পশ্চিমি শৈলীতত্ত্বে একাধিক মতাদর্শের তালিকা করছেন কেউ কেউ (দ্র. ফ্রিম্যান, ১৯৭০ : ৪-৫) ; যেমন স্টাইল হল একটি আদর্শ থেকে বিচ্যুতি (adeviation from the norm), কিংবা স্টাইল হল একই ধরনের বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি বা সমাহার (Style as recurrence or convergence of textual pattern) কিংবা স্টাইল হল ব্যাকরণের সম্ভাবনার বিশেষ নিষ্কাশন (Style as a particular exploitation of a grammar of possibilities)। এ সবের মূলেই কিন্তু আছে নির্বাচন বা choice। অর্থাৎ আমি ভাষার একটি আদর্শ থেকে সরেই যাই, সরে গিয়ে সেই আদর্শের সঙ্গে আমার বাচনের দূরত্বই তৈরি করি—সেখানেও আমি আমার পছন্দমতো উপাদান ও তাদের সম্পর্ক নির্বাচন করছি। আবার আমি একই উপাদান বা বিন্যাসের বারংবার ব্যবহার করছি, ধারাবাহিকভাবে বা গুচ্ছে গুচ্ছে—তারও মূল আছে নির্বাচন। কিংবা ব্যাকরণের নানা সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে আমি ব্যবহার করছি বা ভাঙছি কোনো একটি সম্ভাবনা, তাও হচ্ছে নির্বাচনেরই সূত্রে। সুতরাং ওপরের সমস্ত তত্ত্বের মূল কথা “Style as choice”—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই নির্বাচন কতটা সচেতন কতটা অচেতন বা অর্থ সচেতন ? মিলিচই তাঁর পূর্বোক্ত প্রবন্ধে এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন। তাতে তাঁর উত্তর ছিল যে, রচনার কাজটা অচেতন এবং সচেতন দুইই এবং রচনার নানা পর্যায়ে বা রচনার প্রকারবিশেষে দুয়ের মাত্রার তফাত হতে পারে—এ উত্তর আমাদের কাছে সংযত বলেই মনে হয়। মিলিচ চমৎকার দেখিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে লেখকদের নিজেদের অন্তজ্ঞান যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। সুইফ্ট একাক্ষরিক (mono-syllabic) শব্দ, সংক্ষেপিত শব্দ, mob বা banter জাতীয় শব্দের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিলেন ; চাইতেন লেখা হবে সরল, ছোটো ছোটো বাক্যে তৈরি। কিন্তু তিনি কদাচিৎ এসব নির্দেশ নিজে মান্য করেছেন। তবু এই ভাষাবিজ্ঞানীদের উক্তি ও আচরণের তফাত থেকেই বেশ খানিকটা সূত্র পাওয়া যায় এ সম্বন্ধে।
এ নিবন্ধের প্রথমে যাকে আমরা ‘ভাষার ব্যাকরণ’ বলেছি, যা আমাদের বাক্যগঠনের মূল সূত্রাবলি ও বাক্যের উপাদানগুলি হাতে ধরিয়ে দেয় মাত্র, তা হুবহু মান্য করে যদি বাক্য রচনা করে যাই, বিশেষ করে দ্রুত লেখার সময়—যখন ভাষার শৈলী সম্বন্ধে বিশেষ মনোযোগ দেবার অবসর থাকে না—তখন রচনাকর্ম অনেকাংশে অচেতন বা অর্ধচেতন। কিন্তু যখনই সেই রচনা সংশোধন বা পরিমার্জনের প্রশ্ন ওঠে, তখনই আমরা সচেতন নির্বাচনের এলাকায় পৌঁছে যাই। সংশোধন বা নির্বাচনের দরকার তখনই আমরা বোধ করি যখন আমরা আমাদের রচনার প্রতিক্রিয়া বা effect সম্বন্ধে সচেতন হই। মিলিচ এ দুইয়ের তফাত করেন এইভাবে ঃ রচনা সম্বন্ধে আমাদের অচেতন সিদ্ধান্তগুলি নির্ভর করে stylistic options-এর নির্বাচনের ওপর, কিন্তু সচেতন সিদ্ধান্তগুলি করি rhetorical choice (ওই : ৮৫) সম্বন্ধে।
মিলিচের rhetorical কথাটির ব্যবহার অবশ্যই নতুন বিভ্রান্তি তৈরি করবে। তাঁর stylistic কথাটির অবশ্য চস্কির একটি আলোচনাকে স্মরণ করায়। চম্স্কি সেখানে জানান যে, ‘Thave to see an eye-doctor’ কথাটির বদলে যদি কেউ ‘Thave to see an occulist’ ব্যবহার করে তার ভিত্তি নেহাতই stylistic choice, বা বাক্যটির অর্থের কোনো ব্যত্যয় ঘটায় না। কিন্তু অর্থের ব্যত্যয় না ঘটালেও যে প্রতিক্রিয়ার হেরফের ঘটায় তা চম্স্কি আলোচনা করেননি। অর্থাৎ eye-doctor আর occulist হুবহু সমার্থক শব্দ নয়। দুটির ব্যবহারে আমাদের দুরকম প্রতিক্রিয়া হয়, তার মধ্যে মাত্রাভেদ থাকে।
এঙ্কভিস্ট-এর মতে ‘রেটরিক্যাল চয়েস্-ই আসলে কবিতার শৈলীকে বিশেষত্ব দেয়। তাঁর ধারণায় কাব্যরচনার এই অংশটাই সচেতন নির্বাচনের বিষয়, এই ব্যাপারটাই কবি ভেবেচিন্তে ঠিক করেন। লিচ ও শর্ট (Leech and Short, ১৯৮১) সম্ভবত এই কথা মনে রেখেই language use আর language exploitation-এর তফাত করেছিলেন। ভাষার ব্যবহারটা মূলত অচেতন বা অর্ধ-সচেতন ঘটনা, অংশত সচেতন নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাষার সম্বলগুলির সন্ধান ও সদ্ব্যবহার নিশ্চয়ই পুরোপুরি সচেতন কাজ।
Leave a comment