রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে এক সাড়া জাগানো বিষয়। মার্কসবাদ উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেবারে আলাদা। এই মতবাদ পৃথক দৃষ্টিতে মানুষ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করে। মার্কসবাদে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সমাজ বিকাশের ধারাকে ব্যাখ্যা করা হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়। বস্তুত মার্কসবাদ হল এই বিশ্বসংসার এবং তার অংশ স্বরূপ মানবসমাজ সম্পর্কে একটি সাধারণ বা সামগ্রিক তত্ত্ব। মার্কসীয় রাষ্ট্রচিত্তায় সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলিকে সুসংবদ্ধ তথ্যের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে। এই কারণে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি বিশ্ববীক্ষ্যা (World Outlook)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কেবলমাত্র কার্ল মার্কসের মতবাদকে বোঝায় না। মার্কস এবং তাঁর উত্তরসূরীদের অভিমত সামগ্রিকভাবে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে বিবেচিত হয়।

(১) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি

মার্কসীয় দর্শনে রাজনীতি সমাজের উপরি-কাঠামোর (super-structure) অন্যতম অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়। এই অঙ্গটি রাষ্ট্র এবং তার বিভিন্ন সংগঠন ও কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত। লেনিন (Lenin)-এর অভিমত অনুসারে, “রাজনীতি হল শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক। রাজনীতি হল রাষ্ট্রের ব্যাপারে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের কার্যকলাপের রূপ, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ।” বুরলাট্‌স্কি (Fyodor Burlatsky) তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Lenin wrote that politics is involvement in the affairs of state, the direction of the state, determination of the forms, goals and substance of state activity. Politics begins where there are millions….he stressed that politics have their own objective logic, irrespective of what persons or parties plan in advance.” বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কও রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। তবে শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সম্পর্কই হল রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আর সমগ্র সমাজব্যবস্থার ভিত হল অর্থনীতি। বুরলাট্‌স্কি বলেছেন: “The most general definition of politics is that politics is the form of interrelations among classes, social groups and nations, a form directly of indirectly connected with the manifestation and implementation of power.” লেনিনের মতে রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ (Politics is a concentrated expression of economics.)

লেনিনের অবস্থান: লেনিনের অভিমত অনুসারে যেখানে জনসাধারণের উপস্থিতি বর্তমান সেখানে রাজনীতির আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ঘটনা, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণই হল রাজনীতি। লেনিন রাজনীতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি শ্রেণীসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতির প্রতি বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের সম্পর্কের ক্ষেত্রের কথা বলেছেন। বুরলাস্কি বলেছেন: “Following Marx, Lenin unfailingly stressed that politics is the relationships among classes. But that is not all. Relations among classes may be of an economic, ideological, socio-psychological or other character.” রাজনীতিক বিশ্লেষণের গুরুত্বের কথা লেনিন অনুধাবন করেছেন। তিনি ক্ষমতা ও রাজনীতি সম্পর্কিত আলোচনার উপর জোর দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লেনিন কর্তৃক প্রণীত ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ শীর্ষক দু’টি রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দু’টি পুস্তিকায় লেনিন যে সকল বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: রাজনীতিক ক্ষমতার লক্ষ্য ও প্রকৃতি, রাজনীতিক ক্ষেত্রে সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণীসমূহের সংগ্রাম, জনগণ ও তাদের নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কার্যক্রম, সামাজিক মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে লেনিনের আলোচনা উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া রাজনীতি সংক্রান্ত মার্কসবাদের মুখ্য বিষয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে লেনিনের বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। বুরলাস্কি বলেছেন: “The specific feature of politics is that, as Lenin emphasized, it is the sphere of relationships of all classes and strata to the state and the government, the sphere of the interrelations between all classes.”

মার্কস-এঙ্গেলস: মার্কসবাদ ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিতর্ক বর্তমান। বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে মার্কসবাদে রাজনীতিক বিশ্লেষণের গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদীদের মতানুসারে মার্কসীয় রাষ্ট্রচিত্তায় বিভিন্ন বিষয়ের রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব মার্কস-এঙ্গেলসের রচনার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সমকালীন রাজনীতিক সমস্যাদির তাত্ত্বিক বিন্যাস ও রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের পরিচয় মার্কস-এঙ্গেলসের বিভিন্ন রচনায় বর্তমান। তাঁরা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করেছেন। বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে মার্কস-এঙ্গেলসের রাজনীতিক বিশ্লেষণের পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মার্কস-প্রণীত কতকগুলি রচনার উল্লেখ করা দরকার। এগুলি হল: Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte, Civil War in France, Class-Struggle in France, German Ideology, Revolution and Counter Revolution প্রভৃতি। মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে শ্রমিক শ্রেণীর আর্থনীতিক সংগ্রাম থেকে সৃষ্টি হয় রাজনীতিক সংগ্রামের। শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী হিসাবে শ্রমিকদের আন্দোলন এবং শাসকশ্রেণীর উপর বাধ্যবাধকতা বা চাপসৃষ্টিমূলক কার্যকলাপই হল রাজনীতিক আন্দোলন। মার্কস-এঙ্গেলসের মতানুসারে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার প্রকৃতি সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণীর দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই দুই রাষ্ট্র-দার্শনিকের আলোচনায় যে সমস্ত বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: রাজনীতিক প্রক্রিয়া, শোষক ও শাসক শ্রেণীর রাজনীতি, প্রলেতারীয় রাজনীতি, শ্রেণী-সম্পর্ক ও রাজনীতিতে তার প্রভাব, রাজনীতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলীর প্রকৃতি, একই শ্রেণীর অংশসমূহের মধ্যে সম্পর্ক, সমকালীন রাজনীতিক সমস্যাদির বিচার-বিশ্লেষণ প্রভৃতি। তা ছাড়া আর যে সমস্ত বিষয় মার্কসীয় রাজনীতিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলি হল : সমাজের মুখ্য শ্রেণীসমূহ, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিপ্লবী শ্রেণী ও শ্রেণী-শত্রু, শ্রেণী-শক্তির বিন্যাসের পটভূমিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সমাজের কর্তৃত্বকারী শ্রেণীর ক্ষমতা প্রয়োগ প্রভৃতি। পরিশেষে বুরলাস্কির একটি দীর্ঘ মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The social interest of classes, nations, groups and individuals are most graphically-reflected in the realm of political relations. Politics is the arena of combat as well as the arena for the combination of these interests on the basis of the real correlation of social forces. Politics, too, is the most plastic element of the superstructure, strongly influence not only by base factors (economics, classes etc.), but also by other factors (group and personal interests and views, people’s ideas, culture etc.). Politics, finally, is the active sphere of the social structure, affecting the latter directly and continually.” মার্কসীয় দর্শন অনুসারে রাজনীতি বলতে সামাজিক সমগ্রেরই অংশকে বোঝায়। রাজনীতি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয় বা সমাজ বহির্ভূত বিষয় নয়। রাজনীতি মানবসমাজের কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। সামাজিক সম্পর্কসমূহ সামজিক দৃষ্টিতে দেখাই হল রাজনীতির উদ্দেশ্য।

