চুক্তিবাদী আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতিক শাস্ত্রে রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা বিশেষ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাষ্ট্রের আবির্ভাব, আবির্ভাবের কারণ, রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গে চুক্তিবাদ গুরুত্বপূর্ণ ধারণার জন্ম দেয়। প্রধানত সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্র সম্পর্কিত চুক্তিবাদী ধারণার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্র সম্পর্কিত চুক্তিবাদী আলোচনায় তিনটি ধারণার সুস্পষ্ট প্রাধান্য অনস্বীকার্য। এই তিনটি ধারণা হল: প্রাকৃতিক অবস্থা সম্পর্কিত ধারণা, স্বাভাবিক আইনের তত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণা এবং সামাজিক চুক্তির ধারণা। এই তিনটি ধারণার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িক দার্শনিক, রোমান আইন, বাইবেলের ‘Old Testament মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, উলিয়াম অব ওকাম, বুকানন, অ্যালথুসিয়াস, প্রোটিয়াস, রিচার্ড হুকার প্রমুখ চিন্তাবিদ্ ও উৎসসমূহ উল্লেখযোগ্য।

জোহানেজ অ্যালথুসিয়াস (Althusius) রাষ্ট্রকে একটি লোকসমাজ হিসাবে দেখেছেন। এই লোকসমাজ গঠিত হয়েছে নগর ও প্রদেশের সমন্বয় এবং একটি সাধারণ আইনে এই লোকসম্পদ আবদ্ধ। চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠীসমূহের সংযুক্তির ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। সারিবদ্ধ অসংখ্য সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয়েছে বহু সামাজিক গোষ্ঠী। রাষ্ট্র হল এই সমগ্র সামাজিক গোষ্ঠীর একটি। সার্বভৌম ক্ষমতা জনসাধারণের হাতেই ন্যস্ত। জনসাধারণ যৌথ সংস্থা হিসাবে এই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। চুক্তির মাধ্যমে যৌথ সংস্থা এই সার্বভৌম ক্ষমতা শাসকের হাতে ন্যস্ত করে। এই ক্ষমতা শাসকেরা হারিয়ে ফেলতে পারে। তখন যৌথ সংস্থার হাতেই সেই ক্ষমতার প্রত্যাবর্তন ঘটে।

প্রোটিয়াসের (Grotius) মতবাদ সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তিশীল। হবসের রাষ্ট্রপরিকল্পনা এই মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। প্রোটিয়াসের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ। এই সমাজ সকল শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে গঠিত এবং মানুষের বিবেকবুদ্ধির ভিত্তিতে সংগঠিত। গ্রোটিয়াসের অভিমত অনুযায়ী মানুষ সামাজিক জীব। রাষ্ট্র একটি জনসমাজ। এই জনসমাজ প্রাকৃতিক বিধি-ব্যবস্থার আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং ব্যাপক ও সুসংহত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্র একটি আইনগত ধারণা। সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে ন্যূনতম শর্তাদি ও মূল্যায়নের মাধ্যমে। প্রোটিয়াস এগুলিকেই বলেছেন আইন। তিনি আইন বলতে প্রাকৃতিক বিধানসমূহকেই বুঝিয়েছেন।

রিচার্ড হুকার (Hooker) চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক্‌কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন। হুকারের অভিমত অনুযায়ী সমাজ সংগঠনের উৎস হল মানুষ। রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলে আছে মানুষের সাধারণ স্বীকৃতি, যুক্তির অনুমোদন ও প্রকৃতির শিক্ষা। জনসাধারণের সম্মতি ব্যতিরেকে শাসন কর্তৃপক্ষের শাসন বা নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকতে পারে না।

হবস, লক্ ও রুশো: সামাজিক চুক্তি মতবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তিবিষয়ক একটি কাল্পনিক মতবাদ। নানা দিক দিয়ে মতবাদটি তাৎপর্যপূর্ণ। মতবাদটি কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তিই ব্যাখ্যা করে না, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ধারণেও সাহায্য করে। আলোচ্য মতবাদটির সাহায্যে রাষ্ট্রের প্রকৃতিও ব্যাখ্যা করা যায়। সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলে মানুষের সচেতন প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিকতার ধারা এনেছে।

