জন্মলাভের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কালকে বলা হয় শৈশব। শিক্ষার দিক দিয়ে এটি হল প্রাক্বিদ্যালয় স্তর। এই স্তরে শিশুর বিকাশের হার খুব বেশি হয়। এই সময় শিশুর দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক এবং সামাজিক বিকাশ ঘটে।

(১) দৈহিক বিকাশ: শৈশবে শিশুদের দৈহিক বিকাশ খুব দ্রুতগতিতে ঘটে। পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গেছে জন্মাবার সময় শিশুর উচ্চতা থাকে 17 ইঞ্চি থেকে 21 ইঞ্চি। 2 বছরে তার উচ্চতা হয় 32 ইঞ্চি থেকে 34 ইঞ্চি। জন্মাবার সময় যা উচ্চতা থাকে 5 বছরের উচ্চতা তার দ্বিগুণ হয়। শিশু ছয়মাস বয়সে বসতে শেখে। দশমাস বয়সে হামাগুড়ি দেয়। বারােমাস বয়সে নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে এবং প্রায় আঠারাে মাস বয়সে হাঁটতে পারে। 3 বছরে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে দৌড়াতে পারে।

(২) মানসিক বিকাশ: দেহের পাশাপাশি শৈশবে শিশুর বিভিন্ন ধরনের মানসিক পরিবর্তনও ঘটে। এই সময় শিশুদের ভাষার বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক বছরে শিশু তিন থেকে চারটি শব্দ বলতে পারে। দুবছরে শিশু মােটামুটি 250টি এবং পাঁচ বছরে 2072টি শব্দ শেখে। তা ছাড়া এই বয়সে শিশুর মধ্যে স্মৃতি, কৌতূহল, কল্পনাশক্তির বিকাশ লক্ষ করা যায়। মনােযােগের পরিসর বৃদ্ধি পায়। মূর্ত বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে এবং কারণ দর্শাতে পারে।

(৩) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশ তিনমাস বয়সে শুরু হয়। ওই সময় শিশু আনন্দ এবং অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে শেখে। দেখা গেছে, ছয় মাস বয়সে আনন্দের প্রক্ষোভটি উচ্ছ্বাসে এবং অস্বাচ্ছন্দ্য প্রক্ষোভটি বিরক্তিতে পরিণত হয়। শিশুর প্রক্ষোভের তীব্রতা খুব বেশি, স্থায়িত্ব খুব কম। প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে শিশুরা অক্ষম।

(৪) সামাজিক বিকাশ: জন্মাবার পর শিশু সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক থাকে। এক মাসের শিশুরা কাছাকাছি থাকা বয়স্কদের সম্পর্কে সচেতন হয়। দুমাস বয়সে হাসির দ্বারা প্রতিক্রিয়া করে। ‘মা’কে চিনতে পারে। তিন মাস বয়সে দেখা যায়, শিশুর সঙ্গে কেউ কথা বললে শিশু কান্না থামায় আর চলে গেলে কাঁদে। পাঁচ-ছয় মাসে আদর করা ও বকাবকির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। নতুন লােককে চিনতে পারে। তার কাছে যেতে চায় না। আট-নয় মাসে বয়স্কদের কথা অনুকরণ করে। ‘না শব্দের অর্থ বুঝতে পারে। দেড় বছর বয়সে একটা নেতিবাচক মনােভাব দেখা যায়। এই বয়সে সমবয়সিদের থেকে বয়স্কদের বেশি পছন্দ করে। সমবয়সিদের সঙ্গে বড়াে একটা মেশে না। দুবছর বয়স থেকেই সত্যিকারের সমাজচেতনা দেখা যায়। এই সময় থেকেই শিশুদের মধ্যে সহযােগিতা এবং সহানুভূতির গুণগুলি বিকশিত হয়।

শৈশবে বিকাশগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। শৈশবের চাহিদাগুলিকে নিম্নলিখিত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়一

(১) দৈহিক চাহিদা: দৈহিক চাহিদা বলতে এমন কতকগুলি জৈবিক চাহিদাকে বােঝায় যা শিশুকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই চাহিদাগুলি হল

  • খাদ্যের চাহিদা: শৈশবে দৈহিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত হারে হয়ে থাকে। এই জন্য শিশুর খাদ্যের চাহিদা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে।

  • নিরাপত্তার চাহিদা: শিশু পিতামাতা বা বয়স্কদের কাছ থেকে দৈহিক নিরাপত্তা চায়| নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, জল, বায়ু প্রভৃতি শিশুর দৈহিক নিরাপত্তামূলক চাহিদার উদাহরণ।

  • সক্রিয়তার চাহিদা: কোনাে শিশুই চুপ করে থাকতে চায় না। সবসময় সে কিছু না কিছু করতে চায়। তার ইচ্ছামতাে চলাফেরা, নড়াচড়া ও দৌড়াদৌড়িতে বাধা দিলে সে বিরক্ত হয়।

  • পুনরাবৃত্তির চাহিদা: শিশুর মধ্যে পুনরাবৃত্তির চাহিদা লক্ষ করা যায়। একই কথা সে বারবার বলে, একই কাজ সে বারবার করতে চায়।

(২) মানসিক চাহিদা: শৈশবে শিশুর দৈহিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি মানসিক চাহিদা দেখা দেয়। এই চাহিদাগুলি হল

  • অনুকরণের চাহিদা: শিশু তার বাবা-মা কিংবা অন্যান্য বয়স্কদের নানান আচার-আচরণ অনুকরণ করে। এই অনুকরণই হল শৈশবকালীন আচরণ এবং শিখনের অন্যতম উৎস।

  • আয়ত্তে আনার চাহিদা: শিশু সবকিছুকে নিজের আয়ত্তে আনতে চায়। শিশু যা দেখে তাই নিতে চায় ও পেতে চায়। নিজের জিনিস সে অন্যকে দিতে চায় না।

  • জানার চাহিদা: শিশুর মধ্যে সবকিছু জানার চাহিদা দেখা দেয়। কী, কেনএইসব প্রশ্নের উত্তর সে চায়। এই চাহিদার ফলে অনেক সময় সে কোনাে জিনিসকে ভেঙে তার ভেতরে কী আছে তা দেখতে চায়।

(৩) সামাজিক চাহিদা: শিশু জন্মায় সামাজিক পরিবেশে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ ঘটে। তাই তার মধ্যে কতকগুলি সামাজিক চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। এই চাহিদাগুলি হল

  • সহযােগিতার চাহিদা: শিশুরা বড়ােদের কাছ থেকে সব কাজে সহযােগিতা পেতে চায়। এই চাহিদাপূরণের জন্য বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে তারা বড়ােদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

শৈশবের উপরিউক্ত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শৈশবের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করা প্রয়ােজন।