(২) বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো

মার্কসবাদী রাষ্ট্র দার্শনিকগণ রাজনীতির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বনিয়াদ (Base) ও উপরি-কাঠামোর (Super structure) ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা এই ধারণার প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতি বিচার-বিশ্লেষণের পক্ষপাতী। মার্কসীয় অর্থনীতি ও সমাজবীক্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘ভিত্তি ও উপরিসৌধ’ সম্পর্কিত ধারণা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। শ্রমজীবী জনতার উৎপাদনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়, ‘সমাজসৌধ’-এর বনিয়াদ। এই বনিয়াদের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয় লেখক, শিল্পী, অভিনেতাদের সত্তা। ধনতন্ত্র বিকশিত হয় শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। ধনতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের উপরিতলার শিল্প-সংস্কৃতি গড়ে উঠে।

‘ভিত্তি’ বলতে বোঝায় মানুষের বস্তুগত (material) জীবন বা উৎপাদন পদ্ধতিকে। ‘উপরিসৌধ’ হল মানুষের মানসিক বা ভাবনার জীবন। বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণের জন্য আবশ্যক হল এক সুগঠিত বনিয়াদ। অনুরূপভাবে আর্থনীতিক ভিত্তি ব্যতিরেকে সমাজজীবনে কোন উপরিসৌধের সৃষ্টি হতে পারে না। সমাজদেহের সৃষ্টি হয় ‘ভিত্তি’ ও ‘উপরিসৌধের সমন্বয়ে। সমাজদেহের সৃষ্টির জন্য উভয়েরই আবশ্যক। The German Ideology, The Communist Manifesto The Critique of Political Economy শীর্ষক গ্রন্থসমূহে ‘ভিত্তি-উপরিকাঠামো’ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ‘উপরিসৌধ’ বনিয়াদ-এর স্বার্থের অনুকূল নয়, প্রতিকূল। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় ‘ভিত্তি’ ও ‘উপরিসৌধ’-এর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বর্তমান। স্বীয় কাঠামোর অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে উপরিসৌধের স্বার্থ সংযুক্ত থাকে। উপরিসৌধের স্বার্থের কোন রকম ক্ষতিসাধন ভিত্তি করতে পারে না। কারণ উপরিকাঠামোই হল ভিত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার যাবতীয় ব্যবস্থার ধারক ও বাহক। উপরিসৌধের সৃষ্টি হয় ভিত্তির দৌলতে। অথচ ভিত্তিকে উপরিসৌধই নেতি (negation)-র পর্যায়ে ঠেলে দেয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উপরিসৌধই হল যাবতীয় ভাবাদর্শ (Ideology)-এর ধারক ও বাহক। উপরিসৌধ ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে শিক্ষা, সংস্কৃতি সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ভিত্তি-উপরিসৌধের পারস্পরিক সম্পর্কের এই প্রকৃতির মাধ্যমে শোষণ-পীড়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তার ফলে পুঁজিবাদের অস্তিত্বও অব্যাহত থাকে।

ভিত্তি ও উপরি সৌধ: উৎপাদন ব্যবস্থাকে বলা হয় সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদ। এই বনিয়াদের উপর সমাজের উপরি-কাঠামো গড়ে ওঠে। আইন, আদালত, কারাগার, পুলিশ বাহিনী, সৈন্য বাহিনী প্রভৃতি সকল রাষ্ট্রীয় সংগঠন; কলা, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন ভাবাদর্শের বহুবিধ অভিব্যক্তির সমন্বিত রূপকে উপরি-কাঠামো বলা হয়। সমাজের উপরি-কাঠামোর এই বিশাল ইমারত আর্থনীতিক বনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে থাকে; এবং এই বনিয়াদের দ্বারাই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থাই হল সকল কিছুর মূল। বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন-পদ্ধতির দ্বারা সাধারণভাবে সামাজিক, রাজনীতিক ও মনন বিষয়ক জীবনধারা নির্ধারিত হয়। মার্কস The Critique of Political Economy শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The mode of production of material life determines the social, political and intellectual life process in general. It is not the consciousness of men that determines their being, but, on the contrary, their being that determines their consciousness.” এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সংক্ষেপে বিভিন্নভাবে অভিব্যক্ত সমাজ-জীবনের বহুবিধ বিষয়। তাই মার্কসের রাজনীতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক তত্ত্বকে তাঁর আর্থনীতিক তত্ত্ব থেকে পৃথক করা যায় না।

উৎপাদন-সম্পর্কের সমষ্টি হল সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদ: রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় আলোচনায় বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো হল একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এই কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে সকল সমাজের বনিয়াদ বা ভিত্তি ও উপরি-কাঠামো থাকে। সমগ্র উৎপাদন সম্পর্কই সমাজের ভিত্তি রচনা করে। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কই হল সমাজের ভিত্তি। এবং উৎপাদন-সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত হল সম্পত্তি, বিনিময় ও বণ্টন-সম্পর্ক। এই উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টি সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তি স্থাপন করে। সমাজের অন্যান্য সম্পর্কের উদ্ভব হয় এই উৎপাদন সম্পর্ক থেকে। অর্থাৎ সমাজের সকল সম্পর্কের ভিত্তি হল উৎপাদন সম্পর্ক। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে যে-কোন সমাজের ভিত্তি বা বনিয়াদ হল আর্থনীতিক কাঠামো। এই আর্থনীতিক কাঠামো বলতে নির্দিষ্ট কোন সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টিকে বোঝায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে এ ক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টি বলতে প্রাধান্যকারী বা মুখ্য উৎপাদন-সম্পর্কের সমষ্টিকে বোঝান হয়েছে। অর্থাৎ সমাজের ভিত্তি প্রস্তুত করে প্রাধান্যকারী উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টি। সমাজে এই প্রাধান্যকারী উৎপাদন-সম্পর্ক ব্যতীত অ-প্রধান উৎপাদন-সম্পর্কের অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয়। সমাজের ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে এই প্রাধান্যহীন উৎপাদন সম্পর্কের ভূমিকা নেই। প্রাধান্যহীন উৎপাদন-সম্পর্কের ধারণাটি ব্যাখ্যা করা দরকার। প্রাধান্যহীন উৎপাদন-সম্পর্ক বলতে নতুন আর্থনীতিক ব্যবস্থার নবজাত উপাদানের সঙ্গে বিগত আর্থনীতিক ব্যবস্থার উৎপাদন সম্পর্কের অবশিষ্টাংশের অস্তিত্বকে বোঝায়। বিষয়টি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক আর্থনীতিক উপাদান অঙ্কুরিত হতে পারে। বিপরীতক্রমে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সীমিতভাবে হলেও সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-সম্পর্কের অবশিষ্টাংশের অস্তিত্ব থাকতে পারে। মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে সমাজের ক্রমবিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে সমকালীন আর্থনীতিক কাঠামো সমাজের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রাধান্যকারী উৎপাদন-সম্পর্কের সমষ্টিবদ্ধ রূপই হল এই আর্থনীতিক কাঠামো।

