কার্যবাদ (functionalism)-এর প্রয়োগ প্রথম পরিলক্ষিত হয় জীবনবিজ্ঞানে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কাঠামো কার্যগত দৃষ্টিভঙ্গী গৃহীত হয়েছে সমাজতত্ত্ব ও সামাজিক নৃতত্ত্ব থেকে। নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত ‘কাঠামো-কার্যগত তত্ত্ব’ বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রেও অনুসৃত হচ্ছে। কাঠামো-কাৰ্যগত পদ্ধতি হল রাজনীতিক ব্যবস্থা বিষয়ক সাধারণ তত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য রূপ। এই তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে নৃতত্ত্ববিদ ম্যালিনাউস্কি (B. Malinowski) ও ব্রাউন (Radcliffe Brown) এবং সমাজতত্ত্ববিদ ট্যালকট পারসনস্ (T. Parsons), লেভী (Marion Levy), মার্টন (Robert K. Merton) প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োগের প্রবণতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ১৯৫০ সালের পর। আপ্টর, অ্যালমণ্ড (G. A. Almond), পাওয়েল (G. B. Powell) প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রয়োগ করেছেন।
কাঠামো ও কার্যের অর্থ: অ্যালমণ্ড এবং পাওয়েল-কে অনুসরণ করে ‘কাঠামো’ ও ‘কার্য’ বলতে কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics: A Development Approach শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণের মুখ্য বিষয় হল কাঠামো। ‘কাঠামো’ হল সেই সমস্ত পর্যবেক্ষণীয় কার্যকলাপ যাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘রাজনীতিক ব্যবস্থা’। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল বলেছেন: By structure we means the observable activities which make up the political system.” তাঁরা আরও বলেছেন যে, কাঠামো হল রিস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নির্দিষ্ট ভূমিকাসমূহের সমন্বয় (“We refer to particular sets of roles which are related to one another as structures. “)। রাজনীতিক ব্যবস্থা যে সমস্ত পর্যবেক্ষণীয় কার্যকলাপকে নিয়ে গঠিত হয় তাদের মধ্যে একটা নিয়মানুবর্তিতা (regularity) থাকতে হবে। কেবল রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেই রাজনীতিক কার্যকলাপ সম্পর্কযুক্ত থাকে। মার্টন-এর মতে ‘কাঠামো’ বলতে কোন ব্যবস্থার অন্তর্গত সেই সমস্ত ব্যবস্থাদি (arrangements)-কে বোঝায় যেগুলি কার্যাবলী সম্পাদন করে। অন্যভাবে বলা যায় যে, কাঠামো হল কোন ব্যবস্থার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত কতকগুলি সামাজিক সংগঠন বা কেন্দ্র যার মাধ্যমে কার্য সম্পাদিত হয়। আর রাজনীতিক পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির বা সংগঠনের ক্রিয়াকলাপকে কার্য (function) বা ভূমিকা (role) বলা হয়। ভূমিকা বলতে রাজনীতিক ভূমিকার কথা বলা হয়। রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যক্তির কাজকর্ম বা আচরণের যে অংশ যুক্ত থাকে তাকে বলে রাজনীতিক ভূমিকা। ভূমিকা হল রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি মূল একক। দৃষ্টান্ত হিসাবে আইনসভার কথা বলা হয়ে থাকে। আইনসভাকে ‘কাঠামো’ এবং আইনসভার সদস্যপদকে বা আইন প্রণয়নকে ‘ভূমিকা’ বা কার্য হিসাবে গণ্য করা যায়। অনুরূপভাবে অ্যালমণ্ড আদালতকে বলেছেন কাঠামো এবং বিচারকের পদ বা বিচারকার্যকে বলেছেন ভূমিকা।
কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব সমাজের অতি প্রয়োজনীয় ‘কাঠামোগুলি’ নির্ধারণ করে তাদের কার্যকলাপ স্থির করতে চায়। আবার কতকগুলি ‘কার্য’ নির্ধারণ করে তারা কোন কাঠামো থেকে সম্ভুত তা বিশ্লেষণ করতে চায়। বল বলেছেন: It is a means of explaining what political structures perform what basic functions in the political system and it is a tool of investigation.”
