রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য?

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য হতে পারে কিনা এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য বর্তমান। একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল (Aristotle) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান’ (Master Science) হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কিত সামগ্রিক আলোচনাকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি আলোচ্য শাস্ত্রটিকে চরম বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করতেন। পরবর্তীকালে এই ধারণার সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন। হব্স (Hobbes), ব্লণ্টস্‌লি (Blunts chli), ব্রাইস (Bryce), বদ্যা (Bodin), মন্টেস্কু (Montesquieu), ব্রোঘাম ( Brougham), ডোনে (Donnat), হেলেটজেন্‌ড্রফ (Holtzendroff), পোলক (Pollock) প্রমুখ দার্শনিক ও আধুনিক আচরণবাদী (Behaviouralists) লেখক। অপরপক্ষে বাক্ল (Buckle), কঁং (Comte), মেইটল্যাণ্ড (Maitland) প্রমুখ বিরুদ্ধবাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য নয়। কারণ এর বিষয়বস্তু ব্যাপক, জটিল ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ।

বিজ্ঞানের সংজ্ঞা: এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার শুরুতেই বিজ্ঞানের সংজ্ঞা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। ১৯৫০ সালে ইউনেস্কো (UNESCO)-র এক আলোচনাচক্রে সিদ্ধান্ত হয় যে, “বিজ্ঞান হল কোন একটি বিষয় সম্বন্ধে সুনিয়ন্ত্রিত চিত্তা, অভিজ্ঞতা, ভুয়োদর্শন ও গবেষণাপ্রসূত জ্ঞানভাণ্ডার (“The sum of co-ordinated knowledge relative to a determined subject.”)। অর্থাৎ বিজ্ঞান হল কোন বিষয় সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞান (systematic knowledge)। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দ্বারা এই জ্ঞান সংগৃহীত হয়। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়সমূহের শৃঙ্খলিত জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলা হয় (“Science is coherent knowledge about some interrelated problems.”)। এ প্রসঙ্গে মসকা (Mosca)-র অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর The Ruling Class গ্রন্থে বলেছেন যে, বিজ্ঞান গড়ে উঠে নিয়মানুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক বিশেষ ধারার উপর। এই ধারার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন তথ্য বা বিষয় নির্ভুল ও স্থির সত্য আবিষ্কৃত হয়। এই সত্য দেশ-কাল নির্বিশেষে অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন। বস্তুত নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত সংহত জ্ঞানের সমষ্টি হিসাবে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পরিমাপ ও সত্যতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনার উপর জোর দেওয়া হয়। বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের একটি বৈশিষ্ট্য হল বিশ্বাসযোগ্যতা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য: বিজ্ঞানের উল্লিখিত সংজ্ঞা অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সহজেই বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত করা যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।

(ক) পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, গবেষণা প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের সৃষ্টি, কার্যাবলী, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, নাগরিকদের আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক বিষয়বস্তুর শ্রেণীবিভক্তিকরণ, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি করা যায় এবং এইভাবে শ্রেণীবিভক্ত জ্ঞান থেকে সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠাও সম্ভব। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সঠিক অর্থে বিজ্ঞান পদবাচ্য। বস্তুতঃ অ্যারিস্টটল বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল বিচার, তুলনামূলক আলোচনা প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা-পদ্ধতি রাষ্ট্রের আলোচনায় প্রয়োগ করেছিলেন। ফ্রেডারিক পোলক (Frederick Pol lock)-এর মতানুসারে গ্রীক মনীষী অ্যারিস্টটল থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। তিনি বলেছেন: “The Science of Politics begins with Aristotle.”