মতবাদটির ইতিহাস দীর্ঘ। তবুও ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে মতবাদটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে মতবাদটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই সময় রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারের বিরুদ্ধে চুক্তিবাদী মতবাদটি ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া ব্যক্তি-স্বাধীনতা, গণ সার্বভৌমত্ব এবং বিপ্লবের অধিকারের পক্ষেও সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এই সময় রাজনীতিক চিন্তার ক্ষেত্রে মতবাদটি ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অনেকের মতে ইংল্যাণ্ডের রিচার্ড হুকারই প্রথম সামাজিক চুক্তি মতবাদটিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটি যুক্তিগ্রাহ্য রূপ দিয়েছেন আবার ওলন্দাজ আইনবিদ হুগো প্রোটিয়াস-এর লেখায় সামাজিক চুক্তি মতবাদ সমৃদ্ধ হয়। তবে মূলত তিনজন চিন্তাবিদ মতবাদটির প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা হলেন সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরাজ দার্শনিক টমাস হবস ও জন লক্ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী চিন্তাবিদ জ্যা জ্যাক রুশো। এই তিনজন রাষ্ট্র-দার্শনিক ‘চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী’ (Contractualists) হিসাবে পরিচিত। সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যান্য সমর্থকদের মধ্যে মিলটন, হুকার, পুফেনডরফ, প্রোটিয়াস প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আনুগত্যের উৎস ব্যাখ্যা: দরাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে সামাজিক চুক্তি মতবাদ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই মতবাদের মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তা ছাড়া রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্যের কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও চুক্তিবাদের বক্তব্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদনকারীদের মধ্যে দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চুক্তি যারা সম্পাদন করে বা যারা চুক্তির অঙ্গীভূত তারা চুক্তির শর্তাদি মান্য করে চলতে দায়বদ্ধ। সুতরাং যদি ধরে নেওয়া হয় যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, তা এই ধারণার ভিত্তিতে রাজনীতিক আনুগত্যের (Political obligation) উৎস অনুধাবন করা যায়।

কর্তৃত্বের বৈধতা নির্ধারণ: আবার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বৈধতার বিষয়েও সামাজিক চুক্তি মতবাদ থেকে ধারণা লাভ করা যায়। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্পত্তির অভিব্যক্তি ঘটে। জনসাধারণের সম্মতি বৈধতার সৃষ্টি করে। সুতরাং এই চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বৈধতাযুক্ত হয়। অর্থাৎ এই চুক্তিই হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বৈধতার ভিত্তি। সম্পাদিত চুক্তির স্বরূপ ও শর্তাদির মাধ্যমে কর্তৃত্বের সীমা ও কর্তৃত্বের যথার্থ অধিকারী নির্ধারিত হয়ে থাকে। চুক্তিবাদ জনগণকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎস হিসাবে নির্দেশ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশে সাহায্য করেছে। বার্কারের মতানুসারে চুক্তিবাদ ‘ন্যায় ও স্বাধীনতা’ এই দুই গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি হল সম্মতি, পশুশক্তি নয়’, (Will not force is the basis of the state) এই সত্যটিকে চুক্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