মার্টনের ধারণা: রবার্ট মার্টন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই নতুন অনুধাবন পদ্ধতিটি সম্পর্কে নতুন ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে একই কাঠামো বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে পারে। আবার অভিন্ন কার্য বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমে হতে পারে। যেমন, কোনও একটি রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামো হিসাবে রাজনীতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, সরকারী বিভাগসমূহ প্রভৃতির কথা বলা যায়। রাজনীতিক দল একটি কাঠামো হয়েও ভোটদাতাদের বক্তব্য সরকারকে জানানো, রাজনীতিক বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নির্বাচকদের সতর্ক করা প্রভৃতি কাজ করে থাকে। সেই রাজনীতিক ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও এই সমস্ত কাজ করে। কার্য (functions)-কে মার্টন পর্যবেক্ষণশীল (observed consequences) ফলাফল হিসাবে ব্যক্ত করেছেন। এর দ্বারা নির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থার সঙ্গতি রক্ষা করা যায়। তিনি অ-কার্য (dysfunctions) প্রসঙ্গেও বলেছেন। যে ফলাফল ব্যবস্থার সামঞ্জস্য সাধনের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে তা হল অ-কার্য। তিনি আবার স্বীকৃত কার্য (recognised functions) ও উদ্দিষ্ট কার্য (intended functions) বিষয়েও আলোচনা করেছেন। আবার এর বিপরীত কার্য বিষয়েও আলোচনা করেছেন। কার্য আবার পরিস্ফুট (manifest) বা নিহিত (latent) হতে পারে। পরিস্ফুট কার্য হল সুস্পষ্ট। ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাঠামো এই কার্য সম্পাদন করে। যেমন, আইনের ব্যাখ্যা করা হল আদালতের সুস্পষ্ট কার্য। অপরদিকে নিহিত কার্য সম্পাদনের পিছনের কাঠামোর কোন পরিকল্পিত উদ্দেশ্য থাকে না। যেমন, আদালতের আইনের ব্যাখ্যা থেকে জনগণ আইনের অর্থ সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করে তা হল আদালতের নিহিত কার্য।
মূল বক্তব্য: এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাঠামো নির্ধারণ করে তাদের কার্য বিশ্লেষণ করা হয়, বা কতকগুলি কার্যের ভিত্তিতে তাদের কাঠামো সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয়। এই তত্ত্বে বলা হয় যে সমাজ হল বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ একটি সুসংহত সামগ্রিক ব্যবস্থা। এর অংশ বা উপাদানগুলি সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করে। আবার উপাদানগুলির পারস্পরিক কার্যকলাপ সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে। সমাজের মধ্যে সঙ্কট বা বিচ্যুতির সৃষ্টি হলেও স্বাভাবিকভাবেই তা দূরীভূত হয় এবং পুনরায় ভারসাম্য ফিরে আসে। সমাজের সংহতি বা কাঠামোর স্থায়িত্ব রক্ষা করাই এই তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধ সম্পর্কে ঐকমত্য এবং লক্ষ্য ও নীতির ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য। বলা হয় যে সমাজব্যবস্থা হল একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। এর কাঠামো ও কার্যের পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বারাই যে-কোন পরিবর্তন ধীরে ধীরে সম্পাদিত হয়। তার ফলে সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে, স্থিতাবস্থা নষ্ট হয় না।
রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক–অ্যালমণ্ডের ব্যাখ্যা: অ্যালমণ্ডের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে ব্যক্তির পর্যবেক্ষণীয় আচরণের সঙ্গে সঙ্গে তার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি ও প্রবণতা যুক্ত থাকে। অ্যালমণ্ড রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রবণতাগুলিকে মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা (psychological dimension) হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর মতানুসারে একেই বলে রাজনীতিক সংস্কৃতি। সমগ্র জনগণের মধ্যে যে মূল্যবোধ, বিশ্বাস, বিচক্ষণতা ও দৃষ্টিভঙ্গী বর্তমান তাদের নিয়েই গঠিত হয় এই রাজনীতিক সংস্কৃতি। রাজনীতিক ব্যবস্থার যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণের স্বার্থে রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে জনগণের সকলের মধ্যে সব সময় অভিন্ন প্রবণতা আশা করা যায় না। জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রবণতার পার্থক্য থাকতে পারে এবং থাকে একেই বলে উপসংস্কৃতি। সামাজিকীকরণ হল রাজনীতিক ব্যবস্থার আর একটি অঙ্গ। ব্যক্তি যাতে সাবালক অবস্থায় রাজনীতিক ব্যবস্থায় অভিপ্রেত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে শৈশব অবস্থা থেকেই তাকে প্রচলিত রাজনীতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে বা রাজনীতিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলা হয়। কাঠামো, বিভিন্ন ভূমিকার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া, মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা, উপব্যবস্থা প্রভৃতিকে নিয়ে গঠিত হয় রাজনীতিক ব্যবস্থা। অ্যালমণ্ডের মতানুসারে এ রকম একটি প্রক্রিয়া গড়ে উঠে ব্যবস্থা বা পরিবেশের ভিতর থেকে আসা উপকরণসমূহকে নিয়ে। এই সমস্ত উপকরণ নানাভাবে উপপাদে পরিণত হয়।