(খ) এইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যে শৃঙ্খলিত জ্ঞান, সাধারণ সূত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেগুলি ভবিষ্যতে অনুরূপ অবস্থায় নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা চলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ বৈজ্ঞানিক সত্যের মর্যাদা দাবী করে।

(গ) মানুষ মননশীল ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন তবুও তার রাজনীতিক আচরণের মধ্যে যথেষ্ট সামঞ্জস্য থাকে। এই সুসামঞ্জস্য আচরণ থেকে সুসংবদ্ধ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। ব্রাইস (Bryce)-এর মতে, মানুষের রাজনীতিক আচরণ জটিল বটে কিন্তু তার মধ্যে লক্ষণীয় সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সামঞ্জস্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এই সাদৃশ্যমূলক আচরণের বিশ্লেষণের দ্বারা সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও সাধারণ সূত্র নির্ধারণ করেন। এই জ্ঞান ও সূত্রসমূহ ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করে।

(ঘ) বলা হয় যে, সামগ্রিক বিচারে সমাজ ও সমাজের বিকাশ বস্তুনিষ্ঠ কতকগুলি নিয়মের অনুগামী। এই সমস্ত নিয়মের ভিত্তিতে মানবসমাজের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কতকগুলি সাধারণ সূত্র নির্ধারণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রও সমাজেরই অংশ বিশেষ। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরও কতকগুলি সাধারণ সূত্র নির্ধারণ করা যেতে পারে।

(ঙ) আধুনিক আচরণবাদীদের দৃঢ় অভিমত হল ভৌত বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও সংখ্যায়নের (quantification) পদ্ধতি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভৌত বিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা মূল্যমান-নিরপেক্ষ আলোচনা করার পক্ষপাতী। তথ্যাদি সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ এবং গণিত ও পরিসংখ্যানের প্রয়োগ ঘটিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিষয়মুখী ও মূল্যমান নিরপেক্ষ করা সম্ভব বলে আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সংস্কৃতি (political culture), রাজনীতিক সামাজিকীকরণ (political socialisation), ব্যক্তির আচার-আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সংগৃহীত তথ্যাদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি ধারণা-কাঠামো (conceptual framework) গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হন।

(চ) বর্তমান যুগে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মত পোষণ করেন যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। কারণ বিজ্ঞানের অধিকাংশ লক্ষণ, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এতে বর্তমান। গেটেলের ভাষায়, “বিজ্ঞান বলতে যদি কোন বিষয় সম্পর্কে শৃঙ্খলিত পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, পঠন, বিশ্লেষণ, পৃথকীকরণের দ্বারা লব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারকে বোঝায় তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবশ্যই বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য।” লর্ড ব্রাইস রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘প্রগতিশীল বিজ্ঞান’ হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। পোলক মনে করেন যে, বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ তাঁরাই কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করতে অস্বীকার করেন।

(ছ) আধুনিক লেখকগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে জ্ঞাননিষ্ঠ বিজ্ঞান (positive science) বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে পরিসংখ্যান ও ঘটনাভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ভৌত বিজ্ঞানসমূহের সমমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে পরিসংখ্যান ও গাণিতিক তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেখা যায়। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

(জ) একজন আধুনিক চিন্তাবিদের মতানুসারে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য। কারণ রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ ও শ্রেণীবিভক্ত করা যায় এবং এইভাবে বিশ্লেষিত ও শ্রেণীবিভক্ত জ্ঞান থেকে সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠা করা যায়। জর্জ ক্যাটলিন (G. Catlin) – ও অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য নয়: পক্ষান্তরে, বিরুদ্ধবাদীরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁদের স্পষ্ট অভিমত হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য নয়। বাক্‌ল, কঁৎ, মেইটল্যাণ্ড প্রমুখ চিন্তাবিদ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। মেইটল্যাও (Maitland)-এর মতে, “কোন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের শিরোনাম হিসাবে যখন ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ কথাটি লেখা দেখি, তখন প্রশ্নগুলির জন্য আমার দুঃখ হয় না, দুঃখ হয় ঐ শিরোনামটির জন্য” (“When I see a… set of examination question headed by the word ‘Political Science’, I regret not the questions but the title.”)। যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসাবে মেনে নিতে রাজী নন, তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।

