‘মতাদর্শের অবসান’ তত্ত্বের প্রবক্তা: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক মতাদর্শের অবক্ষয় বা অবসানের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি বিতর্কিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি অংশ মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত এই তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। অত্যাধুনিক এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে বর্তমানে রাজনীতিক জীবনে মতাদর্শের গুরুত্ব অপসৃত। বিশেষত সাম্প্রতিককালের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে রাজনীতিক মতাদর্শের অভাবনীয় অবক্ষয় ঘটেছে। রাজনীতিক মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত তত্ত্বের প্রবক্তাদের একটি বিশেষ রাজনীতিক পরিচয় আছে। এঁরা সকলেই হলেন উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক মূল্যবোধের পরিপোষক। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন ড্যানিয়েল বেল (Daniel Bell), জন কেনেথ গলব্রেথ (J. K. Galbraith), এফ্ ওয়াটকিনস্ (F. Watkins), সিম্যুর মার্টিন লিপসেট (S. M. Lipset), এডওয়ার্ড শিলস্ (Edward Shils) প্রমুখ।
বিভিন্ন মতামত: ড্যানিয়েল বেল তাঁর The End of Ideology: On the Exhaustion of Political Ideas in the Fifties শীর্ষক গ্রন্থে মতাদর্শের অবসান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে আগেকার দিনে মতাদর্শের প্রভাব যেমন ছিল, সাম্প্রতিককালে তার অবসান ঘটেছে। অতীতে মতাদর্শ ছিল যাবতীয় কাজকর্মের ভিত্তি। এখন রাজনীতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব একেবারে হারিয়ে যাওয়ার পথে। বেল এর কতকগুলি কারণও উল্লেখ করেছেন। গলব্রেথ তাঁর The New Industrial State গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে বর্তমান আর্থনীতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রযুক্তিবিদ্যা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা। মতাদর্শগত ধ্যান-ধারণার প্রভাব এখন আর নেই। মতাদর্শগত প্রভাব প্রতিপত্তির আমল অতিক্রান্ত। মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত ওয়াটকিনস্-এর গ্রন্থটির নাম হল The Age of Ideology তাঁর মতানুসারে অবক্ষয় শুরু হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে। এ প্রসঙ্গে ওয়াট্কিস বিভিন্ন কারণের উল্লেখ করেছেন। লিপসেটের অভিমত ব্যক্ত হয় তাঁর The Political Man শীর্ষক গ্রন্থে। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক মতাদর্শের অতীতের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন অস্তমিত।
মতাদর্শের অবক্ষয়ের কারণসমূহ
মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত তত্ত্বের প্রবক্তারা এর বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বিশেষত ডানিয়েল বেল এবং ওয়াট্কিস বহু ও বিভিন্ন কারণ ও পরিস্থিতির কথা বলেছেন। সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মতাদর্শের অবক্ষয় বা অবসানের পিছনে নিম্নলিখিত কারণসমূহের কথা বলা যায়।
(১) আর্থনীতিক ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস: অনেকের মতে সমাজতন্ত্র তার স্বাভাবিক আকর্ষণ হারিয়েছে এবং উদারনীতিক মতবাদ মৃতপ্রায়। অতীতে অর্থনীতি ও সুযোগ-সুবিধাগত বৈষম্য ছিল ব্যাপক। এই বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক মতাদর্শগত বিরোধ-বিতর্কও প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু কালক্রমে উপরিউক্ত বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব হয়। তার ফলে মতাদর্শগত বিরোধ-বিতর্কও হ্রাস পায়। বর্তমানে বামপন্থী ও অ-বামপন্থী নির্বিশেষে সকলেই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর প্রকৃত পরিধি প্রসঙ্গে চিন্তাবিদদের মধ্যে মতাদর্শগত তীব্র অনৈক্যের অবসান ঘটেছে। আগেকার শ্রেণী-বৈষম্য এখন আর নেই। এই কারণে শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত তত্ত্ব তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছে। শিল্প বিপ্লব ইউরোপে একাধিক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। সেই সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। আর্থনীতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মালিক-শ্রেণী বহুলাংশে মেনে নিয়েছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কিত মতাদর্শগত টানাপোড়েনের অবসান ঘটেছে।