রাজনীতিক ব্যবস্থায় উপকরণ ও উপপাদ্যের মধ্যে বিরতিবিহীন প্রবাহটিকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষের ভূমিকাকে তার কার্যত (functional) দিক বলা হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার কার্যগত দিক নির্দেশ করে উপকরণ উপপাদের প্রবাহ। রাজনীতিক প্রক্রিয়া এবং তার ক্রিয়াগত দিক পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত।
অ্যালমণ্ডের ব্যাখ্যা: ইস্টন-এর মত অ্যালমগুও রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা বলেছেন। সমাজ পরিবেশকে প্রভাবিত করে এবং পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশের সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থার একটা সীমারেখা আছে। রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় থাকে। অ্যালমণ্ডের মতানুসারে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় তিন ধরনের কার্য সম্পাদন করতে হয়:
-
(ক) রূপান্তর সংক্রান্ত কার্য,
-
(খ) ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও সংগতি সাধন সংক্রান্ত কার্য এবং
-
(গ) ব্যবস্থার সামর্থ্য সংক্রান্ত কার্য।
(ক) রূপান্তর সংক্রান্ত কার্য – রূপান্তর সংক্রান্ত কার্য ও তার শ্রেণী বিভাগ: রূপান্তরমূলক কার্য বলতে বোঝায় রাজনীতিক ব্যবস্থায় কিভাবে চাহিদা ও সমর্থন অর্থাৎ উপকরণ (input) রূপান্তরিত হয়ে সিদ্ধান্তে অর্থাৎ উপপাদে পরিণত হয় ও কার্যকর হয়। কর্তৃপক্ষের সামর্থ্য রূপান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। রূপান্তর সংক্রান্ত কাজের মধ্যে কতকগুলি উপকরণ সম্পর্কিত এবং কতকগুলি উপপাদ সম্পর্কিত। এই রূপান্তরমূলক কার্য ছ’ধরনের: (১) স্বার্থের গ্রন্থিকরণ (interest articulation) —অর্থাৎ বিভিন্ন দাবিকে সংগঠিত করা এবং সিদ্ধান্তকারী রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের নজরে আনা। স্বার্থের গ্রন্থিকরণ এই কাজটির সঙ্গে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কযুক্ত। অ্যালমণ্ডের মতানুসারে স্বার্থের গ্রন্থিকরণ কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (২) স্বার্থের সমষ্টিকরণ (interest aggregation)—অর্থাৎ বিভিন্ন দাবিকে সমন্বিত করা এবং বিকল্প কার্যপন্থা স্থির করা। স্বার্থের সমষ্টিকরণ কাজটি সম্পাদিত হয় এক বা একাধিক নীতি গ্রহণ বা বিভিন্ন স্বার্থকে জোটবদ্ধ করে। (৩) রাজনীতিক যোগাযোগ সাধন (political communi cation)—অর্থাৎ রাজনীতিক ব্যবস্থা ও তার পরিবেশের ভিতরে রাজনীতিক সংবাদাদি সরবরাহ। (৪) নিয়মকানুন প্রণয়ন (rule-making); (৫) নিয়মকানুনের প্রয়োগ (rule-application) এবং (৬) নিয়মকানুনের সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন (rule-adjudiction)। উপকরণ-কাঠামো প্রথম তিনটি এবং উপপাদ কাঠামো পরের তিনটি কার্য সম্পাদন করে। সরকারের তুলনায় বিভিন্ন উপব্যবস্থা বা সরকারের প্রতিনিধিরাই উপকরণ সম্পর্কিত কাজগুলি অধিক করে থাকে। তবে সরকার নিজে, আদালত ও আমলাতন্ত্র উপপাদ সম্পর্কিত কাজগুলি সম্পাদন করে থাকে।
(খ) রাজনীতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও সংগতি সাধন সংক্রান্ত কার্য: রাজনীতিক সামাজিকীকরণ (political socialisation) ও নিয়োগ (recruitment)-এর মাধ্যমে রাজনীতিক ব্যবস্থা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন ভূমিকা সুনির্দিষ্টভাবে পালনের জন্য বিভিন্ন লোক নিয়োগ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে সামরিক কর্মচারী, শুষ্ক কর্মচারী, কূটনীতিক কর্মচারী প্রভৃতি কর্মচারীদের নিয়োগ ও তাদের নির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতির কথা বলা যায়। সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দরকার। সংরক্ষণ ও সংগতি সাধনের জন্য সামাজিকীকরণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
(গ) রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য সম্পর্কিত কার্য –শ্রেণীবিভাগ: অর্থাৎ উপকরণ ও উপপাদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্যকে বোঝায়। এর উপর রাজনীতিক ব্যবস্তার অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল। সমগ্র পরিবেশের মধ্যে রাজনীতিক ব্যবস্থা একটি একক হিসাবে কাজ করে থাকে। পরিবেশের মধ্যে অন্যান্য ব্যবস্থাও বর্তমান। অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থার আচরণ তার সামর্থ্যের পরিচায়ক। এই ধরনের কার্যের অন্তর্ভুক্ত হল: (১) বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য (regulative capability); (২) আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশের দাবিসমূহের প্রতি রাজনীতিক ব্যবস্থার সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য (responsive capability); (৩) সম্পদ সংগ্রহের সামর্থ্য (extractive capability); (৪) সম্পদ বণ্টনের সামর্থ্য (distributive capability); (৫) পতাকা, সামরিক অনুষ্ঠান, রাজনীতিক নেতাদের নীতি সংক্রান্ত বিবৃতি প্রভৃতির মাধ্যমে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতীকী সামর্থ্য (symbolic capability)।
