রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদ বর্তমান রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই মতবাদে আধুনিক ধ্যান-ধারণার সাহায্যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এ পর্যন্ত আলোচিত অন্য কোন মতবাদই পূর্ণাঙ্গ সত্যের সন্ধান দিতে পারেনি। তাই অন্য কোন মতবাদই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে গার্নার-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: ‘রাষ্ট্র ঈশ্বরসৃষ্ট বস্তু নয়, পাশবিক শক্তির ফলও নয়, চুক্তির দ্বারাও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি, আবার পরিবার সম্প্রসারিত হয়েও রাষ্ট্র গঠিত হয়নি’ (“The state is neither the handiwork of God, nor the result of superior physical force, nor the creation of convention, nor a mere expansion of the family.”)। অর্থাৎ গার্ণারের মতানুসারে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ, বলপ্রয়োগ মতবাদ বা সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে নি।
রাষ্ট্র হল মানবসমাজের বিরতিবিহীন ক্রমবিকাশের ফল: প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্র সৃষ্টির কোন সরল সূত্র নেই। সুদীর্ঘকালের অনুশীলন ও পর্যালোচনার মাধ্যমে আজ এ সত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তির ইতিহাস তমসাচ্ছন্ন। সুদীর্ঘ বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রের। ইতিহাস ও প্রাক্-ইতিহাসের হাজার হাজার বছর ধরে এই বিবর্তনের প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলেছে। এই বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মূলসূত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। বস্তুত মানব সমাজই বিভিন্ন উপাদানের জটিল সংমিশ্রণের দ্বারা নানা পর্যায়ের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নত রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ কোন এক দিনে বা বিশেষ কোন কারণে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। সমাজবিজ্ঞানী বার্জেস (J. W. Burgess) বলেছেন: ‘রাষ্ট্র হল মানবসমাজের বিরতিবিহীন ক্রমবিকাশের ফল’। বার্জেস বলেছেন: “The proposition that the state is a product of history means that it is a gradual and continuous development of human society out of a grossly imperfect beginning through crude but improving forms of manifestation towards a perfect and universal organization of mankind.’। ড. স্টিফেন লিকক (Dr. Stephen Leacock) ও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তাঁর মতেও সমাজের ক্রমবিকাশের এক বিশেষ স্তরে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ: রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূল কথা হল জনসমষ্টির মধ্যে কর্তৃত্ব (authority)-এর সৃষ্টি এবং এই কর্তৃত্বের প্রতি জনগণের আনুগত্য (obligation)। এ সম্পর্কে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সমাজ-নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে আনুষঙ্গিক তত্ত্ব ও তথ্যাদি সংগ্রহ করে ঐতিহাসিক মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছে। অর্থাৎ ‘মানব সমাজের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমিকাশের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে’—এই সিদ্ধান্ত অনুমানভিত্তিক বা কাল্পনিক নয়। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ তথ্য-প্রমাণের উপর এই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত। এই কারণে ঐতিহাসিক মতবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ।
মুখ্য প্রবক্তাসমূহ
ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদের প্রবক্তা হিসাবে হেনরী মেইন (1822-288), বেজহট (1826 77), ম্যাকাইভার (1882-1970) প্রমুখ চিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক মতবাদকে সর্বপ্রথম সুসংহতভাবে বিকশিত করেছেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস [Friedrich Engels (1820-195)। সমাজবিজ্ঞানী মরগ্যান (Lewis H. Morgan) এর গবেষণার ভিত্তিতে এঙ্গেলস তাঁর The Origin of the Family, Private Property and the State বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে এবং রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব অব্যাহত রেখেছে।
স্যার হেনরী মেইন হলেন একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনবিদ ও ঐতিহাসিক। রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিবর্তনবাদী মতবাদের একজন গোড়ার দিকের প্রবক্তাদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। মেইনের Ancient Laws: its Connection with the Early History of Society and its Relation to Modern Ideas প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। এর অল্প আগে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে চার্লস ডারউইন (Charls Darwin) – এর Origin of the Species। হেনরী মেইন সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে বিবর্তনের নীতিকে প্রয়োগ করেছেন। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : “Maine traces the evolution of the modern state to the earlier form of paternal authority of the Kin-group where rights of the individual were unknown. This eventually gave way to the modern form of authority of the state which duly recognizes individual rights. Evalutionary theory postulates that higher forms of social organization represent the logical development from its lower forms.”
