সাবেকী তত্ত্বের সংকটের আলোচনা:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনার ক্ষেত্রে ল্যাস্কির দু’টি গ্রন্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দু’টি গ্রন্থের একটি হল A Grammar of Politics এবং অপরটি হল An Introduction to Politics । প্রথমটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৩১ সালে। প্রথম গ্রন্থটির চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। এই সংস্করণে বইটির শুরুতেই একটি নতুন অধ্যায় সংযুক্ত হয়। এই অধ্যায়টির নাম হল The Crisis in the Theory of the State. A Grammar of Politics-এর চতুর্থ সংস্করণে ভূমিকায় ল্যাস্কি বলেছেন বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর যে সমস্ত পরিবর্তন ও প্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে সেই সব বিষয়কে নিয়েই এই অধ্যায়টির অবতারণা করা হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই অধ্যায়ে ল্যাস্কি উদারনীতিক মতবাদের সমালোচনা করেছেন এবং মার্কসীয় মতবাদের পক্ষে বক্তব্য পেশ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের পরিস্থিতি রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করে। সমকালীন অবস্থার অভিজ্ঞতার আলোকে অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্র সম্পর্কিত সাবেকী ধ্যান-ধারণা ও মতবাদসমূহের ক্ষেত্রে প্রতীয়মান সংকটের পর্যালোচনা করেছেন।
সমকালীন ঘটনাবলী রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বকে প্রভাবিত করে:
ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে যে-কোন মতবাদের উদ্ভব হয় একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক অবস্থার বা ব্যাপক ঐতিহাসিক পটভূমিতে। এই পটভূমি বা ঐতিহাসিক পরিস্থিতির বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা একান্তভাবে অপরিহার্য। তা না হলে কোন মতবাদকেই সহজে এবং সম্যকভাবে অনুধাবন করা যাবে না। তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থের প্রথম পাতাতেই ল্যাস্কি বলেছেন: “No theory of the State is ever intelligible save in the context of its time.” সমকালীন জীবনধারার অভিজ্ঞতার দ্বারা মানুষের রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা প্রভাবিত হয়। রাজনীতিক মতাদর্শের মাধ্যমে মানুষ চেষ্টা করে তার অভিজ্ঞতাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে। সুতরাং উৎপত্তির সমকালীন ঘটনাবলী বা জীবনধারা সম্পর্কে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছাড়া রাষ্ট্র সম্পর্কিত কোন তত্ত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি বা অনুধাবন করা যাবে না। ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্র সম্পর্কিত সাবেকী তত্ত্বের সংকট সম্পর্কে সম্যকভাবে আলোচনার স্বার্থে সংকটের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ব্যাপক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা আবশ্যক।
সমকালীন প্রভাবশালী ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে:
রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বের উপর সমকালীন ঘটনাবলীর প্রভাবকে প্রতিপন্ন করার জন্য অধ্যাপক ল্যাস্কি কতকগুলি উদাহরণের অবতারণা করেছেন। সামাজিক শান্তির জন্য টমাস হবস ছিলেন অতিমাত্রায় উদ্গ্রীব। এ ক্ষেত্রে পিউরিটান বিপ্লবের দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আবার জন লকের সম্মতি তত্ত্বের পিছনে গৌরবময় বিপ্লবের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ম্যাকিয়াভেলী ইতালীর গৃহযুদ্ধের ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আবার হেগেলের ভাববাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রে জার্মানীর নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। অনুরূপভাবে রুশো, গ্রীণ, মার্কস প্রমুখ সকলেই সমকালীন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁদের ভাবনা-চিন্তাকে চিত্রিত করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ একাধিক ঘটনার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভয়াবহ যুদ্ধের পরিণাম, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাংঘাতিক সংকট, অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে জাপানের উত্থান, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য প্রভৃতি বহু ও বিভিন্ন ঘটনা রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা ভাবনার প্রেক্ষাপটে এক নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত করে। এই সমস্ত পরিবর্তনের প্রভাব রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের আকৃতিতে নয়, রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “What is in issue is the nature of the State itself.” সংঘটিত পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে সাবেকী মূল্যবোধ বিভিন্ন সমস্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
সাবেকী মূল্যবোধে সংকট:
বিগত শতাব্দীর সাবেকী মূল্যবোধ এবং রাজনীতিক মতাদর্শ বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। এ প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের এক্তিয়ার, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিগুলির মূল্যায়ন, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা, আইন প্রণয়ন ও প্রশাসন পরিচালনায় বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা, আইন তথা আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে নতুন করে বিচার-বিবেচনা ও মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে উদারনীতিক মতবাদ দীর্ঘকাল ধরে কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। কিন্তু সাবেকী পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। তার ফলে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে নতুন মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে পড়েছে। উদারনীতিক মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই সব ক্ষেত্রে এক ধরনের মূল্যবোধ ছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ার জন্য এই সকল ক্ষেত্রে নতুন করে মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। উদারনীতিক মতবাদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমানাকে সীমাবদ্ধ করার কথা বলা হয়। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকল স্তরেই ক্ষমতা ব্যাপকতর হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ল্যাস্কির অভিমত হল যে, উদারনীতিবাদ প্রবল প্রতিরোধের মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেছেন: “…the challenge to liberal doctrine is clearly a decisive one.” এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকটের আলোচনা করতে গিয়ে ল্যাস্কি কতকগুলি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। এই বিষয়গুলি হল:
-
(ক) উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের সংকট,
-
(খ) আইনের তত্ত্বে সংকট,
-
(গ) সার্বভৌমিকতার সংকট ও বহুত্ববাদ এবং
-
(ঘ) আন্তর্জাতিক আইনের সংকট।
