শূদ্রকের আবির্ভাবকাল ও পরিচয় সংক্ষেপে বর্ণনা করে ‘মৃচ্ছকটিক’এর গঠনকৌশল ও কাহিনী বিন্যাস ব্যাখ্যা করো।
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের নামকরণের এবং এটিকে ‘প্রকরণ’ আখ্যা দেওয়ার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। এই নাটকের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে এর অভিনবত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।
‘সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে শূদ্রকের আবির্ভাব বিস্ময়করভাবে অভিনব।”—বিচার করো।
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের নাট্যকার, কাহিনী ও বৈশিষ্ট্য বিচার করো।
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটি সম্পর্কে সংক্ষেপিত আলোচনা করো।
সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’। গ্রন্থের ‘প্রস্তাবনা’-অংশে নাট্যকার রূপে ‘রাজা শূদ্রকের’ নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য আরও দুটি রচনা শূদ্রকের নামের সঙ্গে জড়িত। একটি নাটক ‘বীণাবাসবদত্ত’ এবং অপরটি একোক্তিমূলক একাঙ্ক বা ভাগ ‘পদ্ম প্রাভূতক’। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’ প্রকরণ বা নাটকের জন্যই তাঁর খ্যাতি। এই খ্যাতির বৃত্তে রচয়িতা নিজে প্রায় বাল্মীকি হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘শূদ্রক’-ই নাটকটির প্রণেতা কিনা, কী তার পরিচয় এবং কোনকালে তিনি বর্তমান ছিলেন–এর প্রতিটি প্রশ্নের নানা সমস্যা দেখা দেওয়াতে পণ্ডিতসমাজে এ বিষয় নিয়ে বিস্তর-বিতণ্ডা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য তাঁর ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে যে আলোকপাত করেছেন তা আলোচনা করা হল। আশা করা যায়, এই আলোচনা থেকে উক্ত প্রশ্নগুলির সদুত্তর পাওয়া যাবে : “শুধু নাট্যসাহিত্যেই নয়, সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যেই ‘মৃচ্ছকটিক’ এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এমনভাবে সাধারণ মানুষকে নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসেই মৃচ্ছকটিকের স্থান একক ও অনন্য।
শূদ্রকের পরিচয়ঃ অপর অনেক নাট্যকারের মতোই এই নাটকের ‘প্রস্তাবনা’তেও নাট্যকারের পরিচয় দান করা হয়েছে। নাট্যকারের নাম শূদ্রক। তিনি বহুগুণ সম্পন্ন ব্রাহ্মণ নরপতি। প্রথম জীবনে শূদ্রক অস্মক দেশের অধিবাসী ছিলেন এবং স্বাতী নামক এক রাজপুত্রের বাল্যবন্ধু ছিলেন। পরে তার সঙ্গে শূদ্রকের মনোমালিন্য হয়। পরবর্তীকালে শূদ্রক উজ্জয়িনীর রাজা হয়েছিলেন। শেষ জীবনে পুত্রকে সিংহাসন দান করে একশত বৎসর দশদিন বয়সে তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করে আত্মবিসর্জন করেন। সাধারণত সংস্কৃত নাটকের অন্তর্ভুক্ত ‘প্রস্তাবনা’ অংশটি স্বয়ং নাট্যকারই রচনা করে থাকেন। