প্রশ্নঃ রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য আলােচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যেকার পার্থক্যগুলাে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বর্তমান সভ্যজগতে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। রাষ্ট্র নামক এ রাজনৈতিক সংগঠনটি সভ্যতার বহু পর্যায় অতিক্রম করে আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এ সংগঠনের মধ্যেই আমরা বসবাস করি, লালিত-পালিত হই এবং মৃত্যুবরণ করি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল যথার্থই বলেছেন, মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাষ্ট্র একটি বিবর্তনমূলক ও সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির উত্তম জীবনযাপনের জন্য রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্যঃ রাষ্ট্র ব্যক্তির প্রয়ােজনে সৃষ্টি হলেও রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্য নিম্নে তুলে ধরা হলাে-

(১) উদ্দেশ্যগত পার্থক্যঃ উদ্দেশ্যগত দিক হতে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। হলাে প্রজাশাসন এবং প্রজাকল্যাণ সাধন করা। আর ব্যক্তির উদ্দেশ্য হলাে রাষ্ট্র থেকে কল্যাণ ও সুশাসন আদায় করে নেয়া।

(২) পৃথক সত্তাঃ রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি হলাে স্বতন্ত্র সত্তা। রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ও বিবর্তিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ব্যক্তি একটি প্রাকৃতিক জীব যা জনগােষ্ঠী গঠনে সহায়তা করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র এবংব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা।

(৩) বিকাশধারাঃ এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়। রাষ্ট্র গড়ে ওঠেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে ব্যক্তির জন্ম হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। কাজেই বলা যায়, উভয় সত্তার বিকাশধারা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।

(৪) বিষয়গত পার্থক্যঃ বিষয়গত ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের বিষয় ব্যাপক ও বিস্তৃত, পক্ষান্তরে ব্যক্তির বিষয় সংকীর্ণ। অধ্যাপক লাস্কি এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “The function of the state is multifarious while the genction of the individual is confinxed to only demography.” অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্ম বহুমুখী এবং ব্যক্তির কর্ম জনসংখ্যামুখী।

(৫) ধারণাগত পার্থক্যঃ রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে বৈসাদৃশ্যের আরেকটি ক্ষেত্র হলাে এটি। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তবে রাষ্ট্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলেও ধর্মনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। পক্ষান্তরে, ব্যক্তি একটি অস্থিতিশীল প্রত্যয়, যা কখনাে রূপান্তরিত হয় রাজনৈতিক জীবে, কখনাে বা সামাজিক, কখনাে বা ধর্মীয় প্রাণীতে।

(৬) ভাববাদী ও বস্তুবাদী ধারাঃ রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্যের অন্যতম প্রধান সূচক হলাে এটি। কেননা, রাষ্ট্র একটি আদর্শবা ভাববাদী ধারণা। রাষ্ট্র হলাে বিমূর্ত ধারণা। একেবাস্তবে দেখানাে সম্ভবপর নয়। অন্যদিকে, ব্যক্তি হলাে বাস্তববাদী ধারণা বা মূর্ত প্রত্যয়, যাকে বাস্তবে দেখানাে সম্ভবপর।

(৭) মানুষের প্রয়ােজনে রাষ্ট্রের সৃষ্টিঃ রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন দুটি সত্তা। রাষ্ট্র মানুষের প্রয়ােজনে ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট একটি বিমূর্ত প্রত্যয়। পক্ষান্তরে, ব্যক্তি হলাে মূর্ত প্রত্যয় এবং মানুষের প্রয়ােজনেই রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম। অর্থাৎ ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়।

(৮) সাংগঠনিক পার্থক্যঃ সাংগঠনিক ইস্যুতেও রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। জনসমষ্টি, ভূ-খণ্ড, সরকার ও সার্বভৌম ক্ষমতা- এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। অন্যদিকে দেহ, মন, আত্মা প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে ব্যক্তির জন্ম।

(৯) উপাদানগত পার্থক্যঃ রাষ্ট্র হলাে রাজনীতির মুখ্য বিষয় বা প্রধান উপাদান। রাষ্ট্র একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ধারণা। ব্যক্তিই রাজনীতির মুখ্য বিষয় তথা রাষ্ট্রকে সচল করে রাখে। অন্যদিকে, Demography বা জনগােষ্ঠীর মুখ্য বিষয় ব্যক্তি। রাষ্ট্রের জনগােষ্ঠীর মূল উপাদান বা সত্তা হলাে ব্যক্তি।

(১০) পরিবর্তনগত পার্থক্যঃ পরিবর্তন বা সংস্কার রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই পদ্ধতিতে সাধিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়- (১) সংবিধান সংশােধন এবং (২) বিপ্লবের মাধ্যমে। অন্যপক্ষে, ব্যক্তির পরিবর্তন সাধিত পাঁচ ভাবে। এগুলি হলাে- (১) রাজনৈতিকভাবে, (২) সামাজিকভাবে, (৩) অর্থনৈতিকভাবে, (৪) ধর্মীয়ভাবে এবং (৫) মনস্তাত্ত্বিকভাবে।

(১১) আবিষ্কার ও গবেষণার ক্ষেত্রেঃ রাষ্ট্র হলাে আবিষ্কার ও গবেষণার ক্ষেত্র। অন্যদিকে ব্যক্তি আবিষ্কার ও গবেষক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তির আবিষ্কার ও গবেষণার ফলে রাষ্ট্রের উন্নতি সাধিত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি উভয় প্রত্যয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনেতিক, ধর্মীয়, মনস্তাত্ত্বিক প্রভতি ইস্যুতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি ব্যতীত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি ব্যক্তির কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের উপস্থিতিও অপরিহার্য।