(২) ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তা চেতনার ব্যাপক পরিবর্তন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিক ব্যবস্থা ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে এক ধরনের চিন্তাধারার প্রাধান্য ছিল। বিংশ শতাব্দীতে তার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। কালক্রমে বাস্তববাদী এবং যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণা গুরুত্ব লাভ করে। আর্থ-সামাজিক ও দার্শনিক ক্ষেত্রে চিন্তাধারার বাস্তবমুখী পরিবর্তন সূচিত হয়। আগে পুঁজিবাদ-বিরোধী মতাদর্শের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ইতিমধ্যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধিত হয়েছে। অতীতের নির্মম-নিষ্ঠুর শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রে বেশ কিছু মানবিক উপাদান সংযুক্ত হয়েছে। তীব্র শোষণ বঞ্চনার উগ্রতা এখনকার পুঁজিবাদে অনুপস্থিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এখনকার একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আকারে প্রকারে পৃথক প্রকৃতির। পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রাদর্শের ধারণা যুক্ত হয়েছে। এই সবের সামগ্রিক ফল হিসাবে পুঁজিবাদ-বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শ হীনবল হয়ে পড়েছে এবং অবক্ষয়ের মুখে পড়েছে।
(৩) চিন্তাবিদদের দায়িত্ব: রাজনীতিক মতাদর্শের অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে চিন্তাবিদদের দায়িত্বও কম নয়। এ প্রসঙ্গে ডানিয়েল বেল-এর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদদের পাণ্ডিত্য ও নিষ্ঠা ছিল বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বিষয়বস্তুর বিচক্ষণ বিচার-বিশ্লেষণ রাজনীতিক মতাদর্শকে বিশেষভাবে অর্থবহ ও সজীব করে তোলে। এ ধরনের সজীব মতাদর্শ মানুষের সমকালীন চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে এবং মানুষকেও প্রভাবিত করে। এ রকম মতাদর্শ মানুষের মনে সাড়া জাগায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। মতাদর্শের এই প্রাধান্যমূলক ভূমিকা বর্তমানে অনুপস্থিত। বিংশ শতাব্দীতেই মতাদর্শের এই অবক্ষয় প্রকট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালের বুদ্ধিজীবীরা সংকীর্ণ রাজনীতিক আঙিনায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির নিরপেক্ষতা এখন আর নেই। তার ফলে মতাদর্শের সজীবতা ও সার্বজনীনতা হ্রাস পেয়েছে। আগের মত মতাদর্শ মানুষের মনে প্রেরণা বা ক্রিয়াশীলতার সৃষ্টি করে না। অর্থাৎ মতাদর্শের মূল্য কমে গেছে।
(৪) জড়বাদী চিন্তা-চেতনার প্রাধান্য: বিংশ শতাব্দীতে মতাদর্শের অবমূল্যায়নের আরও একটি কারণের কথা বলা হয়। সাম্প্রতিককালের মানুষ অতিমাত্রায় জড়বাদী চিন্তা-চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মতাদর্শের মধ্যে শাশ্বত ও আদর্শগত কিছু সারবস্তু বর্তমান ছিল। এই সমস্ত আদর্শের মধ্যে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান শতাব্দীতে এই সমস্ত আদর্শ ও মূল্যবোধ বহুলাংশে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এখনকার মতাদর্শের প্রাণকেন্দ্র হল জড়বাদী বিষয়। শাশ্বত মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য মতাদর্শের সাবেকী তাৎপর্য আর নেই।
(৫) ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রভাব: বিংশ শতাব্দীতে মতাদর্শ বন্ধ্যা বা স্থবির হয়ে পড়েছে। মতাদর্শের এই অবস্থার পিছনে ইতিহাসের কিছু ঘটনার প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরের এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণার বিস্তার, যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা, অমানবিক গণহত্যা, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক মন্দা প্রভৃতি। বিশ্ব ইতিহাসের এই পর্বের টালমাটাল অবস্থা মানবজাতির চিন্তা-চেতনাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। চিন্তাবিদদের মননের সজীবতা ঊষর হয়ে গেছে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা ব্যাপক পরিবর্তনের মুখে পড়েছে। এই সমস্ত কিছুর সামগ্রিক ফলশ্রুতি হিসাবে মতাদর্শের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে।
