বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতিক তত্ত্বের অন্তর্জলিযাত্রার শোকগাথা লিখে ফেলেছেন। অ্যালফ্রেড কোব্যান [Alfred Cobban (1953)], ডেভিড ইস্টন [David Easton (1953)] প্রমুখ চিন্তাবিরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। লাসলেট [P. Laslett (1957)], রবার্ট ডাল [Robert Dahl (1958)] প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রতত্ত্বের মৃত্যু ঘটেছে বলে ঘোষণা করেছেন। অনেকে আবার রাজনীতিক তত্ত্বের চরম দুর্দশার কথা বলেছেন। রাজনীতিক তত্ত্ব সম্পর্কিত এরকম বিষাদময় বর্ণনার মূল কারণ হল সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্বের ঐতিহ্যপূর্ণ ধারায় মূল্যবোধের বিচার-বিবেচনার আধিক্য। তারফলে এ ধরনের রাজনীতিক তত্ত্ব অভিজ্ঞতাবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতার বাইরে থেকে যায়। আদর্শমূলক রাজনীতিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে যৌক্তিক দৃষ্টবাদীদের দিক থেকে বিরূপ সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক তত্ত্বের সমালোচনা করেন।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না যে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব গুরুত্বহীন হয়ে শেষ হয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক যে আগেকার ভাববাদী বা দর্শনকেন্দ্রিক রাজনীতিক তত্ত্ব বহুলাংশে গুরুত্ব হারিয়েছে। তবে রাজনীতিক তত্ত্ব সময় ও প্রয়োজনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে তার গতি-প্রকৃতি বদলেছে। গতি-প্রকৃতির এই পরিবর্তনকে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের অবসান বলা যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে দর্শনকেন্দ্রিক বা মূল্যবোধ সম্পর্কিত রাজনীতিক তত্ত্বের প্রভাব-প্রতিপত্তি লোপ পেয়ে যায়নি। সাম্প্রতিককালের অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও মূল্যবোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। আচরণবাদীদের মধ্যে রাজনীতিক অগ্রাধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁরা শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। তা ছাড়া অত্যাধুনিক গবেষণায়ও বিশেষ কোন মূল্যবোধকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
দাঁতে জারমিনো (Dante Germino)
দাঁতে জারমিনো (Dante Germino) তাঁর Beyond Ideology, The Revival of Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ও পুনরুত্থান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ডেভিড ইস্টন ও অ্যালফ্রেড কোব্যানের মত দাঁতে জারমিনোও মনে করেন যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময়ব্যাপী এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ঘটেছে। জারমিনো কোব্যানের মতই বিশ্বাস করেন যে, যে সময়-কালব্যাপী রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ঘটেছে, তার শেষভাগে অবক্ষয়ের জন্য দায়ী হল দৃষ্টবাদ। তবে গোড়ার দিকে অবক্ষয়ের অতিরিক্ত কারণ হিসাবে তিনি ‘মতাদর্শ’ (ideology) এবং ‘রাজনীতিক মতবাদ’ (political doctrines) সমূহের অস্তিত্বের কথা বলেছেন এবং তুঙ্গীভূত অবস্থায় মার্কসবাদের কথা বলেছেন।
কিন্তু দাঁতে জারমিনো ইস্টন ও কোব্যানের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, বর্তমানে রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরায় অভ্যুত্থান ঘটছে। বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্ব অবদমিত অবস্থায় ছিল। বিরোধী বৌদ্ধিক শক্তিসমূহ ও বিভিন্ন রাজনীতিক আন্দোলন এবং বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার প্রতি আগ্রহের আতিশয্য সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্বকে আড়ালে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাজনীতিক তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য পুনরুত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি দৃষ্টবাদের উজ্জ্বল উত্থানের প্রাক্কালেও প্রতিবাদী দার্শনিক রচনাসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে হেনরী বারজসন (Henri Bergson), ম্যাক্স শেলার (Max Scheler), জুলিয়েন বেনড়া (Julien Benda) প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম করা হয়েছে। এলিটবাদী চিন্তাবিদদের দ্বারাও এই সময় রাজনীতিক তত্ত্বের আংশিক পুনরুত্থান ঘটেছে। এলিটবাদী মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে এক্ষেত্রে গুইডো ডরসো (Guido Dorso)-র নাম করা হয়েছে। পরবর্তীকালে রাজনীতিক তত্ত্বের পরিপূর্ণ পুনরুত্থান সম্পাদিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে একাধিক চিন্তাবিদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। এঁরা হলেন হান্নাহ অ্যারেন্দ (Hannah Arendt), মিখায়েন ওয়াকেশট (Michael Oakeshott), বার্ট্রান্ড ডি জোউভেনাল (Bertrand de Jouvenal), লিও স্ট্রাউস (Leo Strauss), এরিক ভোজেলিন (Eric Vogelin) প্রমুখ। সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্ব উল্লিখিত রাজনীতিক চিন্তাবিদদের হাতে পুনরায় সগৌরবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে কমিউনিস্ট মতবাদ, ফ্যাসীবাদ ও নাৎসীবাদের সামগ্রিকতাবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরুদ্ধে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদের সমর্থনে মতবাদের ইতিহাসের চর্চা শুরু হয়। মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ল্যাসওয়েল (Lasswell) একটি বিজ্ঞানসম্মত রাজনীতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী মেরিয়াম (Merriam) যে লক্ষ্য ও পথ বাত্লেছেন তার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। তবে সাবেকি ঐতিহ্যমূলক ধারার থেকে কিছুটা সরে এসেছে বিজ্ঞানসম্মত রাজনীতিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বের প্রকৃতি হল বহুলাংশে বর্ণনামূলক, পরামর্শমূলক নয়। অ্যারেন্দ, ওয়াকেশট, স্ট্রাউস, ভোজেলিন প্রমুখ চিন্তাবিদের সম্পর্কে সুশিলা রামস্বামী তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “Their views diametri-cally differ from the broad ideas within American political science for they believed in liberal democracy, science and historical progress. All of them reject political messianism and utopianisn in politics.”
মিখায়েল ওয়াকেশট (Michacl Oakeshott)
রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরুত্থানকারীদের মধ্যে এই রাজনীতিক চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর Experience and its Modes শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটি ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই সমাজবিজ্ঞানী প্রণীত অন্যান্য রচনা বা গ্রন্থগুলি হল: Political Education (1956), Rationalism in Politics (1967) এবং Hob bes on Civil Association (1975)। এই চিন্তাবিদের সব থেকে বড় তাত্ত্বিক সাফল্য হল অভিজ্ঞতার দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তিনি অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিক (multidimensional) বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন। অভিজ্ঞতার এই বহুমাত্রিকতাকে দৃষ্টবাদীরা অস্বীকার করেছেন। ওয়াকেশটের অভিমত অনুসারে অভিজ্ঞতা হল নিটোল ও পরিপূর্ণ প্রকৃতি বিশিষ্ট। এর বিভিন্ন ধরনের পন্থা-প্রণালী বর্তমান। দর্শনের উদ্দেশ্য হল অভিজ্ঞতার প্রতিটি পন্থা-প্রণালীকে চিহ্নিত করা এবং অভিজ্ঞতার অন্যান্য দিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা। তার মতানুসারে দর্শন সত্যকে তুলে ধরে এবং ঐতিহাসিক পটভূমির দ্বারা তা নির্ধারিত হয় না। তবে তার স্থান-কালের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে এবং ঘটনা ও মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য করেননি। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাজনীতির প্রক্রিয়া এবং যুক্তিবাদী অনুসন্ধানের ভিত্তি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরস্পর স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিজ্ঞানের পন্থা-পদ্ধতি থেকে দর্শনের শিক্ষা গ্রহণের কিছু নেই। রামস্বামী (Sushila Ramswamy) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “He (Oakeshott) distrusts any accepted route or pattern, which explains his skepticism of rationalism with its efforts at systematization and categorization.”
