মতাদর্শ কাকে বলে সে বিষয়ে কোন সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতি বিজ্ঞানের আলোচনায় মতাদর্শের মত অন্য কোন রাজনীতিক প্রত্যয়কে নিয়ে এত বেশি বিতর্কের সৃষ্টি বড় একটা হয়নি। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাক্লিলান (David McLellan) তাঁর Ideology শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Ideology to the most elusive concept in the whole of the social sciences.” মতাদর্শের অর্থ আলোচনার উদ্দেশ্যে কতকগুলি পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞা বা মতামতকে সন্নিবিষ্ট করতে দেখা যায়। তবে ‘মতাদর্শ’ এই প্রত্যয়টির উদ্ভবের ইতিহাস সুস্পষ্ট। সমাজবিজ্ঞানী ট্রাসি (A.D. Tracy) ফরাসী বিপ্লবের সময় ‘মতাদর্শ’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন। ১৭৯৬ সালে সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ট্রাসির অভিমত অনুযায়ী মতাদর্শ হল একটি বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান হল ‘ধারণাসমূহের বিজ্ঞান’ (science of ideas)। এই চিন্তাবিদ বিশ্বাস করতেন যে, ধারণাসমূহের উদ্ভবের বিষয়টি উন্মুক্ত করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এই কারণে তিনি দাবি করেন যে, ধারণাসমূহের বিজ্ঞান সুপ্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বিজ্ঞানের মতই মর্যাদার অধিকারী হবে। এই দাবির সমর্থনে বক্তব্য বিন্যস্ত করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন যে, যে কোন বিষয়ে যে কোন ধরনের অনুসন্ধান ধ্যান-ধারণার উপর ভিত্তিশীল। স্বভাবতই মতাদর্শকে বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে রানীর মর্যাদা প্রদান প্রয়োজন।
নির্দিষ্ট অর্থ নির্ধারণ কঠিন: ইংরেজি Ideology শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে ‘মতাদর্শ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এই মতাদর্শ শব্দটির প্রকৃত অর্থ ও ব্যঞ্জনা সম্পর্কে অল্পবিস্তর মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত অভিধানগুলিতেও এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ব্যা্যা বর্তমান। এই মতাদর্শ শব্দের সর্বজনগ্রাহ্য কোন নির্দিষ্ট অর্থ নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে এক ফরাসী মনীষী মতাদর্শ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন। ইনি হলেন ট্রাসি। ট্রাসি তাঁর Elements of Ideology শীর্ষক এক বিশাল রচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তারপর মতাদর্শ শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।
মতাদর্শ সম্পর্কিত কতকগুলি মতামত: সাধারণভাবে বলা যায় যে বিশেষ কোন আদর্শ বা ভাবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ধারণাগত কাঠামো হল মতাদর্শ। প্রচলিত রাজনীতিক কাঠামোকে সমর্থন করার জন্য বা পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে চিন্তা-ভাবনা করা হয়। তাই কাজকর্মের সঙ্গে মতাদর্শকে সংযুক্ত করা হয়। এই কারণে অনেকের মতে কাজকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত চিন্তা-ভাবনা হল মতাদর্শ। আবার অনেকের অভিমত অনুসারে মতাদর্শ হল এক গোঁড়া মত বা অন্ধ প্রত্যয় যা অপরিবর্তনশীল। আর একটি মত অনুসারে মতাদর্শ হল মানুষ, সমাজ ও বিশ্ব সংসার সংক্রান্ত মতামত, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত সুসংগঠিত চিন্তা-ভাবনা। এ প্রসঙ্গে দু-একজন চিন্তাবিদের অভিমত উল্লেখ করা আবশ্যক। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের আন্তর্জাতিক বিশ্বকোষে (International Encyclopaedia of the Social Science) মতাদর্শ (Ideology) সম্পর্কে শীলস্ (Edward Shills) বলেছেন: “…comprehensive patterns of cognitive and moral beliefs about man, society and the universe in relation to man and society….” Political Ideology শীর্ষক গ্রন্থে রবার্ট লেন (Robert Lane) এডরনো (T. W. Adorno)-র মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এডরনো-র অভিমত অনুসারে মতাদর্শ হল “….organisation of opinions, attitudes and values a way of thinking about man and society.”
