পার্থক্যের মূল ভিত্তি: মানুষের রাজনীতিক জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা শুরু হয় অতি প্রাচীনকালে। বস্তুত প্রাচীন গ্রীসে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনায় রাজনীতিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। সেই সময় থেকেই রাজনীতিক জীবনের পর্যালোচনার ধারা আজও অব্যাহত আছে। তবে পর্যালোচনার এই ধারায় বর্তমানে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু অতীতে রাজনীতিক জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হত, যে সমস্ত বিষয়কে রাজনীতিক আলোচনার অঙ্গীভূত বলে মনে করা হত এবং যে সকল পদ্ধতির সাহায্যে তাদের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হত সেই সমস্ত ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ ভিন্ন মত ও ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ফলে আলোচনার বিষয়বস্তু, লক্ষ্য এবং পদ্ধতির ক্ষেত্রে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

(১) ঐতিহ্যবাদী আলোচনা রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক, কিন্তু আধুনিক আলোচনা তা নয়: ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনা ছিল রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। মানুষের রাজনীতিক জীব হিসাবেই বিবেচনা করা হত। প্লেটো, এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করতেন মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিকাশ ও কল্যাণ কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব। এজন্য তাঁরা তাঁদের আলোচনাকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আইনের আলোচনার মধেও সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ মানুষের রাজনীতিক আচরণকে তার সামাজিক আচরণের এক প্রকাশ বলেই মনে করেন। এই কারণে এখন বৃহত্তর সামাজিক পটভূমিতে অন্যান্য সামাজিক আচরণের সঙ্গেই তার রাজনীতিক আচরণকে পর্যালোচনা করা হয়। 

(২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে পার্থক্য: প্রকৃত প্রস্তাবে উপরিউক্ত মৌল দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্য হল গুরুত্বপূর্ণ। এই পার্থক্যের কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাদী ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ সরকার, রাষ্ট্র, সার্বভৌমিকতা এবং কর্তৃত্ব ইত্যাদির নিরীখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিকভাবে, রাজনীতি সম্পর্কিত তাঁদের ধারণা ছিল সংকীর্ণ। অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতি সম্পর্কে ধারণার সম্প্রসারণ ঘটেছে। ডেভিড ইস্টন এবং হ্যারল্ড লাসওয়েল প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলি বর্তমানে গ্রহণ করা হয়। ইস্টন বিষয়বস্তুকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ। এবং লাসওয়েলের ভাষায় এটা হল “who gets what, when and how.” নিঃসন্দেহে এই সংজ্ঞা দুটি এবং প্রদত্ত অন্যান্যা আধুনিক সংজ্ঞাগুলি ঐতিহ্যবাদী সংজ্ঞাগুলি থেকে অস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থক। কিন্তু এই আধুনিক সংজ্ঞাগুলি থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রতিপন্ন হয়। বিষয়টি হল এই যে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ সংকীর্ণ সীমার মধ্যে রাজনীতিকে সীমায়িত রাখতে অনিচ্ছুক।

(৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে মতপার্থক্য: ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অপরদিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আন্তঃশাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও সহযোগিতার (inter-disciplinary approach and co-operation) উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার উন্নতির স্বার্থে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি এবং অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্র থেকে তথ্য ও ধারণা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণের মতানুসারে এর ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হবে।

(৪) আলোচনার বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: কি আলোচনা করা হবে, সে বিষয়েও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহ্যগত রাজনীতিক অনুসন্ধানে রাজনীতিক দর্শন আলোচনা করা হত। এ ধরনের আলোচনার তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল অবরোহমূলক পদ্ধতির সাহায্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রবণতা, আদর্শগত উপাদান অর্থাৎ কি হওয়া উচিত তার উপর গুরুত্ব আরোপ এবং রাজনীতিক বাস্তবতার প্রকৃতি ও মানবসমাজের রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে কম গুরুত্ব আরোপ। স্বাভাবিকভাবে এই আলোচনা ছিল মূল্যবোধাত্মক এবং অনুমানভিত্তিক। অপরপক্ষে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীপ্রসূত আলোচনা রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য রাজনীতিক আচরণকে আলোচনা করে থাকে। এরূপ আলোচনায় মূল্যবোধের বিবেচনা অনুপস্থিত।