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে তা কখনও সম্ভব হতে পারে না, কারণ নাট্যকার কখনও আপনার মৃত্যুর কথা লিখে যেতে পারেন না। অতএব, স্পষ্টতই বোঝা যায়, প্রস্তাবনাটি নির্ভরযোগ্য নয় এবং এ থেকে নাট্যকারের যথার্থ পরিচয় লাভ সম্ভবপর নয়। ব্রাহ্মণ-সন্তান ‘শূদ্রক’ নাম গ্রহণ করবেন, এটাও বিশ্বাস্য নয়—তবে কী এটা গ্রন্থকারের ছদ্মনাম? কিন্তু তাহলেও প্রস্তাবনা অংশ নাট্যকার রচিত নয়। কেউ কেউ অনুমান করেন, নৃপতি শূদ্রকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো সভাসদ হয়তো নাটকটি রচনা করে প্রভুর তুষ্ট-সাধনের জন্য তাঁকেই গ্রন্থ-কর্তৃত্ব দান করেন। কিন্তু এটিও নিছক অনুমান মাত্র। আসলে ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের রচয়িতা-বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্যই এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন গ্রন্থে অবশ্য ‘শূদ্রক’ নামক এক রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘স্কন্দপুরাণে শূদ্রককে অন্ধ্রবংশীয় নৃপতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অস্ত্রবংশীয় অপর একজন নৃপতির নাম পাওয়া যায় শিবঙ্গাতী, ইনিই যদি নাটকের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে বর্ণিত শূদ্রকের বাল্যবন্ধু স্বাতী হয়ে থাকেন, শূদ্রক খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা যায়। ‘কথাসরিৎসাগরে’ শুদ্রককে শোভাবতীর রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজশেখর সাতবাহন-সাহসাঙ্কের সঙ্গে শূদ্রকের নাম উল্লেখ করেছেন। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’তে শূদ্রককে বিক্রমাদিত্যের পূর্ববর্তী রাজা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’তে শূদ্রককে বর্ধমানের রাজা, ‘কাদম্বরী’তে বিদিশার রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব স্পষ্টই বোঝা যায়, শূদ্রক নামক কোনো এক শ্রুতকীর্তিত শূদ্রককে অবলম্বনেই পূর্বোক্ত গ্রন্থসমূহে তাঁর নাম উদ্ধৃত হয়েছে—হয়তো তাঁর সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান কোনো গ্রন্থকারেরই ছিল না অথবা শূদ্রক নামে হয়তো বা অনেক নরপতিই প্রাচীনকালে বর্তমান ছিলেন। শূদ্রকও যে কালক্রমে পৌরাণিক বা রূপকথার রাজার সম্মানলাভ করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘শূদ্রককথা’, ‘শূদ্ৰকবধ’, ‘বিক্রান্তশূদ্রক’ প্রভৃতি শূদ্রক-সম্বন্ধীয় গ্রন্থাবলী থেকে। বস্তুত এই সমস্ত শূদ্রকের সঙ্গে নাট্যকার শূদ্রকের কোনো সম্বন্ধ আছে কিনা বলা সম্ভবপর নয়। তা’ছাড়া শূদ্রক যে গ্রন্থকার ছিলেন, এ কথাও এঁদের কেউ উল্লেখ করেননি। অষ্টম শতাব্দীতে বামনই সম্ভবত সর্বপ্রথম শূদ্রকের একখানি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেন, এবং গ্রন্থটি যে ‘মৃচ্ছকটিক’, সে-বিষয়ে অন্যত্র ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। অতএব শূদ্রক যে অন্তত অষ্টম শতাব্দীর পূর্বেই ‘মৃচ্ছকটিক’ রচনা করেছিলেন, এটিই শুধু নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
