মেধার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতাবাদের এই বিরোধিতা প্রযোজ্য বিবেচিত হয়। শ্রেষ্ঠ জাতিবাদের প্রতিও সমাজতন্ত্র নীতিগতভাবে বিরোধী। সকল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠজাতিবাদকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। শ্রেষ্ঠতাবাদের বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র মানুষের জ্ঞান ও কৃষ্টিকে সর্বজনীন করার ব্যাপারে সতত সক্রিয়। সমাজতন্ত্র মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পসংস্কৃতিকে মুষ্টিমেয় বিত্তবান ও বুদ্ধিজীবীদের একচেটিয়া অধিকারের কবল থেকে মুক্ত করে এবং তার উপর সর্বসাধারণের অধিকার সৃষ্টি করে।

(৪) উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থা: উৎপাদন ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র হল পুঁজিবাদের থেকে উন্নততর। সকল সমাজতান্ত্রিক দেশই আর্থনীতিক ক্ষমতার দ্রুত ও ব্যাপক বিকাশ সাধনের ব্যাপারে সক্রিয় থাকে। পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদনের সামাজিক পদ্ধতি ও ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে দ্বন্দ্ব। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এই দ্বন্দ্ব থাকে না। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রমিক আর্থনীতিক সংকট এবং গণ-বেকারত্ব থাকে না। আপথেকার বলেছেন: “…since under socialism the contradic tions between the socialised means of production and the individualised mode of appropriation characteristic of capitalism has been eliminated, it is a system which is unmarked by periodic economic crises, and above all, by the horror of mass unemployment.” সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বের বিস্তীর্ণ অনগ্রসর অঞ্চলকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করে। এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ধনতান্ত্রিক দেশগুলির উৎপাদনী ক্ষমতার শ্রেষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই অনগ্রসর অঞ্চলগুলিকে বিশেষভাবে উৎপাদনক্ষম অঞ্চলে পরিণত করে।

(৫) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে যুদ্ধকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। এই কারণে পুঁজিবাদ যুদ্ধকে লালন করে। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুদ্ধকে বিশেষভাবে ঘৃণা করা হয়। তাই সমাজতন্ত্র যুদ্ধ-বিরোধী সংগ্রামের সামিল হয়।

(৬) গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন: সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রাচুর্য ও শান্তির ভিত্তিতে জনসাধারণের সক্রিয় সার্বভৌমিকতার সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হয়। শ্রেণী-দ্বন্দহীন একটি সমাজের ভিত্তি রচিত হয়। বস্তুত সমাজতন্ত্র জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য ও জনগণের সরকারের ধারণাকে বাস্তবে কার্যকর করে। আপথেকার বলেছেন: “…with the socialist revolution the fullest implementation of the concept of government by, for, and of the people is made possible.”

(৭) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর্থনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এবং আর্থনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে অন্য সকল অধিকার ও স্বাধীনতার ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করে।