(৬) রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব: সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রের কর্ণধার ও রাজনীতিবিদ্গণের দ্বারা মতাদর্শ প্রভাবিত হচ্ছে। আগে দার্শনিক ও মনীষীগণ মতাদর্শের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। তার ফলে তখন মতাদর্শের মধ্যে একটা দার্শনিক চেতনা ও সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা নিহিত থাকত। এখন আর তা থাকে না। মতাদর্শের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বর্তমানে রাজনীতিবিদ্রাই কর্তৃত্ব করে থাকেন। তার ফলে মতাদর্শের মধ্যে দার্শনিক চেতনা বা মূল্যবোধ এখন আর দেখা যায় না। মতাদর্শ এখন অবমূল্যায়নের এক গভীর আবর্তে পড়েছে।
(৭) আধুনিক মতাদর্শের বহুকেন্দ্রিকতা: ড্যানিয়েল বেল মতাদর্শের অবক্ষয়ের একটি বিশেষ কারণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে বর্তমানে মতাদর্শ বহুকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে সংঘবদ্ধতা বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বর্তমানে মতাদর্শগত সকল বিষয়কেই বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেবল মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে নিয়ে দুনিয়া জুড়ে কত রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে তার ইয়ত্তা নেই। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতিটি মতাদর্শের বিরুদ্ধে নানা চিন্তা-ভাবনা ব্যক্ত হচ্ছে। এর ফলে আধুনিক কোন মতবাদই তেমন স্থায়ী ও সুসংহত রূপ লাভ করতে পারছে না। অথচ ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুসংহত বহু ও বিভিন্ন মতাদর্শ বর্তমান ছিল।
(৮) মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয় না: মতাদর্শের গুরুত্ব ও প্রভাব হ্রাসের বিষয়টি আর এক দিক থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। মেহনতী মানুষ আগে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য মরণপণ সংগ্রামের সামিল হত। এখন কিন্তু তা আর হয় না। মতাদর্শের জন্য শ্রমিক সাধারণকে আর সংগ্রাম করতে দেখা যায় না। এখন তাদের যাবতীয় দাবি-দাওয়া আর্থনীতিক। বেতন, পদোন্নতি, পেনশন এবং চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং আর্থনীতিক দাবি-দাওয়ার মীমাংসা হয়ে গেলেই আন্দোলনের অবসান ঘটে। মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন আর হয় না।
(৯) মতাদর্শগত পার্থক্যের তীব্রতা হ্রাস: অতীতে রক্ষণশীল মতাদর্শ এবং প্রগতিশীল মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য ছিল প্রকট। মতাদর্শগত পার্থক্যের এই তীব্রতা এখন অনেকাংশে অস্তমিত। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা এখন অল্পবিস্তর সকলেই গ্রহণ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রগতিশীল মতাদর্শের প্রবক্তারাই প্রথমে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের উপর জোর দেন। তারপর এই তত্ত্ব ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রক্ষণশীল মতাদর্শের প্রবক্তারাও কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাকে গ্রহণ করেন। বর্তমানে মার্কসবাদী ও পুঁজিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য অপসৃয়মান। গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক দল বর্তমানে প্রগতিশীল মতাদর্শ থেকে বহুলাংশে বিচ্যুত। একই কথা জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এখন অধিকাংশ দেশেই মিশ্র অর্থনীতি (Mixed Economy) গ্রহণের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। এই পদ্ধতিতে বহু দেশেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশ এমনকি সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও কৌশলগত পরিবর্তনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