শূদ্রকের জীবৎকাল : অপর অনেক প্রাচীন কবির মতোই শূদ্রকের কাল-নির্ণয়ের যথেষ্ট সমস্যা দেখা দিয়েছে। Sten Konow শূদ্রককে আভীর নরপতি শিবদত্ত থেকে অভিন্ন মনে করেন এবং এই হিসেবে তিনি শূদ্রককে আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টাব্দে উপস্থাপিত করেন। এটি সত্য হলে তাঁকে কালিদাসের পূর্ববর্তীকালের কবি বলেই মেনে নিতে হয়। কিন্তু কালিদাস যেখানে পূর্ববর্তী নাট্যকার ভাস-সৌমিল্ল-কবিপুত্রের নাম উল্লেখ করেছেন, তখন শূদ্রকের মতো এমন একজন শক্তিমান কবির কথা বলেন নি কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। ‘মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে যে সকল আইনকানুনের বিবরণ পাওয়া যায়, তা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল—এই হিসেব থেকে Jolly শূদ্রককে ষষ্ঠ/সপ্তম খ্রিস্টাব্দের রচনা বলে অনুমান করেছেন। নাটকে বর্ণিত বিবরণ থেকে Jacobi সিদ্ধান্ত করেছেন যে, নাটকটি চতুর্থ শতকের পূর্বে কিছুতেই রচিত হতে পারে না। Pischel শূদ্রককে দণ্ডীর শুধু সমসাময়িক (ষষ্ঠ শতাব্দী) বলেই মনে করেন না, তাঁর মতে দণ্ডীই ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটি রচনা করেন। ফলকথা, শূদ্রকের পরিচয় এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত এবং রহস্যাবৃত। তবে তাঁর জীবৎকাল অষ্টম শতকের পূর্ববর্তী এটা নিশ্চিত।
ভাসের ‘চারুদত্ত’ ও শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ – কোনটি মূল : শূদ্রকের পরিচয় যা-ই হোক্, তিনি ‘মৃচ্ছকটিক নাটকটি রচনা করেছেন—দীর্ঘকাল এ বিষয়ে কোনো মতদ্বৈধ ছিল না। কিন্তু ভাসের নাটক-চক্র আবিষ্কৃত হবার পর দেখা গেল, তথায় চারি অঙ্ক-বিশিষ্ট ‘চারুদত্ত’ নামক একটি নাটক রয়েছে, যার সঙ্গে ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের সাদৃশ্য বিস্ময়কর। চারুদত্তের চারিটি অঙ্কে যে সমস্ত শ্লোক বর্তমান, তার অল্প কয়টি ব্যতীত প্রায় সমুদয় অংশই ‘মৃচ্ছকটিকে’র প্রথম চারি অঙ্কেও বর্তমান রয়েছে এবং একে কোনোক্রমেই আকস্মিক যোগাযোগ বলে মেনে নেওয়া চলে না। অবশ্য ‘মৃচ্ছকটিকে’ তদতিরিক্ত কিছু কিছু শ্লোক রয়েছে। এই সাদৃশ্যের ফলেই মৃচ্ছকটিক বিষয়েও নতুন জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে—’চারুদত্ত’ এবং ‘মৃচ্ছকটিক’ এদের পারস্পরিক সম্পর্কটা কী। কেউ বলেন, ভাসের ‘চারুদত্ত’কেই সম্প্রসারিত করে শূদ্রক ‘মৃচ্ছকটিক’ রচনা করেন। পক্ষান্তরে অপর অভিমত এই ভাসই ‘মৃচ্ছকটিকে’র অংশ বিশেষ বর্জন করে সংক্ষিপ্তাকারে ‘চারুদত্ত’ রচনা করেন। চারুদত্তের পূর্ববর্তিতা-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি এই যে চারুদত্তের ভাষায় প্রাচীনত্বের লক্ষণ সুস্পষ্ট। তাই চারুদত্ত যদি ‘মৃচ্ছকটিকে’র আদিরূপ নাও হয়, তবে অন্তত এ কথা বলা চলে যে, যে-মূল অবলম্বনে মৃচ্ছকটিক রচিত হয়েছে, তার অনেকটাই চারুদত্তে বর্তমান রয়েছে। ঐতিহাসিক সুখতষ্করের ভাষায়, … the Charudatta version is on the whole, older than the Mrechakatika ver sion and hence (as a corollary), if our Charudatta is not itself the original of the Mrechakatika, then we must assume that it has preserved a great deal of the original upon which the Mrechakatika is based.’ আবার এ বিষয়ে বিরোধী পক্ষের বক্তব্য এই যে, ‘চারুদত্তের’ নাট্যকার ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের রাজনীতি এবং আইনের ককচি বর্জন করে এর একটা সুখপ্রদ মিলনাস্তক রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন বলেই ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের প্রথম চারটি অঙ্ক মাত্র গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক দেওধরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: …the author of Charudatta, whoever he was, wanted to make a pleasant comedy out of the first four acts of the Mrechakatika and hence has avoided reference to the political resolution to Rohasena and to the lawsuit which is contemplated by the vengeful Sakara. To ভাস ও শূদ্রক – কে কার কাছে ঋণী, এই সমস্যার সমাধানও আপাতত সম্ভব নয়।
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের কাহিনী : উজ্জয়িনীর বণিকপল্লীতে বাস করতেন ব্রাহ্মণ চারুদত্ত; ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও এখন দান ধ্যান করে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন; সংসারে আছে তাঁর স্ত্রী ধৃতা এবং বালকপুত্র রোহসেন। উজ্জয়িনীর সেরা নটী বসন্তসেনা জন্মের খাতিরে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করলেও তিনি অতিশয় হৃদয়বতী। তিনি চারুদত্তের কীর্তিকলাপ শুনে তাঁর গুণে মুগ্ধ ছিলেন, বসন্তোৎসবের দিন কামদেবের মন্দিরে তাঁর দর্শন পেয়ে পঞ্চশরে বিদ্ধ হলেন। মন্দির থেকে প্রত্যাবর্তন-পথে তিনি যখন চারুদত্তের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন, তখন রাজশ্যালক মহাদুর্বৃত্ত শকার সপারিষদ্ দেখতে পেলেন বসন্তসেনাকে এবং তাকে আহ্বান জানালেন। বসন্তসেনা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয়-সন্ধানে চারুদত্তের গৃহে প্রবেশ করলেন। চারুদত্ত অতিশয় ভদ্রভাবে তাকে গ্রহণ করলেন এবং অন্ধকার পথে তাকে স্বগৃহে পৌঁছে দিলেন। তস্করভয়ে ভীতা বসন্তসেনা তার অলঙ্কারগুলি চারুদত্তের গৃহেই রেখে গেলেন।
দৈবক্রমে উক্ত রজনীতেই শর্বিলক নামক এক শিক্ষিত চৌর্যশাস্ত্রবিং ব্রাহ্মণ তার প্রণয়িনী মদনিকার মুক্তিপণ সংগ্রহের নিমিত্ত সিঁধ কেটে চারুদত্তের গৃহ থেকে বসন্তসেনার অলঙ্কারগুলি চুরি করে এনে দিল মদনিকাকে— মদনিকা বসন্তসেনারই পরিচারিকা। অন্তরাল থেকে বসন্তসেনা সমস্ত দেখলেন এবং ওদের কথাবার্তা শুনে মদনিকাকে মুক্তিদান করে শর্বিলকের হাতে তাকে সমর্পণ করলেন।
এদিকে চোর পালালে চারুদত্তের গৃহে সবাই জেগে উঠে দেখলেন, ন্যস্ত অলঙ্কার সব অপহৃত হয়েছে। চারুদত্ত বধূ ধূতা তাঁর রত্নহার খুলে দিলে বন্ধু মৈত্রেয় সেই হার বসন্তসেনাকে অর্পণ করে জানালেন যে পাশাখেলায় চারুদত্ত অলঙ্কারগুলি খুইয়েছেন, তাই এটি পাঠিয়েছেন। বসন্তসেনা সব বুঝতে পেরে মুগ্ধচিত্তে রত্নমালা গ্রহণ করে জানালেন যে সন্ধ্যাকালে চারুদত্তের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন। তারপর যথাসময়ে বসন্তসেনা চারুদত্ত-গৃহে উপস্থিত হলে প্রকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিল। ফলে বসন্তসেনাকে সেই রাত্রি উক্ত গৃহেই থাকতে হল। পরদিন প্রভাতে বসন্তসেনা সেই রত্নমালা ধৃতাকে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতা হলেন। এদিকে বালক রোহসেন তার বন্ধুর একটি সোনার গাড়ি নিয়ে খেলা করছিল, বন্ধু সেটি নিয়ে চলে গেলে পরিচারিকা মদনিকা তাকে একটি ছোট মাটির গাড়ি (মৃৎ + শকটিক = মৃচ্ছকটিক) এনে দিলে বালক সোনার গাড়ির জন্য বায়না ধরে কাঁদতে লাগলো। তখন বসন্তসেনা তার দেহের যাবতীয় অলঙ্কার খুলে রোহসেনের মাটির গাড়ি বোঝাই করে দিয়ে বললেন, এই দিয়ে তোমার সোনার গাড়ি হবে।