হব্সের অভিমত: হব্সের অভিমত অনুসারে প্রাকৃতিক অবস্থার অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ চুক্তি করেছে। এই চুক্তিটি এক পাক্ষিক। জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণই হল একমাত্র পক্ষ। প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সকল অধিকার ও শাসন করার ক্ষমতা নিঃশর্তভাবে ন্যস্ত করেছে একজন বা কয়েকজন শাসকের হাতে। শাসক বা রাজা চুক্তির ঊর্ধ্বে। চুক্তির কোন শর্ত পালনে রাজার কোন দায়-দায়িত্ব নেই। রাজা হলেন সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সার্বভৌম। তাঁর আদেশই হল আইন। সার্বভৌম আইনের দ্বারা প্রজাসাধারণের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। হবস তাঁর চুক্তিবাদে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেননি। সুতরাং রাষ্ট্র হল চরম, নিরঙ্কুশ ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। এবং রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিবর্গকে অনুগত থাকতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির এই আনুগত্য হল নিঃশর্ত ও সীমাহীন। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক আইন ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের এই চরম ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অন্য কোন কিছুর দ্বারাই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের চুক্তির বন্ধন অনন্তকালব্যাপী বজায় থাকবে। রাষ্ট্র বা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের নেই। রাজার ক্ষমতাকে অস্বীকার করলে মানুষকে আবার প্রাকৃতিক অবস্থার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফিরে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে সেবাইন মন্তব্য করেছেন: “For Hobbes there is no choice except between absolute power and complete anarchy, between an omnipotent sovereign and no society whatever.” হব্সের মতানুসারে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষই হল জনসাধারণের স্বাধীনতার স্রষ্টা ও রক্ষক। তাঁর অভিমত অনুযায়ী অবাধ রাজতন্ত্র আইনসঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তথাকথিত প্রজাতন্ত্রই হল প্রাক্‌ রাষ্ট্রীয় অরাজকতার নামান্তর।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত হবসের চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে কতকগুলি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। (ক) মানুষের সামাজিক জীবনেরই সাংগঠনিক রূপই হল রাষ্ট্র। (খ) রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতাযুক্ত। এই সার্বভৌম ক্ষমতা অবাধ, অপরিসীম, অনিয়ন্ত্রিত ও অবিভাজ্য। সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে রাষ্ট্র নৈতিকতা ও ন্যায় অন্যায়ের নির্ধারক। (গ) ব্যক্তি-স্বাধীনতা রাষ্ট্র-নিরপেক্ষ হতে পারে না। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিত্ব হয় না। মানুষের স্বাধীনতার পরিবেশের জন্য অপরিহার্য হল প্রাকৃতিক আইনের এলাকা, শৃঙ্খলার পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণ। (ঘ) মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সকল ক্ষমতা ও অধিকার শাসকের হাতে ন্যস্ত করেছে। শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকার মানুষের নেই। (ঙ) রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য অপরিহার্য।

লকের অভিমত: জন লক্ রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। লক্ গণ-সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে জনসাধারণই হল যথার্থ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। লক্ সাধারণতান্ত্রিক বা সীমাবদ্ধ সরকারের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অবাধ বা অসীম নয়। জনগণের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সরকারের বিরোধিতা করার অধিকারকে লক স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। লক্ সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ধারণা প্রচার করেছেন। তাঁর মতানুসারে প্রাক্ রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় জনগণ কিছু অধিকার ভোগ করত। তারা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে এই সমস্ত অধিকারের কিছু অংশ শাসকের হাতে প্রদান করেছে। শাসক ও রাজা জনসাধারণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং পরিবর্তে জনসাধারণ আনুগত্য প্রদর্শন করবে। শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত পূরণ করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শাসন ক্ষমতা ভোগ করবেন। শাসক চুক্তি ভঙ্গ করলে বা চুক্তির শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে, জনসাধারণ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে। জন লক্ আরও বলেছেন যে, ব্যক্তিবর্গের এমন কিছু অধিকার আছে যা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। এই সমস্ত অধিকার থেকে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যায় না। লক্ সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে গণ্য করেছেন।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত লকের ধারণাকে অনুসরণ করে কতকগুলি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। (ক) রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় খ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা ও সংকল্প। (খ) রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান বা সর্বক্ষমতাসম্পন্ন নয়। কারণ মানুষ রাষ্ট্রের কাছে তার স্বাভাবিক অধিকার সম্পন্ন করেনি। (গ) মানুষ জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্রকে আইন কার্যকর করার অধিকার প্রদান করেছে। (ঘ) রাষ্ট্র পরিচালিত হয় মানবিক অধিকার ও সামাজিক স্বার্থে। রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের আস্থা ও সম্মতি সাপেক্ষে। সুতরাং এই রাষ্ট্র সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। (ঙ) অনেকের মতানুসারে রাষ্ট্র সম্পর্কিত লকের ধারণার মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সামাজিক কল্যাণের সমাহার পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেকে এমন কথাও বলেন যে, রাষ্ট্র হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানার পৃষ্ঠপোষক এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর জিম্মাদার। (চ) লকের মতবাদে রাজার শক্তিকে অধিকার হিসাবে দেখান হয়েছে। রাজার আদেশকে আইন বলা হয়নি। (ছ) লকের মতবাদে শাসকের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে উপায় হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃথকীকরণ, আইন নির্মাতাদের নিয়ন্ত্রণ ও গণ-বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে।

ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতানুসারে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্রনীতিক সমাজ সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রনীতিক সমাজে মানুষ আইনের ভিত্তিতে গড়ে উঠা অধিকারের অধিকারী হয়েছে। রুশো রাষ্ট্রকে হবসের মতই সর্বশক্তিমান হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তবে তিনি সার্বভৌম হিসাবে ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General Will) র কথা বলেছেন। মানুষ চুক্তি করে তাদের সকল ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে অর্পণ করেছে তাদের যৌথ ব্যক্তিত্ব বা সাধারণ ইচ্ছার উপর। সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণ ইচ্ছা সকলের ইচ্ছার যোগফল মাত্র নয়। তা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতও নয়।

রুশোর তত্ত্ব: ইচ্ছা সাধারণের মঙ্গল কামনা করে। অর্থাৎ প্রত্যেকের কল্যাণ কামনা করে। সুতরাং সকলেই হল এই সাধারণের ইচ্ছার সমান অংশীদার। প্রত্যেকে সাধারণের ইচ্ছার অংশীদার এই কারণে যৌথভাবে তারা যা সমর্পণ করেছিল, আবার তারা ফিরে পেল। অর্থাৎ সকল মানুষই যৌথভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল। সমষ্টিগতভাবে জনগণই হল সার্বভৌম। এইভাবে রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। রুশোর মতানুসারে ‘জনগণের ইচ্ছাই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা” (“Vox Populi, Vox Dei.” “Voice of the people is the voice of God.”)। স্বভাবতই সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছাকে কেউ অমান্য করে না। এইভাবে হব্সের মত রুশোও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে চরম, চূড়ান্ত ও অবাধ বলে প্রতিপন্ন করেছেন। এই সার্বভৌমের প্রতি সকলের নিঃশর্ত আনুগত্যের উপর রুশো গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রুশো রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে সরকার বা শাসকের দায়িত্ব হল সাধারণ ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপায়িত করা। সরকার বা শাসক যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তা হল অর্পিত ক্ষমতা। সুতরাং সরকার সাধারণ ইচ্ছার বাহন হিসাবেই প্রতীয়মান হয়।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত রুশোর মতবাদের পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। (ক) রাষ্ট্রের ভিত্তি হল সর্বসাধারণের ইচ্ছা। (খ) রাষ্ট্র বলতে স্বাধীন ও সমান মানুষের এক সংগঠনকে বোঝায়। এই সংগঠন সর্বসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত। (গ) রাষ্ট্রীয় সংগঠনের পিছনে নিয়ন্ত্রণ আছে জনসাধারণের সম্মতিসূচক চুক্তির। এই চুক্তি অলঙ্ঘনীয়। (ঘ) রুশোর মতানুসারে মানুষের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ হল সমাজ বা রাষ্ট্র। এখানে ব্যক্তি সমষ্টিতে পরিণত হয় এবং ব্যক্তিসত্তা প্রতিফলিত হয় সমষ্টির মাধ্যমে। (ঙ) সাধারণের ইচ্ছার বাস্তবায়ন হল সার্বভৌম শক্তি। সামাজিক সত্তা বা রাষ্ট্রের সক্রিয় রূপই হল এই সার্বভৌম শক্তি। (চ) সার্বভৌমের ভিত্তি হল সামাজিক চুক্তি। তাই সার্বভৌমের আইন হল বৈধ। সাধারণের ইচ্ছা আদেশ হিসাবে জারি হলে তা আইনে পরিণত হয়। সার্বভৌমের আইন সর্বসাধারণের শক্তিতে শক্তিমান। এই আইন জনসাধারণের কল্যাণে নিবেদিত ও উদার প্রকৃতির। (ছ) রুশো গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। সাম্য, স্বাধীনতা ও প্রগতির পরিপোষক রাষ্ট্রই হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বার্থ ও সমাজ-স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় থাকে সংঘাত থাকে না।

হবস্, লক ও রুশো সামাজিক চুক্তি মতবাদকে একটি সার্বজনীন মতবাদে পরিণত করেছেন। এই মতবাদের আওতায় তাঁরা রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে সর্ববিধ অধিকার ও কর্তব্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হবস্ রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে চুক্তিবাদকে ব্যবহার করেছেন। লক্ চুক্তিবাদের মাধ্যমে সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করেছেন। রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদে লোকসমাজের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়।

ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়: রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গে সামাজিক চুক্তি মতবাদের একটি বড় কথা হল ‘রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যক্তির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়’। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য নেই। সকল ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র। ব্যক্তিই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। সুতরাং স্রষ্টার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সামাজিক চুক্তি মতবাদে রাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাষ্ট্র নিজে কোন উদ্দেশ্য নয়। সর্বময় কর্তৃত্বসম্পন্ন শাসনব্যবস্থার লক্ষ্যে হস রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলেছেন। অপরদিকে লকের উদ্দেশ্য ছিল গৌরবময় বিপ্লবের লক্ষ্যসমূহের বাস্তবায়ন বা সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণ। গণতান্ত্রিক বা লোকসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রুশো তাঁর চুক্তিবাদে রাষ্ট্রের কথা বলেছেন।

সামাজিক চুক্তিবাদের ভাষ্য অনুযায়ী আগে ব্যক্তি, পরে রাষ্ট্র। ব্যক্তির দ্বারা এবং ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র। নিজেদের বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের সদস্যদের উদ্দেশ্যই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য; তা ছাড়া রাষ্ট্রের আলাদা কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। চুক্তিবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার উৎস হল শাসকের সম্মতি বা অনুমোদন। রাষ্ট্র সম্পর্কিত এই চুক্তিবাদী মতবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিক রাষ্ট্রদর্শনের বনিয়াদ হিসেবে কাজ করেছে।

চুক্তিবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু এ বিষয়ে সকলে একমত যে, রাষ্ট্র হল মানুষের দ্বারা এবং মানুষের ইচ্ছায় গড়ে উঠা একটি প্রতিষ্ঠান। ঈশ্বর রাষ্ট্র সৃষ্টি করেননি; অথবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেও রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি। মানুষই নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে সচেতনভাবে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। মানবসমাজে বিভিন্ন স্বার্থের অস্তিত্ব বর্তমান। এই সমস্ত স্বার্থের মধ্যে বিরোধও বাধে। রাষ্ট্র সেই সমস্ত বিরোধের মীমাংসা ও সমন্বয় সাধন করে এবং ব্যক্তিস্বার্থ সংরক্ষণ করে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদে রাষ্ট্র সমন্বয় সাধন ও ভারসাম্য সংরক্ষণের ধারণা হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ। চুক্তিবাদে রাষ্ট্রের পরিবর্তে কখনও ব্যক্তিকে, আবার কখনও সমাজকে প্রাধান্য প্রদান করা হয়েছে। মানবসমাজে বিভিন্ন ও বিচিত্র স্বার্থসমূহ বর্তমান। রাষ্ট্র এই সমস্ত স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য সম্পাদন করে। তা ছাড়া ব্যক্তিস্বার্থকে সামাজিক স্বার্থের অনুবর্তী করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

চুক্তিবাদী হবসের মতানুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও আইন ন্যায়সঙ্গত। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে, এই কর্তৃত্ব ব্যক্তির নিরাপত্তা রক্ষা করে। সুতরাং এই নিরাপত্তার কারণে কর্তৃত্বের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য যুক্তিসঙ্গত। হবসের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র হল এক ‘লেভিয়াথান’। এই লেভিয়াথান ব্যক্তির নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে। রাষ্ট্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রহরী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। হবসের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলা সংরক্ষণই ছিল রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য। লক্ স্বাভাবিক আইন ও ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকারসমূহের উপর জোর দিয়েছেন। ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকার বলতে লক্ জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার ও বিশেষ করে সম্পত্তির অধিকারের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল ব্যক্তির এই সমস্ত অধিকার সংরক্ষণ। ব্যক্তির সুখ-সমৃদ্ধি ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করবে ও সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করবে। হবস্ ও লক্রে অভিমত অনুযায়ী সমাজ হল ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি বিশেষ। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির কল্যাণের সমাহারই হল সামাজিক কল্যাণ। সামাজিক কল্যাণ হিসাবে স্বতন্ত্র কিছুর কথা তাঁরা বলেননি। তাই তাঁদের মতানুসারে সামাজিক কল্যাণ নয়, ব্যক্তির কল্যাণ সাধনই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।

সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র হল চুক্তির ফল। জনসাধারণের সম্মতি বা অনুমোদন ব্যতিরেকে রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব অসম্ভব। শাসিতের চোখে রাজনীতিক ক্ষমতা ন্যায়সঙ্গত, গ্রহণযোগ্য ও বৈধ হওয়া আবশ্যক। সরকার বা শাসকের ক্ষমতার উৎস হল শাসিতদের বা জনসাধারণের সম্মতি। জনসাধারণই হল সার্বভৌম, সরকার তার এজেন্ট মাত্র। দায়িত্ব সম্পাদনে ব্যর্থ সরকারকে অপসারিত করে জনগণ নতুন সরকার গঠন করতে পারে। লক্ ও রুশোর অভিমত অনুসারে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল সমগ্র সমাজ, জনসাধারণ। এই সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগের উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যক্তিকে নিয়ে জনগণ সরকার গঠন করে। ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সংরক্ষণে সরকার বা শাসকরা যদি অসমর্থ হয়, তাহলে নাগরিকদের অধিকার আছে তাদের অপসারণ করার।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের ভাষ্য অনুযায়ী রাষ্ট্র হল একটি যান্ত্রিক সংগঠন। মানুষ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম এই রাষ্ট্রযন্ত্র। এই রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থার অসুবিধাসমূহকে অতিক্রম করতে পেরেছে। হবস্ লেভিয়াথানের কথা বলেছেন, লক বলেছেন রাজনীতিক সমাজের কথা এবং রুশো সাধারণের ইচ্ছার কথা বলেছেন। এ সবই মানুষেরই সৃষ্টি।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা

সামাজিক চুক্তি মতবাদ এক সময় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এর গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এই মতবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচনা শুরু হয়। চুক্তিবাদের সমালোচকদের মধ্যে হিউম, হেনরী মেইন, বার্ক, বেন্থাম, পোলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রের প্রকৃতির ব্যাখ্যা হিসাবে সামাজিক চুক্তি মতবাদ সন্তোষজনক প্রতিপন্ন হয় না। মতবাদটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।

(১) অনৈতিহাসিক: সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, মতবাদটি অনৈতিহাসিক। রুশোর Contract Social (1762) প্রকাশিত হওয়ার আগেই ইংরাজ দার্শনিক হিউম মন্তব্য করেছেন, চুক্তিবাদ অনৈতিহাসিক মানব-সভ্যতার সমগ্র ইতিহাস অনুসন্ধান করলেও এ রকম কোন চুক্তির উদাহরণ পাওয়া যায় না। আদিম অবস্থায় রাজনীতিক চেতনাশূন্য মানুষের স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র গঠনের কোন কাহিনী ইতিহাসে নেই।

(২) অযৌক্তিক: মতবাদটি অযৌক্তিক। কারণ চুক্তির ভিত্তি হল রাষ্ট্রনীতিক আইন। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনীতিক আইন ছাড়া কোন বৈধ চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না। চুক্তির জন্য একটি আইনগত কর্তৃত্ব থাকতে হবে। এই কর্তৃত্ব চুক্তিকে কার্যকর বা বলবৎ করবে। কিন্তু সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবক্তাদের মতানুসারে প্রাকৃ-রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক অবস্থার অধিবাসীরা চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে চুক্তি সম্পাদনের কথা অযৌক্তিক। কারণ প্রাক্-রাষ্ট্রীয় অবস্থায় কোন আইনগত কর্তৃত্ব ছিল না। কারণ সে সময় কোন রাজনীতিক সংগঠনই ছিল না। এ রকম অবস্থায় কোন বৈধ চুক্তি সম্পাদিত হওয়া বা সেই চুক্তি বলবৎ হওয়ার কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা ছিল না।

(৩) অবিশ্বাস্য: মতবাদটি অবিশ্বাস্য। কারণ প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষের রাষ্ট্র সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। সুতরাং তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের উপযোগিতা উপলব্ধি করাও সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় তারা চুক্তির মাধ্যমে হঠাৎ একদিন রাষ্ট্র সৃষ্টি করল, এরকম ভাবনা অবিশ্বাস্য।

(৪) সন্তোষজনক নয়: রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বা রাষ্ট্রের বৈধতা প্রসঙ্গেও চুক্তিবাদী বক্তব্য সন্তোষজনক নয়। চুক্তিকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করলে চুক্তিসম্পাদনকারী পূর্বপুরুষদের কাছেই এবং তাদের ক্ষেত্রেই তা বাধ্যতামূলক। উত্তরপুরুষগণ খেয়াল-খুশিমত এই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন বা তাঁরা রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটাতে পারেন। অর্থাৎ মতবাদটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। বার্ক (Burke)-এর মতানুসারে মতবাদটি হল ‘অরাজকতার সংক্ষিপ্তসার’ (digest of anarchy)।