(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়সমূহ বিশেষ অনিশ্চিত, ব্যাপক ও জটিল। ফলে বিষয়বস্তুর পরীক্ষাকার্য, গবেষণা এবং শ্রেণীবিভক্তিকরণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সহজসাধ্য নয়। ভৌত বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুগুলিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুসমূহকে তেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা সম্ভব হয় না।

(২) বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অচল। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জড় পদার্থ সকল দেশেই একই গুণবিশিষ্ট এবং পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই ফল প্রদান করে। কিন্তু মানবসমাজে বা রাষ্ট্রে স্থান-কাল ভেদে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। সেইজন্য সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। মহামতি গোখলে (Gokhale)-এর মতে, ‘রাজনীতিক অবস্থা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা যায় না। কারণ মানুষ ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন এবং মানুষকে প্রাণহীন যন্ত্র হিসাবে গণ্য করা যায় না’ (“Political condition cannot be artificially created because man has will-power and cannot be treated like a lifeless tool.”)।

(৩) নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে বস্তুজগতের গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তেমন কোন নির্দিষ্ট নিয়ম কার্যকরী হয় না। এই কারণে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বা নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয় না।

(৪) প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের গবেষণাগার চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিষয়বস্তুর অধিকাংশই বাহ্যিক এবং পরিবেশ নির্ভর, সুতরাং নিয়ন্ত্রণাতীত। সেই কারণে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সকল সিদ্ধান্ত সকল ক্ষেত্রে নির্ভুল হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে অনেক ক্ষেত্রেই অনুমানের উপর নির্ভর করতেই হয়। তাই অনেকের অভিযোগ হল যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ অনুমানসিদ্ধ, বিজ্ঞানসম্মত নয়।

(৫) ভৌত বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানিগণ সম্পূর্ণ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের আলোচনা একেবারে মূল্যমান-নিরপেক্ষ। বিষয়বস্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এইসব বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত ভাল-মন্দের ধ্যান-ধারণার কোন প্রভাব থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনা মূল্যমান নিরপেক্ষ নয়। তাঁরা ব্যক্তিগত ঔচিত্য-অনৌচিত্য বোধের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন এবং একেবারে নিরপেক্ষভাবে বিষয়বস্তুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। বিষয়ের ফলাফলের উপর তাঁরা মতামত জ্ঞাপন করেন। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মূল্যমান-নিরপেক্ষ না হয়ে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে পড়ে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান যথার্থ বিচারে ভৌত বিজ্ঞানের মর্যাদা দাবী করতে পারে না।

(৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গবেষণার কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ কোন সর্বসম্মত পদ্ধতি সৃষ্টি করতে পারেননি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সর্বপ্রধান অস্ত্র হল ‘পরীক্ষা’ (experiment)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই অস্ত্র প্রয়োগ করার সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারিক বা পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সাহায্যে বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে না। রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি শাস্ত্রের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ও সুসংহত পদ্ধতিতে বিষয়বস্তুর গভীর তথ্যাদি আবিষ্কৃত হয়। সংশ্লিষ্ট পদ্ধতির ভিত্তিতে আগেভাগে প্রতিপাদ্য বিষয়ে স্থির সত্য অনুধাবন করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু গবেষণার ক্ষেত্রে এ রকম কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় না।

(৭) বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, এমনকি অণু-পরমাণুকে নিয়েও ভৌত বিজ্ঞানে আলোচনা ও গবেষণা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কিন্তু সমাজস্থ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা তার কাজকর্ম, চিন্তা-ভাবনা প্রভৃতিকে নিয়ে গবেষণা বা আলোচনা অসম্ভব। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে সমাজবদ্ধ মানুষ সম্পর্কে সামগ্রিক আলোচনাই সম্ভব। এই কারণে মার্কসবাদী দর্শনে ব্যক্তি মানুষের পরিবর্তে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