(ক) উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের সংকট
উদারনীতির সমালোচনা: উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শৃঙ্খলা রক্ষা করে, শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তনের ব্যবস্থা করে এবং ব্যাপকভাবে নাগরিকদের দাবি-দাওয়া মেটায়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক সরকার এই সব দায়িত্ব সম্পাদন করে। এই কারণে একে সমর্থন করা হয়। কিন্তু উদারনীতিক ব্যবস্থার সার্থকতা সম্পর্কিত এই বিবরণ বাস্তবে প্রতিপন্ন হয়নি। এই ব্যবস্থা শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তনকে সম্ভব করতে পারেনি এবং সর্বাধিক সংখ্যক নাগরিকের দাবি পূরণ করতে পারেনি। উদারনীতিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ পথে পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না। তা ছাড়া এই ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাহিদারও পরিতৃপ্তি ঘটে না।
উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যাপকহারে দাবি পূরণ করা যায় না: যে-কোন রাজনীতিক সমাজে রাষ্ট্রই হল চূড়ান্ত পীড়নমূলক শক্তি। কিন্তু এই শক্তি প্রযুক্ত হয় তাদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য যারা হল উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিক। একটি বিশেষ শ্রেণী-সম্পর্ক সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The State is the supreme coercive power in any given political society, but it is used to protect and promote in that society the interests of those who own its instruments of production. The State expresses a will to maintain a given system of class relations.” রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে শ্রেণীভিত্তিক, সরকার সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিয়ে গঠিত শ্রেণীর কার্যকর চাহিদা মেটাতে পারে না। এর কারণ হল সেক্ষেত্রে সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। উৎপাদনের উপকরণসমূহের মালিকানা যদি মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তা হলে সেই রাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে সামাজিক দাবি পূরণ করা যায় না। এ রকম রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক শ্রেণীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মালিকানাহীন শ্রেণীর উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে প্রয়োগ করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে কাদের চাহিদা কিভাবে পূরণ করা হবে তা নির্ভর করে সমাজে উৎপাদন উপকরণের মালিকানার প্রকৃতির উপর। যে রাষ্ট্রে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা বর্তমান, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবি পূরণ সম্ভব নয়। আবার উৎপাদনের মুখ্য উদ্দেশ্য যেখানে মুনাফা অর্জন, সেখানে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা কখনই সর্বসাধারণের দাবি পূরণের জন্য কাজ করে না। এই সমস্ত দিক থেকে বলা হয় যে, উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বাধিক ব্যাপক হারে নাগরিকদের চাহিদা পূরণ করা যায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সামাজিক ভিত্তির পুনর্গঠন ব্যতীত সর্বাপেক্ষা ব্যাপকহারে দাবি পূরণ করা যাবে না। এবং এর জন্য প্রয়োজন হল শ্রেণী-সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস।
উদারনীতিক রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন অসম্ভব: উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ পথে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করলে শাসনতান্ত্রিক পথে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সম্পত্তিবান শ্রেণী সবসময় এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে থাকে। উদারনীতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রয়োগ করা হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্যটি হল একটি সুনির্দিষ্ট আইনব্যবস্থাকে বজায় রাখা। এই আইনব্যবস্থাই একটি নির্দিষ্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থা ও শ্রেণী-সম্পর্ক সংরক্ষণের চেষ্টা করে। তাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকশ্রেণী, অর্থাৎ সম্পত্তির মালিক শ্রেণী এই পরিবর্তন চায় না; তারা এর বিরোধিতা করে। এই অবস্থায় নতুন করে শ্রেণী-সম্পর্ক স্থাপন করা দরকার হয়ে পড়ে। তখন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব অনিবার্য: ল্যাস্কি পরিবর্তনের এই পদ্ধতিকে বলেছেন বিপ্লব। যে সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত অবস্থায় থাকে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন সেখানে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাদের হাতে সুযোগ-সুবিধার অধিকার বর্তমান থাকে, তারা এই অধিকারকে অব্যাহত রাখার জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট থাকে। অপরদিকে এই অধিকার থেকে যারা বঞ্চিত, তারা এই ব্যবস্থার বিলোপের ব্যাপারে বিদ্রোহ করে। বঞ্চিত মানুষদের উদ্দেশ্য হল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপরিউক্ত শ্রেণী-সম্পর্ককে পুনর্বিন্যাস করা। এবং তার জন্য বলপূর্বক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছাড়া অন্য কোন উপায় তাদের হাতে থাকে না। ল্যাস্কির অভিমত হল যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য বিপ্লব অনিবার্য। ল্যাস্কির মতানুসারে দুটি আর্থনীতিক শ্রেণীর মধ্যে এই সংগ্রাম সংঘটিত হয়। এবং সার্বভৌম ক্ষমতা দখল করাই হল এই সংগ্রামের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র এই সংগ্রামে সম্পত্তিবান বা ক্ষমতাবান শ্রেণীর পক্ষে তার পীড়নমূলক শক্তি প্রয়োগ করে থাকে।
উপরিউক্ত আলোচনায় অধ্যাপক ল্যাস্কি মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনকে অনুসরণ করেছেন। এবং তিনি বিজ্ঞানসম্মতভাবে উদারনীতিক রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এইভাবে ল্যাস্কি উদারনীতিক গণতন্ত্রের মৌল অনুমানগুলিকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন।
গণতন্ত্রের সংকট: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংকট এবং এই সংকটের স্বরূপ ও কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ল্যাস্কি বিস্তারিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গণতন্ত্র মানুষের কাছে এক সর্বোৎকৃষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হত। কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটে। ল্যাস্কির মতানুসারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ ঘটে। এর কারণ হিসাবে সাবেকী গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কথা বলা হয়। এই ব্যর্থতা হল মানবজাতির সমকালীন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে।