ওয়াকেশট-এর অভিমত অনুসারে ‘দর্শন’ (philosophy) -কে কর্ম বলা যায় না। দর্শনের স্বার্থেই দর্শনকে অনুসরণ করতে হয়। এবং অনুসরণ করার জন্য বাহ্যিক যাবতীয় স্বার্থ, বিশেষত ব্যবহারিক স্বার্থের দিক থেকে দর্শনের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে হয়। একজন দার্শনিক অকাট্য বা সিদ্ধ জ্ঞানের পক্ষপাতী, সর্বজনীন জ্ঞানের নয়। এই চিন্তাবিদ রাজনীতিক দর্শন বলতে দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির বিচার-বিবেচনাকে বুঝিয়েছেন। রাজনীতির অনুশীলনের ক্ষেত্রে তিনি বিমূর্ত ভাবতত্ত্ব ও অভিজ্ঞতাবাদকে অস্বীকার করেছেন। রাজনীতিক দর্শনকে প্রগতিশীল বিজ্ঞান বলা যাবে না। এই সমাজবিজ্ঞানী তাঁর Political Education শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The understanding of politics as an empirical activity is, then, inadequate because it fails to reveal a concrete manner of activity at all. And it has the incidental defect of seeming to encourage the thoughtless to pursue a style of attending to the arrangements of their society which is likely to have unfortunate results, to try to do something which is inherently impossible is always a corrupting enterprise.”
হান্নাহ আরেন্দ (Hannah Arandt)
রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরুত্থানের পিছনে যাঁদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট হলেন আরেন্দ। তিনি তাঁর The Human Condition শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর এই গ্রন্থটি ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল What is authority? (1968), On Revolution (1968) এবং ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত On Violence শীর্ষক একটি রচনা।
এই সমাজবিজ্ঞানী এ বিষয়ে সচেতন যে, আধুনিক দুনিয়ায় মানবিক অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে। তিনি মানুষের কাজকর্মে দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতা ও মর্যাদাবোধ পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। এবং এটাকেই তিনি রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরুত্থানের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। শ্রীমতী আরেন্দ রাজনীতিক তত্ত্বের সঙ্গে বিমূর্ত ভাবতত্ত্বের (ideology) সামঞ্জস্যহীনতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের মধ্যে লুক্কায়িত ও অপ্রকাশিত নানা শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণাকে তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি মানুষের স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্বশীল প্রকৃতির উপর জোর দিয়েছেন। এরই ভিত্তিতে তিনি আচরণবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার সূত্রপাত করেছেন। তাঁর মতানুসারে মানুষের আচরণে একরূপতার ব্যাপারে আচরণবাদী অনুসন্ধান মানুষকে ছাঁচেগড়া বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করে। তিনি তাঁর The Human Condition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The unfortunate truth about behaviorism and the validity of its ‘laws’ is that the more people there are, the more likely they are to behave and less likely to tolerate non-behaviour….Statistical uniformity is by no means a harmless scientific idea; it is no longer the secret political ideal of a society which, entirely. submerged in the routine of everyday living, is at peace with the scientific outlook. inherent in its very existance.”
বার্ট্রান্ড ডি জোউভেনাল (Bertrand de Jouvenal)
রাজনীতিকে প্রশাসনে পরিণত করার ব্যাপারে আধুনিককালে একটি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীমতী আরেন্দ-এর মত জোউভেনালও এই প্রবণতার বিরোধিতা করেছেন। কারণ এই প্রবণতা হেতু সর্বসাধারণের মধ্যে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের ব্যাপারে রাজনীতির সামর্থ্যকে উপেক্ষা করা হয়। আধুনিককালের ধারা অনুযায়ী রাজনীতিকে একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া হিসাবে মনে করা হয়। এই প্রক্রিয়া সামগ্রিকতাবাদ সম্পর্কিত। রাজনীতি বিমূর্ত ভাবতত্ত্বের স্লোগানসর্বস্বতা ও কল্পনাবিলাসিতার বিরোধী। রাজনীতির মধ্যে নৈতিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে। এর উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিবর্গকে সুসংহত করা।