(৮) গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-এর মতানুসারে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কোন স্থির নির্দিষ্ট এবং সম্ভাবনাপন্ন সূত্রের সন্ধান পাওয়া মুশকিল। কারণ, বিষয়বস্তু প্রায়ই পরিবর্তিত হয় এবং ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বিভিন্নভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাবনীয়ভাবে ঘটে। তিনি বলেছেন: “In Political Science it is difficult to find uniform and univarying laws. The material is constantly varying. Actions and reactions take place in various and often unforeseen ways.” রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভৌত বিজ্ঞানের মত কখনই কতকগুলি সমস্যা সম্পর্কে সুসামঞ্জস্য জ্ঞান নয়।

(৯) বস্তুজগতের যে কোন উপাদান এবং তার অণু-পরমাণুকে নিয়ে ভৌত বিজ্ঞানে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারার কেবল রাজনীতিক গতি প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ব্যক্তি মানুষের আচার-আচরণ, ক্রিয়া-কলাপ, চিন্তা-চেতনা প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয় না। এক্ষেত্রে ভৌত বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি কোন কাজে আসে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ব্যক্তিমানুষকে নিয়ে কোন অনুসন্ধান চালাতে পারে না। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে সমাজবদ্ধ মানুষ সম্পর্কে সামগ্রিক আলোচনাই সম্ভব।

(১০) রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বস্তুকে নমুনা হিসাবে দেখানো হয়। বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দার্শনিক মনন ও মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেন। এঁদের আলোচনা তথ্যের থেকে অধিকতর তত্ত্বনির্ভর। 

(১১) কঁৎ (Comte)-এর মতানুসারে (ক) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পদ্ধতি, নীতি ও উপসংহার সম্পর্কে মতৈক্যের অভাব আছে; (খ) অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার অভাব আছে; এবং (গ) বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সুস্পষ্টতার অভাব আছে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞানের মর্যাদা পেতে পারে না।

(১২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার পদ্ধতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। অ্যারিস্টটল ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্লেটো দার্শনিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্র আলোচনা প্রসঙ্গে প্লেটো দার্শনিক রাজার দ্বারা শাসিত এক সাম্যবাদী রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রে সাম্যবাদের অস্তিত্ব নেই।

(১৩) সরকার তার কাঠামো এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যায়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, আইনসভার গঠন, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। 

(১৪) পরিমাপ হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানে বাতাসের আর্দ্রতা পরিমাপ করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা পরিমাপ করা যায় না। মানুষের রাজনীতিক কাজকর্মের সঙ্গে বিভিন্ন মানবিক উপাদান যুক্ত থাকে। কিন্তু এই সমস্ত উপাদানের পরিমাপ অসম্ভব।

(১৫) আলোচ্য বিষয়বস্তু যদি অতিমাত্রায় পরিবর্তনশীল বা গতিশীল হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর সুষ্ঠু বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা বা সাধারণ নিয়ম নির্ধারণ অসম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুও পরিবর্তনশীল ও গতিশীল। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান: বস্তুতপক্ষে, উপরিউক্ত যুক্তিগুলোর সারবত্তা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কখনই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমগোত্রীয় হতে পারে না। তবুও স্বীকার করতে হবে যে রাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান ইতিহাসের মধ্যে একটা মিল আছে। তুলনামূলকভাবে রাষ্ট্রের ইতিহাস আলোচনা ও সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের দ্বারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি, শাসন-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তার সত্যতা মোটামুটিভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণও অধিকমাত্রায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ও পন্থা-পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। ব্রাইস (Bryce)-এর মতে, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান (“Political Science is a progressive science.”) I

প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞান কোন দিক দিয়েই সমজাতীয় নয়। বিষয়বস্তুর প্রকৃতি, আলোচনার পদ্ধতি, উদ্দেশ্য, বিচার-বিশ্লেষণের কলাকৌশল প্রভৃতি ক্ষেত্রে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারতম্য বর্তমান। মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারার সুবিন্যস্ত পর্যালোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারা থেকেই তাঁদের যাবতীয় রসদ ও অভিজ্ঞতা আহরণ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে ম্যাকেঞ্জীর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার The Study of Political Science Today শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The word ‘science’ here indicates simply that there exists an academic tradition of the study of politics, a discipline communicated from teacher to pupil, by speech and writing, for some 2500 years now. It does not mean that this discipline claims to be a natural science or that it can be improved by copying the methods of physics and chemistry.”