অন্যান্য মতামত: অনেকের মতে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত রাজনীতিক চিন্তাভাবনার সুসংবদ্ধ রূপই হল রাজনীতিক মতাদর্শ। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত রাজনীতিক চিন্তাভাবনা একটি সুবিন্যস্ত কাঠামোর মধ্যে সুসংবদ্ধ রূপ ধারণ করলে রাজনীতিক মতাদর্শের সৃষ্টি হয়। আবার অনেকের মতানুসারে নির্দিষ্ট কোন রাজনীতিক ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থনসূচক মূল্যবোধ এবং আদর্শের সংরক্ষণমূলক রাজনীতিক তত্ত্বই হল রাজনীতিক মতাদর্শ। আর একটি মতানুসারে মতাদর্শ হল একটি সুসংবদ্ধ ভাবধারা। এই ভাবধারার মাধ্যমে ইতিহাস, প্রকৃতি ও সমাজে মানুষের অবস্থান সম্পর্কিত ধারণা ব্যক্ত হয়।
অন্যান্য সংজ্ঞা: অনেকে কার্যগত দিক থেকে মতাদর্শের অর্থ ব্যাখ্যার পক্ষপাতী। এ প্রসঙ্গে ফ্রেডরিশ ও ব্রেজিনস্কি (C. J. Friedrich and Z. K. Brzeniski)-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। Totalitarian Dictatorship and Autocracy শীর্ষক গ্রন্থে তাঁরা এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এঁদের মতানুসারে রাজনীতিক কার্যাবলীর সঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শ প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক মতাদর্শ মাত্রেই কোন বিশেষ রাজনীতিক সম্পর্ক বা কাঠামো সংরক্ষণ করা বা পরিবর্তন করার ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকে। আবার ম্যানহেইম (Mannheim) প্রমুখ অনেকে ব্যাপক অর্থে মতাদর্শ কথাটি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। তাঁদের মতানুসারে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগকে চিত্রিত করে এমন যাবতীয় ধারণা, মতবাদ বা তত্ত্ব হল মতাদর্শ। অনেকের মতে মতাদর্শ মাত্রেই সমাজের বিশেষ কোন একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। একটি সামাজিক গোষ্ঠীর মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিচারবোধের সঙ্গে মতাদর্শ জড়িত থাকে। আবার অনেকে বলেন যে, প্রত্যেক সামাজিক গোষ্ঠী হল কোন-না-কোনো মূল্যবোধের ধারক। এই মূল্যবোধকে বলে মতাদর্শ।
অ্যালান বলের অভিমত –বলের বক্তব্য: বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক মতাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা মাত্রেই কোন না-কোনো রাজনীতিক মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই মতাদর্শগত ভিত্তি দৃঢ় হতে পারে আবার দুর্বলও হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে কোন একটি রাজনীতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণার একটি সুসংহত রূপই হল রাজনীতিক মতাদর্শ। এ হল রাজনীতিক ভাবধারার এক সংহত কাঠামোগত প্রকাশ। রাজনীতিক ভাবধারাগুলির গ্রন্থিত ও বিন্যস্ত অভিব্যক্তিই হল রাজনীতিক মতাদর্শ। তিনি বলেছেন: “When these ideas form an articulate, coherent and systematic pattern, we speak of political ideologies.” রাজনীতিক সম্পর্কসমূহ রাজনীতিক মতাদর্শের মাধ্যমে গ্রন্থিবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত হয়।
ক্ষমতার বণ্টন: বল আরও বলেছেন যে, রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শ জড়িত থাকে। রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতি পর্যালোচনা এবং বণ্টন ব্যবস্থার যথার্থতা প্রমাণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক মতাদর্শের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “An ideologies are concerned with nature of distribution of power…. .” বল আরও বলেছেন: “…the most important function of an ideology…is to legitimise the political structures and the distribution of political power.” অর্থাৎ ক্ষমতার বণ্টন হল রাজনীতিক মতাদর্শের লক্ষ্য। একে নিছক রাজনীতিক দর্শন বলা যায় না।
নিছক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ নয়: বলের আরও অভিমত হল প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি সমর্থন বা সংশ্লিষ্ট সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে রাজনীতিক মতাদর্শের ইঙ্গিত থাকে। রাজনীতিক মতাদর্শের লক্ষ্য হল সমগ্র সমাজের পরিবর্তন সাধন এবং এই পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন। পর্যবেক্ষণ অনুধাবন এবং বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে রাজনীতিক মতাদর্শ সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনীতিক মতাদর্শ সুবিন্যস্ত ও গ্রন্থিত ধ্যান-ধারণা প্রচার করে। এবং তদনুসারে সমাজব্যবস্থাকে সংগঠিত করার লক্ষ্য মতাদর্শের মধ্যে বর্তমান থাকে। নিছক পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণ নয়, রাজনীতিক মতাদর্শ সক্রিয় কার্য পরিচালনার উপর জোর দেয়। বল বলেছেন : they are essentially normative arguments to espouse a programme of reform or reaction…. They demand action, not just observation and analysis.”
রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা: অ্যালান বলের মতানুসারে কোন কর্তৃত্বশালী মতাদর্শ যদি সমাজে থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট সমাজের রাজনীতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারণ সংশ্লিষ্ট প্রাধান্যকারী মতাদর্শের স্বীকৃত মূল্যবোধের একটি কাঠামো থাকে। এই কাঠামোর মধ্যে যাবতীয় বিরোধের মীমাংসা সহজেই সম্ভব হয়। বিপরীতক্রমে কর্তৃত্ব বা প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে যদি সমশক্তির একাধিক রাজনীতিক মতাদর্শ থাকে এবং তাদের মধ্যে মতাদর্শগত সংঘাত থাকে, তা হলে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক মতাদর্শ সমাজের সংহতি ও বিচ্ছিন্নতা উভয়ই আনয়ন করে। শক্তিশালী রাজনীতিক মতাদর্শের প্রভাবে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভেদ ও সংকীর্ণতার অবসান ঘটে এবং সমাজব্যবস্থা সুসংহত হয়। আবার রাজনীতিক মতাদর্শগত বিরোধ বিভেদ-বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে এ রকম বিরোধের ঘটনা সুবিদিত।
মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ অভিন্ন নয়: বলের মতানুসারে যে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিতরে ব্যক্তি মানুষের কাজকর্মকে মূল্যবোধের কাঠামো প্রভাবিত করে থাকে। তবে এসবের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শ বর্তমান থাকে। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত হল মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান-ধারণা প্রভৃতি গ্রস্থিত, সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত আকারে প্রকাশিত হলে তা রাজনীতিক মতাদর্শে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ বল বলেছেন যে মূল্যবোধ ও রাজনীতিক মতাদর্শ অভিন্ন নয়।
রবার্ট ডালের অভিমত: রবার্ট ডাল তাঁর Modern Analysis শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক মতাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি সরকারী বা কর্তৃত্বশালী মতাদর্শের (Official or reigning) কথা বলেছেন। এ ধরনের মতাদর্শের উদ্দেশ্য হল প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি সমর্থন সৃষ্টি এবং নেতৃত্বের বৈধতা প্রতিষ্ঠা। নৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি দিক থেকে এই মতাদর্শের মাধ্যমে সরকারী ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ডালের অভিমত অনুসারে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই রাষ্ট্রের কর্ণধার বা নেতাদের সুসংবদ্ধ কিছু তত্ত্বের আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখা যায়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও নেতৃত্বকে অনুকূলভাবে ব্যাখ্যা এবং প্রয়োজনীয় সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য মতাদর্শকে দরকারী মনে করা হয়। সংশ্লিষ্ট তত্ত্বের সমন্বিত রূপকে ডাল মতাদর্শ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডাল বলেছেন যে পদস্থ সরকারী কর্মচারী, সহযোগী ও সহকর্মীদের সঙ্গে নেতৃবৃন্দকে নির্দিষ্ট কোন রাজনীতিক মতাদর্শ প্রচার করতে দেখা যায়। এই মতাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্য হল সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক নেতাদের নেতৃত্বের বৈধতা প্রতিষ্ঠা। তা ছাড়া একটি নির্দিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে এই নেতাদের সংযোগ থাকে। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা সংরক্ষণ এবং অনুকূলে সমর্থন সৃষ্টিও এই মতাদর্শের লক্ষ্য।
রাজনীতিক বিষয়ে সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত ধারণা ও প্রত্যয়ের সৃষ্টি হলে রাজনীতিক মতাদর্শের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক মতাদর্শের সৃষ্টি কোন স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার নয়। তা ছাড়া রাজনীতিক মতাদর্শের স্বরূপ সামাজিক শক্তির বিন্যাসের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।
সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই ক্ষমতাসীন সরকার নিজের স্বার্থের অনুকূল রাজনীতিক মতাদর্শের বিকাশ ও বিস্তারের ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়। তেমনি আবার বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শের বিনাশের ব্যাপারে চেষ্টা চালায়। অর্থাৎ সব জায়গায় সকল রাজনীতিক মতাদর্শের স্বাধীন বিকাশ ও প্রকাশের সুযোগ থাকে না।
রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন (Rod Hague, Martin Harrop and Shaun Breslin) তাঁদের Comparative Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে মতাদর্শ সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী মতাদর্শ হল মানব সমাজ সম্পর্কিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রসঙ্গে জনসাধারণের এক ব্যবস্থা (“… a public system of beliefs and values about human society.”)। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী একেবারে ব্যক্তিগত বিশ্বাস-ব্যবস্থা মতাদর্শ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার শর্তাদি পূরণ করে না। মতাদর্শকে জনসাধারণ সম্পর্কিত হতে হবে; একজন বা দু’একজনের বিষয় হলে হবে না। মতাদর্শকে একটি ব্যবস্থা বলা হয়েছে। কারণ মতাদর্শ হল ধারণাসমূহের এক সুসংগঠিত সমষ্টি। মতাদর্শ হল সুসংবদ্ধ, স্পষ্টব্যক্ত ও সঠিক। মতাদর্শকে ‘বিশ্বাস’ ও ‘মূল্যবোধ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ মতাদর্শের মধ্যে আছে যা বাস্তব এবং যা হওয়া উচিত। হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন এ বিষয়ে বলেছেন: “An ideology is actionrelated providing both an analysis of existing society and an emotionally charged ideal to aim at.” আবার মতাদর্শ হল মানবসমাজ সম্পর্কিত। কারণ মতাদর্শের বিষয়বস্তু অন্তর্নিহিতভাবে সামাজিক ও রাজনীতিক। বাস্তবে মতাদর্শের মধ্যে আর একটি প্রবণতা বা বিষয় বর্তমান থাকে। এই বিষয়টি হল কতকগুলি মৌলিক মূল্যবোধ অনুযায়ী এই বিশ্বসংসারের পরিবর্তন সাধন। হেগ, হ্যারাপ ও ব্রেসলিন এ বিষয়ে বলেছেন: “In practice ideologies are identified by the intense desire of their adherents to transform the world in accordance with their key values.”
হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন মতাদর্শের উৎপত্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে মতাদর্শের প্রকৃতি প্রকাশিত হয়েছে। মতাদর্শের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই তিন রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী দুটি মতবাদের অবতারণা করেছেন। সংশ্লিষ্ট মতবাদ দুটি হল:
- (১) আকর্ষণ তত্ত্ব (Strain Theory) এবং
- (২) স্বাৰ্থ-তত্ত্ব (Interest Theory)।
(১) আকর্ষণ তত্ত্ব (Strain Theory): আকর্ষণ মতবাদ অনুযায়ী মতাদর্শ হল একটি প্রলক্ষণ এবং একটি প্রীতিকার। এই মতবাদ অনুযায়ী মানুষ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বিপ্লবের ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তারা মতাদর্শ সম্পর্কিত আকর্ষণ তত্ত্বের সমর্থক হিসাবে পরিচিত। এই মতবাদ অনুযায়ী সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় না থাকলে এই অভিব্যক্তি ঘটে মতাদর্শের মাধ্যমে। সুতরাং মতাদর্শ হল এই অসামঞ্জস্য বা ভারসাম্যহীনতার প্রলক্ষণ বা প্রকাশ। সমাজব্যবস্থায় বা সমাজের ক্রিয়াকর্মের ত্রুটিবিচ্যুতিরই লক্ষণ হল মতাদর্শ। সামাজিক অব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই মতাদর্শসমূহের উৎপত্তি হয়। এই বক্তব্যের উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের অন্তবর্তী সময়ে জার্মানী জুড়ে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক বেকারত্ব ও আর্থনীতিক অনিশ্চয়তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এ রকম এক সংকটকালীন সময়ে জার্মানীর মানুষজন এই দুর্বিষহ সমস্যার আশু ও সহজ-সরল সমাধানের ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে উঠে। এরকমই এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে জার্মানীতে ফ্যাসীবাদের আবির্ভাব ঘটে। সংকটকালীন পরিস্থিতিতেই মতাদর্শ নিয়ে মাতামাতি তুঙ্গে উঠে। পরবর্তী কালে ক্রমে সেই মতামাতি থিতিয়ে যায়। আকর্ষণ তত্ত্বে এই বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এবং মতবাদের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