উপরি-কাঠামো: বনিয়াদের উপরে থাকে আর্থনীতিক কাঠামো। সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তির উপরে গড়ে উঠে তার উপরি-কাঠামো। উপরি-কাঠামোর উদ্ভব হয় নির্দিষ্ট কোন আর্থনীতিক ভিত্তি থেকে। নির্দিষ্ট কোন আর্থনীতিক ভিত্তি থেকে সামাজিক ভাবধারা, মতাদর্শগত সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব ঘটে। এবং এদেরই সমষ্টিকে বলে উপরি-কাঠামো। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তি থেকে যে সমস্ত ভাবধারা, প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্কের সৃষ্টি হয় তার সমষ্টিকেই বলে উপরি-কাঠামো। এ ক্ষেত্রে ভাবধারা বলতে সামাজিক অনুভূতি, মতামত, মনস্তত্ত্ব, চেতনা প্রভৃতিকে বোঝায়। প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝায় রাষ্ট্র, রাজনীতিক দল, গণ-সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আদালত প্রভৃতি সংগঠনকে। মতাদর্শগত সম্পর্ক বলতে উপরি-কাঠামোগত সম্পর্ককে বোঝায়। এই সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত হল রাজনীতিক, আইনগত, নৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য সম্পর্ক।

রাজনীতিক উপরি-কাঠামো: সামাজিক উপরি-কাঠামোর অন্যতম উপাদান হল রাজনীতি। সকল রাষ্ট্রীয় কাঠামো; পুলিশ, সেনা, কারাগার প্রভৃতি বলপ্রয়োগের যাবতীয় হাতিয়ার; ভাবধারা ও মতাদর্শ প্রভৃতির সমষ্টিকে বলে রাজনীতিক উপরি-কাঠামো। চূড়ান্ত বিচারে আর্থনীতিক ভিত্তির উপর রাজনীতিক প্রকৃতি নির্ভরশীল। রাজনীতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে সমাজের শ্রেণীসমূহের আর্থনীতিক সম্পর্ক ও স্বার্থের ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট শ্রেণীগুলির রাজনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে রাজনীতিক সম্পর্ক সামাঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। তবে কোন নির্দিষ্ট সমাজের আর্থনীতিক কাঠামোর সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন ভাবধারা, মতাদর্শ ও সংগঠনের সৃষ্টি হতে পারে। এগুলিকে বলে বৈপ্লবিক ভাবধারা, মতাদর্শ ও সংগঠন।

প্রাধান্যকারী মতাদর্শ: প্রত্যেক উপরি-কাঠামোর উদ্দেশ্য হল তার আর্থনীতিক বনিয়াদের বিকাশ ও সংরক্ষণ। নির্দিষ্ট কোন একটি উপরি-কাঠামোর বিকাশের মূল শক্তি হল সংশ্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের বিকাশ। যে-কোন সমাজের নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ ভাবধারা, মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক কাঠামোর অস্তিত্বের সঙ্গে ঐ সমস্ত ভাবধারা, মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এগুলি হল সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রাধান্যকারী ভাবধারা, মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে Dialectical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে মরিস কর্নফোর্থ (Maurice Cornforth) বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে যে কোন নির্দিষ্ট সমাজের ভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন প্রাধান্যকারী ভাবধারা, মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের উপরি-কাঠামো গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। মার্কস-এঙ্গেলস ম্যানিফেস্টোতে মন্তব্য করেছেন, যে, সমাজের বৈষয়িক উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটলে, তদনুসারে মানুষের বৌদ্ধিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন সমাজে উৎপাদন সম্পর্কের উপর প্রাধান্যকারী মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি নির্ভরশীল।

উপরি-কাঠামোর উপর আর্থনীতিক ভিত্তির প্রভাব: মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় প্রত্যেক যুগেই একটি নির্দিষ্ট আর্থনীতিক ভিত্তি থাকে। এবং তদনুসারে একটি নির্দিষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উপরি-কাঠামোও গড়ে উঠে। সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তিতে যদি পরিবর্তন ঘটে তা হলে তার প্রভাব উপরি-কাঠামোর উপরও পড়ে। এবং উপরি-কাঠামোও তদনুসারে পরিবর্তত হয়। সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তির অবলুপ্তি ঘটলে সংশ্লিষ্ট উপরি-কাঠামোও ভেঙ্গে পড়ে। আগেকার ক্ষয়িষ্ণু সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তি ভেঙ্গে পড়লে, তার উপর গড়ে উঠা উপরিকাঠামোও অবধারিতভাবে অবলুপ্ত হয়। সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব সংঘাত সংশ্লিষ্ট উপরি-কাঠামোতেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি করে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সম্ভৃত বিরোধ উপরি কাঠামোতেও বিরোধের সূত্রপাত করে। অর্থাৎ সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তির পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট উপরি কাঠামোর পরিবর্তন অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত।

বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামোর পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া: তবে উপরি-কাঠামোর উপর ভিত্তির এই প্রভাব প্রতিক্রিয়া একেবারে একচেটিয়া নয়। বনিয়াদ যেমন উপরি-কাঠামোকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে, অনুরূপভাবে বনিয়াদও উপরি-কাঠামোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। বুরলাস্কি (Fyodor Burlatsky) বলেছেন : “The interrelationship of basis and superstructure is not, however, one sided. The political superstructure, in its turn, has an enormous impact on all of social life.” উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলির সক্রিয় ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। উপরি-কাঠামোর মধ্যে যে সমস্ত উপাদান থাকে, সেগুলি ঐতিহাসিক সংগ্রামকে প্রভাবিত করে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে এই উপদানগুলি ঐতিহাসিক সংগ্রামের চেহারা-চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃত প্রস্তাবে বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা থাকে। আবার উপরি-কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানের মধ্যেও পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত থাকে। তবে চূড়ান্ত বিচারে আর্থনীতিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার: মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা কেবল প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, এমন নয়। রাজনীতিক উপরি-কাঠামোও আর্থনীতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ত্রিবিধ হতে পারে। আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও একমুখী হতে পারে। এই সম্পর্ক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিপরীতমুখী হতে পারে। আবার আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। বুরলাট্‌স্কি লিখেছেন: “Engels wrote that the reaction of the power upon economic development can be of three kinds it can run in the same direction, and then development is more rapid; it can oppose the line of development, in which case now a-days it will go to pieces in the long run in every great people, or it can prevent the economic development from proceeding along certain lines, and prescribe other lines.” তবে চূড়ান্ত বিচারে সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তি উপরি-কাঠামোর সকল উপাদানকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। রাজনীতিও এই প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে না। মার্কস-এঙ্গেলসের মতানুসারে আর্থনীতিক প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে আর্থনীতিক উপাদানই চূড়ান্তভাবে তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে। আবার এ কথাও ঠিক যে আর্থনীতিক প্রাধান্যমূলক প্রভাব সত্ত্বেও সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্যান্য উপাদানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বুরলাস্কি বলেছেন: “Along with the decisive influence of the economy, various other factors have a major effect on all areas of social life, especially on so plastic an element as the political process.”

