অথবা, সংবিধানের উপকারিতা বর্ণনা কর।
অথবা, সংবিধানের আবশ্যকতা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ “Constitution is that body of rules which regulates the ends for which the powers of the government is exercised.” [K. C. Wheare, The Statute of Westminister, P. 12] সংবিধান হলাে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি এবং একটি দেশের মেরুদণ্ডস্বরূপ। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সংবিধান হলাে রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা। সংবিধানের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্রই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। সংবিধান হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যা অন্যান্য আইন এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। প্রতিটি স্বাধীন দেশের জন্য সংবিধান অত্যাবশ্যক। আর উত্তম সংবিধানের মাধ্যমেই জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণীত হয়। এরিস্টটলের মতে, “রাষ্ট্র কর্তৃক পছন্দকৃত জীবনপ্রণালীই সংবিধান।” (The way of life the state has chosen for itself.) [W. Ebenstein, Great Political Thinkers (New Delhi; Oxford and IBH Publishing Co. 1966), P-103]
সংবিধানের গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা বা উপকারিতাঃ একটি উত্তম ও কার্যকরী সংবিধান যে কোন রাষ্ট্রের অতি মূল্যবান সম্পদ। সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। সংবিধানের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা বণ্টন এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। নিম্নে রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা বা উপকারিতা বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হলাে-
১. দেশের মৌলিক পরিচয়ঃ প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে তার নিজ দেশের পরিচয় জানা। এমতাবস্থায় সংবিধান এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় সীমানার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ও প্রতীক, ধর্মীয় অধিকার, রাষ্ট্রীয় ভাষা, নাগরিকত্ব জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন, জাতীয় সংস্কৃতি প্রভৃতি মৌলিক বিষয় কিরূপ হবে সে সম্পর্কে সংবিধান ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
২. জাতীয় আদর্শ ও চেতনা লাভঃ সংবিধানে কোন জাতির মৌলিক আদর্শ, লক্ষ্য ও ধ্যানধারণা স্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকে। এসব মূল্যবোেধ সংবিধানে এজন্যই লিপিবদ্ধ করা হয় যেন একটি জাতি নিজেকে অন্যান্য জাতি থেকে আলাদা পরিচয়ে চিনতে পারে, যা তাকে দেশের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে। ফলে জাতীয়তাবােধ সৃষ্টিতে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
৩. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণঃ সংবিধানে সেদেশের জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা থাকে। এমনকি অধিকারসমূহ কিভাবে সংরক্ষণ করা যাবে তার দিক নির্দেশনাও থাকে। আর সংবিধান, অধ্যয়ন করলে নাগরিকগণ তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। সরকার ব্যক্তির এরূপ কোন অধিকার ক্ষুন্ন করতে চাইলে সে আদালতের সাহায্য চাইতে পারে। ফলে সরকার সেসব অধিকার লঙ্ঘনের সাহস পায় না।
৪. স্বৈরাচার রােধঃ অনেক সময় কোন কোন সরকার তার নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য স্বৈরশাসকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে সংবিধান সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধার সৃষ্টি করে। কেননা সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ ও মৌলিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়, ফলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে সরকারের পক্ষে কোন স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না।
৫. জরুরি বিধানাবলিঃ রাষ্ট্র সংকটকালীন সময়ে উপনীত হলে কিভাবে পরিচালিত হবে, যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের কর্তব্য কি, কোন আইন বলবৎ থাকবে, নাগরিকদের কি কি অধিকার খর্ব বা রহিত করা হবে, মােটামুটি একটি নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া থাকে। অতএব এ সম্পর্কে ধারণা সংবিধান পাঠে নাগরিকরা জানতে পারে।
৬. সংবিধানের মর্যাদা উপলব্ধিঃ সাধারণ আইন থেকে সাংবিধানিক আইনের যে আলাদা মর্যাদা সংবিধান সংশােধন পদ্ধতির আলােকে তা উপলব্ধি করা যায়। সংবিধানে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে পার্থক্য করা হয় এবং এ ধরনের আইনের মধ্যে সাংবিধানিক আইন অধিকতর মর্যাদাযুক্ত বলে গণ্য করা হয়। এ কারণে সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যবােধের সৃষ্টি হয়।
৭. সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভঃ দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা গ্রহণীয় হবে তা সংবিধানেই লিপিবদ্ধ করা হয়। কোন বিশেষ পন্থায় দেশের সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে সে সম্পর্কেও সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। যেমন- বাংলাদেশ, ভারত ও ব্রিটেনের সরকার ব্যবস্থা পার্লামেন্ট শাসিত, প্রয়ােজনে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সময়ােপযােগী সরকার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর সরকার ব্যবস্থা কোন নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হবে, ভােটাধিকার ব্যবস্থা কেমন হবে, আইনসভার সদস্যদের যােগ্যতা কি হবে প্রভৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশ সংবিধানেই দেয়া থাকে।
৮. পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনাঃ দেশের সাথে অন্য দেশের সম্পর্ক কিরূপ হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও চুক্তি কোন নীতিতে পরিচালিত হবে তার একটি দিকনির্দেশনা সংবিধানে উল্লেখ থাকে। এক দেশ যাতে অন্য দেশকে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ বা আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য আন্তর্জাতিক সংবিধান আছে। উদাহরণ হিসেবে জাতিসংঘ সনদের কথা বলা যায়।
৯. সুষ্ঠু প্রশাসনঃ যে কোন দেশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। আর সংবিধান সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য ক্ষমতা বণ্টন, দায়িত্ব পালন, তত্ত্বাবধান, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া থাকে। কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ কিংবা লঘন করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে। তাই সুষ্ঠু প্রশাসনের মাধ্যমে সুষ্ঠু দেশ পরিচালনায় সংবিধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০. শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণয়ঃ উত্তম সংবিধানের মাধ্যমেই জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণীত হয়। শাসন ও শাসিতের দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুনির্দিষ্ট বিধান সংবিধানে উল্লেখ থাকে। তাই এর মাধ্যমেই শাসন ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়।
১১. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভঃ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কি হবে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ এখতিয়ার কতটুকু হবে সে ব্যাপারে সংবিধানে নির্দেশ করা থাকে। দেশ তার প্রয়ােজনে কি ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ নাকি মিশ্র অর্থনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ থাকে। ফলে দেশের অর্থনীতি সে অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সুতরাং নাগরিকগণ সংবিধানের মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
১২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাঃ প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। কেননা জাতীয় উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন অস্থিতিশীল না হতে পারে সেজন্য সংবিধানে বিভিন্ন আইনকানুন ও নিয়মনীতি লিপিবদ্ধ থাকে। অতএব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যও সংবিধান অপরিহার্য।
উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংবিধান হলাে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। সংবিধান ভিন্ন কোন রাষ্ট্র বা সংগঠনই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে। সংবিধানের মাধ্যমেই কোন দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষিত হয় এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হয়। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও বিভিন্ন নিয়মকানুনসমূহ সন্নিবেশিত থাকে। ফলে নাগরিকগণ তাদের অধিকার ও দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে। অতএব একটি সর্বসম্মত মৌলিক নীতিমালা তথা সংবিধান প্রণয়নের বিকল্প নেই।
Leave a comment