মানুষের জ্ঞানের আধারস্বরূপ বিজ্ঞানশাস্ত্রসমূহের প্রত্যেকটির নিজস্ব গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান-সামাজিক বিজ্ঞান নির্বিশেষে সকল বিজ্ঞানেরই স্বতন্ত্র উপযোগিতা আছে। অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে একথা পুরোপুরি প্রযোজ্য। ভারতীয় চিন্তাবিদ আসিরবাথম (Asirvatham) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন: “It gives precision and definiteness to the meaning of political terms. It is conducive to ciarity and honesty of thought. It is an aid to interpretation of history. A knowledge of past political thought is of an invaluable help in understanding present-day politics and international relations. Constructive political progress rests upon a sound and comprehensive political theory, applicable to present-day conditions and needs. Political thought represents a high type of intellectual achievement. Finally if government can be shaped and improved by human ingenuity, no study is more valuable than a study of political theory. Political theory is thus intensely practical and intensely important.”
যে কোন সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ করার উপযোগিতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। একটি সামাজিক বিজ্ঞান গড়ে উঠার পিছনে কতকগুলি মৌলিক প্রবণতা কাজ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্ভবের সহায়ক প্রবণতাসমূহ সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয়।
(১) বাস্তব জীবনের দিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা যে কারণে গড়ে উঠেছে তার গুরুত্ব আমরা প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করি। রাষ্ট্রব্যবস্থা বিভিন্ন বিধিরীতির মাধ্যমে অগণিত মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি বিভিন্ন কার্যকলাপ রাষ্ট্রব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তার করে। এই সমস্ত বিষয়ে কিছু সুসংহত বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা-ভাবনা আবশ্যক। এর প্রয়োজনীয়তা আধুনিক যুগে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বর্তমানে রাষ্ট্র ও রাজনীতি ব্যাপকভাবে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ও কর্মে বিস্তৃত হয়েছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ক্রিয়াকলাপের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার, তা হলে বাস্তব জীবনের বাধা-বিঘ্নগুলি সম্পর্কে আগে থেকেই সজাগ হওয়া সম্ভব হয়। আইনশৃঙ্খলার রাজনৈতিক প্রশ্নটি এখন একটি সার্বজনীন রাজনৈতিক প্রশ্ন। অধুনা সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তার ফলে সামাজিক মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র-রাজনীতি সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
(২) অন্য যে কোন জ্ঞান-শৃঙ্খলার মতই রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বিশেষীকৃত জ্ঞান লাভ সম্ভব। এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এই বিশেষ সামাজিক বিজ্ঞানটি সভ্য মানুষের চিন্তা-ভাবনার জগতে যে অবদান জুগিয়েছে তার উপযোগিতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
(৩) বর্তমানে মতাদর্শগত বিতর্ক আলোচনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই আলোচনা বিভিন্নভাবে অগণিত মানুষের জীবন ও কর্মকে প্রভাবিত করে চলেছে। এ বিষয়ে অন্য যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানই স্বচ্ছতম ধারণা উপস্থাপিত করে। সমাজতন্ত্রবাদ, সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, গান্ধীবাদ, সর্বোদয় ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের যে সমস্ত মতাদর্শ রাষ্ট্র ও রাজনীতির কর্মপ্রবাহে প্রতিনিয়ত উপস্থাপিত হচ্ছে, তাদের যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
(৪) ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ গড়ে উঠার পিছনে যে আদর্শ ও মূল্যবোধগত প্রবণতা বর্তমান তা বিশ্লেষণ করলে এই সামাজিক বিজ্ঞান পাঠের উপযোগিতা অনুধাবন করা যাবে। রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চিন্তা-ভাবনা করেছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই শাসক-শাসিতের সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বৈধতার প্রশ্ন নিয়ে কোন-না-কোন বক্তব্য পেশ করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শাসন-ব্যবস্থার মৌলিক উপযোগিতা এবং তার কল্যাণমূলক ক্রিয়াকলাপভিত্তিক বৈধতার প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আলোচিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির যৌক্তিকতা এবং কল্যাণপ্রসূ দিকটি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
(৫) দলীয় রাজনীতির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষ বর্তমানে রাষ্ট্র-রাজনীতির কর্মপ্রবাহে জড়িয়ে পড়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে আনুষ্ঠানিক জ্ঞান চর্চা ছাড়াও ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। তবুও দল বা দলীয় রাজনীতির প্রবক্তারা অস্বীকার করে না যে, একটা স্তরে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংক্রান্ত তত্ত্বগত জ্ঞানের মূল্য তাৎপর্যপূর্ণ।
(৬) মার্কসবাদী লেখকগণ রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংক্রান্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপিত করেন। তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপযোগিতা উপলব্ধি করা যায়। এঁদের মতানুসারে রাষ্ট্রব্যবস্থা হল মূলত শ্রেণীশাসন ও শোষণের যন্ত্র বিশেষ। আপামর জনসাধারণের কল্যাণসাধনে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থাই উপযুক্ত নয়। তাই এঁদের মতানুসারে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এক বৈপ্লবিক চেতনা ও প্রবাহ আনা দরকার। এই বিপ্লবের সাহায্যে এই শোষণমূলক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এইভাবে শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। যে সমস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই বক্তব্য সমর্থন করেন না, তাঁরা রাষ্ট্রকে এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সমাজের কল্যাণসাধন সম্ভব। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এ রকম বিপরীতধর্মী ধ্যান-ধারণা কেবলমাত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই জানা যায়।
রোডী, ক্রিসটল ও অ্যান্ডারসন (Rodee, Christol and Anderson) তাদের Introduction to Political Science শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যান্য লেখকরাও আলোচ্য সামাজিক বিজ্ঞানটির লক্ষ্য ও প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমের আলোচনার মৌলিক উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে সুনাগরিকতার শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার সাধন করা। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। এধরনের শাসনব্যবস্থার সাফল্যের স্বার্থে সুনাগরিকের ভূমিকা অপরিহার্য। সুনাগরিক সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য জ্ঞান-বুদ্ধি রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরবরাহ করে। গণতান্ত্রিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ সম্পাদনের সামর্থ্য সৃষ্টি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অজ্ঞান ও অবহেলা গণতন্ত্রের বিপদস্বরূপ। বিজ্ঞ-বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল নাগরিক গণতন্ত্রের সাফল্য সুনিশ্চিত করে। স্বাধীনতার জন্য মূল্য হিসাবে সদা সতর্কতার উপর জোর দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে আধুনিককালের সরকার ও রাজনীতির জটিল প্রকৃতি সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান-বুদ্ধি অধুনা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তারজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ভোট দেওয়াটাই সুনাগরিকতার শেষ কথা নয়। বিদ্যমান সরকারের কার্যপ্রক্রিয়া, সরকারের প্রতিটি নীতি ও সিদ্ধান্তের পিছনে বর্তমান শক্তি ও স্বার্থসমূহ, সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহের সম্ভাব্য ফলাফল, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও প্রতিনিধিদের কার্যকলাপ প্রভৃতি বিষয়ে নাগরিকদের সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠই এ সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও জ্ঞান-বুদ্ধি সরবরাহ করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহারিক জীবনে বৃত্তিগত ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করে। রাজনীতি, আইন, সরকারী চাকরি, পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে চাকরি, শিক্ষকতা প্রভৃতি পেশার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রদান করে।
Leave a comment