(৩) আর্থনীতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে অর্থনীতি-নিরপেক্ষ কোন আলোচনাই বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না। আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজজীবনের আর সবকিছুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্র, সরকার, আইন ও অন্যান্য সকল প্রাসঙ্গিক বিষয় সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করলে সে আলোচনা একপেশে ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। কোন দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে বা রাজনীতিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে সেই দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ আবশ্যক। তবে এও উল্লেখযোগ্য যে, মার্কসবাদে সমাজের সব কিছুর ভিত্তি হিসাবে আর্থনীতিক উপাদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; কিন্তু সমাজের উপরি-কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব ও গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা হয় না।

(৪) রাজনীতির গুরুত্ব

মার্কসবাদ অনুসারে অর্থনীতি-নিরপেক্ষ যে কোন আলোচনা অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু এই তত্ত্বে রাজনীতির গুরুত্বকেও অস্বীকার করা হয় না। রাজনীতি অর্থনীতির ঘনীভূত ও সম্পূর্ণ রূপ হলেও, রাজনীতি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। লেনিন (Lenin) বলেছেনঃ ‘অর্থনীতির উপর রাজনীতির অবশ্যই পূর্বাধিকার থাকবে’ (“Politics must take precedence over economics.”)। আর্থনীতিক বনিয়াদ থেকে সৃষ্ট উপরি-কাঠামোর কোন অংশই নিষ্ক্রিয় নয়। এই অংশগুলিও বনিয়াদকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ হিসাবে রাজনীতি প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অর্থনীতির সেবা করে থাকে। যাই হোক, বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো মিলিতভাবে প্রত্যেক সমাজ-ব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রকে প্রতিপন্ন করে। ভিত বা উপরি-কাঠামো মিলিতভাবে প্রত্যেক সমাজব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রকে প্রতিপন্ন করে। ভিত বা বনিয়াদে ব্যক্ত হয় ব্যবস্থার আর্থনীতিক ভিত্তি। এবং রাজনীতিক ও ভাবাদর্শগত রূপ ব্যক্ত হয় উপরিকাঠামোতে। প্রত্যেক সামাজিক ব্যবস্থার আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে অন্য সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে তার পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। একটি সমাজব্যবস্থা থেকে অপর একটি সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের সময় বনিয়াদের মত উপরি-কাঠামোতেও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন সমাজের সৃষ্টি হয়।

রাজনীতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া: মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আর্থনীতিক ভিত্তির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু আর্থনীতিক কাঠামো একমাত্র নির্ধারক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়নি। মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে আর্থনীতিক ভিত্তি এবং রাজনীতিক উপরি-কাঠামো পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া ও নির্ভরশীলতার সম্পর্কে আবদ্ধ। মার্কস-এঙ্গেলসের মতানুসারে রাজনীতিক উপরি-কাঠামোর চেহারা-চরিত্র নির্ধারণ করে সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তি। আবার অনুরূপভাবে আর্থনীতিক বিকাশের প্রকৃতি ও পরিধিকে প্রভাবিত করে রাজনীতিক উপরি-কাঠামো। মার্কসবাদী আলোচনায় রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কথা বলা হয়। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাজনীতিক উপাদন হল এমনি একটি উপাদান যা সতত সক্রিয় থাকে। সকল সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কযুক্ত থাকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে রাজনীতি হল বিভিন্ন সামাজিক বিরোধ এবং বিশেষত শ্রেণী-সংঘাতের এক সামগ্রিক রূপ। আবার মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে আর্থনীতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে উঠে। আবার সমাজের আর্থনীতিক জীবনধারা এবং দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার উপর রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য।

রাজনীতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে বুরলাট্‌স্কির অভিমত: এ প্রসঙ্গে বুরলাট্‌স্কি (Fyodor Burlatsky)-র অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Mrax and Engels gave a great deal of attention to the study of the nature of politics, of political power, of the nature of political activity, formulating the demands of proletarian politics in juxtaposition to the exploiting classes.” মানুষের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনীতির গভীর ও ব্যাপক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বুরলাট্‌স্কি তাঁর বইটির শুরুতেই এক দীর্ঘ মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্যটি অত্যন্ত প্রাসাঙ্গিক। তিনি বলেছেন: “One of the most striking phenomena of contemporary social life is the greatly increased role of politics in mankind’s material and cultural life. Politics influences the economy, the forms and scale of the distribution of material goods, ideology, culture, ethics, the family, life-style, in a word all aspects of social life. One cannot form a picture of social life, of the functioning of a state, that is at all complete without studying the nature of politics.” বুরলাস্কি আরও বলেছেন: “The class-struggle becomes real, consistent and developed only when it embraces the sphere of politics.”

(৫) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ

রাজনীতি সম্পর্কিত বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের আলোচনা বাস্তব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন। রাজনীতিক জীবনের মূল ভিত্তির আলোচনা বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণে অবহেলিত। এই কারণে রাজনীতি সম্পর্কিত বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির মূলগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতির সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার পথ অবলম্বন করা হয়েছে। রাজনীতিক ঘটনাবলীর বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকগণ আইনানুগ ও আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি। মানবসমাজ, সমাজের ভিত্তি, সামাজিক উপরি-কাঠামো, বিভিন্ন পারস্পরিক আর্থ সামাজিক ও রাজনীতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মার্কসবাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকগণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। বুরলাস্কি বলেছেন: “A materialist approach to the study of politics means to apply the laws of dialects, of historical mate ism, to the cognition of political phenomena…..”