ব্রিটিশ রাজনীতিক ও শাসনতান্ত্রিক তাত্ত্বিক ওয়ালটার বেজহট (walter baghot)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ physiscs and politics: thoughts on the application of the principles of natural selection and inheritance to political society প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। এই গ্রন্থে বেজহট তাঁর ‘সামাজিক বিবর্তন’ সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা করেন। বেজহট তাঁর সামাজিক বিবর্তনের মতবাদকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ সম্পর্কিত ডারউইনের জীবতাত্ত্বিক মতবাদের সঙ্গে মেইনের মানব ইতিহাসের বিবরণের সমন্বয় সাধন করেছেন। বেজহটের বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গাউবা বলেছেন: “.some societies emerged as ‘fittest’ in the process of ‘natural selection’ as applied to political society.”
সমাজতত্ত্ববিদ রবার্ট ম্যাকাইভার তাঁর The Moderns State শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ম্যাকাইভার রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে ঐতিহাসিক মতবাদের আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রের রাজকর্ম বা ভূমিকাগত মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে এই সমাজবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক মতবাদের উপর নির্ভর করেছেন। বিবিধ প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ের ভিতর দিয়ে কিভাবে আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়েছে তা ম্যাকাইভার ঐতিহাসিক মতবাদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য প্রতিপাদনে অসমর্থ সামাজিক চুক্তি মতবাদকে ম্যাকাইভার রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদ হিসাবে বাতিল করে দিয়েছেন। ম্যাকাইভার বলেছেন: “Sociey, which is the very condition of human life, is made to depend on a rationalized and fullgrown human will which itself is meaningless except for a remotely long process of social growth. Within this process the state has emerged as a ‘will-organization’, con trolling and instituting those forms of order which prove amenable to political law.”
মানবসমাজের ক্রম-বিবর্তনে সহায়ক উপাদানসমূহ: মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের জন্মলগ্ন জানা যায়নি। তবে একথা ঠিক যে, মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য সমাজজীবন বিভিন্ন রূপান্তর গ্রহণ করেছে। এই রূপান্তরের পথেই আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে। মানবসমাজের এই রূপাত্তরের ধারা অনুধাবন ও অনুশীলন করা দরকার। তার থেকে দেখা যায়। যে সমাজের বিরামহীন বিবর্তনের পথে বিভিন্ন উপাদানের সক্রিয় অবদান আছে। এই উপাদান বা শক্তিগুলি সংখ্যায় পাঁচটি। এগুলি হল:
-
(১) রক্তের সম্পর্ক,
-
(২) ধর্ম,
-
(৩) বলপ্রয়োগ,
-
(৪) আর্থনীতিক চেতনা এবং
-
(৫) রাজনীতিক চেতনা।
সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই শক্তিগুলি বিভিন্ন পরিমাণে মিশ্রিত থেকে একই সঙ্গে বিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। এবং তার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। কিন্তু এই বিবর্তনের পথে উপাদানগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা কঠিন। যাই হোক, উল্লিখিত উপাদানগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা দরকার।
(১) রক্তের সম্পর্ক
রক্তের সম্পর্ক থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্রের সৃষ্টি: আত্মীয়তার বন্ধন বা রক্তের সম্পর্ক হল রাষ্ট্রগঠনের প্রাথমিক উপাদান। রক্তের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যসূত্র হিসাবে কাজ করে। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক প্রবণতার চাপে এবং বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। মানুষের সামাজিক জীবনের যোগসূত্র হিসাবে রক্তের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতেই আদিমকালে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে। আর রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান হিসাবে পরিবারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একই রক্তের ধারায় সৃষ্ট পরিবার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভক্ত হয়েছে। তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে গোষ্ঠীর। উত্তর পুরুষের মধ্যে এই রক্তের সম্বন্ধ বা আত্মীয়তার বন্ধন ধীরে ধীরে বৃহত্তর সামাজিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রূপান্তরিত হয়েছে। ম্যাকাইভার বলেছেন: ‘রক্তের সম্পর্ক সমাজ সৃষ্টি করল এবং সমাজ অবশেষে সৃষ্টি করল রাষ্ট্রের’ (‘Kinship creates society and society at length cre ates the state.”)। ম্যাকাইভারের মতানুসারে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রসারিত হয় এবং কালক্রমে রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্কে পরিণত হয় (“…. the extended kin relation merges into political relation.”)। সুশিলা রামস্বামী তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থটিতে এ বিষয়ে লিখেছেন: “The Kin-relationship, according to MacIver, is a time-bracket while the political structure that binds the families and individuals that it includes is space-bracket.” ম্যাকাইভার তাঁর The Modern State গ্রন্থে আরও বলেছেন: “The web of blood relationship is thus woven and rewoven which creates and sustains the kin with all its potentialities of extension and subdivision.”
