সাহিত্য প্রকরণের ভাষায় কবির ব্যক্তিক অনুভূতির সহজ সাবলীল সংগীত মুখর আত্মপ্রকাশই হল গীতি কবিতা। গীতি কবিতার ভাবকে মূর্তি দানের জন্য যখন বিশেষ ধরনের অবয়ব শৃঙ্খলা মানা হয় তখন নির্দিষ্ট প্রকরণ ভিত্তিক সনেট জন্মলাভ করে। গীতি কাব্যে এই বিশেষ শাখায় কবির আবেগকে চোেদ্দ পঙক্তির পরিসরে বেঁধে রাখা হয়। এছাড়াও মিল বিন্যাসের কঠিন শৃঙ্খলা কবিকে মেনে চলতে হয়। বাংলায় এ ধরনের কবিতা চতুদর্শপদী কবিতা নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। তবে মজার বিষয় এই যে এত বন্ধন সত্ত্বেও এর সকল প্রতিবন্ধকতাকে স্বীকার করে নিয়েই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের খ্যাতিমান কবিগণ সনেটের রূপকল্পে এমন অসাধারণ সব কবিতা সৃষ্টি করে গেছেন যা বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ হিসাবে বিবেচ্য হয়ে থাকে।
সনেট শীর্ষক মন্ময় কবিতায় উদ্ভব ইতালিতে। ইতালির কবি পেত্রার্ক-এর জন্মদাতা। ইতালিয় ভাষায় সনেটের প্রতিশব্দ ‘সনেটো’। তবে সনেটের ইতিহাসে ইতালিয় সনেটের মতোই গৌরব লাভ করেছিল ইংরাজী সনেট। ষোড়শ শতাব্দীতে ওয়াট এবং সাদে সর্বপ্রথম ইংরাজী সনেট রচনা করেন। স্তবক ও মিল বিন্যাস নিয়ে ফরাসি সনেটেও এক প্রকরণ হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায় বহুকাল পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে এই ধরনের কবিতার প্রচলন হয়, ‘চতুদর্শপদী কবিতা নামে। ক্রমে সনেট নামটি বাংলায় গৃহীত হতে থাকে।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরাজী সাহিত্যে সনেটের জন্মের পর থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই বিশেষ ধরনের গীতি কবিতা যুগে যুগে ইংরাজী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সিডনি, শেকসপিয়র, কীটস্, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ব্রাউনিং প্রমুখরা সুবিখ্যাত সনেট রচয়িতা হিসাবে বিশ্ব সাহিত্যে আদৃত হয়েছেন। তবে সনেটের প্রবর্তক পেত্রার্কের নামানুসারে প্রেতার্কীয় সনেটের ঘরানাটি সনেটের আদি ঘরানা। একে ধ্রুপদী সনেট নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ইংরাজী সনেটের নব্য ঘরানার সাথে এর কিছু রীতিগত পার্থক্য ও বিরাজমান। পেত্রার্কীয় সনেটে মোট ১৪টি পঙক্তি থাকে আবার এই ১৪টি পঙক্তি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের ৮টি পঙক্তিকে বলা হয় octave বা অষ্টক। আর দ্বিতীয় ভাগের ৬টি পঙক্তি spstet বা যষ্টক নামে অভিহিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অষ্টকের মধ্যে দুটি ভাগ লক্ষ্য করা যায় ১২ পঙক্তি বিশিষ্ট এই বিভাগকে বলে quatrain বা চতুষ্ক। অনুরূপভাবে ষষ্টকের ও দুটি ভাগ দেখা গেলে তাদের বলা হয় Tercet বা ত্রিপদিকা। এছাড়াও পেত্রার্কীয় সনেটে অন্ত্যানুপ্রাস বা চরণান্তিক মিলের ও একটা মোটামুটি নিয়ম ছিল। ইংরাজী সনেটেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা মিলটনের মতো কেউ কেউ পেত্রার্কীয় আদর্শই অনুসরণ করেছেন। তবে শেকসপিয়র রীতি প্রবর্তনার ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। তিনি অনেক ক্ষেত্রে অষ্টক ষষ্টক বিভাগও মেনে চলেননি। তার হাতে স্তবক বিন্যাস নতুন রূপ পায়—৪+৪+৪+২ শেষ অংশটি একটি মিলযুক্ত দ্বিপদী।
অষ্টক ও ষষ্টকের চরকনান্তিক মিল বা অন্ত্যানুপ্রাসের স্থায়ী ধরনটি হল এই রকম— ক খ ক খ বা ক খ খ ক। ষষ্টক যখন দুই তৃষকের বা ত্রিপদীর সমন্বয়ে সেখানে মিলে সাধারণ ধরন-ক খ গ ক খ গ। প্রয়োজনে সনেট রচয়িতা এর ইতর বিশেষ ঘটাতে পারেন।