(২) স্বাৰ্থ-তত্ত্ব (Interest Theory): স্বার্থ-অনুসারে মতাদর্শ হল একটি সুযোগ এবং একটি হাতিয়ার। এই মতবাদ অনুযায়ী মানুষ ক্ষমতার জন্য উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। একদল চিন্তাবিদ রাজনীতিকে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম হিসাবে দেখেন। সমাজের মধ্যে সমঝোতা বা ভারসাম্যের অনুসন্ধানকে রাজনীতি হিসাবে দেখেন না। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রাই স্বার্থ-তত্ত্বের সমর্থক হিসাবে পরিচিত। এই মতবাদের সুস্পষ্ট সমর্থক হিসাবে মার্কসবাদীদের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে মার্কসবাদী বাদেও এই তত্ত্বের অন্যান্য সমর্থক আছেন। এই মতবাদ অনুযায়ী মতাদর্শের সৃষ্টি রাজনীতির স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মের অন্তর্ভুক্ত। এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, মতাদর্শের কাজ হল স্বার্থসমূহকে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করা। স্বার্থ-তত্ত্ব আত্ম-স্বার্থের উপর এক উজ্জ্বল আবরণের সৃষ্টি করে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই মতবাদে দেখান হয় যে, কেন বিশেষ একটি সামাজিক গোষ্ঠীর স্বার্থসমূহের সংরক্ষণ ও পরিপোষণের জন্য সরকারের দিক থেকে বিশেষ উদ্যোগ আয়োজন আবশ্যক।
মার্কসাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রাধান্যকারী মতাদর্শ হিসাবে স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের মূল্যবোধকে ব্যবহার করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল মালিকদের দ্বারা অব্যাহত শ্রমিক শোষণকে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করা। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মতাদর্শ হল অনিবার্যভাবে বৈষম্যমূলক ও বিকৃত ব্যবস্থা। এই মতবাদের সব থেকে বড় একটি ইতিবাচক দিক আছে। এই মতবাদের সাহায্যে অধিকাংশ রাজনীতিক বিতর্ককে সহজেই অনুধাবন করা যায়। বলা হয় যে, স্বার্থসমূহের সংঘাতকে নীতিগত বিরোধ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়।
উপরিউক্ত দুটি মতবাদের কোনটিতেই মতাদর্শকে স্বাধীন একটি শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। আকর্ষণ তত্ত্ব ও স্বার্থ-তত্ত্ব উভয় তত্ত্বেই মতাদর্শকে সামাজিক কাঠামোর অঙ্গীভূত করা হয়েছে। বৃহত্তর সমাজব্যবস্থায় একটি মতাদর্শ প্রবর্তিত হলে, মতবাদটি নিজের থেকেই মাথা তোলে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন সমাজব্যবস্থায় সমানাধিকারের মতাদর্শ এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে মার্কসবাদের কথা বলা যায়। মতাদর্শমূলক বুদ্ধিজীবিরা কেবলমাত্র ধারণাসমূহের প্রায়োগিক বিষয়াদির ব্যাপারেই প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেন; তাঁরা আত্মস্বার্থ বা সামাজিক সংকটের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন না।
অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood): আধুনিককালের রাজনীতি বিজ্ঞানের এক বিশিষ্ট লেখক হলেন হেউড। তিনি তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক মতাদর্শ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বিভিন্ন রাজনীতিক ধারণা ও প্রত্যয়সমূহের মধ্যে ‘মতাদর্শ’ হল বিশেষভাবে বিতর্কিত। সামাজিক-বৈজ্ঞানিক অর্থে মতাদর্শ কথাটি বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। সংক্ষেপে মতাদর্শের সংজ্ঞা প্রদান সহজ নয়। এক্ষেত্রে মতাদর্শ সম্পর্কিত ধারণা সুস্পষ্ট হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর বিতর্কিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
অ্যান্ড্রু হেউড-এর অভিমত অনুযায়ী একটি মতাদর্শ হল মোটামুটিভাবে সুসংহত কতকগুলি ধারণা। এই ধারণাগুলি সুসংগঠিত রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মের ভিত্তি প্রস্তুত করে। এই রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মের উদ্দেশ্য হতে পারে ক্ষমতার বিদ্যমান ব্যবস্থার সংরক্ষণ, সংস্কার সাধন বা অপাসারণ। হেউড বলেছেন: “An ideology is a more or less coherent set of ideas that provides the basis for organized political action, whether this is intended to preserve, modify or overthrow the existing system of power.”