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোন ভৌত বিজ্ঞান নয়। এ কথা ঠিক। এতদ্‌সত্ত্বেও বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিষয়বস্তুর গবেষণার ক্ষেত্রে সাফল্যের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ইতিহাস থেকে তথ্যাদি সংগ্রহের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের ব্যাপারে তাঁরা বহুলাংশে কৃতকার্য হয়েছেন। অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রের অবসান ও জুলুমশাহীর আবির্ভাবের কারণ, আইনের সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনীয়তা, গণ-অভ্যুত্থানের কারণ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে কতকগুলি বৈজ্ঞানিক সূত্র উদ্ভাবন করেছেন। বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবে এগুলি স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রায় ১৫৮টি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করে অ্যারিস্টটল এই সমস্ত মূল সূত্রগুলি আবিষ্কার করেছেন। এই গ্রীক পণ্ডিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এইভাবে তিনি আলোচ্য শাস্ত্রটিকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে সাহায্য করেছেন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও বস্তুবাদ: আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছিল ঐতিহাসিক, দার্শনিক বা আইনগত দৃষ্টিভঙ্গীর উপর প্রতিষ্ঠিত। তখন এই বিজ্ঞান যতটা তত্ত্বনির্ভর ছিল ততটা তথ্যনির্ভর ছিল না। কল্পনার প্রাধান্য ও আদর্শের গুরুত্ব ছিল বেশী; বস্তুনির্ভরতা ছিল কম। রাষ্ট্রনীতিতে আধুনিকতার সূত্রপাত করেন মেকিয়াভেলি। হবস্ হলেন বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত রাষ্ট্রনীতির অগ্রদূত। মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তার দ্বারা রাষ্ট্রনীতি বাস্তবমুখী ও বিজ্ঞাননির্ভর হয়েছে। মার্কসবাদ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বা জ্ঞানতত্ত্বের (epistemology) মাধ্যমে রাজনীতির মূল সত্যকে প্রকাশ করেছে।

সাম্প্রতিককালে অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা (Empirical Theorists) বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রে সাধারণ তত্ত্বের (general theory) অবতারণা করেন। আচরণবাদীরা (Behaviouralists) ভৌত বিজ্ঞানের মত বিভিন্ন গাণিতিক তত্ত্ব ও পরিসংখ্যান পদ্ধতি প্রয়োগের সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। যদি সুশৃঙ্খল পঠন-পাঠন ও ব্যাপক গবেষণার ভিত্তিতে সুসংবদ্ধ নিয়ম ও ব্যবস্থার আলোচনাকে বিজ্ঞান বলা হয়, তা হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবশ্যই একটি বিজ্ঞান। কেবল ধ্রুববিজ্ঞানকে (cardinal science) বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য না করে যদি সুসংবদ্ধ জ্ঞান অর্জনকে বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করা হয় তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের মধ্যে আপেক্ষিক সম্পর্কের সূত্র প্রদান করা যায়।

ব্রাইস-এর মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আবহাওয়াবিদ্যার মত একটি অপরিণত বিজ্ঞান। রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতির সমপর্যায়ের বিজ্ঞান না হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। বর্তমানে গাণিতিক তত্ত্ব ও পরিসংখ্যানের প্রয়োগের ভিত্তিতে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ, পরিশীলিত অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডার রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বহুলাংশে বিজ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছে।

