অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা লৌকিক আর বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা পরমাত্মার প্রতীক – আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও

উত্তর: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক নান্দনিক সৃষ্টিসম্ভার। এ সাহিত্যদ্বয়ের রস আস্বাদনে পাঠক বিমোহিত। রাধা চরিত্রই এ সাহিত্যদ্বয়কে দান করেছে অনন্যতা। কিন্তু উভয় সাহিত্য দর্শনে আমরা রাধা চরিত্রের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধার প্রেম অশ্লীলতায় ভরা। সে মানবিক গুণে গুণান্বিত। লৌকিক প্রেমের আদর্শে তার জীবন প্রবাহিত। এগারো বছরের বালিকা, আইহনের স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদের পরিবেষ্টিত রাধা সমাজসংস্কারের ভয়ে ভীত। কিন্তু আমরা অতি দ্রুতই তার এই চরিত্রের পরিবর্তন দেখতে পাই। শীঘ্রই সে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদ হয়ে উঠে। কৃষ্ণ ব্যতীত সে জীবন-যৌবনকে অসাড় মনে করে। শয়নে-স্বপ্নে সবসময়ে সে কৃষ্ণ নাম জপ করে। কৃষ্ণ মিলনের জন্য তার চিত্ত অধীর হয়ে উঠে। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা বিরহ বেদনায় ব্যাকুলা।

বৈষ্ণব পদাবলীতে এ রাধাকে শোকাকুলা অবস্থায় পাই। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা জীবাত্মার প্রতীক। এখানে কৃষ্ণের সাথে তার প্রেম স্বর্গীয়। তার প্রেম কামগন্ধহীন দেবী প্রেম। পদাবলির প্রথম থেকেই রাধা কৃষ্ণপ্রাণগতা। কৃষ্ণধ্যানে সে তার আত্মবিস্মৃত। বৈষ্ণব কবিদের মতে-মর্ত্যের মানবিক প্রেম শুদ্ধ প্রেম নয় তা কাম ও দেহবুদ্ধিযুক্ত। তাতে স্বার্থহীনতার ভাবটিও দেখতে পাওয়া যায়।

এজন্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনি বৈষ্ণব সাধনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। উভয় সাহিত্যে রাধা ব্যক্তি হিসেবে একই হলেও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় ভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা মানবলীলা এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা দেবলীলায় উপজীব্য। বৈষ্ণব রাধার মুখে প্রথম থেকেই কৃষ্ণ গান। যোগমগ্না তন্ময়। আহারে বিহারে অমনোযোগী। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা প্রথমে অভিমান শেষে মিলনের অস্থিরতার এক কামলোলুপ আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং মধ্যযুগের এ রস আস্বাদিত সাহিত্যদ্বয়ের আলোচনার পরিশেষে এসে একথাই বলতে পারি যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা চরিত্রের সমাপ্তি যেখানে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার আরম্ভ সেখান থেকেই।