এদিকে চারুদত্তের গৃহ থেকে বেরিয়েই সামনে গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেয়ে একে চারুদত্তের গাড়ি ভেবে বসন্তসেনা তাতে চড়ে বসলেন। কিন্তু এটি ছিল রাজশ্যালক শকারের গাড়ি। এই সুযোগে শকার বসন্তসেনাকে মনস্তুষ্টিবিধানে চেষ্টা করেও যখন অপারগ হল, তখন তার গলা টিপে ধরলো। তারপর তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে গেল। এই সময় জনৈক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তাকে দেখতে পেয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে তাকে বৌদ্ধমঠে নিয়ে গেলেন। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী প্রথম জীবনে কিছুদিন সংবাহক নামে চারুদত্তের সেবক ছিলেন এবং এক সময় বসন্তসেনা দ্বারাও উপকৃত হয়েছিলেন।
শকার এবার রাজদ্বারে অলঙ্কারের লোভে বসন্তসেনাকে হত্যার অপরাধে চারুদত্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এল। বিচার করে অধিকরণিক বা প্রধান বিচারপতি চারদত্তের নির্বাসন দণ্ড দিলে রাজা পালক তার মৃত্যুদণ্ড বিধান করলেন। চারুদত্তকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল– চণ্ডালও তাকে শূলে চড়ানোর জন্য প্রস্তুত। এমন সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু সংবাহক বসন্তসেনাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন— ঘাতকের উদ্যত হস্ত স্তব্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শবিলক এসে জানালেন, আর্যক কারাগার থেকে পালিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করে রাজা পালককে হত্যা করে স্বয়ং রাজা হয়েছেন এবং তার বন্ধু চারুদত্তকে বেণা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ রাজ্য দান করেছেন। চারুদত্ত মুক্তি পেয়ে নিজেও একটি রাজ্যের রাজা হলেন, শকার তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তাকেও ক্ষমা করলেন এবং রাজা আর্যক বসস্তসেনাকে চারদত্তের বধূ বলে স্বীকার করে নিলে ধৃতা তাকে আলিঙ্গন করলেন।
কাব্য-বিচারঃ প্রকরণ : সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের বিচারে নানাদিক দিয়ে ব্যতিক্রমী এই দৃশ্য কাব্যটিকে যথার্থ নাটক না বলে আলঙ্কারিকগণ প্রকরণরূপে চিহ্নিত করেছেন। আলঙ্কারিকগণ দৃশ্যকাব্যগুলিকে দশটি শ্রেণী বা দশরূপকে ভাগ করেছেন। এ দশরূপকের মধ্যে নাটক হল একটি রূপক। প্রকরণ আর একটি রূপকের নাম। এছাড়া, প্রহসন, ভাণ প্রভৃতি আরও আটটি রূপক রয়েছে। দৃশ্যকাব্যের এই দশরূপকের মধ্যে নাটক ও প্রকরণই শ্রেষ্ঠ। নাটকের কাহিনী বা বিষয়বস্তু যেখানে কবি কল্পিত হবে না, হবে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা লোক প্রসিদ্ধ সুপরিচিত কাহিনী সেখানে প্রকরণের বিষয়বস্তু