উদারনীতিক গণতন্ত্রে সংকটের স্বরূপ: সাবেকী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র রাজনীতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রসারিত করার ব্যবস্থা করা হয়নি। এই ব্যবস্থায় সার্বজনীন ভোটাধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। অথচ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে। উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কুক্ষিগত থাকে। এবং এরাই উৎপাদনের সঙ্গে বণ্টনব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আর্থনীতিক ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভবন গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। কেবলমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র হতে পারে না। আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গেও গণতন্ত্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। শুধুমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রে অধিকার প্রদান করলেই আর্থনীতিক ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হয় না। বস্তুত রাজনীতিক গণতন্ত্র এবং আর্থনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হল অসঙ্গতিপূর্ণ। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার পরিধির বিস্তৃতিএবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই পরিধির সংকোচন স্পষ্টই পরস্পর-বিরোধী অবস্থার সৃষ্টি করে। সাবেকী গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুসারে সর্বসাধারণের রাজনীতিক অধিকারকে স্বীকার করা হয়; সার্বজনীন ভোটাধিকারকে মেনে নেওয়া হয়। আবার সঙ্গে সঙ্গে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনকেও মেনে নেওয়া হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও অধিকার প্রসারিত হয়, কিন্তু আর্থনীতিক ক্ষেত্রে তা সংকুচিত হয়। উদারনীতিক গণতন্ত্রে এই সুস্পষ্ট বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। আর্থনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে রাজনীতিক গণতন্ত্রের অসামঞ্জস্য প্রকট হয়ে পড়ে। একদিকে ব্যাপক রাজনীতিক অধিকারের স্বীকৃতি, অপরদিকে আর্থনীতিক অধিকার থেকে বঞ্চনা মানুষের মধ্যে অসন্তোষের পাহাড় সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে এ হল সাবেকী গণতান্ত্রিক কাঠামোর দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য। এবং এর ফলে উদারনীতিক গণতন্ত্রে সংকট দেখা দেয়।
রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকটের সৃষ্টি: উদারনীতিক গণতন্ত্র চরম সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণী-সম্পর্কের যে কাঠামো বর্তমান থাকে তার মধ্যে উৎপাদন শক্তির পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব হয় না। উদারনীতিবাদ একটি বিশেষ সামাজিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। সমাজের মধ্যে বিকশিত একটি নতুন সামাজিক শক্তি তার বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকট দেখা দেয়। উদারনীতিবাদে উৎপাদন-উপাদানের ব্যক্তিগত মালিকানার উপর জোর দেওয়া হয়। আইনের কাঠামো প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা কাজ করে। কিন্তু কোন রাজনীতিক মতাদর্শের বৈধতা নির্ভর করে একটি বিষয়ের উপর। এই বিষয়টি হল কত অধিক সংখ্যক ব্যক্তির চাহিদা আইন পূরণ করতে সমর্থ। উদারনীতিক গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে তত্ত্বগতভাবে আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের কথা বলা হয়। কিন্তু এই ধারণাকে কোনভাবেই বাস্তব বলা যায় না। এই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ এবং সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সংরক্ষণই হল আইনের উদ্দেশ্য। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এখানে পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর জোর দেওয়া হয় এবং যুক্তি ও সহিষ্ণুতার কথা বলা হয়।
গণতন্ত্রে জনগণ ও পুঁজিপতিদের মধ্যে বিরোধিতা: পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিরাই উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং মুনাফা অর্জন করাই হল পুঁজিপতিদের প্রধান উদ্দেশ্য। সমাজ বা জনগণের কল্যাণ সাধন তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে থাকে না। কিন্তু জনগণ নিজেদের বৈষয়িক কল্যাণের জন্য উদ্যোগী হয়। রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর জনসাধারণ তাদের বস্তুগত কল্যাণ বৃদ্ধির ব্যাপারে সক্রিয় হয় এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। উদারনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক গণতন্ত্রের পরিধি ব্যাপক হয়। এই অবস্থায় নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জনসাধারণ সরকারের উপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণ তাদের বৈষয়িক কল্যাণের জন্য উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। তখন জনগণের এই রাজনীতিক ক্ষমতা পুঁজিপতি শ্রেণীর আর্থনীতিক ক্ষমতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় পুঁজিপতিরা জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। পুঁজিবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হল পুঁজিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি পুঁজিবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তা হলে পুঁজিপতিরা সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। এবং এইভাবে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। মুষ্টিমেয় মানুষের আর্থনীতিক প্রাধান্যের সঙ্গে যখন জনসাধারণের রাজনীতিক অধিকার ও ক্ষমতার সংঘাত শুরু হয়, তখন পুঁজিবাদ সংকটের সম্মুখীন হয়। এই সময় উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর যাদের মালিকানা আছে তাদের আর্থনীতিক স্বার্থের নিরাপত্তা আর থাকে না। এবং তখনই পুঁজিপতিরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাতিল করে ফ্যাসিবাদকে আহ্বান জানায়। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে কেবল ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থাতেই উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় রাখা সম্ভব হয়। তবে ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে। এবং এই কারণে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বও দীর্ঘদিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না।
উপসংহার: পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা হল মুনাফাকেন্দ্রিক। এ ধরনের অর্থব্যবস্থায় সমাজের আর্থিক অবস্থার ওঠা-নামা ঘটে। অবধারিতভাবে মন্দা ও বেকার অবস্থার সৃষ্টি হয়। জনগণ কিন্তু অর্থনীতির সংকট থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য চেষ্টা করে। তারা সাধ্যমত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মেহনতী মানুষেরা এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় অবলম্বনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তার ফলে সম্পত্তিবান মালিক শ্রেণীর সঙ্গে জনসাধারণের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। পুঁজিপতিরা রাষ্ট্র-শক্তির সাহায্য লাভ করে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করা হয়। এই অবস্থায় গণতন্ত্র এক কাগুজে ঘোষণায় পরিণত হয়। গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়। পুঁজিপতিদের স্বার্থ বিপন্ন হলেই রাষ্ট্রের দুর্দিন, আইন শৃঙ্খলার অবনতি প্রভৃতি সোরগোল তোলা হয়। রাষ্ট্র-যন্ত্রকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। পুঁজিপতিদের হাতের হাতিয়ার হিসাবে যদি রাষ্ট্র থাকে, তা হলে এ ঘটনা ঘটবেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রেণী-কাঠামো অব্যাহত থাকে। এই ধরনের রাষ্ট্রে সম্পত্তিবান মালিক শ্রেণী অর্থব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে এ হল গণতন্ত্রের সংকট।
