প্রশ্নঃ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, সংস্কৃতির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালী সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ কলে।

সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যঃ সংস্কৃতির সংজ্ঞার মধ্য দিয়েই এর বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। নিম্নে সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) সংস্কৃতি শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত হয়ঃ সংস্কৃতি জৈবিক বংশগতির মাধ্যমে আসে না বরং সমাজ থেকে এটি শিখতে হয়। এটি আজন্ম প্রবণতা নয়। সহজাত সংস্কৃতি বলতে কিছু নেই। সংস্কৃতিকে প্রায়ই বলা হয়- “আচরণ শিক্ষার দিক বা পথ।” সহজাত আচরণ হলাে চোখ বন্ধ করে ঘুমানাে, কিন্তু সংসকঋতি হলাে মানুষের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে বা পরিস্থিতি মােকাবিলা করার যােগ্যতা।

(২) সংস্কৃতি মুলত সামাজিকঃ সংস্কৃতি বিচ্ছিন্নভাবে অস্তিত্বশীল নয় বা বিরাজমান নয়। সংস্কৃতি সমাজের উৎপাদন। কোনােভাবেই তা ব্যক্তির তৈরি বিষয় নয়। এটি সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক। অন্যান্য মানুষের সঙ্গ ছাড়া কোনাে ব্যক্তি বা মানুষ সংস্কৃতি অর্জন করতে পারে না। মানুষের মধ্যে থেকেই মানুষ কেবলমাত্র মানুষ হতে পারে। একটি মানবিক পরিবেশেই সংস্কৃতির সাহায্যে মানুষ মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারে।

(৩) সংস্কৃতির অংশীদারিত্বতাঃ সমাজতাত্ত্বিক ধারণায় সংস্কৃতি অবশ্যই অংশিদারিত্বমূলক। এটি এমন কোনাে বিষয় নয় ব্যক্তি একাই অর্জন করতে পারে। যেমনঃ প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ধারণা ও নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলাে সমাজ বা গােষ্ঠির সদস্যদের মধ্যে অংশিদারিত্বমূলক। বিজ্ঞানের আবিষ্কার, যেমনঃ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, ডারউইনের বিবর্তনবাদ, কালিদাস, কান্তে বা কিটসের সাহিত্যকর্ম, হেগেল-কান্টের দর্শন কর্ম, সুলতানের বা লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির শিল্পকর্ম ইত্যাদি সবই হলাে একটা ব্যাপকসংখ্যক মানুষের সাথে বিনিময়যােগ্য, সবাই এসব থেকে শিখতে চায়।

(৪) সংস্কৃতি হস্তান্তরিত হতে পারেঃ সংস্কৃতি এক প্রজন্ম হতে আর এক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হওয়ার যােগ্য। মাতাপিতা সন্তানদেরকে সংস্কৃতি শেখায় এবং তারা আবার তাদের সন্তানদেরকে শেখায়। ঠিক এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মে সংস্কৃতি বিনিময় হতে থাকে। সংস্কৃতি বংশের মাধ্যমে নয় বরং তা ভাষার মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়। ফলে ভাষা হলাে সংস্কৃতির প্রধান বাহক। ভাষা নানাভাবে এক প্রজন্মের অর্জনকে আর এক প্রজন্মের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। ভাষা শুধুমাত্র বাহক নয় বরং এটি নিজেই সংস্কৃতির অংশ। ভাষা অর্জন মানুষের কাছে বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছিল। সুতরাং, সংস্কৃতির বিনিময় অনুকরণ ও নির্দেশনার মাধ্যমে একটা স্থান তৈরি করে।

(৫) সংস্কৃতি একটি চলমান ও ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়াঃ সংস্কৃতি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিরাজমান থাকে। এর ঐতিহাসিক প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান ধারায় চলেছে। সংস্কৃতি হলাে একটি ক্রমপ্রবৃদ্ধি যা এর নিজেকে যুক্তকরে এবং অতীত ও বর্তমানের অর্জনের সাথে এবং ভবিষ্যতে মানবজাতি যাতে আরাে অর্জন করতে পারে তার জন্য সুযােগ তৈরি করে দেয়। ফলে। লিন্টন (Linton) নামক সমাজবিজ্ঞানী একে মানবজাতির সামাজিক উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

(৬) সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ও সুসংহতঃ সংস্কৃতি তার নিজস্ব উন্নয়নে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করেছে। একই সাথে সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে আন্তঃসম্পর্কীয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সমাজের মূল্যবােধ ব্যবস্থা এর অন্যান্য দিক যেমনঃ নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা, ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

(৭) সংস্কৃতি মানুষের দিক নির্দেশনার প্রতীকঃ আমাদের জৈবিক ও সামাজিক সকল চাহিদা ও আশাপূরণে সংস্কৃতি সঠিক সুযােগ-সুবিধা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেমনঃ আমাদের প্রয়ােজন হলাে খাদ্যের, বস্ত্রের, আশ্রয়ের এবং অপরদিকে, আমাদের আশা হলাে মর্যদার, নামের, খ্যাতির ও অর্থের।

(৮) সংস্কৃতি মূলত গতিশীল ও অভিযােজিত প্রক্রিয়াঃ সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল তবে সম্পূর্ণরূপে স্থির নয়। প্রবৃদ্ধি ও পরিবর্তন সংস্কৃতির মধ্যে চলমান। যদি বৈদিক যুগের সংস্কৃতির সাথে আজকের ভারতের তুলনা করা হয়, তাহলে বিস্ময়কর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, বাহ্যিক পৃথিবীর পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে সংস্কৃতি অভিযােজিত।

(৯) সংস্কৃতির ভিন্নতাঃ প্রত্যেক সমাজেরও নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এটি এক সমাজ হতে আরেক সমাজে পৃথক। প্রত্যেক সমাজের সংস্কৃতিই তার নিজের হতে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ সংস্কৃতি একক নয়। যেমনঃ সংস্কৃতিক উপাদান, প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আদর্শ, নৈতিকতা, অভ্যাস ও রীতিনীতি ইত্যাদি প্রত্যেক জায়গায় একইরকম নয়। কোনাে সংস্কৃতিই স্থির বা পরিবর্তনহীন নয়।

(১০) অতিজৈবিক ও ধারণাগতঃ সংস্কৃতিকে মাঝে মাঝে অতিজৈবিক বলে অভিহিত করা হয়। ‘Super-organic’ দ্বারা Herbert Spencer বুঝাতে চেয়েছেন যে, “সংস্কৃতি জৈবও না, অজৈবও না বরং এ দ’টির ঊর্ধ্বে।” ‘Supersonic’ বা অতিজৈব শব্দটি বাহ্যিক বস্তু বা বাহ্যিক ক্রিয়া ও সামাজিক অর্থ দাঁড় করিয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, মানুষের জীবনপ্রণালির সমন্বয়ে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যুগ-যুগান্তরের মানুষের সমষ্টির সমষ্টিগুলােই হলাে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, প্রেম ও ভালবাসার মধ্যদিয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যােগায়। সংস্কৃতি মানুষকে মহিমান্বিত করে এবং তার আত্মপরিচয় ফুটিয়ে তােলে।