হবে সম্পূর্ণরূপে কবি কল্পিত। নায়ক হবেন ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী বা বণিক। নায়ক দুর্দিনে পতিত হয়ে সম্পত্তি, প্রণয় বা কর্তব্য সম্পন্ন করার ব্যাপারে যত্নবান হবেন। এতে নাটকসুলভ উদাত্ত নায়ক দেবচরিত্র বা রাজা-রাজড়ার প্রণয়লীলার কথা বর্ণনা করা যাবে না। তবে নায়ক হবেন ধীর ও প্রশান্ত শ্রেণীর। লোকধর্ম, কাল ও মর্মে আসক্ত। নায়িকা হবেন কুলস্ত্রী, বেশ্যা বা উভয়ই। দাস, বেশ্যা, চেট (তরুণী, দাসী), বীট (কামুক, লম্পট), জুয়াড়ী প্রভৃতির স্থানও হবে নির্দিষ্ট। অঙ্ক সংখ্যা হবে পাঁচ থেকে দশ এবং পঞ্চসন্ধি সমন্বিত। —এই লক্ষণগুলির সঙ্গে মিলিয়ে আলঙ্কারিকগণ দশরূপকের অন্তর্গত ‘মৃচ্ছকটিক’ রূপকটিকে নাটক না বলে প্রকরণ জাতীয় রূপক রূপেই চিহ্নিত করেছেন। এতে অঙ্ক সংখ্যা দশটি। নায়ক চারুদত্ত ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও বণিক বৃত্তিতে নিয়োজিত। নায়িকাদের একজন কুলবধূ ‘ধৃতা’, অপরজন নটী ‘বসন্তসেনা’। নাটকের কাহিনী লৌকিক এবং নাট্যকার কল্পিত। প্রধান রস শৃঙ্গার। এতে বিট, চেট, জুয়াড়ী ইত্যাদি, বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর সমাবেশ ঘটেছে। অর্থাৎ প্রকরণ জাতীয় রূপকের যে সকল উপাদান একান্ত প্রয়োজন, তার কোনোটারই অভাব ঘটে নি। সেদিক থেকে প্রকরণ হিসেবে এর সার্থকতার কোনো অভাব নেই।
নামকরণ : কাহিনীর নামকরণটিও সমভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সংস্কৃত নাটকে এমন তুচ্ছ বিষয় অবলম্বনে গ্রন্থের নামকরণ ইতঃপূর্বে কিংবা পরবর্তীকালে কখনও ঘটেছে কিনা সংশয়জনক। কোনো রাজা বা নায়কের নামের পরিবর্তে গ্রন্থনাম ‘মৃচ্ছকটিকম্’ = মৃৎ + শকটিকম্’ অর্থাৎ মাটির নির্মিত ছ্যাকড়া (গাড়ি)। নাটক চারুদত্তের বালকপুত্র রোহসেনকে খেলার জন্য পরিচারিকা একটি ছোটো মাটির গাড়ি দিলে বালক সোনার গাড়ির জন্য বায়না ধরে; তখন ঐ গৃহে উপস্থিত ছিলেন নটীশ্রেষ্ঠা বসন্তসেনা, তিনি তার দেহের সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার খুলে দিলেন বালকের সোনার গাড়ির জন্য। তারপর থেকেই ঘটনার জটিলতা এবং সংঘাতের আবর্ত সৃষ্টি হতে হতে নাটকটি চরম পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। অতএব সমগ্র নাটকে ঐ মাটির গাড়ির একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলেই নাটকটি সার্থকনামা। এই নামকরণের আর একটি তাৎপর্যও ইঙ্গিতবহ। মঞ্চের ওপরে একটা মাটির গাড়িতে সোনার গহনা ভরা এই গাড়িটাই যেন নাটকের চরিত্রগুলির প্রতীক। বহিরঙ্গে দৈন্য অথচ অন্তরে খাঁটি সোনা। একমাত্র ব্যতিক্রম বসন্তসেনা, তিনি ধনী কিন্তু সৎ। – এই মাটির গাড়ি, মৃৎ শকটকে কেন্দ্র করেই ঘটনাসমূহ উদ্ঘাটিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই নামকরণের মধ্যে নাট্যকার সাধারণ চরিত্রগুলিকে সামনে রেখে আরও গভীর কথা বলতে চেয়েছেন, আর এইদিক থেকে নামকরণটি সার্থকতর।