(খ) আইনের তত্ত্বে সংকট
ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে যেমন সংকটের সৃষ্টি হয়, তেমনি আইনের তত্ত্ব সম্পর্কেও সংকট দেখা দিয়েছে। তাঁর অভিমত হল: “Just as there is a crisis in the theory of the state, so also, there is a crisis in the theory of law.” বিংশ শতাব্দীতে আইনের তত্ত্বের ক্ষেত্রে সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এখন আইনের মৌলিক ভিত্তি ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। এবং আইনের সাবেকী উদারনীতিক মতবাদ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আইনের তত্ত্বে এই সংকট রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকটের সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক ল্যাস্কি প্রথমে আইনের বহুল প্রচলিত বিশুদ্ধ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন এবং সেই তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন।
বিশুদ্ধ মতবাদ: আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকের নাম যুক্ত আছে। তবে এ ক্ষেত্রে হস ও অস্টিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দুই রাষ্ট্র-দার্শনিকের মতানুসারে আইনের পিছনে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা বর্তমান থাকে এবং এই ক্ষমতাই চূড়ান্তভাবে আইন মেনে চলতে বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ আইনকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন ও অনুমোদন অপরিহার্য। আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হল যে, আইন প্রণয়ন করে কোন ব্যক্তি বা আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। তার পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন ও অনুমোদন বর্তমান থাকে। তাই লোকে শাস্তির ভয়ে আইন মান্য করে চলে। আইনের মূল ও সর্বোচ্চ উৎস হল রাষ্ট্র। তাই আইনের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বাধ্যবাধকতার যুক্তি ছাড়াও আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বে আইন মান্য করার ক্ষেত্রে আরও কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়। যেমন বলা হয় যে, আইন মান্য করা হয় কারণ আইন প্রয়োজনীয়। তা ছাড়া আইন হল যুক্তির অভিব্যক্তি। তাই আইন মেনে চলা হয়। আবার আইনের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ লক্ষ্য পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। এই কারণে আইন আনুগত্য লাভ করে। আবার এও বলা হয় যে, আইন হল আচরণের এমন এক অনুশাসন যা সমাজের সর্বাধিক চাহিদা পূরণের সহায়ক। সুতরাং আইন মান্য করা হয়।
আইনের বিশুদ্ধ মতবাদের সমালোচনা: ল্যাস্কি আইন সম্পর্কিত এই বিশুদ্ধ তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তাত্ত্বিক যুক্তির বিচারে না হলেও বাস্তব বিচারে ল্যাস্কি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন।
- (১) এই তত্ত্ব অনুসারে ন্যায়বিচারের ধারণা আইনানুমোদিত নয়। আইনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের ধারণা সম্পর্করহিত।
- (২) আইনের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আলোচ্য তত্ত্বে সামাজিক ও নৈতিক বিচার-বিবেচনার গুরুত্বকে স্বীকার করা হয় না। অথচ বর্তমানে সমাজতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার উপর জোর দেওয়া হয়।
- (৩) আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বটিকে যুক্তিশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু আইন যদি বাস্তবজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তা হলে যৌক্তিকতার বিষয়টি অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কারণে যুক্তিশাস্ত্র নয়, বাস্তব জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের ভূমিকা আলোচনা করা আবশ্যক।
- (৪) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত নিয়মাবলীর সমষ্টি হল আইন। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যসাধন করাই হল আইনের লক্ষ্য। আইনের মধ্যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য প্রতিফলিত হয়। A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “Law, ultimately, therefore, is a body of rules which seek to fulfil the object of the state. ” রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সমাজে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী-সম্পর্ক রক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগের ক্ষমতাকেও প্রয়োগ করা হয়। আইনের প্রতি আনুগত্য আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগের ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। কিন্তু আইন হল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী-সম্পর্কের অভিব্যক্তি। সংশ্লিষ্ট শ্রেণী সম্পর্ক সংরক্ষণের জন্যই আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন একটি বিশেষ শ্রেণী-স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ সমাজের একটি বৃহৎ অংশের দাবি আইন পূরণ করতে পারে না। তাই আইন সমাজের এই অংশের আনুগত্য আদায় করতে পারে না।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ব্যাখ্যা: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে কেবল মার্কসীয় মতবাদের মাধ্যমে আইনের বিষয়বস্তু যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ একমাত্র মার্কসীয় ধারণাতেই শ্রেণী-সমাজ ও শ্রেণী-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই ধারণা অনুসারে শ্রেণীহীন সমাজ ছাড়া আইনের দৃষ্টিতে সমতার কথা অর্থহীন। ল্যাঙ্কি মন্তব্য করেছেন: “There cannot be equality before law except in a narrowly formal sense, unless there is a classless society.” Q সমাজে উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বর্তমান, সেখানে সম্পত্তিবান শ্রেণীর আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে আইন নিযুক্ত থাকে। উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকলে এই মালিকানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণী-সম্পর্ক রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অনুকূল আইনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। শ্ৰেণী-সম্পর্ককে আইন কখনই অতিক্রম করতে পারে না। যে আর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রতিফলন আইনের মধ্যে ঘটে, তার দ্বারাই আইনের চেহারা-চরিত্র নির্ধারিত হয়। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Law cannot transcend the relations it is intended to enforce. Its ultimate postulates are never self-determined but given to it by the economic system of which it is the expression.”