হেউডের অভিমত অনুযায়ী মতাদর্শের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বর্তমান।
-
(১) প্রত্যেক মতাদর্শই বিদ্যমান ব্যবস্থার একটি বিবরণ তুলে ধরে। সাধারণত একটি বিশ্ববিক্ষণ বা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে এই বিবরণ প্রতিপাদন করা হয়।
-
(২) সকল মতাদর্শেই অভিপ্রেত ভবিষ্যতের একটি মডেলের পরিচয় প্রদান করা হয়। এ হল সুন্দর সমাজের এক রূপরেখা।
-
(৩) প্রত্যেক মতাদর্শেই ব্যাখ্যা করা হয়, কীভাবে রাজনীতিক পরিবর্তন করা যায় বা করা উচিত। অর্থাৎ কীভাবে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বাঞ্ছিত অবস্থায় উপনীত হওয়া সম্ভব।
মতাদর্শ সম্পর্কিত উপরিউক্ত ধারণা সামাজিক বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মতাদর্শের উপরিউক্ত সংজ্ঞার পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হেউড মতাদর্শের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাতন্ত্র্য সম্পাদক বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মতাদর্শ দু’ধরনের সংশ্লেষণ বা সমন্বয় সম্পাদন করে। এই দু’ধরনের সংশ্লেষণ হল: অনুধাবন ও অঙ্গীকার (Understanding and commitment)–এর মধ্যে সংশ্লেষ এবং চিন্তা ও কার্য (thought and action) – এই দু’য়ের মধ্যে সংশ্লেষ। উপরিউক্ত সংজ্ঞার মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয় যে মতাদর্শ বিষয়টি জটিলতাপূর্ণ। এই জটিলতার কারণ আছে। রাজনীতিক মতবাদ ও রাজনীতিক প্রায়োগিক দিকের মধ্যে প্রচলিত সীমানাসমূহকে এবং বর্ণনামূলক ও নীতিমূলক চিন্তাধারার মধ্যে বিদ্যমান সীমানাসমূহকে মতাদর্শ স্বতন্ত্রভাবে সুস্পষ্ট করে।
অনুধাবন ও অঙ্গীকারের মধ্যে সংশ্লেষণ সম্পাদনের মাধ্যমে মতাদর্শ বিদ্যমান অবস্থা এবং বাঞ্ছিত অবস্থার মধ্যে পার্থক্যকে অনেকাংশে অস্পষ্ট করে তোলে। মতাদর্শসমূহ বর্ণনামূলক। এই সুবাদে মতাদর্শ ব্যক্তিবর্গ এবং গোষ্ঠীসমূহকে বৌদ্ধিক উপাদানসমূহ সরবরাহ করে। তদনুসারে মানুষজন তাদের সমাজের কার্যধারা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং বিশ্ব বিক্ষণের একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে। এ রকম বর্ণনামূলক অনুধাবন কতকগুলি নীতিমানমূলক ও নির্দেশমূলক বিশ্বাসমূহের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত থাকে। এই সমস্ত বিশ্বাসের মধ্যে থাকে বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ততার ধারণা এবং কোন বিকল্প বা ভবিষ্যৎ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা। হেউড বলেছেন: “Ideology … has a powerful emotional or affective character: it is a means of expressing hopes and fears, sympathies and hatreds, as well as of articulating beliefs and understanding.”