লিও স্ট্রাউস (Leo Strauss)
স্ট্রাউস আধুনিককালের সমস্যাদির মোকাবিলার ব্যাপারে সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্বের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। লিও স্ট্রাউসের উল্লেখযোগ্য রচনা ও গ্রন্থগুলি হল: The Political Philosophy of Hobbes: Its Basis and Genesis (1936 ), Political Philosophy and History (1949), Natural Right and History (1952), What is Political Philosophy and other Studies? (1959) প্রভৃতি।
স্টাউসের অভিমত অনুযায়ী একজন রাজনীতিক দার্শনিককে অবশ্যই সত্যানুসন্ধানী হতে হবে। সত্যের উপরই তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করবেন। লিও এই ধারণাকে সমর্থন করেননি যে, সকল রাজনীতিক তত্ত্ব বিমূর্ত ভাবতত্ত্বমূলক প্রকৃতির এবং রাজনীতিক তত্ত্বে নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক স্বার্থ প্রতিফলিত হয়। এ কথাও তিনি স্বীকার করেননি যে অধিকাংশ রাজনীতিক চিন্তাবিদ্ উদ্দেশ্যমূলক বা প্রারোচনামূলক ভূমিকা পালন করেন। লিও তাঁর What is Political Philosophy and other Studies? শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
লিও-র মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনীতিক দর্শন অভিন্ন রূপের। কারণ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উপাদান সমন্বিত বিজ্ঞান দর্শনের সঙ্গে একরূপবিশিষ্ট। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক বিষয়াদির মূল্যায়ন করেছেন। অ্যারিস্টটল রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপকে ন্যায়নীতিমূলক হিসাবে দেখেছেন। প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক বিষয়াদিতে তিনি বিচক্ষণতার স্বাধিকারের কথা বলেছেন।
লিও নতুন (new) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্যকভাবে পর্যালোচনা করেছেন। এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্ব, বিশেষত অ্যারিস্টটলের রাজনীতিক তত্ত্বের সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনা অসঙ্গত। কারণ অ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, একজন রাজনীতিক দার্শনিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে নিরপেক্ষ অবস্থানযুক্ত হতে হবে। কারণ মানুষের লক্ষ্য সম্পর্কে তার অধিকতর ব্যাপক উপলব্ধি এবং স্বচ্ছ অনুধাবন থাকবে। সুসঙ্গতি ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণতার দিকে নজর রেখে অতীতের দর্শনসমূহ পর্যালোচনা করা হয়। লিও-র অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্ত্বের সাবেকি বিশিষ্ট গ্রন্থসমূহের দার্শনিক রচয়িতারা সামগ্রিক বিচারে শ্রেষ্ঠ। কারণ তাঁরা যথার্থই সহজাত সৃজনীক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁদের রচনাবলী তাঁদের বিচক্ষণতার পরিচয় প্রকাশ করে।
লিও আচরণবাদীদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। কারণ আচরণবাদীরা রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদন করেন। এই পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলা হয়। আচরণবাদ অনুযায়ী তাত্ত্বিক বিজ্ঞানসমূহের উৎস থেকে প্রায়োগিক বিজ্ঞানসমূহের সৃষ্টি হয়। লিও-র মতানুসারে দৃষ্টবাদের মত আচরণবাদও ক্ষতিকারক। কারণ চূড়ান্ত নিয়মনীতিসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞানকে আচরণবাদ অস্বীকার করে। সর্বাত্মক মতবাদ (totalitarianism)-এর উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আচরণবাদ ন্যায়-অন্যায় ও ঠিক-বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনে অসহায় ও অসমর্থ। এ ক্ষেত্রে আচরণবাদীদের দীনতা প্রকট হয়ে পড়েছে। সুশিলা রামস্বামী তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Strauss equates behaviouralism’s value-free approach with dogmatic atheism’ and ‘permissive egalitarianism’. It is dogmatically atheistic because of its attitude of ‘Unreasoned unbelief. It is rooled in permissive egalitarianism because its proponents…distinguish facts and values….”
