উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নায়িকা রাধিকা। এ চরিত্রটি কবি বড়ু চণ্ডীদাস যত্নসহকারে কাব্যে অঙ্কন করেছেন। কাব্যের কাহিনি অগ্রসর হয়েছে মূলত রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই এই তিনটি চরিত্রকে নিয়ে। রাধা এ কাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র। সমালোচকের মতে রাধা চরিত্রের বিকাশে ও পরিণতিতে কবি যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা অনন্য সাধারণ। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের প্রথমে তাম্বুলখণ্ডে যে এগারো বছরের রাধার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে, সে নারী তখনো সংসার অনভিজ্ঞ রূঢ় সত্যভাষিণী, অল্প বয়সী, অশিক্ষিত গোপ বালিকা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে শ্রীমতী রাধিকার এগারো বছর বয়স থেকে তেরো বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের মানসিক ও দৈহিক বেড়ে ওঠার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ‘বংশীখণ্ডে’ রাধা চুরি করেছে কৃষ্ণের বাঁশি। এই খণ্ডে রাধা চিত্রিত হয়েছে চঞ্চলা, চপলা এক বালিকা হিসেবে। বংশীখণ্ডে রাধার হৃদয় তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে কৃষ্ণের সান্নিধ্য পাবার জন্য। বংশীখণ্ডের রাধা সম্পর্কে সমালোচকের মন্ত ব্য নিম্নরূপ:

“নির্জন বনভূমির পথের অন্তরালে নাম না জানা শুভ্র বনফুলের মতো এ কাব্যকুঞ্জের স্থানে স্থানে এমন শিশিরস্নাত নির্মল শুভ্র যুথিকা ফুটে উঠেছে যা সমগ্র কাব্যখানিকে এক অপূর্ব স্বর্গীয় সৌরভে বিমণ্ডিত করে তুলেছে এবং রাধা চরিত্রও এখানে পদাবলীর রাধার মতোই আকুলা নিবেদিতা।”

বংশীখণ্ডে’ রাধার দেহমন জেগে উঠেছে। দুরন্ত কিশোরী প্রেমানুভূতি অনুভব করেছে। বাঁশির সুরে তার দেহমন আকুল হয়েছে। হৃদয় উতল হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাতের জন্য। কৃষ্ণের প্রতি এখন রাধার মনে আর আগের মতো ঘৃণা বা বীতশ্রদ্ধা নেই। কৃষ্ণের প্রতি বৈরিতার পরিবর্তে তার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য রাধা এখন ব্যাকুল। কৃষ্ণের বাঁশীর সুর তাই রাধাকে অস্থির করে তোলে, সে ছুটে যেত বংশীবাদক কৃষ্ণের কাছে:

“কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।

কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে॥

আকুল শরীর মোর বে আকুল মন।

বাঁশীর শবদে মোর আওলাইলো রান্ধন ॥”

বাঙালির জীবন ও সমাজের সুন্দর চিত্র রয়েছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘বংশীখণ্ডে’। রাধার রান্নার বর্ণনা থেকে বাঙালির দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাত ছাড়াও শাক ভাজা, মাছের ঝোল, অম্বল ছিল বাঙালির দৈনন্দিন আহার্য। নিমপাতা, পটল, ঘি, লেবু প্রভৃতি উপকরণের কথাও রাধার রান্নার বিবরণ থেকে পাওয়া যায়:

“অম্বল ব্যঞ্জনে মো বেশোআর দিলোঁ।

সাকে দিলোঁ কানাসোআঁ পাণী।”

কৃষ্ণপ্রেমে পুড়ে পুড়ে রাধার অন্তরের মলিনতা দূর হয়েছে। জগৎসংসারের সবকিছু ভুলে গিয়ে এখন রাধিকা তার দেহমন সমর্পণ করেছে কৃষ্ণের কাছে। যে রাধিকা এতদিন কৃষ্ণের প্রতি ছিল বিরক্ত, বংশীখণ্ডে সেই রাধাই কৃষ্ণের প্রেমে আত্মহারা। কৃষ্ণকে দেখার জন্য ছল করে রাধা যমুনার তীরে জল আনতে যায়:

“সুণহ সুন্দরী রাধা বচন আহ্মার।

যমুনাক যাই ছলে জল আনিবার ॥

তোহ্মার বচনে যমুনাক আহ্মে জাইব।

তথা গেলে কেমনে কাহ্নাঞির লাগ পাইব ॥”

কৃষ্ণের বাঁশী তার নিত্যসঙ্গী।’ বাঁশী ছাড়া কৃষ্ণ একদণ্ড থাকতে পারে না। কারণ এই বাঁশীর সুরই তাকে রাধার সান্নিধ্য এনে দেয়। তাই বাঁশী চুরির পর কৃষ্ণ তার বাঁশী ফিরে পেতে অস্থির হয়ে ওঠে। নিম্নোক্ত পঙ্ক্তিতে সেই চিত্র রয়েছে:

“পরাণ বড়ায়ি তোক্ষে বোলহ রাধারে।

বাঁশী দিআঁ জীআউক মোরে॥

যত কিছু করিলোঁ মোওঁ রাধার আতোষে।

তোর ফল পাইলোঁ নিজ দোষে ॥”

বংশীখণ্ডে রাধা-কৃষ্ণ-বড়ায়ি চরিত্রের কথোপকথন বা সংলাপের মধ্য দিয়ে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। এখানে এসে কাহিনি মানবীয় প্রেমচেতনায় এক অনন্ত অভিসারের পথে ধাবিত হয়েছে। বাঙালির সমাজচিত্র অতিসুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ‘বংশী খণ্ডে’। গ্রামবাংলার আবহমান চিত্র সাবলীল হয়ে ফুটে উঠেছে এই খণ্ডে।