সমাজভেদে আইনের প্রকৃতি: সকল সমাজব্যবস্থাতেই আইনের কাজ হল সম্পত্তিবান বা মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ। কারণ সকল সমাজব্যবস্থাতেই এই শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থকে জনগণের স্বার্থ হিসাবে এবং এই শ্রেণীর যুক্তিকেই আইনের যুক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। এই শ্রেণীর স্বার্থেই সমকালীন আইন প্রণীত হয় এবং সমকালীন প্রশাসন পরিচালিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামস্ত শ্রেণীর স্বার্থে আইন প্রণীত ও প্রযুক্ত হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পুঁজিপতিদের স্বার্থেই আইনের ব্যবস্থা বিন্যাস করা হয়। তবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের চেহারা-চরিত্র পৃথক প্রকৃতির হয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উৎপাদনের উপাদানের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের লক্ষ্য হল সামগ্রিকভাবে সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: ল্যাস্কি আইন সম্পর্কিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গেও আলোচনা করেছেন। আইন সম্পর্কিত সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বা শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইন প্রণীত হয় না। এ ক্ষেত্রে আইনের মুখ্য লক্ষ্য হল শ্রেণী-কাঠামো অব্যাহত রাখা এবং শ্রেণী-স্বার্থ রক্ষা করা। সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত ও প্রযুক্ত নিয়মাবলীই হল আইন। আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তি বা রাষ্ট্রের সমর্থন বর্তমান থাকে।
উপসংহার: প্রচলিত আইনের মাধ্যমে সমাজের সকলের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি পূরণ করা যায় না। আইনের সাহায্যে তা করতে গেলে সমাজে যে শ্রেণী-কাঠামো বর্তমান তার বিলোপ সাধন আবশ্যক। সমাজের উৎপাদন-উপাদানগুলি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কুক্ষিগত থাকে। সমাজে শ্রেণী-কাঠামো প্রকট রূপ ধারণ করে। এই অবস্থার অপসারণ সহজে সম্ভব নয়। তাই আইন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। তাই পুঁজিবাদী সমাজে আইনের সংকট তীব্রতর হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপর পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণী কাঠামো, শ্রেণী-সম্পর্ক প্রভৃতি অবাধে অব্যাহত থাকে। উদারনীতিক উপায়ে বা শান্তিপূর্ণ পথে এই অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব প্রতিপন্ন হয়। বৈপ্লবিক পরিবর্তনও সম্ভব হয় না। আবার প্রচলিত আইনের মাধ্যমে জনসাধারণের চাহিদারও সন্তুষ্টি সাধন সম্ভব হয় না। এইসবের পরিণতি হিসাবে আইনের সংকট এড়ান যায় না।
(গ) সার্বভৌমিকতার সংকট ও বহুত্ববাদ
বহুত্ববাদের আবির্ভাব: রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকট সৃষ্টির আর একটি কারণ হল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরুদ্ধে বহুত্ববাদী আক্রমণ। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বা সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে বহুত্ববাদী ধারণার সৃষ্টি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এবং তার অব্যবহতি পরে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরুদ্ধে বহুত্ববাদীরা বক্তব্য রাখেন। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বক্তব্যের এই ধারাকে বহুত্ববাদ বলে। প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ও স্বৈরী ক্ষমতার দাবির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই বহুত্ববাদী ধারণার সূচনা হয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি এবং অন্যান্য সামাজিক সংঘ-সংগঠনের বিরোধের ফলশ্রুতি হিসাবে সার্বভৌমিকতার এই বহুত্ববাদী ধারণা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বহুত্ববাদের জন্মের কারণ অংশত যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান হওয়ার বাসনার মধ্যেই বর্তমান। তিনি বলেছেন: “In part pluralism was born of reaction from the Moloch-like demands of the state in war-time.”
বহুত্ববাদী প্রতিক্রিয়ার দুটি কারণ: রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরুদ্ধে বহুত্ববাদী প্রতিক্রিয়ার দুটি মূল কারণ বর্তমান। এই দুটি কারণ হল:
- (১) আইনানুসারে রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান হিসাবে দাবি করা হয়।
- (২) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা হয় যে, নিজের রাজ্যক্ষেত্রের মধ্যে সকলের সামগ্রিক স্বার্থের প্রতিনিধি হল রাষ্ট্র। সুতরাং জনগণের আনুগত্যের উপর রাষ্ট্রের চূড়ান্ত দাবি বর্তমান।
সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদী তত্ত্বকে অধ্যাপক ল্যাস্কি স্বীকার করেননি। বস্তুত বহুত্ববাদী প্রবক্তাদের মধ্যে ল্যাস্কির নাম অগ্রগণ্য। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। আইনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরম ও ব্যাপক ক্ষমতার দাবিকে তিনি নিতান্তই একটি আনুষ্ঠানিক বিষয় হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এই দাবির কোন যোগ নেই। তা ছাড়া রাষ্ট্র জনগণের আনুগত্যের উপর চূড়ান্ত অধিকার দাবি করতে পারে না। রাষ্ট্র তার এলাকার মধ্যে সমগ্র জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সমালোচনা: রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তি আনুগত্য প্রদর্শন করে। কিন্তু ব্যক্তির এই আনুগত্য একমুখী নয়। এ হল বহুমুখী। আবার ব্যক্তির আনুগত্য স্থিতিশীল নয়, পরিবর্তনশীল। বহুত্ববাদীদের মতানুসারে সমাজের বিভিন্ন সংঘ-সমিতির মধ্যে রাষ্ট্র হল অন্যতম। রাষ্ট্র সমগ্র জনগণের বা সমাজের সামগ্রিক স্বার্থের প্রতিনিধি নয়। বিভিন্ন স্বার্থকে কেন্দ্র করে বহু সংঘ-সমিতির সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি এই সমস্ত সমিতির সদস্য হয়। কারণ এই সমিতিগুলিও ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে থাকে। সুতরাং সমাজের বহু ও বিভিন্ন সংঘ সমিতির মধ্যে রাষ্ট্র অন্যতম। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতা অসীম বা অবাধ হতে পারে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। ব্যক্তির আনুগত্য লাভের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন অগ্রাধিকার থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার ব্যক্তির কাছে অর্থহীন। তার আনুগত্যের ব্যাপারে ব্যক্তি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য তার অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের আইন তার চাহিদা পূরণে কতটা সক্ষম তার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তি তার আনুগত্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বহুত্ববাদের সারমর্ম: বহুত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে ল্যাস্কির অভিমত হল সামাজিক জীবন হল জটিল এবং এর প্রকৃতি বহুত্ববাদী। কোন বিশুদ্ধ আইনগত তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রকৃতি পর্যালোচনা করা যায় না। বিশুদ্ধ আইনী তত্ত্ব এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আবার রাজনীতিক বিজ্ঞতা বা নৈতিক অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র অধিকতর আনুগত্যের দাবি তুলতে পারে না। তা ছাড়া বহুত্ববাদীদের আরও বক্তব্য হল যে একটি ক্ষমতার ধারণার উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে। সার্বভৌম ক্ষমতা বলতে রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতাকে বোঝায়। এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে। এই কারণে দেখা যায় যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে বলবৎ করে।