মার্কসবাদ অনুসারে একটি মাত্র সামাজিক বিজ্ঞান বর্তমান যা ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব প্রভৃতি সব কিছুকেই একযোগে অঙ্গীভূত করেছে। ঐক্যবদ্ধ এই সামাজিক বিজ্ঞানটিকে বলা হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হল সমাজরূপের বা সমাজবিকাশের প্রণালীবদ্ধ আলোচনা।

মার্কসবাদে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে বৈজ্ঞানিকভাবে মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে ব্যাখ্যা করা হয়। সমাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অংশবিশেষ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে জগৎ প্রকৃতিগতভাবেই বস্তু বা পদার্থ। জগতের প্রত্যেক বস্তু পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কযুক্ত। এই বস্তুজগৎ পরিবর্তনশীল ও গতিময়। বস্তুজগতের এই পরিবর্তন ও বিকাশের মূলে আছে বস্তুর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধ। এঙ্গেলস মন্তব্য করেছেন যে, “ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম।” দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব বা সূত্র মানবসমাজের ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলে তাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতির মধ্যে যে বিধান ও চালিকাশক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, সে বিষয়ে সাধারণ তত্ত্বই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:

বস্তুত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করা। সমাজের বৈষয়িক জীবনযাত্রা উৎপাদন পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন পদ্ধতির দু’টি দিক আছে: উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি বলতে বোঝান হয়েছে সেই মানুষদের যাদের উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে এবং সেই যন্ত্রপাতি যার সাহায্যে দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদিত হয়। আর উৎপাদন-সম্পর্ক বলতে সেই সম্পর্ককে বোঝায় যা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় এবং বাস্তবসামগ্রীর বণ্টন ও বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়। এদের মধ্যে উৎপাদন শক্তি অধিক গতিশীল। উৎপাদন শক্তির বিকাশ এবং তার ফল হিসাবে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের ইতিহাসই হল সমাজ বিকাশের ইতিহাস। উৎপাদন শক্তির উন্নতি ও পরিবর্তন হয়, তার প্রতিঘাত পড়ে উৎপাদন-সম্পর্কের উপর এবং তার ফলে সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। Das Kapital গ্রন্থে মার্কসের অভিমত অনুসারে সমগ্র সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত থাকে। এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রও সম্পর্কযুক্ত। লেনিনও সমাজের অন্যান্য সম্পর্কের নির্ধারক হিসাবে উৎপাদন সম্পর্কের কথা বলেছেন। অর্থাৎ সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তিতে পরিবর্তন, সমাজের উপরি-কাঠামোতেও তার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তার ফল হিসাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা, এক কথায় উপরি-কাঠামোর সকল অঙ্গেই পরিবর্তন সূচিত হয়।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে সমাজ বিকাশের ধারা:

উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বিকাশের ধারায় পাঁচ ধরনের সমাজব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস-সমাজ, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরেই গড়ে উঠে সেই সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা। এইভাবে আদিম শ্রেণীহীন প্রাক-সভ্য সাম্যতন্ত্র এবং আধুনিক শ্রেণী বৰ্জিত সুসভ্য সাম্যতন্ত্রের মধ্যবর্তী পর্যায়ে যে তিন ধরনের শ্রেণী সমাজ (দাসতন্ত্র, সামত্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র) পরিলক্ষিত হয় তাদের সবকটি সমাজেই রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা প্রভৃতি এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যাতে সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ বজায় থাকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের উৎপাদন-পদ্ধতি এবং উপরি-কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠে যাতে ক্রমশ শ্রেণীহীন এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কস বলেছেন : “এই বনিয়াদের (আর্থনীতিক) সঙ্গে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজচেতনার সামঞ্জস্য আছে। বাস্তব ভিত্তির উপরই আইনগত ও রাজনীতিক ইমারত (super structure) খাড়া হয়। সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মনন বিষয়ক জীবনধারাকে বাস্তব জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে না। মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের ধ্যান-ধারণা বা ভাবধারা হল বস্তুময় জগতেরই অভিব্যক্তি। ” মার্কস আরও বলেছেন: “The ideal is nothing else than the world reflected by the human mind, and translated into forms of material thought.”

(৬) ক্ষমতার ধারণা

রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার ধারণা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। কোন রাজনীতিক প্রক্রিয়া বা রাজনীতিক মতবাদ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ধারণা কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই কারণে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিচার বিশ্লেষণ হল রাজনীতিক তত্ত্বের একটি মৌলিক বিষয়। রাজনীতি ও ক্ষমতা সম্পর্কে বুরলাস্কি (Fyodor Burlatsky) তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতি হল শ্রেণী-সম্পর্কিত ঘটনাবলীর প্রকাশ। শ্রেণী-সম্পর্কের মাধ্যমে রাজনীতির অভিব্যক্তি ঘটে। ক্ষমতা ক্ষমতা প্রয়োগের সঙ্গে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট থাকে। এই কারণে সামাজিক সম্পর্ক থেকে রাজনীতি ও রাজনীতিক সম্পর্ককে স্বতন্ত্র করা সম্ভব। বুরলাট্‌স্কি বলেছেন: “The centre of political theory and of the study of specific political processes is the concept of power. This concept is the key to understanding political institutions, political movements and politics itself.” তিনি আরও বলেছেনঃ “Marx and Lenin indicated many times that the concept of power is one of the fundamental concepts of political theory….that the fundamental question of any revolution is the question of power in the state.”

ক্ষমতার শ্রেণীগত ব্যাখ্যা:

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হল ক্ষমতার শ্রেণীগত ধারণা। মার্কসবাদীরা শ্রেণীগত দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতার প্রশ্নটির পর্যালোচনা করেছেন। ক্ষমতার প্রশ্নটি হল একটি শ্রেণীগত প্রশ্ন। ক্ষমতার শ্রেণী-চরিত্র থাকে। বলপ্রয়োগের হাতিয়ারের উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্ভরশীল। বুরলাট্‌স্কি বলেছেন : “The most characteristic feature of politics as a class phenomenon is its direct or indirect connection with power and activity to implement power.” তিনি আরও বলেছেন: “The question of power cannot be evaded or brushed aside, because it is the key quesiton determining everything in a revolution’s development, and in its foreign and domesite politics.” শ্রেণীগত শাসন-শোষণের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। শোষক শাসনশ্রেণী অন্যান্য শ্রেণীর উপর শাসন-শোষণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রয়োগের পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান, আন্দোলন ও রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভবপর হয়। রাজনীতি ও ক্ষমতার মাধ্যমে শ্রেণী-সংগ্রাম যথার্থ সংগ্রামে পরিণত হয়। ক্ষমতা ও ক্ষমতার প্রয়োগ সম্পর্কিত কাজকর্মের সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামের সংযোগ থাকে। এই সংযোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে। বুরলাস্কির অভিমত অনুসারে শ্রেণী, গোষ্ঠী ও জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি রকম বা ধরন সাধারণভাবে রাজনীতি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই রাজনীতি ক্ষমতার প্রকাশ-প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত থাকে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি-প্রয়োগ সম্পর্কে বাস্তববাদী আলোচনা করে থাকেন। এবং তাঁরা এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা ধারণার ভিত্তিতে এই আলোচনা করে থাকেন।

