অথবা, বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার পরিচয় দাও
উত্তর: আদি মধ্যযুগের বাংলার একমাত্র নিদর্শন বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। চর্যাপদের পর ভাষাগত পরিণতির সার্থকরূপ এ কাব্যেই দেখতে পাওয়া যায়। চর্যাপদের ভাষায় প্রাদেশিকতার উন্মেষ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা রীতিমতো বিশেষভাবে প্রাদেশিক রূপ গ্রহণ করেছে। এ ভাষা যে বাংলা তা আমাদের কষ্ট করে প্রমাণ করতে হয় না। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের বাংলা ভাষার খাঁটিরূপ এতে রক্ষিত আছে।
নবজাত বাংলা ভাষা বড়ু চণ্ডীদাসের মতো শক্তিশালী কবির হাতে অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত হয়েছে। কবি সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন; তাই কাব্যের প্রতিটি পদের আরম্ভে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। বাংলা ভাষার বিশিষ্ট বাগভঙ্গি এবং রচনাশৈলী এতে আপন স্বভাবে ভাস্বর। নিচে এর ভাষাতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো:
ক. ধ্বনিতত্ত্বগত:
- ১. প্রাকৃত অপভ্রংশ প্রভাবিত আনুনাসিক উচ্চারণ এবং বানানে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে খুব বেশি হয়েছে। যেমন- কাহ্নঞি, আহ্মি, তোহ্মা, হআঁ, কথাহোঁ, কভোঁহি, এঁবে, বন্দিআঁ, তেজিঞাঁ, পরিআঁ মোঁ ইত্যাদি।
- ২. ই-কার উ-কারে পরিণত হয়েছে। যেমন- দুচারিণী = দ্বিচারিণী
- ৩. উচ্চারণে ই-কার এবং ঈ-কারের পার্থক্য রক্ষিত হয়নি। যেমন- ই > ঈ = তীন, অনুমতী, অসম্মতী। ঈ > ই = সিতল, সিতা, সিশের।
- ৪. আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাতের দরুন অ-কার ‘আ’-কারে পরিণত হয়েছে। যেমন- আতিশয়, আবল, আভাগী, আসুখ ইত্যাদি।
- ৫. পাশাপাশি দুই স্বরধ্বনির এক যুগ্মস্বরে সংশ্লিষ্ট উচ্চারণ বাংলা বাক্রীতির প্রভাব সূচিত করে। বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইল রান্ধন (বংশী, ২) কাহ্নাঞিক বুইল বড়ায়ি মধুরে বচন (বিরহ, ৫০)
- ৬. বিপ্রকর্ষ, স্বরসঙ্গতি, যুক্তবর্ণের একটি লোপ, স্বতো মুধন্যী ভবন ইত্যাদি আরও নানা ধ্বনিগত পরিবর্তক লক্ষিত হয়। যেমন-
বিপ্রকর্ষ – আরতি = আর্তি, বে আকুল = ব্যাকুল
বর্ণবিপর্যয় – দহ < হৃদ, পুহাইল = পঢ়াইসো,
স্বরসঙ্গতি – সোআদ (স্বাদ), রসন (রসনা),
যুক্ত ব্যঞ্জনের একটির লোপ – মাঝ <মধ্য, খাটো
আল <খট্টপাল, আঠ < অষ্ট ইত্যাদি।
স্বতোমুধন্যীভবন – ডাহিন < দক্ষিণ।
খ. রূপতত্ত্বগত:
- ১. যে যুগের ভাষায় ঈ-কারান্ত স্ত্রীলিঙ্গের রূপ যথেষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- বিশেষ পদে – এগার বৎসরের বালী। বিশেষণে স্ত্রী প্রত্যয়ের প্রয়োগ- বে আকুল, গোআলিনী, ক্রিয়াপদে – রাধা বিরহে বিকলী।
- ২. সংস্কৃতে দ্বিবচন আছে। প্রাকৃত অপভ্রংশ এবং বাংলায় দ্বিবচনের প্রয়োগ না থাকলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সংস্কৃতের দ্বিবচন রূপ লক্ষিত হয়। যেমন- পতী, মুনী, হরী প্রভৃতি শব্দ।
- ৩. কারক ও বিভক্তির কিছু উদাহরণ:
কর্তায় ‘শূন্য’ বিভক্তি – ভ্রমর না পাএ রথে।
কর্তায় ‘এ’ বিভক্তি – গাইল চণ্ডীদাসে।
কর্মে ‘ক’ বিভক্তি – বচনেক দেহ। পুতনাক নিয়োজিল।
অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তি – বাটত সৃজিআঁ। সেজাত সুতি আঁ।
করণে এ বা এঁ বিভক্তি -নেত্রা এঁ, মামাএ।
অপাদানে ‘তে’ বিভক্তি- আজি হৈতে। জলতে উঠিলা রাহী।
- ৪. অনুসর্গের ব্যবহার শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাওয়া যায়। যেমন-
এ ধন বসতী সব তেজিবাক পারী। (বিরহ, ৬৯)
লাজে পিঠ দিআঁ মো বহিলোঁ দধিভার। (বিরহ, ৩৫)
মিছা কোহ্নে আহ্মারে দোষমি। (বংশী, ২৫)
