অনুসন্ধান পদ্ধতির গুরুত্ব: যে-কোন বিষয় বা শাস্ত্র সম্পর্কে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, আলাপ-আলোচনা, মূল্যায়ন প্রভৃতি সুশৃঙ্খল প্রণালীর মাধ্যমে হওয়া আবশ্যক। তবেই আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। এই কারণে প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই অনুসন্ধান বা অনুধাবন পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হয়। এই কারণে সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞান নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রেই অনুধাবনের উপযোগী প্রণালীর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বস্তুত সুশৃঙ্খল প্রণালীতে আলোচনাকেই অনুসন্ধান পদ্ধতি (Methodology) বলা হয়।
সাবেকী আলোচনার পদ্ধতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি সামাজিক বিজ্ঞান। এই সামাজিক বিজ্ঞানটির ক্ষেত্রে সুষ্ঠু অনুসন্ধান পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সাম্প্রতিককালে বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। এই সূত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। কোন পদ্ধতিকেই সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত বলা যায় না। সেই প্লেটো-অ্যারিস্টটলের আমল থেকে আরম্ভ করে সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত অনুসন্ধান পদ্ধতিকে সাবেকী আলোচনা পদ্ধতি (Traditional Method) বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সাবেকী আলোচনা পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
আলোচনা পদ্ধতি সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে: রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। প্রবহমান মানবসমাজের যে দিকটি নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে তার প্রকৃতি গতিশীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই গতিশীল চরিত্র যথাযথভাবে অনুধাবনের উপযোগী সর্বকালের সর্বজনগ্রাহ্য কোন অনুসন্ধান পদ্ধতি উদ্ভাবন করা একপ্রকার অসম্ভব। গোখলে যথার্থই বলেছেন যে, “রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত অসংখ্য পুঁথিপত্র প্রকাশিত হওয়ার পর এখনও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য কোন পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে একথা বলা শক্ত”। তাঁর কথায়: “Even now after a bumper crop of political literature has been published it is difficult to say that methodology acceptable to all has been drawn up.”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন আলোচনা পদ্ধতি
প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুসন্ধান পদ্ধতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অনুসন্ধান পদ্ধতি সম্পর্কিত এই বিতর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে সকল অনুসন্ধান পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণত আলোচনা করা হয় তাদের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি প্রণিধানযোগ্য : (১) ঐতিহাসিক পদ্ধতি, (২) পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি, (৩) পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, (৪) দার্শনিক পদ্ধতি, (৫) তুলনামূলক পদ্ধতি, (৬) আইনমূলক পদ্ধতি, (৭) জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি, (৮) সমাজবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি (৯) মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি ও (১০) পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি।
ঐতিহাসিক পদ্ধতি
ঐতিহাসিক পদ্ধতির মূল বক্তব্য: অতীতের জ্ঞান এবং বর্তমানের পর্যালোচনা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী আলোচনার পথ প্রশস্ত করে। রাষ্ট্রনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রকৃতি জানতে হলে তাদের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। ঐতিহাসিক পদ্ধতির মাধ্যমে এই ধারণা লাভ করা যায়। পোলক (Pollock)-কে অনুসরণ করে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ গতি বিশ্লেষণ করতে চায়। তারা অতীতে কেমন ছিল এবং কিভাবে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে সে বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করে তা ব্যাখ্যা করা হয়। তাঁর কথায়: “The Historical Method seeks an explanation of what institutions are and are tending to be, more in the knowledge of what they have been and how they came to be, what they are, than in the analysis of them as they stand.” অ্যালান বল মনে করেন, ঐতিহাসিক বর্ণনামূলক পদ্ধতি প্রাপ্ত প্রমাণের মাধ্যমে অতীতের ঘটনা ব্যাখ্যা এবং বর্তমানের রাজনীতিক কার্যকলাপের কোন কোন দিক সম্পর্কে অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায়। তিনি বলেছেন: “The historical descriptive technique is to examine past events through what evidence is available and draw tentative conclusions as to some aspects of contemporary political activity.” বস্তুত রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাষ্ট্রনীতিক প্রতিষ্ঠান উভয়ের অনুশীলনে ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভব। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও মতবাদের সঠিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন অসম্ভব। রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান পায়। ল্যাস্কি বলেছেন: “The study of Politics must be an offer to modify results of experience in the history of States.” প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস্, হেগেল, মিল, মার্কস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