আধুনিক কালে এই ধারণা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও সমর্থিত যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ব্যাপক অর্থে বিজ্ঞানসম্মত হওয়া আবশ্যক। সঠিক ও সম্পূর্ণ অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিজেকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিপন্ন করতে পারে। আলোচ্য সামাজিক বিজ্ঞানটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতিসমূহ অবলম্বন করতে পারে। মার্কসবাদী ও দৃষ্টবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধরনের দাবি করেন। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আচরণবাদী বিপ্লবের মধ্যেও এধরনের চিন্তা-ভাবনার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতির একটি বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ আকর্ষণ অধুনা অত্যধিক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনা নিরপেক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্যের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। তারফলে রাজনৈতিক দুনিয়া সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ধ্যান-ধারণা অর্জন করা সম্ভব হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অভিজ্ঞতামূলক সাক্ষ্য-প্রমাণ ভিত্তিক তথ্যাদি এবং নৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শভিত্তিক মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। তথ্যাদি বা ঘটনাসমূহ বস্তুনিষ্ঠ। এগুলি বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রদর্শন করা যায় বা তুলে ধরা যায়। এবং এসবের সমর্থনে সাক্ষ্য-প্রমাণ দেওয়া যায়। অপরদিকে মূল্যবোধ হল অন্তর্নিহিতভাবে মূলত ধারণাগত ও বহুলাংশে ব্যক্তিগত বিষয়।

তবে রাজনীতির বিজ্ঞান সম্যকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এই সমগ্র প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

এক: প্রথম প্রতিবন্ধকতা হিসাবে পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখযোগ্য। মানুষ গিনিপিগ নয়। মানুষকে নিয়ে গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। মানুষের অন্তরের বিষয়টি অজ্ঞাত থাকে। ব্যক্তিবর্গের আচার-আচরণ নিয়ে যাবতীয় সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা ভাসাভাসা, অনুমানসাপেক্ষ বিষয়াদির উপর নির্ভরশীল এবং নানা কারণে সীমাবদ্ধ প্রকৃতির। এ প্রসঙ্গে অ্যানড্র হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “In the absence of exact data, we have no reliable means of testing our hypotheses. The only way round the problem is to ignore the thinking subject altogether by subscribing to the doctrine of determinism.”

দুই: গোপন মূল্যবোধের অস্তিত্বও রাজনীতি বিজ্ঞানের যথার্থ বিজ্ঞান হয়ে উঠার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে দাবি করা হয় যে, রাজনীতির মতবাদ ও মডেল সম্পর্কিত ধারণাসমূহ মূল্যবোধ নিরপেক্ষ। কিন্তু সম্যকভাবে বিচার-বিবেচনা করলে এই দাবি টিকে না। মানবসমাজ, মানুষের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রভৃতির অপ্রকাশ্য রাজনীতিক ও মতাদর্শগত ব্যঞ্জনা বর্তমান। এসবের অনুমানের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মতবাদসমূহ গঠিত হয়। ঘটনাসমূহ বা তথ্যাদির সঙ্গে মূল্যবোধ গভীরভাবে সংযুক্ত। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “A conservative value biascan be identified in behaviouralism, rational – choice theories and systems theory. Similarly, feminist political theories are rooted in assumptions about the nature and significance of gender divisions.”

তিন: রাজনীতি-বিজ্ঞানের আলোচনায় নিরপেক্ষ প্রকৃতির বিষয়টি অনেক সময় তুলে ধরা হয়। কিন্তু রাজনীতি বিজ্ঞানের আলোচনা নিরপেক্ষ এ রকম দাবি অমূলক। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের আলোচনার ও ফলাফলের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা, কেবলমাত্র কঠিন নয়, কার্যত অসম্ভব। পারিবারিক পটভূমি, আর্থনীতিক অবস্থা, সামাজিক অভিজ্ঞতা, ব্যক্তি মানুষের আবেগ-অনুভূতি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতি এবং মানুষের জীবনধারার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কোনকিছু ধারণা স্থায়িভাবে গড়ে উঠে। এই মানবসমাজ এবং সমাজের কাঠামো ও কার্যাবলী সম্পর্কে রাজনীতির আলোচনা করা হয়। স্বভাবতই বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা রাজনীতি বিজ্ঞানের আলোচনায় অসম্ভব। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…scientific objectivity in the sense of absolute impartiality or neutrality must always remain and untouchable good in political analysis, however regorous our research methods may be. Perhaps the greatest threat to the accumulation of reliable knowledge thus comes not from bias as such, but from the failure to acknowledge bias, reflected in bogus claims to political neutrality.”