বহুত্ববাদের সীমাবদ্ধতা: রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদকে সমর্থন করা যায় না। তেমনি আবার সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বকেও স্বীকার করা যায় না। এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে সার্বভৌমিকতার তত্ত্বে সংকট। এই সংকটটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। রাষ্ট্র হল শ্রেণী-সম্পর্কের মাধ্যম। এই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বহুত্ববাদ ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র হল উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিক শ্রেণীর হাতের একটি হাতিয়ারস্বরূপ। এ কথা মেনে নিলে শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করাই হবে বহুত্ববাদের মৌলিক লক্ষ্য। শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ক অব্যাহত থাকলে বহুত্ববাদ অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ শ্রেণী-সম্পর্ক এবং মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও ব্যাপক সার্বভৌম ক্ষমতা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থাকে এবং সেই সঙ্গে প্রচলিত সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের হাতে চরম ক্ষমতার অস্তিত্ব অপরিহার্য। সমাজের যে শ্রেণী উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিক এবং সেইগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, রাষ্ট্র হল সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর হাতের প্রশাসনিক হাতিয়ার। বহুত্ববাদীরা চান রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হল শ্রেণী-কাঠামোর অবসান। শ্রেণী-কাঠামো ভেঙে ফেলতে না পারলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অথচ বহুত্ববাদীরা শ্রেণী কাঠামোকে ভেঙে ফেলার কথা বলেননি। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করলেই শ্রেণী-কাঠামোর পরিবর্তন করা যায় না। বলা হয় যে বহুত্ববাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদের বিকাশকে সম্ভব করে তোলা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের এক্তিয়ারকে সীমাবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বহুত্ববাদীরা শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ককে মেনে নিয়েছেন। এবং এরই ভিত্তিতে বহুত্ববাদের ইমারত গড়তে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু এই উদ্যোগ অর্থহীন, কারণ তা অসঙ্গতিপূর্ণ। শ্রেণী শাসিত সমাজে বহুত্ববাদের বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে না।
উপসংহার: বহুত্ববাদকে কার্যকর করতে হলে শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্কের পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু উদারনীতিক উপায়ে বা শান্তিপূর্ণ পথে তা সম্ভব নয়। আবার আমূল পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবও ঘটছে না। সুতরাং শ্রেণী-শাসিত সমাজ ও বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ক বজায় থাকবে। এবং এই ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব অব্যাহত থাকবে। অথচ একত্ববাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হয় এবং গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। তার ফলে রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকটের সৃষ্টি হয়।
(ঘ) আন্তর্জাতিক আইনের সংকট
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: ল্যাস্কি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘সংকট’ শীর্ষক অধ্যায়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বে সংকটের কথা বলতে গিয়ে উদারনীতিক গণতন্ত্র, আইন, সার্বভৌমিকতা প্রভৃতি ধারণাগুলির ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংকটের কথা বলেছেন। এবং তারপর তিনি আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সংকট প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক আইনের ধারণায় কেন এবং কিভাবে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। ল্যাস্কি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের এক আন্তরিক প্রবক্তা। এক ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন। রাষ্ট্রের তত্ত্বে সংকট প্রসঙ্গে আলোচনার প্রাক্কালে ল্যাস্কি আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সংকট নিয়ে আলোচনার উপর জোর দিয়েছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে জাতীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতিও সমকালীন আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ল্যাস্কি আর্থনৈতিক উপাদানকে মূল ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এবং এ ক্ষেত্রে তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের প্রভাব: আন্তর্জাতিক আইনের সংকট আলোচনার ক্ষেত্রে ল্যাস্কির দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের প্রভাব বিশেষভাবে বর্তমান। এই সময়ে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে যে কেন্দ্রীয় সমস্যার সৃষ্টি হয় তার মূল সমকালীন আর্থনীতিক সম্পর্কের মধ্যেই বর্তমান। ল্যাস্কির মতানুসারে প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে সমগ্র মানবজাতি কার্যত এক আন্তর্জাতিক নির্ভরশীলতার নিয়ম-নীতির অধীন হয়ে পড়ে। কারণ এই সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। যোগাযোগের মাধ্যমগুলির মাধ্যমগুলির বিকাশ ও বিস্তার সাধিত হয়। তার ফলে বিশ্ববাজারের সৃষ্টি হয়। বিশেষত আর্থনীতিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য প্রয়োজনেও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। এ রকম অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা যে-কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার প্রচলিত ধারণা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ল্যান্ধি বিশ্ববাজারের সৃষ্টি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব মূলত এই দু’টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক আইনের সংকট সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ল্যাস্কি প্রদত্ত আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা: আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির সংজ্ঞা আলোচনা করা আবশ্যক। রাষ্ট্র, তার নাগরিক ও অন্যান্য সংঘ-সংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য থাকে জাতীয় আইন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রাসঙ্গিক নিয়মকানুনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য আছে আন্তর্জাতিক আইন। ল্যাস্কি তাঁর An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক আইন বলতে সেই সমস্ত নিয়মকানুন ও বিধিব্যবস্থার সমষ্টিকে বোঝায় যা রাষ্ট্রসমূহ ও তাদের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সংরক্ষণের জন্য আবশ্যক। A Grammar of Politics: “International law may be defined as the body of rules which govern the relations between the states; and its binding force depends upon their consent to observe the rules it imposes.” অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন হল কতকগুলি নিয়মকানুনের সমষ্টি। এগুলির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় আন্তঃ-রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক। তা ছাড়া এগুলির প্রয়োগযোগ্যতা রাষ্ট্রসমূহের সম্মতির উপর নির্ভরশীল।