(৫) তুলনামূলক পদ্ধতির মূল বক্তব্য: ঐতিহ্যগত রাজনীতিক আলোচনা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পর্যলোচনায় পরিণত হত। এর ফলে আলোচনা হয়ে উঠত আইনমুখী। বিভিন্ন আইনগত নথিপত্র ও সংবিধানের ভিত্তিতে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামো ও সংগঠনকে বর্ণনা করা হত। অন্যদিকে আধুনিক রাজনীতিক অনুসন্ধান, রাজনীতিক প্রবাহ ও ব্যবস্থাকেন্দ্রিক। এখানে রাজনীতিক উপকরণ-কাঠামোর (Political input structure) উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

(৬) প্রকৃতি ও পদ্ধতিগত পার্থক্য: উভয়ের মধ্যে উদ্দেশ্যগত পার্থক্যও বর্তমান। ঐতিহ্যগত আলোচনার লক্ষ্য হল রাজনীতিক আদর্শের বা আদর্শ রাজনীতিক জীবনের অনুসন্ধান করা। অন্যদিকে আধুনিক বিশ্লেষণধারার পর্যালোচনায় লক্ষ্য হল রাজনীতিক ঘটনাবলীকে বাস্তবসম্মত উপায়ে উপস্থাপিত করা। বস্তুতঃ তত্ত্ব নির্মাণ এবং জ্ঞান আহরণের জন্যেই জ্ঞান আহরণ হল আধুনিক আলোচনার লক্ষ্য।

(৭) আচরণবাদী আলোচনায় ধারণাগত কাঠামোর উপর গুরুত্ব আরোপ: উভয়ের মধ্যে প্রকৃতি ও পদ্ধতিগত ক্ষেত্রেও পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক পর্যালোচনায় ক্রমাগত বেশী করে অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি, তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ, পরিমাপকরণ, পরিসংখ্যান প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ধরনের আলোচনায় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য ভৌত বিজ্ঞান থেকে অনেক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। অপরপক্ষে ঐতিহ্যবাদী আলোচনার পদ্ধতিসমূহ হল দার্শনিক, অবরোহমূলক, ঐতিহাসিক, তুলনামূলক। কিন্তু এই সমস্ত পদ্ধতি কঠোর অর্থে বৈজ্ঞানিক বা অভিজ্ঞতাবাদী নয়।

(৮) তুলনামূলক পদ্ধতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ধারণাগত কাঠামো (analytical frame work) নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ব্যবস্থাপক বিশ্লেষণ (system analysis), কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব (structural functional analysis), গোষ্ঠী তত্ত্ব (group approach) প্রভৃতির কথা বলা যায়। এ ধরনের আলোচনায় ‘Casual Theory’ নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। অপরপক্ষে ঐতিহ্যবাদী আলোচনার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ‘Value Theory’ নির্মাণ করা; ধারণাগত কাঠামো নির্মাণ নয়।

তবে চূড়ান্ত বিচারে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাদী উভয় প্রকার অনুসন্ধানই আনুষ্ঠানিক যুক্তিবিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তার ফল হিসাবে এই যুক্তিবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উভয় প্রকার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেই দেখা যায়।

পরিশেষে উল্লেখ করা দরকার যে, ঐতিহ্যগত ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর যোগসূত্র হল তুলনামূলক পদ্ধতি। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: ‘Comparative government and politics was to provide the link between the traditional approaches to political science and the more recent developments in the discipline.” তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে অতীত ও সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার তুলনা করা হয় এবং সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গ্রীক পণ্ডিত এ্যারিস্টট্ল থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বঁদা, মন্টেস্কু, ব্রাইস প্রমুখ অনেকে হলেন এই পদ্ধতির অনুগামী। তবে তুলনামূলক পদ্ধতিও একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। কোন একটি রাষ্ট্রে কোন বিশেষ ধরনের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিক কার্যকলাপ দেখা যায়’—এর জবাব তুলনামূলক পদ্ধতি থেকে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, এই পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্যাদির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বিন্যাসের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। সর্বোপরি বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে আগে দেখা দরকার যে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভিন্ন অবস্থা ও পরিবেশ আছে কিনা। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উদ্ভব হয়েছে।