আনুগত্য ও শৃঙ্খলা-বোধের সৃষ্টি: রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে পরিবারের। এই পরিবারের মধ্যেই মানুষ আনুগত্য ও নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা লাভ করেছে। এই আনুগত্য ও শৃঙ্খলাবোধই হল রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি। আদিম পরিবারের অগ্রজ ব্যক্তিদের নির্দেশ অনুজ ব্যক্তিগণ পালন করেছে। এইভাবে আদেশ দান ও আদেশ পালনের মাধ্যমে রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠনের ভিত্তি রচিত হয়েছে।
(২) ধর্ম
প্রাচীন সমাজের অন্যতম যোগসূত্র হল ধর্মবোধ: প্রাচীন কালের সমাজব্যবস্থায় রক্তের সম্পর্কের মত ধর্মও পরিবার ও গোষ্ঠীজীবনে সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গোষ্ঠীজীবন ক্রমশ ব্যাপক ও জটিল রূপ ধারণ করল। সেই সময় রক্তের সম্পর্কের বন্ধন ক্রমশ শিথিল হতে লাগল। এই অবস্থায় ধর্মই মানুষকে এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ ও একত্রিত করেছে। গোষ্ঠী-জীবনের এই বিপর্যয়ের মুখে ধর্মই সমাজ-জীবনের ভাঙন রোধ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘ধর্ম’ আদিম সমাজব্যবস্থায় ‘রক্তের সম্পর্কের’ মত একটি যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করেছে। ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন বলেছেন: ‘ধর্ম ছিল রক্তের বন্ধনের প্রতীক ও চিহ্ন; একতার, শুদ্ধতার, কর্তব্যসমূহের প্রকাশ” (“Religion was the seal and sign of common blood, the expression of its one ness, its sanctity, its obligation.”)। সুশীলা রামস্বামী মন্তব্য করেছেন: “Religion and political rule were so intertwined that it was difficult to differentiate the two. Obedience to law and to authority rested largely on the divine power of the ruler and in the sacredness of immemorial institution.”
ধর্ম আনুগত্যবোধ বিকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করেছে: প্রাচীন সমাজের আদিম মানুষ প্রথমে প্রকৃতি পূজা (animism) এবং তারপর পূর্ব-পুরুষদের পূজা (ancestor worship) ধর্মাচরণ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ঋতু পরিবর্তন প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে তারা ভয় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তারা জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য সব কিছুকেই দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। কালক্রমে আদিম মানুষ পূর্বপুরুষদের পূজা শুরু করে। তারা পূর্বপুরুষদের আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করার ব্যাপারে তারা গোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিদেরই উপযুক্ত মনে করত। পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করার মত নৈসর্গিক শক্তিসমূহকে বশ করার ক্ষেত্রেও তারা গোষ্ঠীর প্রধানতম ব্যক্তিকে মেনে চলত। গোষ্ঠীপতিই ছিলেন প্রধানতম ব্যক্তি। কালক্রমে এই গোষ্ঠীপতি প্রধান পুরোহিত হিসাবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করেন। আদিম মানুষ ধর্মভয়ে পুরোহিতদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত। পুরোহিতগণ এই আনুগত্যের সুযোগে সমাজের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেন। আবার অনেক সময় যাদুকর হিসাবে পরিচিত এক শ্রেণীর অত্যন্ত চতুর ব্যক্তি বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার দ্বারা জনগণকে বিস্ময়ে অভিভূত করত। তারাও সমাজের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করত। ধর্ম এই আনুগত্যবোধ বিকাশ করে রাষ্ট্র গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গেটেল বলেছেন: ‘রাষ্ট্রনৈতিক বিবর্তনের প্রাথমিক ও সর্বাপেক্ষা সংকটময় পর্যায়ে ধর্মই বর্বরসুলভ অরাজকতাকে দমন করে, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের শিক্ষা দিতে পেরেছিল’ (“In the earliest and most difficult periods of political development, religion alone could subor dinate barbaric anarchy and teach reverence and obedience.”)।
আদিম মানুষের অজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগে কোথাও গোষ্ঠীপতি, আবার কোথাও পুরোহিত তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও শাসন কায়েম করেছে। তখন ধর্ম ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল। ধর্ম মানুষের সমাজচেতনাকে জাগ্রত করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। তা ছাড়া মানুষকে ধর্ম আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছে। আবার বিশৃঙ্খল ও অরাজক অবস্থার মধ্যে ধর্ম শৃঙ্খলা এনেছে। সুশীলা রামস্বামী মন্তব্য করেছেন : “Com mon worship reinforced kinship by disciplining the early man to authority.”