(৫) প্রাকৃতিক আইন ও অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব: সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবক্তারা প্রাক্-রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক আইন (natural law) এবং প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক অধিকার (natural rights)-এর কথা বলেছেন। কিন্তু চুক্তিবাদীদের এই ধারণা যথার্থ নয়। চুক্তিবাদে প্রাকৃতিক আইন হিসাবে যে কথা বলা হয়েছে সঠিক বিচারে তা আইন হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রকৃত কোন আইনের অস্তিত্ব অসম্ভব। আবার প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাও ভ্রান্ত। অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। সভ্য সমাজব্যবস্থার বাইরে অধিকারের কল্পনা করা যায় না। তা ছাড়া রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ ছাড়া অধিকার বা স্বাধীনতার সৃষ্টি হতে পারে না। সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কে চেতনা ও অধিকার সম্পর্কে পারস্পরিক স্বীকৃতি ছাড়া অধিকার বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে গ্রীণ (T. H. Green) মন্তব্য করেছেন: “…without this recognition there can be no right.” সুতরাং প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রকৃতপক্ষে আইন ও অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব।

(৬) রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিষয়ক ধারণা ভ্রান্ত: সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রকে অংশীদারী কারবারের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। কারণ চুক্তির ভিত্তিতেই উভয়েরই সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাষ্ট্র এবং অংশীদারী কারবার কোনক্রমে সমপর্যায়ের সংগঠন নয়। অংশীদারী কারবারের সঙ্গে অংশীদারদের সম্পর্কের থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক অনেক বেশী দৃঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। ব্যক্তিমাত্রেই কোন-না-কোন রাষ্ট্রের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যকে ব্যক্তি অগ্রাহ্য করতে পারে না।

(৭) সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে নি। চুক্তি বলতে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে স্বেচ্ছায় স্থাপিত সম্পর্ককে বোঝায়। অর্থাৎ ব্যক্তিবর্গ চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য নয়। অথচ এভাবে প্রকৃত রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হতে পারে না। গার্ণার তাঁর Political Science and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The contract theory tends to make the state matter of caprice and if followed out to its logical conclusion it would lead to the subversion of all authority and possibly the dissolution of the state.”

(৮) সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী এই মতবাদে রাষ্ট্রকে মানুষের প্রয়োজন পূরণের যন্ত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। চুক্তিবাদীদের কাছে মানুষ ও মানুষের প্রয়োজনই বড়, রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র হল মানুষের ইচ্ছার অধীন; মানুষের দাসস্বরূপ। রাষ্ট্রের স্রষ্টা হিসাবে এখানে মানুষকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

(৯) সমালোচকদের মধ্যে অনেকের অভিযোগ হল যে, চুক্তিবাদের মধ্যে কৃত্রিমতা বর্তমান। এই কৃত্রিমতা নিন্দনীয়। পোলক চুক্তিবাদী মতবাদকে রাজনীতিক প্রতারণা হিসাবে অভিযুক্ত করেছেন। বেন্থামের অভিমত অনুসারে সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিনোদনমূলক অর্থহীন কথাবার্তায় পরিপূর্ণ। রুন্টস্‌লির অভিযোগ অনুযায়ী চুক্তিবাদ খামখেয়ালী প্রকৃতির ধারণায় ভরা।

(১০) হস রাষ্ট্রকে রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বর্তমানে তা গ্রহণযোগ্য নয়। হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সর্বগ্রাসী। এই রাষ্ট্র ব্যক্তির প্রয়োজনে সৃষ্ট, কিন্তু কালক্রমে তা ব্যক্তিকেই গ্রাস করে ফেলে।

লকের মতবাদে সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রের ধারণা বর্তমান। সমালোচকদের মতানুসারে লকের রাষ্ট্র বুর্জোয়া শক্তি ও স্বাধীনতার সহায়ক। লকের মতবাদে সম্পত্তির অধিকার রাষ্ট্রের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছে। লক রাষ্ট্রীয় স্বৈরচারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার কথা বলেছেন; কিন্তু বিত্তবানদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। লকের রাষ্ট্রতত্ত্ব হুইগ উদারবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই কারণে লকের রাষ্ট্রতত্ত্ব সকলের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না।

রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্বে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পারস্পরিক অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্টতার অভাব অনস্বীকার্য। সমালোচকদের অনেকে অভিযোগ করেন যে, রুশোর সাধারণের ইচ্ছার তত্ত্বের মধ্যে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণা বর্তমান। সমালোচকদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, রুশোর মতবাদে রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের সমর্থন এবং গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিসত্তার বিনাশ পরিলক্ষিত হয়। রুশো রাজনীতিক ঐক্য ও সংহতির ধারণার সঙ্গে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণাকে সংযুক্ত করেছেন। তার ফলে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে এবং বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল্যায়ন

সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতির ব্যাখ্যা হিসাবে গুরুত্ব হারিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মতবাদটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয় উল্লেখযোগ্য।

(১) চুক্তিবাদ রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। শাসনব্যবস্থাকে শাসিতের উপর স্থাপন করে এই মতবাদ আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনের পথ প্রশস্ত করেছে। চুক্তিবাদ জনগণকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎস হিসাবে নির্দেশ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশে সাহায্য করেছে। বার্কার-এর মতানুসারে চুক্তিবাদ ‘ন্যায়’ ও ‘স্বাধীনতা’ এই দুই গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হয়েছে।

(২) ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি হল সম্মতি, পশুশক্তি নয়’ (Will, not force is the basis of the State)—এই সত্যটিকে চুক্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। 

(৩) সর্বপ্রথম চুক্তিবাদেই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে। লকের আগে কেউ এই পার্থক্য করেননি। 

(৪) ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা প্রভৃতি রাষ্ট্রনীতিক ধারণাসমূহের বিকাশ ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অস্বীকার করা যায় না। চুক্তিবাদের মানবিক অধিকারের ঘোষণা ঐতিহাসিক মর্যাদাযুক্ত।

(৫) চুক্তিবাদের মাধ্যমে মানুষের রাজনীতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রুশোর সাম্য ও সমানাধিকারের তত্ত্ব থেকেই সাম্প্রতিককালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ধারণা এসেছে।

(৬) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশে চুক্তিবাদ সাহায্য করেছে। লক্ দ্বিতীয় চুক্তি বা সরকারী চুক্তি (Governmental Contract)-র শর্ত হিসাবে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি সংরক্ষণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণা বর্তমান। 

(৭) সামাজিক চুক্তি মতবাদ ‘সার্বভৌমিকতা’ (Sovereignty)-র ধারণাকে যথাযথভাবে বিকশিত করেছে। ইংরাজ দার্শনিক হস আইনগত সার্বভৌমিকতা, লক্ রাজনীতিক সার্বভৌমিকতা এবং ফরাসী দার্শনিক রুশো জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণা প্রচার করেছেন। 

(৮) মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে’—চুক্তিবাদ এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

(৯) পরবর্তীকালে রাষ্ট্রচিন্তায়ও চুক্তিবাদের প্রভাব অপরিসীম। অনেকের মতানুসারে বেন্থাম-এর হিতবাদ হল লকের সুখতত্ত্বের সম্প্রসারিত রূপ। আবার কারও কারও মতে লকের মতবাদই হল মণ্টেস্কু (Montesquieu)-র ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উৎস। 

(১০) সামাজিক চুক্তি মতবাদে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিক আলোচনার সূত্রপাত পরিলক্ষিত হয়। এই মতবাদে প্রথম রাজনীতির আলোচনায় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাকে যথাসম্ভব খোলা খুলিভাবে ব্যবহার করা হয়। 

(১১) চুক্তিবাদেই প্রথম সমাজ-বন্ধনের নীতি হিসাবে শৃঙ্খলা ও আনুগত্য বোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। হস নিয়ম-শৃঙ্খলা, যুক্তি ও আনুগত্য বোধের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। লক্ বলেছেন দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণের কথা। সাম্য, স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলার ধারণাকে রুশো বিকশিত করেছেন। 

(১২) সামাজিক চুক্তি মতবাদের সুবাদে কতকগুলি ধারণা রাজনীতির চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই ধারণাগুলি হল: সমাজে সম্যক শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন; বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত শক্তিসমূহ সুসংহতভাবে পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন; ব্যক্তিসত্তার সামাজিক সত্তায় রূপান্তর অভিপ্রেত; সমাজ সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয় প্রভৃতি।