লিও স্ট্রাউস ইতিহাসবাদিতা সম্পর্কিত ডেভিড ইস্টনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী লিও-র অভিযোগ হল রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে নতুন বিজ্ঞান (new science) বিশেষভাবে দায়ী। এই নতুন বিজ্ঞান সামগ্রিক বিচারে নিয়মনীতি বা আদর্শমূলক বিষয়াদিকে উপেক্ষা করেছে এবং পশ্চিমের সাধারণ রাজনীতিক সমস্যাসমূহকে তুলে ধরেছে।
এরিক ভোজেলিন (Eric Vogelin)
রাজনীতির তত্ত্বের পুরুস্থানের পিছনে এরিক ভোজেলিনের ইতিবাচক অবদানও অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞানী ভোজেলিন তাঁর The New Science of Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়।
ভোজেলিনের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্য। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব অসম্ভব। রাজনীতিক তত্ত্ব হল একটি গবেষণামূলক বিজ্ঞান। ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের দিক থেকেই রাজনীতিক তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যাসমূহের সমালোচনামূলক ও অভিজ্ঞতাবাদী বিচার-বিশ্লেষণ রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে অভিপ্রেত। রাজনীতিক সমাজতত্ত্বকে বিমূর্ত ভাবতত্ত্ব, কল্পনাবিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা যায় না। এরিক ভোজলিন বলেছেন: “Theory is not just any opening about human existence in society; it rather is an attempt at formulating the meaning of existence by explicating the content of a definite class of experiences. Its argument is not arbitrary but derives its validity from the aggregate of experiences to which it must permanently refer for empirical control.”
স্যার ইসাইয়াহ বারলিন (Sir Isaiah Berlin)
সাম্প্রতিককালের এই সমাজবিজ্ঞানী সাবেকি রাজনীতিক তাত্ত্বিক আলোচনার সমর্থনে সদর্থক বক্তব্য দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। দর্শনের ভূমিকা ও ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কিত বারলিনের ধারণা স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, অসংখ্য পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবোধের অস্তিত্ব আছে। তার ভিতর থেকেই পছন্দ করা হয়েছে। এই পছন্দ অন্যান্যদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বারলিনের অভিমত অনুসারে বিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে বড়মাপের ও প্রাধান্যমূলক কোন কাজ হয়নি। এই কারণে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে রাজনীতিক তত্ত্ব মৃত বা মৃত্যুপথযাত্রী। সুশিলা রামস্বামী এ প্রসঙ্গে বারলিনের অবস্থান সম্পর্কে বলেছেন: “The absence of critical dimension has nothing to do with the nature of political theory, which will survive in a society whose ends collided.”
বারলিন দৃঢ়তার সঙ্গে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, একমাত্র বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাতেই সাবেকি অর্থে রাজনীতিক দর্শনের অনুসরণ সম্ভব। কারণ যে কোন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান আবশ্যক। কঠোরভাবে একত্ববাদী ব্যবস্থায় এ ধরনের অনুসন্ধান অসম্ভব। দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রে বিভিন্ন ধারণা এবং মূল্যবোধসমূহের মধ্যে অগ্রাধিকার এই দুয়ের মধ্যে বিদ্যমান প্রখর পার্থক্য প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। কোন একটি মডেল বাস্তব অবস্থাকে বিকৃত করে কিনা তা অনুধাবনের ব্যাপারে রাজনীতিক চিন্তাবিরা উদ্যোগী হন। এই উদ্যোগ সূত্রে তাঁরা সত্য, ন্যায়সঙ্গতা ও বৈধতার অনুসন্ধান করেন। মূল্যবোধসমূহ এবং মূল্যবোধসমূহের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ ও বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হতে পারে। এই সমস্ত বিষয় সঠিক অর্থে দার্শনিক।
বারলিনের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক দর্শন হিসাবেও রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় বা অবসান ঘটেনি। এ বিষয়ে বারলিন বলেছেন: “To suppose, then that there have been or could be ages without political philosophy, is like supposing that as there are ages of faith, so there are or could be ages of total disbelief. But this is an absurd notion: there is no human activity without some kind of general outlook: scepticism, cynicism, refusal to dabble in abstract issues or to question values, hard-boiled opportunism, contempt for theorizing, all the varieties of nihilism, are, ofcourse, themselves meta-physical and ethical positions committal attitudes.”