(৩) যুদ্ধবিগ্রহ
মানুষের বাঁচার তাগিদ বা আত্মরক্ষার সংগ্রাম চিরদিনের। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিগ্রহ বা বলপ্রয়োগের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। বস্তুত রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে যুদ্ধবিগ্রহ বা আত্মরক্ষার তাগিদের একটি বড় ভূমিকা আছে। একথা অস্বীকার করা যায় না। এ ব্যাপারে ওপেনহাইমার (Oppenheimer), গামপ্লোউইজ (Gum plowicez), কার্ল মার্কস (Karl Marx) প্রমুখ চিন্তাবিদ্গণ সমমত পোষণ করেন।
কালক্রমে গোষ্ঠী-জীবন আরও ব্যাপক রূপ ধারণ করল। তার ফলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘর্ষের ঘটনা ক্রমশ বাড়তে লাগল। তখন আক্রমণ করা ও আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য একটি বলপ্রয়োগকারী শক্তির সংগঠন ও ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠল। গোষ্ঠীর মধ্যে সংগঠিত এই শক্তি কালক্রমে সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হল। তখন এই শক্তি গোষ্ঠীভুক্ত সকলের আনুগত্য অর্জন করল। যুদ্ধনায়ক এই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হলেন। যুদ্ধের সময় তিনি সেনাপতি হিসাবে সৈন্য পরিচালনা করতেন। শান্তির সময় তিনি শাসক হিসাবে দ্বন্দ্ব-বিবাদের মীমাংসা করতেন। এইভাবে রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠন সৃষ্টির পিছনে বলপ্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অস্বীকার করা যায় না। এই কারণে বলা হয় যে, যুদ্ধের ফলেই রাজার উৎপত্তি হয়েছে’ (“War begot the king.”)।
আবার অসভ্য ও দুর্বিনীত মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই আনুগত্য ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে আনা হয়েছে। তার ফলে সুস্থ সমাজজীবন সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া বলপ্রয়োগের সাহায্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয় এবং রাজ্যসীমা ও সম্পদ বৃদ্ধি করতে হয়। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও বলপ্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
(৪) আর্থনীতিক চেতনা
প্রাচীনকালের আদিম মানুষ প্রকৃতি থেকে খাদ্য আহরণ করত। বন-জঙ্গল থেকে তারা ফলমূল সংগ্রহ ও পশুপক্ষী শিকারের মাধ্যমে দিনাতিপাত করত। এই উদ্দেশ্যে তাদের শৃঙ্খলার ভিত্তিতে যুধবদ্ধ জীবনযাপন করতে হত। তখন ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তির সৃষ্টি হয়নি। তারা যা কিছু সংগ্রহ করত তা সবই সমানভাবে ভাগ করে ভোগ করত। তারপর কালক্রমে মানুষ পশুচারণ ও কৃষিযুগে উপনীত হল। এই পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ দেখা দিল। ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তির সৃষ্টি হল। ক্রমশ উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটল। এইভাবে আর্থনীতিক কর্মপ্রয়াস বৃদ্ধি পেতে লাগল। তার ফলে ধনবৈষম্যের ভিত্তিতে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্ভব হল এবং শ্রেণী-সংঘর্ষের সৃষ্টি হল। এই অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা ও শাসনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হল। এইভাবে প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে সংগঠিত হল।
মার্কসবাদীরা রাষ্ট্র সৃষ্টির ব্যাখ্যা হিসাবে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও শ্রেণীসংঘর্ষের সৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনকে বড় করে দেখেছেন। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে অর্থনীতির যে একটি বড় ভূমিকা আছে তা অনস্বীকার্য। গেটেল-এর মতানুসারে, ‘রাষ্ট্র সৃষ্টির পিছনে আদিম মানুষের আর্থনীতিক কার্যকলাপের অবদান নানাভাবে বর্তমান’ (The economic activities of early peoples, therefore, contrib – uted to the origin of the state in several ways.”)।
(৫) রাজনীতিক চেতনা
আর্থনীতিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গেই জে রাজনীতি চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। প্রাচীনকালে রক্তের সম্পর্ক ও ধর্মভয় আদিম মানুষের মনে অন্ধ আনুগত্যের সৃষ্টি করেছিল। তাই এই সময়কে রাষ্ট্রনীতিক অবচেতনার যুগ বলা হয়। গোষ্ঠী-জীবন অতিক্রম করে মানবসমাজ কালক্রমে বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়েছে। তখনই বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় আদিম মানুষ নিজের অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে যুদ্ধনায়কের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। তা ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জটিল আর্থনীতিক ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ বুঝেছে যে, কোন শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপন না করলে জীবন ও সম্পত্তি অনিশ্চিত। তাই বলা হয় যে, উপযোগিতার উপলব্ধি থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