নিজস্ব প্রয়োগ-যোগ্যতার অভাব: আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলার ব্যাপারে কোন রকম বাধ্যবাধকতা নেই। এই আইনের পিছনে রাষ্ট্রের সম্মতি থাকে। তাই আন্তর্জাতিক আইন প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রসমূহের সম্মতির উপর আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা বা কার্যকারিতা নির্ভরশীল। A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The validity of International law depends upon their consent in its operation.” তা না হলে এই আইনের নিজের কোন প্রয়োগ-যোগ্যতা নেই। আন্তর্জাতিক আইনের মূল্য বা কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের সম্মতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক আইন যদি কোন রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়, তা হলেই যথার্থ কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। রাষ্ট্রসমূহের উপর আন্তর্জাতিক আইন যদি বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য না হয়, তা হলে এই আইনের প্রয়োগ-যোগ্যতা তাদের সম্মতির উপর নির্ভরশীল থাকবে। এবং রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের অভিপ্রায়ের অধীন হয়ে পড়বে।
নিজের সুবিধার জন্য রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে: রাষ্ট্রসমূহ স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলে। কারণ এই আইন মেনে চললে তাদের সুবিধাই হয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে রাষ্ট্রগুলির সম্মতি প্রদানের বিষয়টি তাদের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকেই গড়ে উঠে। বর্তমানে আর্থ সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রই একা চলতে পারে না। আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ক্রমশ বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বহুলাংশে শিথিল হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রসমূহের আনুগত্য অর্জন করেছে। কিন্তু কখনো রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে বা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র নির্দ্বিধায় আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে। রাষ্ট্রসমূহ স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সাধারণত নিজেদের সুবিধার বিচারে এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক আইন স্বীকার করে নেয়।
জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইন: রাষ্ট্রের উপর জাতীয় আইন বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করার উপায় নেই। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের জাতীয় আইন যদি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়, তা হলে আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা স্বীকৃত হয় না; জাতীয় আইনেরই বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ জাতীয় আইনের প্রাধান্য যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে অন্য কোন আইনের বৈধ কর্তৃত্ব আর থাকে না। জাতীয় আইনের উপরে আন্তর্জাতিক আইনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না নিলে আন্তর্জাতিক বৈধতা বিপন্ন হয়। জাতীয় আইন লঙ্ঘিত হলে লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি প্রদান করা হয়। অপর পক্ষে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হলে লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রকে শাস্তি প্রদানের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই প্রকৃত প্রস্তাবে এই আইনের সঠিক কোন বৈধ ভিত্তি নেই। এবং আন্তর্জাতিক আইনকে অর্থহীন করে তোলার পিছনে মূল দায়িত্ব হল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি: আন্তর্জাতিক সমাজের সৃষ্টি হয় জাতীয় রাষ্ট্রগুলিকে নিয়েই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই এই আন্তর্জাতিক সমাজের ধারণা ক্রমশ গুরুত্ব লাভ করে। এই অবস্থায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। জাতিসংঘ (League of Nations) এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation) হল এ রকম দু’টি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সংগঠন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগযোগ্যতা বৃদ্ধি করাই হল এই সংগঠনের মুখ্য লক্ষ্য। কিন্তু অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অভিপ্রেত কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এর কারণ হল সামগ্রিক যুদ্ধের আশংকা এখনও বর্তমান। আক্রমণকারী রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সামর্থ্য আছে কিনা তার উপরই এই আইন মান্য করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নির্ভরশীল। বর্তমানে আস্তঃ-রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ক্ষমতা-কেন্দ্রিক রাজনীতির দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ-যোগ্যতা রাষ্ট্রসমূহের সম্মতির উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। এই কারণে এখনও এই আইনের প্রতি আনুগত্যের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়নি।
শ্রেণী-সম্পর্কের প্রভাব: ল্যাস্কি আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রকৃতির উপর জোর দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণের পক্ষপাতী। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বলেছেন কোন রাষ্ট্রের প্রকৃতি শ্রেণী সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। কারণ রাষ্ট্রমাত্রেই একটি বিশেষ শ্রেণী-সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যস্ত থাকে। এবং চূড়ান্ত বিচারে আন্তর্জাতিক আইনও এই শ্রেণী-সম্পর্কের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র যে শ্রেণী-সম্পর্ক রক্ষা করে চলে তা আর্থনীতিক সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণাধীন। কোন একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র তার এই আর্থনীতিক সম্পর্ককে সার্বভৌম ক্ষমতার দ্বারা বহির্বিশ্বে বিস্তারিত করে থাকে। এবং এই সার্বভৌম ক্ষমতার অস্তিত্বের কারণেই আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার অবসান ব্যতিরেকে আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা যায় না।