শেলডন উলিন (Sheldon Wolin)
উলিনও সাবেকি রাজনীতিক ঐতিহ্যের সমর্থনে বক্তব্য পেশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে উলিনের বক্তব্যের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন রচনা। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: Politics and Vision : Continuity and Innovation in Western Political Thought (1960) Political Theory: Trends and Goals (1968); Democracy and the Welfare State (1987); Political Theory From Vocation to Invocation (2000) প্রভৃতি।
উলিন আচরণবাদের বড় সমালোচক হিসাবে পরিচিত। আচরণবাদের প্রভাবে সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্ব হীনবল হয়ে পড়েছে, এ ধারণা ঠিক নয়। উলিন আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন যে, তাঁরা পদ্ধতির উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং আসল উদ্দেশ্য বা কারবার (Vocation)-কে আড়াল করেছেন। আচরণবাদী সামাজিক বিজ্ঞানীরা সাবেকি রাজনীতিক তত্ত্বের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেছেন। উলিন রাজনীতিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে আচরণবাদীদের এই আক্রমণ উল্লেখ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রীক পণ্ডিত প্লেটোর সময় থেকে অদ্যাবধি সৃষ্ট রাজনীতিক তত্ত্বের ঐতিহ্যবাহী ধারার উপযোগিতা ও সার্থকতা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। রাজনীতিক তত্ত্বের সারাংশ ও তাৎপর্যের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে উলিন রাজনীতিক তত্ত্ব বা রাজনীতিক দর্শনকে পুনরায় উজ্জীবিত করে তোলা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ করেছেন।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত Politics and Vision Continuity and Innovation in Western Political Thought শীর্ষক গ্রন্থটিতে উলিন রাজনীতিক তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্ত্বে রাজনীতিক উপাদানসমূহকে দুটি অর্থে দেখা হয়। (ক) রাজনীতিক তত্ত্বে রাজনীতিক বিষয়াদির বিবরণ দেওয়া হয় এবং একটি নান্দনিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা হয়। (খ) তাত্ত্বিকদের কাল্পনিক সামর্থ্যের সঙ্গে রাজনীতিক তত্ত্ব সংযুক্ত হয়। রাজনীতিক তাত্ত্বিকগণ নান্দনিক বক্তব্যের মাধ্যমে রাজনীতিক উপাদানসমূহ সম্পর্কে বিমূর্তভাবে অতিরঞ্জিত করে বক্তব্য ব্যক্ত করেন। এর উদ্দেশ্য হল আলোচ্য রাজনীতিক উপাদানগুলিকে উজ্জ্বল করে প্রতিপন্ন করা। রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে কল্পনাশক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ কোন রাজনীতিক তাত্ত্বিকের পক্ষে সকল রাজনীতিক বিষয়কে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হয় না। উলিন বলেছেন: “…a political philosopher unavoidably infects his own thought with post ideas and situations. In this sense the past is never wholly superseded, it is constantly being recaptured at the very moment that human thought is seemingly preoccupied with the unique problems of its own time. …. Thus Western tradition of political thought has exhibited two somewhat contradictory tendencies a tendency towards an infinite regress to the past and a tendency towards cumulation… or a tendency towards acquiring new dimensions of insight”
উলিনের অভিমত অনুযায়ী অতীতের বড়মাপের রাজনীতিক মতবাদসমূহ সাম্প্রতিককালের সমস্যাদি ও বিদ্যমান অবস্থার উপর আলোকপাত করে। বর্তমানের রাজনীতি অধিকতর ভালভাবে অনুধাবনের জন্য অতীতের রাজনীতিক তত্ত্বসমূহকে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কেবলমাত্র সমকালীন মানের আলোকে বা মানদণ্ডে তত্ত্বগুলির বিচার-বিবেচনা বাঞ্ছনীয় নয়। পদ্ধতির অনুসন্ধানে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের কারণে সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক তত্ত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনামূলক মান-মাত্রাকে পরিত্যাগ করেছে। অথচ রাজনীতিক তত্ত্বের এই বৈশিষ্ট্যটি বরাবরের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। উলিনের মতানুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব শুধুমাত্র একটি পদ্ধতি নয়, তার থেকে অধিক কিছু। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনীতির পরিবর্তন ও উত্থান-পতনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। রাজনীতিক তত্ত্ব সম্পর্কিত উলিনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুশিলা রামস্বামী বলেছেন: “The vocation for political theory is that it does not suppress, displace or overcome politics but that it attends to the ongoing challenges and provides thoughtful political action.”