মতাদর্শ অনেক সময় অনিবার্যভাবে মূল্যবোধের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে; মূল্যবোধের সঙ্গে মতাদর্শের স্বাতন্ত্র অনেকাংশ অস্পষ্ট হয়ে যায়। মতাদর্শ ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট পার্থক্য প্রতিপাদন করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এ দিক থেকে বিচার করে মতাদর্শকে দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিপন্ন করার প্রবণতা দেখা দেয়। মতাদর্শ হল কতকগুলি নীতি, উপদেশাবলী ও মতবাদ। এগুলি বৌদ্ধিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার কাঠামো করণে সাহায্য করে। মতবাদ হল রাজনীতিক আলোচনার ভাষা। রাজনীতিক জ্ঞানের অনুসন্ধান কার্যে সহায়ক পরিকাঠামো গঠনে মতাদর্শ সাহায্য করে। মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির অনুধাবনের কাঠামো বিন্যস্ত হয় মতাদর্শের সাহায্য।
অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The notion of ideology as an intellectual framework or political language is also important because it highlights the depth at which ideology structures human understanding.”
রাজনীতিক দর্শন ও মতাদর্শ: একটি মৌলিক পর্যায়ে রাজনীতিক দর্শনের মতাদর্শের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এই পর্যায়ে রাজনীতিক দর্শনের মতই রাজনীতিক মতাদর্শ বিমূর্ত ধারণা ও মতবাদসমূহ নিয়েই চর্চা করে। অনেক সময় রাজনীতিক মতাদর্শের প্রস্তাবসমূহ নিরাবেগ অনুসন্ধান হিসাবে প্রতীয়মান হয়। সঠিক অর্থে মতাদর্শ ধারণামূলক এবং ক্রিয়ামূলক হওয়া আবশ্যক। এ রকম অবস্থায় কোন কোন মতাদর্শ একটি ক্ষেত্রে অত্যধিক শক্তিশালী হলেও, অন্য ক্ষেত্রটিতে ততটা শক্তিশালী নয়। হেউড উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। ফ্যাসীবাদ সব সময়ই প্রয়োগিক লক্ষ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্বভাবতই ফ্যাসীবাদকে ক্রিয়া সম্পর্কিত মতাদর্শ বলা যায়। বিপরীতক্রমে নৈরাজ্যবাদ এবং বিশেষত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে, বহুলাংশে দার্শনিক পর্যায়েই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে।
অল্পবিস্তর সাদৃশ্য সত্ত্বেও, রাজনীতিক দর্শনের সঙ্গে মতাদর্শের বৈসাদৃশ্যের দিকটিও উপেক্ষা করা যায় না। রাজনীতিক দর্শনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুসংহতি আছে, আছে সুস্পষ্ট একটি গড়ন। মতাদর্শের মধ্যে এসব অনুপস্থিত। মতাদর্শ অল্পবিস্তর একত্র আসঞ্জনশীল। রাজনীতিক দর্শনের মত মতাদর্শের তেমন সুস্পষ্ট কোন গঠন-গড়ন নেই। এর কারণ মতাদর্শ হল অঘনীভূত বা অনেকাংশে অনিশ্চিত প্রকৃতির কতিপয় ধারণা। একটি মতাদর্শের ধারণা অন্যান্য মতাদর্শকে অংশত আবৃত করে প্রসারিত হয় বা অধিক্রমণ করে। মতাদর্শসমূহ অনেক সময় একে অপরের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। কারণ মতাদর্শ সম্পূর্ণ রুদ্ধ বা সীল অবরূদ্ধ কোন চিন্তাধারা নয়। এ ধরনের স্বরূপের সুবাদে মতাদর্শগত বিকাশ ঘটে এবং বর্ণসঙ্কর বা সংমিশ্রিত মতাদর্শের সৃষ্টি হয়। এ রকম সংমিশ্রিত মতাদর্শের উদাহরণ হিসাবে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ, উদারনীতিক সংরক্ষণশীলতাবাদ, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ প্রভৃতির কথা বলা হয়।