সীমাবদ্ধতা: এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়। ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তিবাদী মন নিয়ে বিজ্ঞানীর ন্যায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার। লর্ড ব্রাইস-এর মতানুসারে ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বাহ্য-সাদৃশ্য অনেক সময় অভিন্ন প্রতিপন্ন হয়। এ রকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যথেষ্ট সতর্ক এবং অনুসন্ধানী না হলে সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে ঐতিহাসিক পদ্ধতি পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়।
মূল্যায়ন: সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক পদ্ধতির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে ঐতিহাসিকগণ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্যে ইতিহাস আলোচনার পথ বেছে নিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পোলক-এর মতানুসারে ঐতিহাসিক পদ্ধতির লক্ষ্য হল কোন প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ, অতীত অবস্থা এবং গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। বর্তমান অবস্থার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য নয়। ঐতিহাসিক পদ্ধতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর বর্ণনামূলক আলোচনার ব্যাপারে বিশেষভাবে উপযোগী।
পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি
পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির প্রতিপাদ্য বিষয় ও ত্রুটি: রাজনীতিক বিষয়সমূহের যথাযথ অনুশীলনের জন্য পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি অবলম্বনের উপর ব্রাইস (Bryce), লাওয়েল (Lowell) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলির গঠন, প্রকৃতি, কার্যাবলী যথাসম্ভব ব্যাপক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে কতকগুলি সাধারণ সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ তত্ত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে। লাওয়েলের মতে, ‘বাস্তব রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলীর প্রধান গবেষণাগার কোন গ্রন্থাগার নয়, বহির্বিশ্বের রাজনীতিক জীবন’। তাঁর কথায়: “The main laboratory for the active working of political institution is not a library but the outside world of political life.” তিনি আরও বলেন: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান, পরীক্ষামূলক নয়’ (“Politics is an observational and not an experimental science.’)। লর্ড ব্রাইস লিখিত The American Common wealth এবং The Modern Democracies পুস্তকদ্বয় পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা পদ্ধতির প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য হয়। পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আছে। পর্যবেক্ষণের সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যথাসম্ভব সতর্ক হতে হবে। কোন সাধারণ সূত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য ও সাধারণীকরণ সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে চলবেন।
পরীক্ষামূলক পদ্ধতি
পরীক্ষামূলক পদ্ধতির মূল বক্তব্য ও সীমাবদ্ধতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলিতে উপযুক্ত ধরনের সরকার গঠনের জন্য গবেষণা চালান হয়। তা ছাড়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যালোচনা এক অর্থে নতুন নতুন আইন-কানুন, ন্যায়নীতির ধারণা এবং তত্ত্ব ও দর্শনের পরীক্ষামূলক আলোচনা মাত্র। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল অসন্তোষজনক প্রতিপন্ন হলে তা পরিহার করা হয় এবং সন্তোষজনক হলে অন্যান্য দেশে প্রয়োগের কথা বলা হয়। কিন্তু ভৌত বিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্যত অচল। ভৌত বিজ্ঞানের উপকরণগুলি জড় এবং সর্বাবস্থায় সমজাতীয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুসন্ধানের উপাদানসমূহ সদাপরিবর্তনশীল সচেতন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ব্রাইস বলেছেন: “The Phenomenon with which the chemist deals are and always have been identical, they can be weighed and measured, where as human phenomena can only be described.” গার্ণারও এই কথা বলেছেন: “We cannot do in politics what the experimenter does in chemistry.”