মানুষের সমাজচেতনাই তার রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধির সহায়ক। রাষ্ট্র সৃষ্টির পিছনে এই রাজনীতিক চেতনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল-এর মতানুসারে ‘মানুষ রাজনীতিক জীব’ (‘Man is a political animal.”)। মানুষের এই রাজনীতিক প্রকৃতির অভিব্যক্তি হল রাষ্ট্র।
সমালোচনা (Criticism): ঐতিহাসিক মতবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ। তবুও মতবাদটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কয়েকটি কারণে মতবাদটির বিরূপ সমালোচনা করা হয়।
(১) রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসাবে ঐতিহাসিক মতবাদ মৌলিকতা দাবী করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত অন্যান্য মতবাদগুলি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এই মতবাদে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক মতবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক অন্যান্য মতবাদগুলির সমাহার বিশেষ।
(২) ঐতিহাসিক মতবাদে রাষ্ট্রের বিবর্তনের বিষয়টিকেই বড় করে দেখান হয়েছে। তুলনামূলক বিচারে রাষ্ট্রের উদ্ভবের কারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর তত জোর দেওয়া হয়নি।
(৩) এই মতবাদে রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার ফলে কোন উপাদানের প্রতি সুবিচার করা হয় নি।
(৪) তা ছাড়া বিভিন্ন উপাদান ও তথ্যের সমাবেশ ঘটায় মতবাদটি জটিল হয়ে পড়েছে। তার ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
(৫) ঐতিহাসিক মতবাদে রাষ্ট্র সৃষ্টির উপাদানগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয় নি।
মূল্যায়ন (Evaluation): রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে ঐতিহাসিক মতবাদ হল একমাত্র গ্রহণযোগ্য মতবাদ। এই মতবাদ বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে এই মতবাদের সৃষ্টি হয়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে আকস্মিক ভাবে কোন একদিন বা কোন বিশেষ কারণে বা কোন বিশেষ উপাদানের দ্বারা রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি। সমাজ বিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র হল মানব সমাজের অবিরাম ক্রমবিকাশের ফল।
ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি প্রসঙ্গে যে সত্যের সন্ধান দেয়, তা আবিষ্কৃত কোন মৌলিক সত্য নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে বিবর্তনবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক অন্যান্য মতবাদগুলির এক সমষ্টিগত রূপ। রক্তের সম্পর্ক হল পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক মতবাদের স্বীকৃতি। ধর্ম ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদকে সমর্থন করে। যুদ্ধ বলপ্রয়োগ মতবাদের ইঙ্গিত দেয়। এবং আর্থনীতিক ও রাষ্ট্রনীতিক চেতনার মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই উপাদানগুলি একক ভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু প্রতিটি উপাদানই রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে কোন না কোন ভাবে সাহায্য করেছে। অন্যান্য মতবাদের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম একটি উপাদানকে একমাত্র উপাদান হিসাবে ধরে নিয়েছে। অন্যান্য মতবাদগুলির এটাই হল মস্ত ভুল। বিবর্তনবাদ সেই ভুল সংশোধন করেছে। কাল্পনিক মতবাদগুলি প্রত্যেকটির বক্তব্যকে এই মতবাদে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ‘রাষ্ট্র হল মানব সমাজের বিরতিবিহীন ক্রমবিকাশের ফল’—এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যই বিবর্তনবাদের বড় অবদান। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই সত্য আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। এই কারণে ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদই হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিজ্ঞানসম্মত ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য মতবাদ। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসাবে এই মতবাদের বক্তব্য অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যাদির দ্বারা ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়েছে।
Leave a comment