কাহ্ন সমে সাধিতে না পায়িলোঁ রতীসিধী। (বিরহ, ৫)
সখি জন লআ (হার, ১)
সতাল ফুল লআঁ (বৃন্দাবন, ১২)
- ৫. ক্রিয়ারূপের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে- সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে উত্তম পুরুষে ক্রিয়াপদে ‘অহম’ জাত ‘ও’ এবং মধ্যম পুরুষে ক্রিয়া বিভক্তি ‘সি’ প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন- পাখী নহোঁ তার ঠাঁই উড়ী পড়ি যাওঁ। ওঁ প্রয়োগ মেহিনী বিদায় দেউ পসিআঁ লুকাও। সি- প্রয়োগ – হৃদয়ত ভয় না মানসী। কেছে আমান করসী।
- ৬. কাল : অতীতকালের পুরাঘটিতের উদাহরণঃ মো তবে আছিলোঁ শিশুমতী। বর্তমান : আতী বুঢ়ী না দেখোঁ নয়নে। ভবিষ্যৎ: নাঅ বান্ধিতে গিয়া করিউ যতনে।
- ৭. উত্তম পুরুষে একবচনে ও বহুবচনে দুটি পৃথক ক্রিয়ারূপের ব্যবহার দেখা যায়। যথা: একবচনে- মোওঁ, চলোঁ, চলিবোঁ, চলিলোঁ এবং বহুবচনে- আহ্মে, চলিএ, চলিব, চলিল, চলিত।
- ৮. নাম ধাতুর যথেষ্ট ব্যবহার লক্ষিত হয়। যেমন- পাশে জনি লোক উপহাসে (< উপহাস) , হেন মনে পড়িহাসে (প্রতিহাস), এবে তাঁক উপেখহ (< উপেক্ষা)
- ৯. যৌগিক ক্রিয়ার ব্যবহার চর্যাগীতিকার সময় হতেই বাংলায় চলে এসেছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে লক্ষিত হয়। যেমন- দরশন ভৈল, গুনিয়া সেহুঁ, আনিআঁ দিবোঁ।
- ১০. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নিত্যবৃত্তকালের পদ গঠিত হয়েছে। যথা: পূর্ণ সট পাতী বড়ায়ি চাহিত মঙ্গলে।
গ. শব্দগুচ্ছ : শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শব্দের বিবিধ প্রয়োগ লক্ষণীয়।
- আরবি ফারসি – মজুরিয়া, মজুরি, পসরা।
- দ্রাবিড় শব্দ – অনল, কাল, চন্দন, চূড়া, পূণ, ময়ূর, সাল, মুক্তা, বলয়া, পিক।
- কোল শব্দ – কদলী, তাম্বুল, উমরু।
- দেশি শব্দ- ছোলঙ্গ, পোটলী, ডাল, ঠেটা, টলে, ডাকর, ডালী ইত্যাদি।
ঘ. প্রবাদ প্রবচন: বাংলা ভাষায় প্রচলিত বহু প্রবাদ কাব্য আমরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যেও দেখতে পাই। যেমন-
- ১. ললাট লিখিত খণ্ডন না জাএ। (দানখণ্ড)
- ২. মোর মন পোড়ে যেন কুম্ভারের পনী (বিরহ খণ্ড)
- ৩. পাখি জাতি নহোঁ বড়ায়ি উড়ী পড়ি যাওঁ। (বংশী খণ্ড)
- ৪. কাটিল ঘাঅত লেম্বুরস দেহ কত। (বিরহ খণ্ড)
- ৫. মধু লোভে ভ্রমর গুজরে। (বিরহ খণ্ড)
- ৬. মাকড়ের হাতে সেহ্ন ঝুনা নারীকেল।
- ৭. মাকড়ের যোগ্য কড়ো নহে গজমতী।
ছন্দ: বাংলা ছন্দের ইতিহাসে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ছন্দের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর অধিকাংশ ছন্দই পয়ার। এতে প্রথম বাংলা অক্ষর বৃত্তের নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন-
নিন্দয়ে চান্দ চন্দন রাধা সব খনে।
গরল সমান মানে মলয় পবনে। (বিরহ খণ্ড)
৮/৬ মাত্রার পয়ার বন্ধের উদাহরণ:
তোর ভাঁগে ছিল রাধা | রতি আনুমতি।
হরিষ করিআঁ তোর মাথে ধর ছাতী। (ছত্র খণ্ড)
দ্বিপদী: ১০/৮
গোআল জরম আহ্মে শুন।
দধি দুধে উতপতী। এবে তাক উপেখহ কেহ্নে। তোর ভৈল কি কুমতী। (নৌকা খণ্ড)
অন্যান্য ছন্দোবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৬/৬/৮ এবং ৮/৯/১০ ভাগের ত্রিপদী। যেমন-
ক্ষেপে সজল নয়নে।
দশ দিশে খনে খনে
নীল হীন কৈশ যেন নীল নলিনে। (বিরহ খণ্ড)
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ভাষার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার একটি সুন্দর সাহিত্যিক রূপের সাথে পরিচিত হই। পরবর্তীকালে বাংলা বাক্যে এ ভাব ও ভাষা অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল। কবি লৌকিক সাহিত্য হতে বিভিন্ন উপাদান আহরণ করে তাঁর কাব্যের সৌন্দর্য বর্ধন করেছেন
Leave a comment