গুরুত্ব: এই সমস্ত অসুবিধে সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আছে। কোন তত্ত্ব বা নীতি জনকল্যাণের অনুপন্থী কিনা তা পরীক্ষা করা যেতে পারে। আবার জনকল্যাণবিরোধী নীতি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা যেতে পারে। পুরোপুরি না হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে অনেকাংশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়। সাম্প্রতিককালে গাণিতিক ও পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বহুলাংশে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার পথে উদ্যোগী হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানসম্মত নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি ও প্রয়োগ করেছেন। বস্তুত সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক জীবনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সতত অব্যাহত। তার ফলেই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান, আইন কানুন প্রভৃতির সৃষ্টি হচ্ছে।
দার্শনিক পদ্ধতি
দার্শনিক পদ্ধতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় দার্শনিক পদ্ধতির প্রবক্তাদের মধ্যে প্লেটো, রুশো, টমাস ম্যুর, বেন্থাম, হেগেল, কাণ্ট, হস, গ্রীণ, ব্রাৰ্ডলে, বোসাংকত প্রভৃতি ব্যক্তিগণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতি অনুসারে কতকগুলি বিষয়কে অনুমানের ভিত্তিতে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয় এবং অবরোহণ পদ্ধতি (deductive method)-তে কতকগুলি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজন, প্রকৃতি, কার্যাবলী, এর আদর্শ, ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ের মীমাংসা দার্শনিক উপায়ে করা হয়েছে। দার্শনিক পদ্ধতিতে ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় বা রাজনীতিক জীবনের এক সর্বজনীন মূল্যবোধ নির্ধারণ করা হয়। সেই মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র, সমাজ, নাগরিক, আইন, অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে নিয়ম-নীতি নির্ণয় করা হয়। দার্শনিক পদ্ধতির অনুগামীদের ভাববাদী দার্শনিক বলা হয়।
সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব: মানুষের বাস্তব জীবন এবং রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক বিবর্তনকে উপেক্ষা করে ভাব ও আদর্শের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাই এই পদ্ধতিলব্ধ ফল অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব বিবেচিত হয়। আদর্শবাদীরা মানব চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অতি সরলীকরণের পথে এগিয়েছেন। তারফলে মানব চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পূর্ণ সফল হতে পারেননি। তাঁরা আদর্শ (Ideal) ও বাস্তব (Real)-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি এবং বস্তুনিষ্ঠ ও সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার বিকাশের ফলে দার্শনিক পদ্ধতির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। তবুও রাষ্ট্রনীতিক আলোচনায় অবরোহণ পদ্ধতির গুরুত্ব ও নৈতিক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বল (Alan R. Ball)-এর মতানুসারে রাজনীতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে ভাববাদীদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তুলনামূলক পদ্ধতি
তুলনামূলক পদ্ধতির মূল বক্তব্য: এই পদ্ধতি অনুসারে অতীতের বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও ঘটনাবলীর সঙ্গে বর্তমানের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং তুলনামূলক আলোচনার ভিত্তিতে কার্যকারণ সূত্র নির্ধারণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে অতীতের ও বর্তমানের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন রাজনীতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। কোন একটি রাজনীতিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি এই পদ্ধতিতে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। অ্যারিস্টটলের ১৫৮টি রাষ্ট্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণের দ্বারা তাঁর রাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করেছিলেন। ‘মণ্টেস্কু’ তাঁর The Spirit of Laws এবং ‘মেইন’ তাঁর Ancient Laws রচনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন। আধুনিককালে ব্রাইস তাঁর Modern Democracies গ্রন্থে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন।
সীমাবদ্ধতা: এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। তুলনীয় রাজনীতিক বিষয়গুলির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। অন্যথায় উপনীত সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে বাধ্য। জেলিনেকের মতানুসারে এই পদ্ধতিকে অভিন্ন ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং অভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক ও ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান-সমৃদ্ধ সমকালীন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মধ্যে অ্যালমন্ড পাওয়েল, আপ্টার, কোলম্যান প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অ্যালমন্ড কোন একটি রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে তুলনার একক হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ পশ্চিমী রাজনীতিক ব্যবস্থার মত এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনীতিক ব্যবস্থা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তুলনামূলক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করেছেন। তবে এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতকগুলি সতর্কতার কথা বলা হয়। যেমন, তুলনামূলক আলোচনার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হবে এবং সংগৃহীত তথ্যাদিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। তা ছাড়া সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে কোন একটি রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। আলোচ্য দেশগুলির জীবন ও কাঠামোকে আলোচনা করতে হবে সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে। সর্বোপরি সদ্য স্বাধীন দেশসমূহের রাজনীতিক ব্যবস্থা বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলা হয়।
