অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসর আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্মান ও ক্ষমতার জীব। গুণ-ক্ষমতা ও যােগ্যতার প্রেক্ষিতে মানুষ বিচিত্র এবং পরস্পর নির্ভরশীল। মূলত এ কারণে মানুষ বাঞ্ছিত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় সমাজ গঠন করে। আর এই সমাজকে সুষ্ঠু সামঞ্জস্যশীল উপায়ে পরিচালনার মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা, ঐক্য, সংরক্ষণ ও বিকাশধারা প্রবর্তনের জন্য গঠন করা হয় রাষ্ট্র। তাই সহজ কথায় বলতে গেলে, যে বিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে, তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিসর ও পরিধিঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিবর্তন, স্বরূপ, নীতি, আদর্শ, কার্যকলাপ প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধি ও বিষয়বস্তু। সুতরাং রাষ্ট্রই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল ও কার্যাবলীই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি। রাষ্ট্র ও মানুষের রাজনৈতিক জীবনসংক্রান্ত সকল বিষয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
(১) রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করা হয়। এক্ষেত্রে বিখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের ধ্যান-ধারণা আলােচনা করা হয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক তত্ত্বের কতগুলাে মৌলিক ধারণা, যেমন-সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকবাদ, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি ও এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
(২) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই আলােচনার ক্ষেত্রে দেশের সংবিধান, সরকারি কাঠামাে, রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর সংগঠন ও কার্যকলাপ, বিভিন্ন সরকারি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন, জনমত ও প্রচারণার প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করা হয়।
(৩) রাজনৈতিক আচরণঃ আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সাম্প্রতিক উন্নয়ন। এর মাধ্যমে ব্যক্তি, গােষ্ঠী ও দলের রাজনৈতিক আচরণ মূল্যায়ন করা হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে নাগরিকের রাজনৈতিক আচরণ মূল্যায়ন।
(৪) রাজনৈতিক মতবাদঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কার্যাবলী ও পরিচালনা সংক্রান্ত বিভিন্ন মতামত নিয়ে আলােচনা করা হয়। যেমন-বিবর্তন মতবাদ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ,সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে আললাচনা করা হয়। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংগঠন যেমন- ন্যাটো, সেন্টো, সিয়াটো, আসিয়ান, আফটা, নাফটা, সাপটা, সার্ক ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে।
(৫) তুলনামূলক রাজনীতিঃ সাম্প্রতিককালে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দুই বা ততােধিক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধ্যয়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। দুটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলােচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভিন্ন দেশের শাসনব্যবস্থার দোষ, গুণ, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক ইত্যাদির ব্যাপক বিশ্লেষণ করে।
(৬) আইনব্যবস্থাঃ আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া, কার্যাবলী ও উৎস, আইনের শাসন, নিয়মতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার ইত্যাদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ বিষয়গুলাে নিয়ে পর্যালােচনা করলে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষ। এগুলাে পড়ে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
(৭) বিচারব্যবস্থাঃ বিচার বিভাগীয় কার্যপ্রক্রিয়া, প্রশাসনিক কাজের ওপর বিচারবিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলােচ্য বিষয়। বিচারবিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম একটি। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় বিচারবিভাগ ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত আলােচনা একটি আবশ্যিক বিষয়।
(৮) লােক প্রশাসনঃ লােক প্রশাসন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়, কারণ এটা রাজনীতির অংশবিশেষ। প্রশাসন যন্ত্রের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠন, সরকারি কর্মচারীগণের নিয়ােগ এবং তাদের কার্যাবলা ও দায়িত্বশীলতা, সরকারি তহবিল পরিচালনা প্রভৃতি বিষয় লােক প্রশাসনের আলােচনার অন্তর্ভূক্ত।
(৯) আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ সমগ্র পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলােচিত হয়। আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সংগঠন, কূটনীতি, জাতীয়তাবাদ, প্রতিরক্ষার সাথে সম্পর্কিত ব্যাপক সমস্যা প্রভৃতি সব কিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়।
(১০) জোট নিরপেক্ষতা ও যৌথ নিরাপত্তাঃ উন্নয়নশীল দেশগুলাের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনা করেন। জোটনিরপেক্ষতা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের অস্তিত্বের সহায়ক। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান যৌথনিরাপত্তার সংস্থা জাতিপুঞ্জ এবং জাতিসংঘের কার্যক্রম নিয়ে আলােচনা করে।
(১১) অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন (Discipline) বা বিষয়ের সাথে তার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নিয়ে আলােচনা করে থাকে। যার ফলে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্কের সুস্পষ্টরূপ প্রতিফলিত হয়।
(১২) অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মপন্থায় সমন্বয়ঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রব্যবস্থার অতীতকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্তমান ব্যবস্থাকে সূদৃঢ় করে। একইভাবে বর্তমান ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যত রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক ধারণা প্রদান করে।
(১৩) স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তজাতিক বিষয় সম্পর্কে ধারণাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান স্থানীয় বিষয় যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম সরকার ইত্যাদির গঠন কাঠামােসহ সার্বিক আলােচনার মাধ্যমে জাতীয় ব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তি দান করে। আবার জাতীয় বিষয়- সরকার, দল ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটন করে। আন্তর্জাতিক প্রাতষ্ঠান, যেমন- জাতি সংঘ, ইউনিসেফ, কমনওয়েলথ, ADB, IDB ইত্যাদি সার্বিক বিষয়ের ওপর আলােচনা করে থাকে।
(১৪) রাজনৈতিক অধিকারঃ রাষ্ট্র হচ্ছে একজন নাগরিকের সকল প্রকারের অধিকারের উৎস। একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বকে স্পষ্ট করে তােলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনৈতিক অধিকারের দলিলস্বরূপ।
(১৫) আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতিঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান যেমন- নির্বাচন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্টী ইত্যাদি এবং অনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দুদক, টি.আই.টি ইত্যাদি নিয়ে আলােচনার মাধ্যমে এর স্বরূপ উদ্ঘাটন করে থাকে।
পরিশেষঃ সার্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি অনেক। যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের কয়েকটি বিশেষ বিষয়ের নয় বরং রাষ্ট্রের সকল বিষয়ের সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে আলােকপাত করে, যা বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞানে পরিণত করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
Leave a comment