উপরিউক্ত কার্যাদি রাজনীতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমে সম্পন্ন করে। সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন কাঠামোর দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। পরিবেশের সঙ্গে কাঠামো, কার্যাবলী দক্ষতার সংগতি বজায় রাখতে না পারলে রাজনীতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। অপরপক্ষে, রাজনীতিক ব্যবস্থায় চাহিদা ও উপকরণের সঙ্গে সিদ্ধান্ত বা উপপাদের সামঞ্জস্য সাধন করতে পারলে ভারসাম্য বজায় থাকে।
পারসনস্-এর ধারণা: সমাজতত্ত্ববিদ ট্যালকট পারসনস্ (T. Parsons)-ও কাঠামো কার্যগত দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সমাজ হল পরিবর্তনশীল উপাদানসমূহের ব্যবস্থা। কার্যকারণগত বিচারে এই উপাদানগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর ভিত্তিতে পারসনস্ সমাজের বিভিন্ন অংশকে বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তিমাত্রেই তার ভূমিকা পালন করে একটি কার্যকলাপের কাঠামোর ভিতরে। আবার একটি ব্যবস্থার ভিতরে যাবতীয় কার্যকলাপ সংঘটিত হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার অস্তিত্ব বজায় রাখা একান্তভাবে অপরিহার্য। কারণ এই ব্যবস্থার স্বীকৃত মূল্যবোধ অনুসারে সকল স্ব স্ব ভূমিকা পালন করে থাকে। এই ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি ও রক্ষা করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে সমাজের মুখ্য কার্যসমূহের গুটিকয়েক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করতে হয়। পারসনস্ কার্যগত (functional) চারটি ভাগের (categories) এবং কাঠামোগত (structural) চারটি ভাগের (categories) কথা বলেছেন। কার্যগত চারটি ভাগ হল : (ক) ‘Pattern Maintenance’ বা ব্যবস্থা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মূল নীতির প্রতিষ্ঠা; (খ) ‘Integration’ বা ব্যবস্থার এককসমূহের মধ্যে সংহতি রক্ষা; (গ) ‘Addaption’ বা ব্যবস্থার সামর্থ্যের বিকাশ এবং পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন; এবং (ঘ) ‘Goal Attainment’ বা ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। পারসনস্ কাঠামোগত যে চারটি ভাগের কথা বলেছেন সেগুলি হল:
-
(১) ‘Values’ বা মূল্যবোধ—সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি মূল্যবোধের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়;
-
(২) ‘Norms’ বা রীতি—মূল্যবোধ প্রয়োগের পদ্ধতিসমূহ রীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়;
-
(৩) ‘Roles’ বা ভূমিকা— সামঞ্জস্য সাধনের ক্ষেত্রে ভূমিকার কার্য গুরুত্বপূর্ণ; এবং
-
(৪) ‘Collectivities’ বা যৌথ ব্যবস্থা—সমাজব্যবস্থার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে এই যৌথ ব্যবস্থা দরকার।
সমালোচনা: বিরুদ্ধবাদীরা কাঠামো-কার্যগত তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কাঠামো কার্যগত তত্ত্বের সমালোচনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।
(১) এই তত্ত্ব রক্ষণশীল দোষে দুষ্ট। সমাজের স্থিতাবস্থা ও ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারেই এই মতবাদ অতিমাত্রায় আগ্রহী। পরিবর্তনকে এই তত্ত্ব উপেক্ষা করতে চায়। বল বলেছেন: “The approach has been criticised partly because it is concerned with system maintenance and as such tends…to justify to status quo.” কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব পরিবর্তন বিমুখ এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এই তত্ত্ব সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। কোন কাঠামো কিভাবে অস্তিত্ব ও স্থিতাবস্থা রক্ষা করে চলে, এ তত্ত্ব কেবল তাই ব্যাখ্যা করে।
(২) এ হল একটি সীমাবদ্ধ ও অসম্পূর্ণ তত্ত্ব। এর দ্বারা কেবল বর্তমান অবস্থাই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ঐতিহাসিক পর্যালোচনা বা ভবিষ্যতের কোন উদ্দেশ্যমূলক আলোচনা এই তত্ত্বের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে রাজনীতিক জীবনের সকল বিষয়ের আলোচনা করা বা রাজনীতিক জীবনের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে তত্ত্বটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সাধারণ তত্ত্ব হিসাবে গণ্য হতে পারে না। অধ্যাপক বল মন্তব্য করেছেন: “this approach cannot provide a general theory for all aspects of Political Science.”