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরুত্থান ঘটেছে। এবং রাজনীতিক তত্ত্বের এই পুনরুত্থানের পিছনে ‘হ্যাবারমাস’ (Habermas), ‘নজিব’ (Nozick), ‘রালস’ (Rawls) প্রমুখ সাম্প্রতিক কালের রাজনীতিক চিন্তাবিদদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পুনরুত্থানের পরবর্তী পর্বে আলোচ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে কতকগুলি বিশেষ বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে সাধারণভাবে উল্লেখযোগ্য হলঃ অ-তত্ত্ববিদ্যামূলক প্রেক্ষিতে কল্যাণমূলক অধিকারসমূহ ও সামাজিক ন্যায়, গণতান্ত্রিক তত্ত্ব ও বহুত্ববাদ, উপযোগিতাবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, নারীবাদ, নয়া সামাজিক আন্দোলনসমূহ ও পৌর সমাজ এবং উদারনীতিবাদ সমভোগতন্ত্রবাদ। মার্কসবাদের জনপ্রিয়তার অবক্ষয়ের সুত্রে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করেছে সমভোগতন্ত্রবাদ (communitarianism)।
রাজনীতিক তত্ত্বের এই পুনরুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে, রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় বা অবসান সম্পর্কিত আগেকার ঘোষণা অকালীয় এবং অদূরদর্শিতা দোষে দুষ্ট। তবে সাবেকি রাজনীতিক ঐতিহ্য ও সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। পরেরটি প্রেরণা পেয়েছে আগেরটি থেকে। সুতরাং পুনরুত্থানের পরবর্তী পর্বের রাজনীতিক তত্ত্ব একবারে নতুন নয়; পরিশীলিত রাজনীতিক তত্ত্ব। সাম্প্রতিককালের জটিলতাসমূহের সঙ্গে সাবেকি রাজনীতিক ঐতিহ্যের বৃহত্তর কাঠামোর সামঞ্জস্য সাধন করা হয়েছে।
রাজনীতিক তত্ত্ব—পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতা: অনেকের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ঘটেনি; কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনায় দু’ধরনের ক্রিয়াকলাপের অন্তর্ভুক্তি পরিলক্ষিত হয়েছে।
-
(ক) কার্যক্ষেত্রে রাজনীতিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে, সরকার কিভাবে কাজ করে, বা তাদের উৎসগুলিই কি কি, অথবা কেন তাদের মান্য করা হয়, এবং
-
(খ) দার্শনিক ক্ষেত্রে রাজনীতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নির্ধারণের চেষ্টা করেছে এবং সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যসমূহে উপনীত হওয়ার জন্য কিভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংগঠিত হওয়া দরকার সে বিষয়ে সুপারিশ করেছে।
রাজনীতিক তত্ত্বের দার্শনিক দিকটি ছিল প্রকৃতিগতভাবে দূরকল্পনামূলক। দেশ, কাল এবং ব্যক্তিভেদে রাজনীতিক তত্ত্বের দার্শনিক দিকটির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত দূরকল্পনামূলক রাজনীতিক তত্ত্বও ক্রিয়াকর্মকে প্রভাবিত করেছে। এই কারণে ঐতিহাসিক দিক থেকে কতকগুলি বিষয় বিচার-বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়েছে। এই বিষয়গুলি হল: রাজনীতিক তত্ত্বসমূহের উদ্ভবের সময়কাল ও সমকালীন অবস্থা; প্রবক্তা ব্যক্তিবর্গের শ্রেণী-পরিচিতি ও অন্যান্য পরিচয়সূচক পূর্ববর্তী বিষয়াদি; এবং কিভাবে রাজনীতিক তত্ত্বসমূহ মানুষের আচার-আচরণকে প্রভাবিত করেছে। প্লেটো থেকে হেগেল পর্যন্ত রাজনীতিক তত্ত্বের স্রষ্টা অধিকাংশ ব্যক্তিই প্রাথমিকভাবে ছিলেন দার্শনিক। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, তাঁদের রাজনীতিক দর্শন ছিল তাঁদের সাধারণ দর্শনেরই অংশমাত্র। এ প্রসঙ্গে ভার্মা (S.P. Varma) তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “It is being recognised only recently that the ‘rightness’, or rationality, of a form of political organisation or a political policy cannot be legitimately deduced from ultimate logic and metaphysical principles.”