সনেট ভাব বিস্তারের মধ্যেও বৈচিত্র্য ও রক্ষা করা প্রয়োজন। মূল ভাবের একটি আবর্ত অষ্টকে রূপায়িত করার পর ষষ্টকে ওইভাবেই অন্য এক আবর্তকে ধরতে হয়। অক্ষর ভিত্তিক (১৪ অক্ষর) ও চরণ ভিত্তিক (১৪ চরণ) শৃঙ্খল। এবং বিন্যাসে শৃঙ্খলিত প্যাটার্নের মধ্যে দিয়ে ভাব যখন গমন করে তখন তা এক ভাব পিনদ্ধ মহিমা লাভ করে। গীতি কাব্যের এই ক্লাসিক উপস্থাপনাই সনেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভাবের দিক থেকেও সনেটের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। পেত্রার্কীয় সনেটের আদর্শ বিষয় ছিল প্রেম। তবে পরবর্তীকালে কবিগণ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে সনেট রচনার ক্ষেত্রে যে সতর্কতার প্রয়োজন তা হল ভাবের অখণ্ড গভীরতা ও সংযম।
সূত্রাকারে সনেটের বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করলে এরকম দাঁড়ায়—
(১) সনেট মূলত ১৪ অক্ষর সন্মীল্লিত ১৪ পঙক্তির কবিতা। দেশীয় পয়ার-ই এর আসল ভিত্তিভূমি।
(২) অষ্টক ষষ্টক এই দুই বিভাজন রক্ষা করা হয় কাব্য দেহে।
(৩) এতে একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা থাকে। তবে অষ্টক ষষ্টক আবর্ত ভেদে ভাবের বৈচিত্র্য প্রদর্শন কাব্য।
(৪) সাধারণ গীতি কাব্যের ভাবের গভীরতা ও গাম্ভীর্য রক্ষার বাহন হবে শব্দ ও নির্মিতির সংযম জ্ঞান । কিন্তু ভাব তারল্য সনেটে বর্জনীয়। পরিবর্তে ভাব শৃঙ্খলা ও সংযমের মধ্য দিয়ে আভিজাত্য অর্জনই সনেটের লক্ষ্য। ভাব ও রূপের আদর্শ মেলবন্ধন উন্নত কবিকৃতির কাজ।
সনেটে মূলত ১৪টি পঙক্তি থাকা আবশ্যক বটেই। তবে আধুনিক বাংলা সনেটেও অনেক ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসৃত হয় না। এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ পঙক্তির সনেটও লক্ষ্য করা যায়।
সনেটের আলোচনা প্রসঙ্গে পেত্রার্কের কথা যেমন বিস্মৃত হওয়া যায় না তেমনই দাস্তে ও ট্যাসোর কথাও পৃথকভাবে উল্লেখযোগ্য। সনেটের জন্মদাতা পেত্রাক হলেও ইতালিয় সনেটের ক্ষেত্রে এই দুই ইতালিয় কবির অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর প্রবর্তক হলেও বাংলা সনেটের শ্রেষ্ঠ শিল্পী নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ সনেটগুলির সন্ধান মিলবে ‘চৈতালী’ এবং ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে। মধুসূদনের অসামান্য সনেটগুলি বাংলা সাহিত্যে সার্থক সনেটের আদর্শ স্বরূপ। আর রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঠিক বিপরীত ভূমিকায়। সনেট নিয়ে তিনি বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। মিশ্র কলাবৃত্ত রীতিতে সনেট রচনা প্রচলিত রীতির পরিবর্তে দলবৃত্ত রীতিতেও সনেট রচনা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সনেট পেত্রার্কীয় এবং শেকসপিয়রীয় উভয় রীতিরই যেমন সম্বন্বয় রয়েছে তেমনই আবার পূরবী কাব্যগ্রন্থে কিছু ১৮ অক্ষরের সনেটের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে তার হাতেই সনেট উপভোগ্য উৎকর্ষ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের আগে অক্ষয়কুমার বড়ালের সনেট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আর রবীন্দ্রত্তোর যুগে যারা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখরা।
Leave a comment