[1] আইন ও শাসন বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল সরকার গঠন করে। এজন্য শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে একটা সুসংহত ঐক্য বজায় থাকে। ফলে সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সুষ্ঠু পরিবেশ রচিত হয়। শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগের মধ্যে কোনাে বিরােধ না থাকায় সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার আশঙ্কা দেখা যায় না।
[2] গণতন্ত্রসম্মত: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রীপরিষদ হল দেশের শাসন বিভাগের প্রকৃত কর্ণধার। মন্ত্রীপরিষদ তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এই কারণে মন্ত্রীপরিষদের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার কোনাে সুযােগ থাকে না। মন্ত্রীপরিষদ জনস্বার্থবিরােধী কোনাে পদক্ষেপ নিলে আইনসভায় বিরােধী পক্ষের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে। প্রয়ােজন হলে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে মন্ত্রীপরিষদকে পদচ্যুত করার ক্ষমতাও আইনসভার রয়েছে।
[3] নমনীয়তা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান গুণ হল, এটি এমন একটি নমনীয় শাসনব্যবস্থা যেখানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে প্রশাসন বা সরকারের প্রয়ােজনমাফিক রদবদলের সুযােগ রয়েছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন অনেক বেশি সহজসাধ্য।
[4] রাজনৈতিক শিক্ষাবিস্তার: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারি নীতি, সরকারি কার্যক্রম এবং মুলতবি প্রস্তাব ও দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আইনসভায় যেসব আলােচনা হয় তা গণমাধ্যম মারফত প্রচারিত হওয়ায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
[5] আন্তর্জাতিক সুনাম: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে নিয়ােগ করা সম্ভব হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণ কিংবা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালামের নিয়ােগের কথা বলা যায়।
[6] প্রশাসনিক স্বচ্ছতা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের পক্ষে কোনাে সিদ্ধান্ত আইনসভাকে না জানিয়ে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আইনসভায় সবিস্তারে আলােচিত হওয়ার পর বাস্তবে রূপায়িত হয়। এর ফলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় থাকে বলে অনেকে মনে করেন।
[7] বিরােধী দলের মর্যাদা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি প্রধান গুন হল, এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় বিরােধী পক্ষের মর্যাদা ও গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে। আইনসভায় বিরােধী দলনেতা এখানে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত হন। তা ছাড়া আইনসভার অধিবেশনে সরকারের যাবতীয় নীতি ও কর্মসূচির ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে অবাধ সমালােচনা করার অধিকার বিরােধী পক্ষের থাকে। এর ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র অধিকতর জনমুখী ও সাফল্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে।
সংসদীয় সরকারও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থার উল্লেখযােগ্য ত্রুটিগুলি হলㅡ
[1] ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের অনুপস্থিতি: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সমালােচনায় প্রথমেই বলা যায়, এখানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ না থাকায় মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা একই সঙ্গে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করায় সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনার জন্য তাঁরা যথােপযুক্ত সময় পান না। ফলে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সুশাসনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
[2] স্থিতিশীলতায় অন্তরায়: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনশীলতা বা নমনীয়তা একটি দুর্বলতা। স্থিতিশীল ও সুদৃঢ় সরকার প্রতিষ্ঠা এক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
[3] আমলাতান্ত্রিকতা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা ও বিশেষীকৃত দক্ষতার প্রয়ােজন, অধিকাংশ মন্ত্রীদের তা থাকে না। এর ফলে মন্ত্রীদের আমলানির্ভর হতে হয়। এই কারণে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়।
[4] দলীয় সংকীর্ণতা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হল রাজনৈতিক দলব্যবস্থা। সংকীর্ণ দলাদলি, দলীয় স্বার্থসাধন, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের প্রতিযােগিতা, নির্বাচনি দুর্নীতি প্রভৃতি সংসদীয় শাসনব্যবস্থার দক্ষতাকে খর্ব করে। লর্ড ব্রাইস সংসদীয় সরকারের প্রধান ত্রুটি হিসেবে সংকীর্ণ দলীয় মনােভাব এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার কথা বলেছেন।
[5] বহুদলীয় ব্যবস্থার কুফল: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় বহু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের জন্য অনেক সময়ে কোনাে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। ফলে একাধিক দলের সমন্বয়ে জোট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু শরিক দলগুলির অন্তর্বিরােধে মন্ত্রীপরিষদ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তা স্বভাবতই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
[6] নয়া স্বৈরাচারের উদ্ভব: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ওপর মন্ত্রীপরিষদের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে বিস্তারিত হয়। এইভাবে মন্ত্রীসভা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। তা ছাড়া জাতীয় সংকট ও জরুরি অবস্থার সময় মন্ত্রীসভা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ে। এইসব কারণে অনেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে ‘নয়া স্বৈরাচার বা New Despotism বলে থাকেন।
[7] অযােগ্যদের প্রাধান্য: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় যেসব প্রতিনিধি আইনসভায় সদস্যপদ লাভ করেন, তাঁরা গুণগত যােগ্যতার নিরিখে নির্বাচিত হন না। বহু অযােগ্য ব্যক্তি দলীয় মনােনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন। ফলে আইনসভার গুণগত মান হ্রাস পায়, শাসনব্যবস্থায় অযােগ্যদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
[8] জরুরি অবস্থার অনুপযােগী: সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে জরুরি অবস্থার অনুপযােগী বলে মনে করা হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গােলযােগের পরিস্থিতিতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
উপসংহার: উল্লিখিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, সব ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাই অধিকতর গ্রহণযােগ্য। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলে মন্ত্রীপরিষদ বা আমলাতন্ত্র কখনও স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না।
Leave a comment