তবে রাজনীতিক তত্ত্ব সব সময়েই দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা থেকে সম্ভৃত এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায়। না। অতীতেও সকল রাজনীতিক তত্ত্ব দর্শনসম্ভূত নয়, বা দর্শনের অংশমাত্র নয়। আগেকার দিনেও এমন কিছু চিন্তাবিদ ছিলেন যাঁরা রাজনীতির আলোচনায় সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে টক্ভিল (Tocqueville), বেজহট (Bagehot), ওয়ালাস (Graham Wallace) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস (Hobbes)-এর বিখ্যাত ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan) শীর্ষক গ্রন্থে দার্শনিক বিচার-বিবেচনার পরিবর্তে বিদ্যমান অবস্থার বাস্তব প্রয়োজনের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। আবার চুক্তিবাদী ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো (Rousseau)-কেও প্রাথমিক বিচারে দার্শনিক বলা যায় না। তবে টমাস হিল গ্রীণ (Green), বোসাংকেত (Basanquet) প্রমুখ ইংরেজ চিন্তাবিদ ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক। ভাববাদী দার্শনিকরা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সূত্রে আদর্শবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালে ব্যাপক অনুসন্ধানমূলক সামাজিক সমীক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভিজ্ঞতাবাদী রাজনীতিক চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিককালের রাজনীতিক অনুশীলনে দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বের অবক্ষয় ঘটেছে।
উপরিউক্ত বক্তব্য সত্ত্বেও এ রকম কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না যে, রাজনীতিক তত্ত্বের বা রাজনীতির তত্ত্বীয়করণের অবক্ষয় ঘটেছে। এ বিষয়ে পারট্রিজ (P. H. Partridge) তাঁর Politics, Philosophy. Ideology শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে, অধুনা দর্শনের আওতা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিজের স্বতন্ত্র ও বিশেষজ্ঞ অবস্থান অর্জন করেছে। এই অবস্থান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাধারণ সমস্যাদি সম্পর্কে অধুনা আলোচনা করে এবং তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। সাধারণ বিষয়ের তত্ত্বীয়করণের প্রক্রিয়ার উপর দীর্ঘকাল ধরে দর্শনেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যথেষ্ট বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজনীতিক বিষয়াদির তত্ত্বীয়করণ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। দার্শনিক ও রাজনীতিক আলোচনার মধ্যে সীমারেখা নতুন করে নির্ধারিত হয়েছে। দর্শনিক ও অভিজ্ঞতাবাদী বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে বর্তমানে সুস্পষ্ট পার্থক্য প্রতিপন্ন হয়। অধুনা রাজনীতিক তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে দার্শনিক বা সমাজতত্ত্ববিদদের ভিড় দেখা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নিজেদের এলাকায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির সম্যক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত উপায়-পদ্ধতি আয়ত্ত করেছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনীতিকে দর্শনে পরিণত করার ব্যাপারে এক ধরনের প্রয়াস ও প্রবণতা দার্শনিকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত নৈতিক ও রাজনীতিক দর্শনের মধ্যে রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ সফল হয়নি। কারণ দার্শনিকরা ধরে নিয়েছিলেন যে, রাজনীতিকে বিচ্ছিন্নভাবে, মানুষ তার মূল্যবোধ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। সাবেকি ঐতিহ্যগত পর্যায়ে এবং আধুনিক আচরণবাদী পর্যায়ে রাজনীতিক তত্ত্ব সাফল্য ও সমৃদ্ধি লাভ করছে। ডেভিড ইস্টন, ল্যাসওয়েল, কার্ল ডয়েটস্ প্রমুখ আধুনিককালের আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক বিষয়াদির অনুশীলনে নতুন মান ও মাত্রা সংযুক্ত করেছেন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে নৈতিক প্রেরণাসম্ভৃত এক ধরনের সামাজিক চিন্তা-ভাবনা। বহু বিশিষ্ট রাজনীতিক দার্শনিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যাদি সম্পর্কে অনুসন্ধান অনুশীলন করেন। তারফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিবিধ রাজনীতিক তত্ত্ব বিকশিত হয়। পরিশেষে বারলিন (Isaiah Berlin) এর একটি অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “So long as rational curiocity exists — a desire for justification and explanation in terms of motives and reasons, and not only of cause or functional correlations or statistical probabilities, political theory will not wholly perish from the earth, however many of its rivals, such as sociology, philosophical analysis, social psychology, political science, economics, jurisprudence, sematics, may claim to have dispelled its imaginary realm.”
Leave a comment