নীতি কবিতা : ধর্ম, দর্শন, অর্থনীত, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে কোনো তত্ত্ব বা জ্ঞানগর্ভ উপদেশ প্রচারের উদ্দেশ্যে যে কাব্য কবিতা রচিত হয় তাকেই বলে নীতি কবিতা। নীতি কবিতায় কবির সাফল্য সেখানেই যেখানে নীতি কবিতা শুধু তত্ত্ব নীরস জ্ঞানকে কল্পনা জারক রসে জারিত করে আপন মনোমাধুরী মিশ্রিত করে পাঠককে আকৃষ্ট করে। যেমন রবীন্দ্রনাথের কণিকার ভক্তিভাজন জুতা আবিস্কার, পুরাতন ভৃত্য, ইত্যাদি কবিতায় নীতি কথাকে কবি আপন কাব্যে শৈলীর মাধুর্যে অপরূপ সুন্দর করে তুলেছেন। এছাড়াও নীতি কবিতার উদাহরণ হিসাবে রজনীকান্ত সেনের ‘অমৃত’ সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মাদক মঙ্গলের নাম উল্লেখ করা যায়।
ব্যঙ্গ কবিতা : Satire শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Satira থেকে। স্যাটায়ার কাব্য কবিতায় উপন্যাস ছোটগল্পে ব্যঙ্গশ্লেষের ধারালো ফলাটি মেলে ধরতে চায় ব্যক্তি বিশেষকে বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করে। ব্যঙ্গের চাবুকে জর্জরিত করে লোকচরিত্র সংশোধন ও সামাজিক অনিয়ম, দূর্নীতির সমালোচনার করাই ব্যঙ্গ কবিতায় মূল উদ্দেশ্য বাংলায় সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত ব্যঙ্গ কবিতা অনেক লেখা হয়েছে। এদের মধ্যে ঈশ্বর গুপ্তের ‘অনাচার’, ‘বিধবা বিবাহ’ ইত্যাদি, রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘সরস মতী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
লিপি কবিতা : পত্রাকারে রচিত যে সমস্ত কবিতা বাংলা সাহিত্যে তাদের আসন পাকা করে নিয়েছে তাদেরই লিপি কবিতা বা পত্রকাব্য বলে। লিপি কবিতার একটি বিশেষ আকৃতির গীতি কবিতা, কবি মনের কল্পনা পত্রাকারে প্রকাশিত হয় এই শ্রেণির কবিতায়। গীতিরস বা নাটকীয়তার ও ঝলক থাকতে পারে এই শ্রেণির কবিতায়। বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লিপি কবিতা ও উদাহরণ হল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গণা কাব্য’। এছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পুরীর চিঠি, রাধারানী দেবীর ‘পরিণীতার পত্র’ লিপি কবিতার বিশিষ্ট উদাহরণ।
ওড বা স্তোত্র কবিতা : প্রাচীন গ্রিসে ওড বা স্তোত্র কবিতার জন্ম। এও এক শ্রেণির গীতি কবিতা। প্রাচীন গ্রিসে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে সংগীত ও নৃত্য সহযোগ যেসব স্তুতিমূলকগান গীত হত, সেগুলির স্তোত্র কবিতার পূর্বপুষ্ট। ওড প্রায়শই এক ধরনের ছন্দোবদ্ধ কবিতা যা কঠিন উদ্দেশ্য করে রচিত। এ জাতীয় কবিতার অনুভূতি, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ শৈলীর মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওড় রচয়িতা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ। তার মহুয়া নামের কবিতাগুলি এ জাতীয় কবিতা। এছাড়াও সোনারতরী কাব্যগ্রন্থের ‘বসুন্ধরা’ ‘সমুদ্রের প্রতি’ ইত্যাদি কবিতা, শ্রেষ্ঠ ওডের উদাহরণ। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে মোহিতলাল মজুমদারের ‘পাথ’ জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এলিজি বা শোক গীতি : শোক কবিতা বা এলিজি হল এমন এক রচনা যে রচনায় কবি ব্যক্তিগত শোকানুভূতি প্রকাশ করে থাকেন। সাধারণত বন্ধু, আত্মীয় বা কোনো নিকটজনের বিয়োগ ব্যথাকে উপলক্ষ্য করে এজাতীয় কবিতা রচিত হয়। ইংরাজি সাহিত্যে অন্যতম এলিজি রচিয়িতা হলেন মিলটন (লিসিডাস), শেলি (অ্যাডানাইস), ব্রাউনিং (লা সেইজিয়াস) প্রভৃতি। প্রিয় বন্ধু আর্থার হ্যালাম এর মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করে লেখা ‘ইন মেমোরিয়াম’ দীর্ঘ এলিজির অন্যতম উদাহরণ। বাংলা সাহিত্যেও এলিজরি অভাব নেই বিহারীলাল চক্রবর্তী, ‘বন্ধু বিয়োগ’, অক্ষয় বড়ালের ‘ত্রা’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পাথরের ফুল’, ইত্যাদি উল্লেখ্য।
ভক্তিমূলক কবিতা : মন্ময় কবিতার অন্তর্গত হল ভক্তিমূলক কবিতা। ধর্মই এই কবিতার মূল উপজীব্য। কিন্তু শুধুই ধর্মের তত্ত্ব সার্থক ভক্তিমূলক কবিতার বিনীত হতে পারে না। বিষয়কে তুচ্ছ করে যখন এ জাতীয় কবিতা অনুভূতির আলোর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখনই সার্থক এ জাতীয় কবিতা । যেমন চর্যাপদের কিছু কিছু পদ ধর্মতত্ত্ব ত্যাগ করে সার্থক কবিতা হয়ে উঠেছে। লালন ফকিরের গান নিছক ধর্মতত্ত্বে আটকা পড়ে থাকেনি, সার্থক কবিতা হয়ে উঠেছে। এছাড়া অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘কোথা তুমি’, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’, রামপ্রসাদের পদাবলী এ জাতীয় কবিতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
জীবনী কাব্য : মহামানব, বা মহাপুরুষ, সাধারণ মানুষ হয়েও হয়ে ওঠেন অসাধারণ, আমাদের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। মৃত্যুর পরেও আমাদের স্মৃতিতে থেকে যান তাঁরা, এমন মহাপুরুষদের জীবন অবলম্বনেই রচিত হয় জীবনীকাব্য । সে কাব্য ঠিক ইংরেজির biography নয়। কারণ biography-র পরীক্ষিত তথ্য সর্বদা জীবনীকাব্যে মেলেনা, বরং মহাপুরুষদের কিছু মানবীয় ও কিছু অতি লৌকিক লীলা কাহিনি নিয়ে রচিত হয় জীবনকাব্য, এদিক থেকে তা Hagiography-র পর্বভুক্ত।
বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবকে নিয়ে কিছু জীবনীকাব্য লেখা হয়েছে। যেমন বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্য ভাবগত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর শ্রী চৈতন্য ভাবগত, লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল ইত্যাদি। এছাড়াও ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের তৃতীয়াংশে মূলত জীবনীকাব্যই রচনা করে ছিলেন।
মহাকাব্য ও সনেট : সনেট হল গীতি কবিতা একটি অন্যতম প্রকরণ, কিন্তু মহাকাব্য হল আখ্যান কাব্যের প্রকরণ, সনেট মূলত ক্ষুদ্র কবিতা। তাতে চৌদ্দ পঙক্তি ও প্রতি পঙক্তিতে চৌদ্দ অক্ষর বা মাত্রা থাকে, কিন্তু মহাকাব্যের বিষয়বস্তু হয়ে বিশাল ও ব্যাপক, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল প্রসারী। এছাড়া সনেট নির্মাণ রীতির বিশিষ্টতার কারণে ভাবের সংযত লক্ষ্য করা যায় কিন্তু মহাকাব্যের এমন কোনো নিয়ম নেই। মহাকাব্যে বিচিত্র ও বিভিন্ন বহু ভাবের সমাবেশ একত্রিত হতে পারে। সনেট ভাষার ঋজুতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মহাকাব্যের ভাষা তুলনায় হয় অনেক গুরুগম্ভীর। ওজস্বিতা থাকে ভাষার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সুতরাং সনেট ও মহাকাব্য দুটিই কবিতার ভিন্ন প্রকরণ হলেও তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য, পরিলক্ষিত হয়।
Leave a comment