(৩) এই তত্ত্ব মূল্যবোধের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্রনৈতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি হিসাবে একে সব সময় সঠিক বিবেচনা করা হয় না।
(৪) সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্কের গুরুত্বকে এই তত্ত্বে একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে তাই এই তত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক বলে বিবেচিত হয়।
(৫) কাঠামো কার্যগত দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বীকৃত মূল্যবোধ, আদর্শ ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে সমাজবাসীদের ব্যাপক মতৈক্যের কথা বলা হয়। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। পশ্চিমী উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজগুলিতে আদর্শ, মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মতৈক্য দেখা যায় না।
(৬) এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমাজের সংকট ও সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না। সমাজব্যবস্থায় অনৈক্য ও সংঘাত কেন বিশেষ পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়, এই সমস্ত সংঘাতের সমাধান কিভাবে করা যায়, এ ব্যাপারে এই তত্ত্ব কোন অভিজ্ঞতাবাদী বা ইতিহাস-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গীর সন্ধান দিতে পারেনি। কোন বৃহত্তর সমাজের বিচার-বিশ্লেষণ এই তত্ত্বের মাধ্যমে অসম্ভব।
(৭) আবার সদ্য স্বাধীনতা-প্রাপ্ত কোন দেশ এবং তার সমস্যাদির ক্ষেত্রে এ তত্ত্বের প্রয়োগ অসম্ভব। কারণ এই সমস্ত সদ্য স্বাধীন দেশগুলিতে পরিবর্তনের স্রোত প্রবহমান থাকে। অথচ কাঠামো-কার্যগত তত্ত্ব স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে।
(৮) এই দৃষ্টিভঙ্গীতে পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ও মার্কিন শাসনব্যবস্থার কাঠামোকে আদর্শ বলে মনে করা হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত অ্যালমণ্ডের বক্তব্যের উপাদনসমূহ পশ্চিমী উদারনৈতিক সমাজব্যবস্থা, বিশেষতঃ মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছে। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে অন্যান্য অনুন্নত দেশসমূহের রাজনীতিক ব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণকে বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না। স্বভাবতই এই তত্ত্বের সর্বজনীনতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। তা ছাড়া এই দৃষ্টিভঙ্গীর উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো সংরক্ষণ।
(৯) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকেও এই তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়। এই তত্ত্বে সমাজের অর্থনৈতিক প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর তেমন জোর দেওয়া হয় না। এই তত্ত্বে সমাজকে একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা (built-in-mechanism) হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। শ্রেণী-সংগ্রাম, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রভৃতি ইতিবাচক দিককে অগ্রাহ্য করা হয়। সমাজের সমস্যাদির সমাধানের ক্ষেত্রে এ সবের গুরুত্বকে স্বীকার করা হয় না। এই তত্ত্বে সমাজের গুণগত পরিবর্তন ও পরিমাণগত পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা হয়নি।
গুরুত্ব: বছবিধ বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও এই মতবাদের তাৎপর্য হল এই যে, সমাজব্যবস্থার জটিলতা এবং সমাজের বিভিন্ন অংশ উপাদানের পারস্পরিক ভূমিকা বিশ্লেষণে এই তত্ত্ব সাহায্য করে। এই তত্ত্বে সমাজের বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ের ধারণা এবং ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কথা অস্বীকার করা যায় না। এ বিষয়ে অ্যালমণ্ড এবং পাওয়েলও সতর্ক ছিলেন।
Leave a comment