গতানুগতিকতার বর্জন ও অভিনবত্ব আনয়ন : বিষয়বস্তুর দিক থেকে নাটকের কাহিনী বিশেষ তাৎপর্যময়। এতে শৃঙ্গার রসই প্রধান হলেও এতে নর-নারীর হৃদয়বেদনার চিত্রই শুধু উদ্ঘাটিত হয়নি, সেকালের পক্ষে প্রায় অভাবিত একটি রাষ্ট্রবিপ্লবও নাটকটিতে স্থান পেয়েছে এবং প্রজাগণ নিজেরা রাজা নির্বাচন করেছেন এমন একটা আশ্চর্য ঘটনাও এই নাটকের অঙ্গীভূত হয়েছে। এই রাষ্ট্রবিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় সমাজে ও রাষ্ট্রে যে সমস্ত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা-ও একালে পাঠককে বিস্ময়বিমূঢ় করে রাখবার পক্ষে যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বিষয়টি স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, “সংস্কৃত সাহিত্য বলিতে সাধারণত বোঝায়, অভিজাত শ্রেণীর সাহিত্য। জনসাধারণের জীবন-চিত্র সেখানে বিরল। ‘মৃচ্ছকটিক’ গণ-জীবন-বিচিত্র। কিন্তু এই নাটকের প্রায় ত্রিশটি চরিত্র সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সংকলিত হয়েছে। ভাল-মন্দ, ধনী-দরিদ্র, নিষ্ঠুর-দয়ালু, উদার-নীচ এই নানা ধরনের পরস্পর বিরুদ্ধ চরিত্রের সমাবেশে সামাজিক জীবনযাত্রার এক বৃহদংশ এখানে প্রতিফলিত। গণ অভ্যুত্থান এই নাটকের একটি মূল ঘটনা। রাষ্ট্রবিপ্লবে এখানে রাজা সাব্যস্ত হইয়াছেন ঘোষপল্লীর আর্যক, এখানে বৌদ্ধভিক্ষুসঙ্ঘের কুলপতি নিযুক্ত হইয়াছেন একজন জুয়াড়ী, মন্ত্রী হইয়াছেন একজন চৌর্যবিদ্যাবিশারদ ব্রাহ্মণ আর কুলবধূর মর্যাদা লাভ করিয়াছেন একজন গণিকা। সমাজের অতি সাধারণ মানুষ এখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে।”
ভাষা ব্যবহার স্বাতন্ত্র্য : ভাষা ব্যবহারে নাট্যকার যথেষ্ট নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এটি সংস্কৃত নাটক, কিন্তু নাটকের পাত্রপাত্রীদের মধ্যে মাত্র ৬ জন সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেছেন আর ২২ জন কথা বলেছেন দু’রকম প্রাকৃতে; অবশ্য কেউ কেউ প্রয়োজনবোধে সংস্কৃত এবং প্রাকৃত উভয় ভাষাই ব্যবহার করেছেন। সব মিলিয়ে নাটকটির অসাধারণত্ব দর্শক পাঠক সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ড. সুকুমার সেন বলেন, “মৃচ্ছকটিক সংস্কৃত সাহিত্যে অত্যন্ত একক রচনা। এমন মনোহারী অথচ সম্ভাব্য কাহিনী দ্বিতীয় কোনো সংস্কৃত বইয়ে নাই। কাহিনীটি আধুনিক শুধু নাটক নয়, গল্প-উপন্যাসের এমনকি ডিটেকটিভ কাহিনীর কাছও ঘেঁষিয়া যায়। ভূমিকা-সংখ্যা অনল্প নয় এবং চরিত্রচিত্রণ সবই হৃদয়গ্রাহী ও যথাসম্ভব স্বাভাবিক এবং স্থানকালের গন্ধরঙ মাখা।” সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ড. সুশীলকুমার দে বলেন, “The drama is bold and original in conceiving those characters, and they are presented not as types but individuals of diversified interest. They are living men and women drawn from all ranks of society, from the high-souled Brahmana to the law-down theif; and the drama includes, in its broad scope farce and tragedy, satire and pathos, poetry and wisdom, kindliness and humanity.” অতএব সব মিলিয়ে যে ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটককে সংস্কৃত নাটক সমূহের শিরোমণির মর্যাদা দান করে বলা হয়, `it is the most Shakespearean of all Sanskrit plays”, তা অকারণ নয়।
Leave a comment