আইনমূলক পদ্ধতি
আইনমূলক পদ্ধতির মূল বক্তব্য ও ত্রুটি: এই পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রকে একটি আইনমূলক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হয়। আইনমূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আইন প্রণয়ন ও আইন কার্যকরী করার মধ্যেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়। গেটেল বলেছেন: “The juridical or legalistic method regards the state as a legal person or corporation existing for the creation and enforcement of law.” আইনের গণ্ডীর বাইরে রাষ্ট্রের কোন কার্যকলাপের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় না। গার্ণার (J. W. Garner) -ও একই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন: “It regards the State Primarily as a corporation or juridical person and views political science as a science of legal norms…” মূলত জার্মান, ফরাসী ও ইংরাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এই দৃষ্টিভঙ্গীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আইনমূলক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে রাজনীতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এই পদ্ধতি রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়েও নীরব। সেইজন্য পদ্ধতিটি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। কেবলমাত্র আইনগত দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে কোন একটি রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে না।
জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি
জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি ও তার ত্রুটি: জীবদেহের সঙ্গে সাদৃশ্যমূলক আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের গঠন, ক্রমবিকাশ, বিবর্তন, কার্যাবলী ইত্যাদি ব্যাখ্যা করাই এই পদ্ধতির মুখ্য লক্ষ্য। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং সাদৃশ্যমূলক আলোচনার ভিত্তিতে বিবর্তনবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল প্রকৃতিকে ক্রমবিকাশ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে এই ধরনের সাদৃশ্যমূলক আলোচনার স্বার্থকতা অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনেক সময় ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত সৃষ্টি করে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এর গুরুত্ব অপসৃয়মান।
সমাজতত্ত্বমূলক পদ্ধতি
সমাজতত্ত্বমূলক পদ্ধতির মূল বক্তব্য: এই পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রকে একটি সমাজদেহ এবং নাগরিকদের এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিসাবে মনে করা হয়। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যাদের সমন্বয়ে এই সমাজদেহ বা রাষ্ট্র গঠিত হয় তাদের কার্যকলাপের গুণাগুণ অনুসারে রাষ্ট্রের কার্যকলাপের গুণাগুণ বিচার করা হয়। সমাজতত্ত্বমূলক পদ্ধতির সাহায্যে মানুষের রাজনীতিক কার্যকলাপ যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের প্রতিষ্ঠানসমূহ, ধর্মবিশ্বাস, অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রভৃতিকে নিয়ে এক সামগ্রিক ব্যবস্থা হল সমাজ। এই সমাজের বিভিন্ন পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির যাবতীয় মিথষ্ক্রিয়া (Interaction)-র প্রতিফলন ঘটে রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই কারণে এই পদ্ধতিতে সমগ্র সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক জীবনের পর্যালোচনার কথা বলা হয়। স্পেনসার (Herbert Spencer) এবং কং (August Comte) রাষ্ট্র সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। মার্কস সমাজতত্ত্বের পটভূমিকায় রাষ্ট্রসম্পর্কিত তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে সমাজতত্ত্বমূলক পদ্ধতির গুরুত্ব অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের একটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধারার স্রষ্টা হিসাবে যে সমস্ত চিত্তাবিদদের নাম উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন প্যারেটো, মস্কা, মার্কস্, টনিজ প্রভৃতি। এই ধারা লিপসেট (S. M. Lipset), কর্নহাউজার (Kornhouser) প্রমুখ সমাজতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে অব্যাহত আছে।
সীমাবদ্ধতা: স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনীতিক দল প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের আওতায় আসেনি। তা ছাড়া সমাজতত্ত্বমূলক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলা হয় যে, অভিন্নতা প্রতিপন্ন করার জন্য এই পদ্ধতিতে কিছু বাহ্যিক সাদৃশ্যের আলোচনার উপর নির্ভর করা হয়। এইভাবে উপনীত সিদ্ধান্তসমূহ সব সময় অর্থবহ হয় না। গার্ণার (J. W. Garner) এই পদ্ধতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতির ন্যায় অনুপযুক্ত বলে অভিহিত করেছেন। তবে বর্তমানে রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়। এবং এই কারণে এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান।
মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি
মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতির প্রতিপাদ্য বিষয়: রাষ্ট্র নাগরিকদের নিয়েই গঠিত। এই রাষ্ট্রের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য নাগরিকদের ব্যক্তিমানসের পরিমণ্ডল, সমষ্টির মানসিক প্রবণতা প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার। এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞান বিশেষভাবে সহায়ক। তা ছাড়া, রাজনীতিক দলব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জনমত প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্লেষণের জন্য সামাজিক মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও ব্যাপক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে জনসাধারণের রাজনীতিক আচার-আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ বিশেষ জরুরী হয়ে পড়েছে। মানুষের প্রবৃত্তির মধ্যে তার যাবতীয় কার্যকলাপের কারণ নিহিত থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তির রাজনীতিক আচার-আচরণের কারণ তার সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই বর্তমান। এই কারণে প্রবৃত্তি, ভাবাবেগ, মনোভাব, অনুভূতি প্রভৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের রাজনীতিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ম্যাক্ডুগাল (McDougall) মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনীতিকে বাস্তবমুখী করে গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এই পদ্ধতির প্রবক্তা হিসাবে অন্যান্যদের মধ্যে ওয়ালেস (Graham Walles), লেব ( Labon), টার্ডে (Tarde) প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রাইস (Lord Bryce)- এর মতানুসারে, মনোবিজ্ঞানের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল নিহিত আছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। এই জনমতের গতিপ্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতি অপরিহার্য। তা ছাড়া বর্তমানে সামরিক ও অসামরিক কর্মচারী নিয়োগ, সরকার পরিচালনা, বিচারকার্য সম্পাদন প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।
সীমাবদ্ধতা: মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এই পদ্ধতিতে কেবল ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কি ঘটা উচিত সে বিষয়ে কিছু বলা হয় না। আবার মানুষ কেবল আবেগ-অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়, এ ধারণাও ঠিক নয়। মানুষ যুক্তি এবং ন্যায়-অন্যায় বোধের দ্বারাও পরিচালিত হয়। অধ্যাপক গার্ণার এই পদ্ধতিটিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুসন্ধান পদ্ধতি হিসাবে উপযুক্ত মনে করেননি।
মূল্যায়ন: বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রুম্যান (Truman), আলপোর্ট (Allport), গণসেল (Gonsell) প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এউড (Ellwood) এই পদ্ধতিকে সামরিক অভ্যুত্থান, বিপ্লব বিদ্রোহ প্রভৃতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সাক্ষাৎকার, নমুনা সংগ্রহ, সংখ্যায়ন প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অনুসরণ করে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি
অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির প্রকৃতি: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে এই পদ্ধতি প্রয়োগের এক বিশেষ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অত্যাধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই (Behaviouralists) অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কলাকৌশল অবলম্বন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পর্যালোচনার যে প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে তারই ফলশ্রুতি হিসাবে এই পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার সাহায্য নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে পরিমাপ ও সংখ্যায়নের সাহায্যে তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করা হয়। অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির প্রবক্তারা পরীক্ষামূলক, পর্যবেক্ষণমূলক এবং পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রনীতিক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ সরকারের নীতি ও কর্মধারা সম্পর্কে উপযুক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন। জনমত ও জনসংখ্যা, ভোটদান, আর্থনীতিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয় পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমালোচনা
অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বিভিন্ন যুক্তির ভিত্তিতে এই পদ্ধতির সমালোচনা করা হয়।
-
(১) পরীক্ষা ও পরিসংখ্যানের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ার আশংকা থাকে।
-
(২) এই পদ্ধতিতে মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হয়। তার ফলে মানবসমাজ একটি কৃত্রিম গবেষণাগারে পরিণত হয়।
-
(৩) রবার্ট ডাল (Robert A. Dahl) প্রমুখ চিন্তাবিদদের অভিমত অনুসারে অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির অনুসরণকারীরা মূল্যমান-নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠ বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা কিছু অভিনব, জটিল এবং অর্থহীন ধারণা সৃষ্টি করেন।
-
(৪) অভিজ্ঞতাবাদীরা কেবল পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের পক্ষপাতী। তাঁদের সামনে কোন নির্ণায়ক মান থাকে না। তাই অভিজ্ঞতাবাদীদের আলোচনা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ার আশংকা থাকে।
মূল্যায়ন: তবুও অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এই পদ্ধতির মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনকে মূল্যায়ন-নিরপেক্ষ করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া, এই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টাও দেখা যায়। বস্তুত অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বহুলাংশে বস্তুনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত করেছে।
গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বিতর্ক একটি বিরাট সমস্যা। এই গতিশীল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাম্য অনুসন্ধান পদ্ধতি সম্পর্কে অনেকের বক্তব্য হল: স্থান, কাল ও বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুসারে পদ্ধতি স্থিরীকৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। লিপসন (Lipson) বলেছেনঃ “Two choices are open to the students of Politics. He may fit the subject to the method or the method to the subject.” রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতিই এককভাবে যথেষ্ট নয়। প্রায় সকল পদ্ধতিরই অল্পবিস্তর গুরুত্ব ও প্রয়োজন রয়েছে। কোন বিশেষ ক্ষেত্রে কোন্ পদ্ধতি প্রয়োগ করা উচিত তা সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা বা ঘটনাবলীর দ্বারা নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আবার অনেকের মতে কোন একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন না করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি একত্রে প্রয়োগ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা অধিকতর সমৃদ্ধ হতে পারে। তাঁদের মতে ঐতিহাসিক, পর্যবেক্ষণমূলক এবং তুলনামূলক পদ্ধতি একত্রে প্রয়োগ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান লাভবান হবে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে ব্রাইস ও অন্যান্য বহু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই নীতি অনুসরণ করে সাফল্যের সন্ধান পেয়েছেন। আবার লিপসন প্রমুখ আর একদলের মতে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক পদ্ধতির সুষ্ঠু সংমিশ্রণের মধ্যেই সঠিক পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। লিপসন বলেছেন: “The methodology of Political Science becomes a combination of the two approaches of Philosophy and History.” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা কেবল বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যা হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও আলোচনা করে। অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঐতিহাসিক পদ্ধতির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। আর ন্যায়-নীতি, উদ্দেশ্য, কার্যাবলী প্রভৃতির তাত্ত্বিক মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন দার্শনিক পদ্ধতির।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও মূল্যায়ন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিসমূহের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সাবেকী আলোচনা পদ্ধতি বহুলাংশে তার গুরুত্ব ও প্রভাব হারিয়েছে। এর কারণ হল সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির কিছু দুর্বলতা আছে।
আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা: সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির দুর্বলতাগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। এই দুটি ভাগ হল:
(১) সাবেকী আলোচনা পদ্ধতি সংকীর্ণ। তা ছাড়া এই সমস্ত পদ্ধতির প্রকৃতির মধ্যেই কিছু সমস্যা নিহিত আছে। এগুলি হল সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিগুলি হল প্রধানত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ও আইনানুগ। রাষ্ট্রের আইনানুগ পরিকাঠামোর বাইরেও বহু রাজনীতিক কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিতে এই সমস্ত কার্যাবলীর উপর বড় একটা গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিতে আইনানুমোদিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
(২) সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির দুর্বলতা কতকগুলি বাহ্যিক বিষয়ের দ্বারা প্রকট হয়ে উঠে। এই সমস্ত বাহ্যিক বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাজনীতিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ব্যাপক বিস্তার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদীদের প্রভাব; ভৌত বিজ্ঞানসমূহের কলাকৌশল সাধ্যমত সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের আলোচনায় গ্রহণ করার প্রবণতা, আলোচনা পদ্ধতির ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের অগ্রগতি প্রভৃতি। তা ছাড়া সাম্প্রতিককালে রাজনীতিক জীবনের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনীতিক জীবনের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিগুলি ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যান্য দুর্বলতা: উপরিউক্ত দুর্বলতা ছাড়া সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির আরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। (ক) কাঠামোগত বিচারে সাবেকী আলোচনা পদ্ধতি যথেষ্ট উন্নত নয়। (খ) এই সমস্ত পদ্ধতিতে ক্ষেত্রবিশেষে ধারানুসারী তথ্যাদি সংগ্রহ করার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। (গ) পূর্ব নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তসমূহের দ্বারা বর্ণনামূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবিত হয়ে থাকে। (ঘ) ব্যাপকতর সামাজিত পটভূমিতে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনা করা হয় না। তারফলে সিদ্ধান্তসমূহ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিগুলির কিছু দুর্বলতা আছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তাদের প্রভাব বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও সাবেকী আলোচনা পদ্ধতিগুলির গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। সেই প্লেটো অ্যারিস্টটলের আমল থেকে অদ্যাবধি সাবেকী আলোচনা পদ্ধতির মাধ্যমেই বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বহু অমূল্য সম্ভারের সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। তা ছাড়া সাম্প্রতিককালেও ঐতিহাসিক, দার্শনিক, তুলনামূলক প্রভৃতি সাবেকী পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট হয়ে যায়নি। আধুনিককালের রাজনীতিক কাঠামো ও কার্যাবলীর পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই সমস্ত পদ্ধতি প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করতে সক্ষম।
Leave a comment