(৭) শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম

মার্কসবাদের একটি বিশিষ্ট বিষয় হল শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব। Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে মিলিবাও (Ralph Miliband) -এর অভিমত অনুসারে মার্কসীয় রাজনীতির মূলে বিরোধের ধারণা বর্তমান। শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব হল মার্কসীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রেণী-সংগ্রামের উপর মার্কসবাদে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বুরলাস্কির মতানুসারে মার্কসীয় রাজনীতিতে মানবসমাজের বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং সমাজ বিকাশের বিশেষ একটি হাতিয়ার হিসাবে শ্রেণী-সংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই শ্রেণী-সংগ্রামকে রাজনীতিক সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সংগ্রাম হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার এবং প্রশাসন ক্ষমতার উপর আধিপত্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোন্ শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে তা নির্ধারিত হয় রাজনীতিক সংগ্রামের মাধ্যমে। এই কারণে শ্রেণী সংগ্রামের এক প্রধান রূপ হিসাবে রাজনীতিক সংগ্রামের কথা বলা হয়। প্রত্যেক শ্রেণী স্ব স্ব শ্রেণী-স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাজনীতিক সংগ্রামের সামিল হয়।

রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ হল শ্রেণীগত মতবাদ। মার্কস-এঙ্গেলসের মতানুসারে বিদ্যমান সকল মানবসমাজের ইতিহাস হল শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজেই শ্রেণী-সংঘাত বর্তমান। এই সংঘাত হল শোষক ও শোষিত শ্রেণীর মধ্যে। শ্রমিক শ্রেণী যে সমস্ত আন্দোলনের মাধ্যমে শাসক শ্রেণীর বিরোধিতা করে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, সেই আন্দোলনকে রাজনীতিক আন্দোলন বলা হয়। রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বে রাজনীতিক আন্দোলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ শ্রেণী-সম্পর্কের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যই হল রাজনীতিক আন্দোলন। এই রাজনীতিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয় মেহনতী মানুষের বিভিন্ন আর্থনীতিক আন্দোলনের ভিতর থেকে। আর্থনীতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের সকল শ্রেণীর রাজনীতির প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। সাধারণত সকল সমাজব্যবস্থাতেই শাসন ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের কার্যাবলী নির্ধারণ করে শাসকশ্রেণী। এই শাসকশ্রেণী এবং ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তিদের মধ্যে তারতম্য নির্ধারণ করা আবশ্যক। তা হলে অর্থনীতি এবং রাজনীতির পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক নিরূপণ করা যাবে।

(৮) প্রলেতারীয় একনায়কত্ব

মানব সমাজের পরিবর্তন প্রসঙ্গেও মার্কসীয় রাজনীতির বক্তব্য পৃথক প্রকৃতির। মার্কসীয় রাজনীতির এই স্বাতন্ত্র্যের দিকটিও বুরলাস্কি উল্লেখ করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজ বিকাশের ধারাকে বিস্তারিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের মতানুসারে সমাজ বিকাশের ধারায় প্রলেতারীয় বিপ্লব এবং প্রলেতারীয় একনায়কত্ব অবশ্যম্ভাবী। প্রলেতারীয় বিপ্লবের ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অবসান ঘটবে ও প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং প্রলেতারীয় একনায়কত্বের আওতায় অবশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থা উবে যাবে।

মার্কসীয় দর্শনে রাজনীতির একটি বিশেষ তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। এই তত্ত্বটি হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব। মার্কসবাদের মাধ্যমে এক সমৃদ্ধ সমাজদর্শনকে তুলে ধরা হয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার এক বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তির সন্ধান দিয়েছেন। শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদ এবং শোষণহীন সমাজের ভবিষ্যৎ রূপকর্মকে সংযুক্ত করার উদ্যোগ মার্কসবাদে বর্তমান। মার্কসবাদ অনুসারে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বা সাম্যবাদের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটি বাস্তব শক্তি আবশ্যক। এই বাস্তব শক্তি বলতে শ্রমিক শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে।

(৯) সমাজের সামগ্রিক সত্তা

মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে রাজনীতি সমাজের অন্যান্য বিষয় থেকে স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধিকারসম্পন্ন নয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে সমাজের রাজনীতিক, আর্থনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিষয়গুলিকে স্বতন্ত্রভাবে পর্যালোচনা করার প্রবণতা হল কৃত্রিমতাপূর্ণ। মার্কসবাদ অনুসারে সমগ্র সমাজের কাঠামো ও কার্যকলাপের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক হল অত্যন্ত গভীর। রাজনীতি এবং অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম প্রভৃতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ সবের কোন একটি ক্ষেত্রের পরিবর্তনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে মার্কসবাদে রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক জীবনের অন্যান্য দিকগুলির কোন রকম কৃত্রিম তারতম্য বা ব্যবধান সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় না। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী রাজনীতির উদ্দেশ্য হল সামাজিক সম্পর্কসমূহকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা (the ensemble of social relations)।

মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাজনীতি সম্পর্কে অনুশীলন সমগ্র সমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই করা হয়। কেবল রাজনীতি নয়, সমাজের যে-কোন বিষয় সম্বন্ধে পর্যালোচনা সমগ্র সমাজব্যবস্থার পটভূমিতে করা হয়। মার্কসবাদে সমগ্র সমাজকে একটি অখণ্ড, অবিভাজ্য এবং সামগ্রিক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেইজন্য সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত সকল বিচার-বিশ্লেষণ সামগ্রিকভাবেই সম্পাদিত হয়। আপাত বিচারে এক্ষেত্রে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। আচরণবাদে সমাজের বিভিন্ন অংশকে আলাদাভাবে অনুশীলন করা হয়। এবং তারপর এই অনুশীলনের ফলগুলিকে একত্র করে সমগ্র সমাজব্যবস্থার স্বরূপ বিচার করা হয়। সুতরাং স্পষ্টতই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক প্রকৃতির। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে মানুষের সমগ্র সামাজিক অস্তিত্বই রাজনীতির অঙ্গীভূত। তা ছাড়া, আচরণবাদী তত্ত্বে কেবল ঘটনাকে নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং ধারণার প্রাধান্য বর্তমান থাকে। এই তত্ত্বে ইতিহাসের প্রভাবকে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু মার্কসবাদে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে আলোচনা করা হয়। আবার আচরণবাদী তত্ত্ব মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থক এবং রক্ষণশীল। কিন্তু মার্কসবাদ প্রগতিশীল এবং সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী।

(১০) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী

রাজনীতিক সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ হল রাজনীতি সম্পর্কিত এক বস্তুবাদী মতবাদ। এ হল রাজনীতিক প্রক্রিয়ার এক সাধারণ বস্তুবাদী বিশ্লেষণ। বুরলাট্‌স্কি তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ অনুসারে রাজনীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নীতি এবং দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের নীতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বুরলাস্কি বলেছেন: “A materialist approach to the study of politics means to apply the laws of dialectics, of historical materialism, to the cognition of political phenomena…. ” রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসবাদী আলোচনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধিত হয়েছে। মানুষের সামাজিক জীবন ও সমস্যাদির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ এবং বাস্তব সত্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে মার্কস-এঙ্গেলস এক বিশেষ তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। এর বৈজ্ঞানিক মূল্য অপরিসীম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জিত মানুষের যাবতীয় জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়েছে মার্কসীয় মতবাদে। এই কারণে বলা হয় যে রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল এক সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ বৈজ্ঞানিক মতবাদ। এই মতবাদ মানবসমাজের বিকাশ, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও যথাযথ জ্ঞান অর্জনের জন্য সকল বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডারের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। Studies in Marxism and Political Science গ্রন্থে সেশাদ্রি (K. Seshadri) এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ হল পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। বুরলাস্কি (F. Burlatsky) তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Allegations by bourgeois scholars that Marxism Leninism has no firm traditions in the scientific analysis of political problems is without basis in fact.”