আন্তর্জাতিক আইনের সংকটের প্রকৃতি: বর্তমানে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজের ধারণা এখন অনেক বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু জাতীয় রাষ্ট্রের শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ক অব্যাহত আছে। জাতীয় রাষ্ট্রগুলিতে অর্থব্যবস্থা ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ একটি শ্রেণী। এই শ্রেণীটি হল উৎপাদনের উপাদানের মালিক এবং উৎপাদন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণকারী। এই ধরনের আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থায় মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন পরিচালিত হয়। অতি-উৎপাদনের জন্য বিক্রয় বাজারের প্রসার জরুরী হয়ে পড়ে। তখন বিদেশী বাজার দখলের জন্য উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়। এইভাবে সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্যবাদের। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিদেশী বাজার দখলের জন্য যুদ্ধের সামিল হয়। এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার নগ্ন প্রকাশ ঘটে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। এই সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে জাতীয় রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। কারণ জাতীয় রাষ্ট্রের শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্কের অবসান ব্যতিরেকে তা সম্ভব নয়। এবং এই অবসান বাস্তবে অসম্ভব। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনের সংকট এড়ান যাবে না। এই সংকটের প্রকৃতিটা হল এ রকম : পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ক অব্যাহত আছে। তার ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাও বহাল আছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজের ধারণা অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ-যোগ্যতা বৃদ্ধি বা এই আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন বৃদ্ধি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। অথচ এই দুই অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ক বজয়া থাকলে মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন এবং অতি-উৎপাদন হবেই। এর থেকে সাম্রাজ্যবাদের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী এবং সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ ডেকে আনবে। যুদ্ধের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আইনের সংকট সৃষ্টি করবে। সুতরাং এই সংকট নিবারণের জন্য শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্কের অবসান আবশ্যক। কিন্তু শ্রেণীবিন্যস্ত রাষ্ট্রগুলি এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে অপারগ। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনের সংকটও অনপনেয়।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বড় বাধা: জাতিসংঘ এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ এই দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠন আইনের সফল প্রয়োগের ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই চেষ্টা বড় একটা সফল হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে সাফল্যের বিচারে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কিছুটা এগিয়ে। যাইহোক রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা হল জাতিসংঘের অপমৃত্যুর অন্যতম কারণ এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্যের পথে একটি বড় বাধা। অধ্যাপক ল্যাঙ্কির অভিমত হল আন্তর্জাতিক আইনের সফল প্রয়োগকে সুনিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার অবসান অপরিহার্য। কিন্তু কোন রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতাকে ছাড়তে রাজী নয়। আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্র এ রকম কোন অভিপ্রায় ব্যক্ত করেনি। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনের সংকট সাধনের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা স্বীকার করে নিলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ যোগ্যতা বা প্রাধান্য সম্পর্কে সংশয়-সন্দেহ থেকেই যাবে। রাষ্ট্র যদি তার সার্বভৌম ক্ষমতাকে বর্জন করতে সম্মত না হয় তা হলে আন্তর্জাতিক আইনের সফল প্রয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে না। সুতরাং সমস্যাটি হল ‘আন্তর্জাতিক আইন বনাম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা।
জাতীয় আইনের উপর আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য: আন্তর্জাতিক আইনের আলোচ্য সংকট নিরসনের ব্যাপারে অস্ট্রিয়ার আইনবিদরা এক বিকল্প পথের কথা বলেছেন। এঁদের মতানুসারে জাতীয় আইনের উপরে আন্তর্জাতিক আইনকে প্রাধান্য প্রদান করা প্রয়োজন। তা হলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ যোগ্যতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। ল্যাস্কির মতানুসারে অস্ট্রিয় গোষ্ঠীর এই উদ্যোগ যুক্তির দিক থেকে যথার্থ, কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত। A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন: “Their effort, which is logically sound, is nevertheless unrealistic.” আন্তর্জাতিক আইনকে জাতীয় আইনের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা বা না-করার বিষয়টি পুরোপুরি প্রত্যেক সার্বভৌম রাষ্ট্রের একেবারে নিজস্ব বিষয়। কোন রাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত কারোর উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। প্রতিটি রাষ্ট্র হল সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই নিজে স্বেচ্ছায় স্বীকার না করলে অন্য কেউ তা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। এবং জাতীয় রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক আইনকে প্রাধান্য প্রদানের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি বা দেখায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে গুটিকয়েক রাষ্ট্র এ রকম নীতির কথা ব্যক্ত করেছে। তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। সর্বোপরি বাস্তবে আন্তর্জাতিক আইনের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করতে এই রাষ্ট্রগুলিও সক্ষম হবে কিনা সে বিষয়েও সংশয়-সন্দেহ থেকেই যায়। অর্থাৎ এই পথেও আন্তর্জাতিক আইনের আলোচ্য সংকট নিবারণ সম্ভব নয়।
উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয় রাষ্ট্রের শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্কের পটভূমিতে আদর্শ আন্তর্জাতিক সমাজের ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় না। এটা সম্ভব করতে হলে প্রতিটি রাষ্ট্রকে সার্বভৌম ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। এর কারণ হল সমকালীন শ্রেণী-কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রের পক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতা একান্তভাবে অপরিহার্য। তার ফলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ-যোগ্যতা রাষ্ট্রসমূহের সম্মতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই আইনের বৈধতার মাত্রা তথা লঙ্ঘনের মাত্রা উভয়ই রাষ্ট্রের স্বেচ্ছা-সম্মতির উপর নির্ভরশীল থাকে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনকে পূর্ণাঙ্গ রূপে পরিণত করতে হলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি রাষ্ট্রগুলিকে বাধ্যবাধকতা ব্যক্ত করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল এই যে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের পরিস্থিতিতে তা কার্যত অসম্ভব। একে সম্ভব করে তুলতে হলে আর্থনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মৌলিক পরিবর্তন সাধন একান্তভাবে অপরিহার্য।
Leave a comment