রাজনীতিক দর্শনের সঙ্গে মতাদর্শের আরও পার্থক্য আছে। প্রত্যেক মতাদর্শের মধ্যে বিচিত্র বা বিভিন্ন ধরনের, এমনকি বিরোধী বিবিধ ঐতিহ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এমন কি একই মতাদর্শের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক বিরোধ-বিতর্ক দেখা যায়। এই বিরোধিতার তিক্ততা অনেক সময় তীব্রতর হয় বরং বিরোধী মতাদর্শের সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধ-বিতর্ক ততটা তীব্র বা তিক্ত না। অনেক সময় অভিন্ন রাজনীতিক শব্দ ব্যবহার বা প্রত্যক্ষ প্রয়োগ করে এই বিতর্ক চলতে থাকে। বিরোধ-বিতর্কের সামিল উভয়পক্ষই ‘গণতন্ত্র’, ‘ন্যায়’, ‘স্বাধীনতা’, ‘সাম্য’ প্রভৃতি প্রত্যয় প্রয়োগ করে বিতর্ক জারি রাখে। তারফলে রাজনীতিক মতাদর্শের আলোচনায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। মতাদর্শের আলোচনায় এ রকম বিরোধ-বিতর্ক বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে এবং অভিন্ন মতাদর্শের ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে হেউড মন্তব্য করেছেন: “Clearly however, there must be a limit to the incoherence or shapelessness of ideologies.” যাইহোক, সাধারণভাবে বলা যায় যে, প্রত্যেক মতাদর্শের মধ্যে বেশকিছু কেন্দ্রগত বা মৌলিক, সন্নিহিত ও প্রান্তবর্তী ধারণা থাকে। সংশ্লিষ্ট মতাদর্শের অঙ্গীভূত নীতিসমূহের মধ্যে বা মতবাদের মধ্যে এগুলি সবই উপস্থিত নাও থাকতে পারে।
প্রকৃত প্রস্তাবে মতাদর্শসমূহেকে বিচার করার সত্যতা যাচাই করার জন্য সত্যতার কোন বস্তুগত মানদণ্ড পাওয়া যায় না। তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, মতাদর্শের মধ্যে বিবিধ মূল্যবোধ থাকে, থাকে কল্পনাবিলাস এবং আশা ও অনুপ্রেরণা। এগুলি নিজেদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপযোগী নয়। সুতরাং মতাদর্শকে এক কথায় সত্য বা মিথ্যা বলে চিহ্নিত করা যায় না। হেউড মন্তব্য করেছেন: “Ideologies are embraced less because they stand up to scrutiny and logical analysis and more because they help individuals, groups and societies to make sense of the world in which they live.”
বিভিন্ন দিক থেকে মতাদর্শের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মতাদর্শ প্রচলিত ক্ষমতা-কাঠামোকে তুলে ধরে। এই উদ্দেশ্যে মতাদর্শ বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামোকে স্বাভাবিক, সঠিক, ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিপন্ন করে। আবার সমকালীন ক্ষমতা-কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানায় বা দুর্বলও করে। এই লক্ষ্যে মতাদর্শ বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর অন্যায়-অবিচারকে বড় করে দেখায় এবং বিকল্প শক্তি-কাঠামোর আকর্ষণীয় দিকগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মতাদর্শসমূহ সামাজিক দুনিয়ার এক বৌদ্ধিক মানচিত্র সরবরাহ করে। মতাদর্শসমূহ ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে ক্ষমতার বৃহত্তর কাঠামোর সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করে।
বিশ্বসংসারে বহু ও বিভিন্ন সত্য, মূল্যবোধ ও মতবাদ বর্তমান। এগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আছে। মতাদর্শসমূহ কিছু মূল্যবোধকে অন্যান্যদের উপরে অগ্রাধিকার দেয়, তাছাড়া বিশেষ কিছু মতবাদের উপর বৈধতা আরোপ করে। সত্যকে অনাবৃত করার ব্যাপারে মতাদর্শসমূহের দাবিকে অস্বীকার করা যায় না। এই কারণে অনেকে মতাদর্শকে ‘সত্যের শাসন’ (regumes of truth) হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। আবার সত্যের শাসন হিসাবে মতাদর্শ সবসময় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মতাদর্শ রাজনীতিক আলোচনার ভাষা সরবরাহ করে; সমাজ কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে সমাজের কাজ করা উচিত সে বিষয়ে কিছু ধারণা ও আগাম অনুধাবন প্রদান করে। এইভাবে মতাদর্শ ব্যক্তিবর্গের চিন্তাধারা ও কার্যধারার কাঠামো নির্ধারণে সাহায্য করে।
Leave a comment