মানুষ ও জড় পদার্থের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য সাধারণ সূত্র বা নিয়মগুলির ভিত্তিতেই মার্কসীয় দর্শনের সৃষ্টি। মানবসমাজের গতি-প্রকৃতি যে সকল সাধারণ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলি বহির্জগতের সাধারণ নিয়মের ন্যায় একই রকমের। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান উদ্দেশ্যমূলকভাবে বহিঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহার করা যায় এবং হয়। অনুরূপভাবে সমাজকে অধ্যয়নের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন বা বিকাশের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। মার্কসবাদ কোন বিমূর্ত নৈতিক সূত্র বা ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবেই এই তত্ত্ব স্বীকৃতি দাবি করে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বাস্তব রাজনীতির স্বরূপ সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়। তাই এ হল একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

(১১) গতিশীল মতবাদ

বিজ্ঞানের অপরাপর শাখার মত মানবসমাজের বিকাশ সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস এবং পৃথিবী সম্পর্কিত তথ্যের ভিত্তিতে। সেইজন্য তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদ গতিশীল। এর শেষ সীমারেখা টানা হয়নি। ইতিহাসের অগ্রগতি এবং মানুষের অগ্রগতি এবং মানুষের অধিকতর অভিজ্ঞতা অর্জন মার্কসবাদকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর মার্কসবাদকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে লেনিন ও স্ট্যালিনের অবদান উল্লেখযোগ্য। এঙ্গেলসের মতানুসারে মার্কসের সমগ্র বিশ্ববীক্ষ্যা একটি বদ্ধ ধারণা নয়, এ হল একটি পদ্ধতি; কতকগুলি অনড় সিদ্ধান্তের সমষ্টি নয়, তা হল অনুসন্ধানের প্রারম্ভিক বিন্দু ও পূর্ণতর অনুসন্ধানের ভিত্তি।

(১২) সামাজিক কাঠামোর রূপান্তর

মার্কসবাদ নিছক জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে গবেষণা করে না। মার্কসবাদীদের মূল উদ্দেশ্য হল বর্তমান। সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন। রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্ব নিছক একটি মতবাদ নয়; এ হল কার্যসম্পাদনের নির্দেশক (….not a dogma but a guide to action.’)। মার্কসবাদ হল মানবসমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের মতবাদ। এই মতবাদে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধনের ক্ষেত্রে মৌল শক্তিসমূহের ভূমিকার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে যে মানবসমাজের বৈপ্লবিক রূপাত্তরের ফলশ্রুতি হিসাবে মানুষ শোষণমুক্ত এক সমৃদ্ধশালী সমাজব্যবস্থায় উপনীত হবে। মার্কসীয় তত্ত্বে এ বিষয়ে এক বৈজ্ঞানিক রূপরেখার পরিচয় পাওয়া যায়। তা ছাড়া মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানুষের সমগ্র সামাজিক অস্তিত্বই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। মানবসমাজের সকল স্তরে রাজনীতি জড়িত। রাজনীতির আওতার বাইরে মানবজীবনের কোন অংশ থাকতে পারে না।

(১৩) মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি

মার্কসীয় রাজনীতি ও সমাজদর্শনের মধ্যে একটি যথার্থ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান দেখা যায়। মার্কসবাদে মানুষকে সামগ্রিক মানুষ হিসাবে দেখা হয়। এ হল সমাজসচেতন, সৃষ্টিশীল, দায়িত্বশীলকর্মী মানুষ। মার্কসবাদে ব্যক্তিকে অহংসর্বস্ব সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ হিসাবে দেখা হয় না। মানুষ পরিবেশ থেকে স্বতন্ত্র নয়। মার্কসবাদে আর্থনীতিক কাজকর্ম এবং সামাজিক সম্পর্কসমূহের মধ্যে মানুষকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।

(১৪) মানুষ নিজের ভাগ্যের নির্ধারক

একটি দার্শনিক প্রত্যয় মার্কসীয় রাজনীতিক ধ্যান-ধারণার পিছনে বর্তমান। এই দার্শনিক প্রত্যয় অনুসারে মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই পরিবর্তন করতে সক্ষম। মানুষের জন্য এ হল মার্কসের এক দার্শনিক উপলব্ধি। এই দার্শনিক উপলব্ধি বাস্তব এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি জাগতিক। এই দার্শনিক উপলব্ধি শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণীসচেতনতার সৃষ্টি করবে এবং মানুষকে দেবে কাজের কর্মসূচী।

রাজনীতির আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা

রাজনীতির আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ-বিরোধী রাষ্ট্র-দার্শনিকরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন না। তাঁরা রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিকোণের বিরূপ সমালোচনা করে থাকেন। সমালোচকদের যুক্তিগুলি আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ: সমালোচকরা রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ’ (economic determinism) হিসাবে অভিযুক্ত করেন। বিরুদ্ধবাদীদের অভিমত অনুসারে মার্কস বাদীরা কেবলমাত্র আর্থনীতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। আর্থনীতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের এই অবস্থা আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ হিসাবে পরিচিত। সমালোচকদের মতানুসারে রাজনীতির আলোচনায় এই আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদকে সমর্থন করা যায় না।

(খ) অর্থনীতি-বহির্ভূত উপাদানগুলিকে উপেক্ষা: সমালোচকদের আরও অভিযোগ হল যে রাজনীতি সম্পর্কিত আলোচনায় মার্কসবাদীরা কেবলমাত্র আর্থনীতিক উপাদানের উপর জোর দিয়েছেন। সুতরাং এই আলোচনা একদেশদর্শিতা দোষে দুষ্ট। রাজনীতি সম্পর্কিত এই আলোচনা আংশিক বা অসম্পূর্ণ। মানবসমাজের পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অর্থনীতি ছাড়া অন্যান্য উপাদান বা শক্তির কার্যকর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি-বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠী, জাতি ও জাতীয়তাবাদ, রাজনীতিক গণতন্ত্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সমস্ত উপাদানের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বটোমোর (Tom Bottomore) তাঁর Marxist Sociology শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে মার্কসবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্ত উপাদানের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন; কিন্তু শ্রেণী-সম্পর্ক ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাঠামোর মধ্যে এই সমস্ত উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি।

(গ) স্বতন্ত্র মার্কসীয় রাজনীতিক তত্ত্ব নেই: সমালোচকদের মতানুসারে মার্কসবাদকে একটি স্বতন্ত্র রাজনীতিক তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করা যায় না। মার্কসবাদী বক্তব্যের মধ্যে রাজনীতিক তত্ত্ব হিসাবে কোন কিছুর পরিচয় পাওয়া যায় না। মার্কস-এঙ্গেলস এবং মার্কসের উত্তরসুরীরা কোন স্বতন্ত্র রাজনীতিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেননি। তাঁরা অন্যান্য বিষয় ও সমস্যাদির আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি, শ্রেণী-সম্পর্ক, ক্ষমতা প্রভৃতির কথা বলেছেন। অর্থাৎ মার্কসীয় রাজনীতিক তত্ত্ব হিসাবে কিছু নেই। মার্কসীয় রাজনীতির উপর যে সমস্ত রচনার সাক্ষাৎ মেলে সেগুলি বিক্ষিপ্ত এবং অ-বিন্যস্ত। মার্কস-এঙ্গেলস এবং লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ, গ্রামস্কি প্রমুখ মার্কসের উত্তরসুরীদের রচনা থেকে ধ্রুপদী মার্কসবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এই সমস্ত লেখার ভিত্তিতে মার্কসীয় রাজনীতি সম্পর্কে কোন সুসংহত ধারণা লাভ করা যায় না। এ প্রসঙ্গে মিলিবাগু (Miliband)-এর অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…the most careful textual scrutiny will not yield a smooth harmonious consistent and unproblematic Marxist political theory…it is only by a very superficial reading, or by fiat, that such a Marxist political theory, of a distorted kind, can be obtained.”

(ঘ) মার্কসীয় চিন্তা-কাঠামোর মধ্যে মতানৈক্য: ধ্রুপদী মার্কসবাদ সম্পর্কে মার্কসবাদীদের সঙ্গে অ মার্কসবাদীদের বিরোধ সর্বজনবিদিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের মধ্যেও ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় বক্তব্যের বিভিন্ন বিষয়কে মার্কসবাদী বিভিন্ন পণ্ডিত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসবাদ প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার ভিত্তিতে বিভিন্ন মার্কসবাদী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত এই বিংশ শতাব্দী জুড়ে মার্কসবাদের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অভাব নেই। তার ফলে রাজনীতি সম্পর্কে সমজাতীয় ও সুসংহত কোন মার্কসবাদী চিন্তা-কাঠামো গড়ে উঠেনি। মিলিবাও বলেছেন: “Not only are the texts susceptible to different and contradictory interpretations, they also do actually incorporate tensions, contradictions and unresolved problems which form an intrinsic part of Marxist political thought.”

(ঙ) রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য অস্বীকৃত: মিলিবাণ্ডের মতানুসারে ধ্রুপদী মার্কসবাদী তত্ত্বে রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য অস্বীকৃত। মার্কসবাদ অনুসারে রাজনীতির কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদন পদ্ধতি। সুতরাং উৎপাদন পদ্ধতির উপর রাজনীতি নির্ভরশীল। এবং এই কারণে রাজনীতির প্রকৃতি হল পূর্ব-নির্ধারিত। এ প্রসঙ্গে মিলিবাণ্ডের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Politics is…so determined and conditioned as to give politics a mostly derivative, subsidiary and epiphenomenal character.” অর্থাৎ মার্কসবাদী তত্ত্বে আর্থনীতিক ভিত্তির উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং রাজনীতির উপর তত বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। মার্কসবাদের বনিয়াদ—–উপরি-কাঠামোর রাষ্ট্রতত্ত্বকে অবহেলা করা হয়েছে।

(চ) ব্যাপক ও জটিল: মিলিবাণ্ডের অভিমত অনুসারে মার্কসীয় তত্ত্ব রাজনীতির আলোচনাকে সমস্যাবহুল করে তুলেছে। কারণ রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় আলোচনা হল অতিমাত্রায় ব্যাপক। মানবসমাজের বিস্তৃত পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করার জন্য এই ব্যাপকতার সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাপকতার কারণে রাজনীতি বিষয়বস্তু হিসাবে তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে এবং অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে।

(ছ) আচরণবাদীদের সমালোচনা: সাম্প্রতিককালের বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিরূপ সমালোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বুরলাট্‌স্কি বলেছেন: “Behaviourists maintain that the study of individual and mass psychology as a factor of political life is alien to Marxism.”

মার্কসীয় চিন্তাবিদদের জবাবী অভিমত

রাজনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উপরিউক্ত যুক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী চিন্তাবিদদেরও কিছু বক্তব্য আছে। এই সমস্ত বক্তব্য সম্পর্কেও আলোচনা করা আবশ্যক। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে মার্কস-এঙ্গেলস কেবলমাত্র আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদের তত্ত্ব প্রচার করেছেন, এ কথা ঠিক নয়। আর্থনীতিক কাঠামোকে রাজনীতিক উপরি-কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিষয়ে এঙ্গেলস আলোচনা করেছেন। এঙ্গেলস-এর অভিমত অনুসারে তিনি নিজে অথবা মার্কস আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদকে কোথাও একমাত্র নির্ধারক হিসাবে প্রতিপন্ন করেন নি। বুরলাস্কি বলেছেন: “Engels wrote that, according to the materialistic understanding of history, in real life production and reproduction are the determining factor only in the final analysis.” বুরলাস্কির আরও অভিমত হল: “Engels set himself decisively apart from those sham Marxists who took economic relations as the exclusive determinant of social development and in so doing judged everything from the point of view of economic determinism.” আর্থনীতিক ও অন্যান্য উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মার্কস বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। মার্কসবাদী আলোচনায় আর্থনীতিক উপাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; কিন্তু অন্যান্য উপাদানের প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করা হয়নি। মার্কসবাদে রাজনীতিক সম্পর্ককে সামাজিক সম্পর্কের অংশ হিসাবে আলোচনা করা হয়েছে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা বিচ্ছিন্নভাবে রাজনীতিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করেননি। মার্কসবাদীরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে একটি সুসংহত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবসমাজের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মার্কসবাদের রাজনীতিক তত্ত্বের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

মার্কসীয় দর্শনের মানবিক মূল্যবোধের দিকটি তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপিকা ড. বেলা দত্তগুপ্ত তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “তাঁর (মার্কসের) পরিচয় ছিল ‘এক শোষণমুক্ত নতুন পৃথিবীর নতুন সমাজের স্বাপ্নিক’ হিসেবে। তিনি নতুন সমাজের অর্থাৎ শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি এই “ dehumanised world”, এই “political animal world”-এর আমূল পরিবর্তন করে সমাজের প্রকৃত সত্য, আসল রূপ উদ্ঘাটন করার চেষ্টায় তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অতিবাহিত করেছেন। …..তিনি চেয়েছিলেন dehumanised সমাজের বদলে এক ‘humane’ অর্থাৎ মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে ‘আপন, পরের, বাহির ঘরের সব ব্যবধান ঘুচে যাবে। মানুষই হবে স্বরাট, সম্রাট।”