(১০) মতাদর্শগত সমধর্মিতা: সাম্প্রতিককালের দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মতানুসারে বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি ও বিকাশ ঘটেছে এবং তারফলে মানবসভ্যতার ইতিহাসে শিল্প-সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। এই শিল্প-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পরস্পর বিরোধিতার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে এবং এই দুই রাজনীতিক ব্যবস্থা পরস্পরের কাছাকাছি আসছে। পুঁজিবাদী মতাদর্শের মধ্যে আগেকার অবাধ শাসন-শোষণ এখন আর নেই। পুঁজিবাদের পরবর্তী ভূমিকা এখন পরিবর্তিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শগত ও উদ্দেশ্যগত আপসহীনতা বর্তমানে অপসৃত। তার ফলে মানবসমাজের মধ্যে অভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রকৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ সাবেকী দুই পরস্পর-বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে সমধর্মিতার সৃষ্টি হয়েছে। পরস্পর-বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে এই সমধর্মিতা হল আসলে মতাদর্শের অবসানের আগাম বার্তা।
সমালোচনা (Criticism): রাজনীতিক মতাদর্শের অবক্ষয় বা অবসান সম্পর্কিত তত্ত্বটি বিশেষভাবে বিতর্কিত। মূলত পশ্চিমী উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত ধারণার প্রচারক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এই ধারণা তীব্র বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকদের অভিমত অনুসারে এ হল মতাদর্শ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর অবস্থা সৃষ্টির এক অপচেষ্টা। যাইহোক সংশ্লিষ্ট ধারণার বিরুদ্ধে সমালোচকদের যুক্তিগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যায়।
(ক) অ্যালান বলের অভিমত: রাজনীতিক মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত মতবাদের সমালোচকদের মধ্যে অ্যালান বল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বল বলেছেন যে আজকাল মতাদর্শগত একটি অবস্থান থেকে মতাদর্শগত অন্য একটি অবস্থানে গমনের ঘটনা ঘটছে। পশ্চিমী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতাদর্শগত অবস্থার পরিবর্তনের এমন ঘটনা এখন প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু একে মতাদর্শের অবসান বলা চলে না। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত। অ্যালান বল আরও বলেছেন যে সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক ক্ষেত্রে মতাদর্শগত ভিত্তি ও মূল্যবোধের ব্যাপারে ব্যাপক সমধর্মিতা পরিলক্ষিত হয়। এতদসত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয় যে, মতাদর্শের অবসান ঘটেছে। বলের মতানুসারে প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট একটি মতাদর্শের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও একটি মতাদর্শগত ভিত্তি আছে। তবে এই ভিত্তি সুস্পষ্ট হতে পারে বা অস্পষ্ট হতে পারে।
(খ) রাজনীতিক সমঝোতা মানে মতাদর্শের অবসান নয়: অনেকের মতানুসারে আজকাল বিভিন্ন রাজনীতিক দলের মধ্যে ব্যাপক মতৈক্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং বর্তমানে মতাদর্শের অবসান হয়েছে। সমালোচকদের মতে এই ধারণাও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্জাত। কারণ বিভিন্ন শ্রেণী ও দলের মধ্যে নানা বিষয়ে বোঝাপড়া থাকতে পারে এবং থাকেও। এতদ্সত্ত্বেও দেশে বিভিন্ন রাজনীতিক দল, গোষ্ঠী, সংঘ প্রভৃতি থাকে। এদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শগত পার্থক্যও থাকে। এর থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় মতাদর্শের অস্তিত্ব আছে এবং এর অবসান সম্ভব। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যাপক মতৈক্যের কথা বলা হয়। এখানে পরস্পর সংঘবদ্ধ রাজনীতিক ধ্যান-ধারণার অস্তিত্ব বর্তমান। এর অর্থ এই নয় যে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতাদর্শ নেই। প্রসঙ্গত গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা হল দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ। এখানকার প্রধান দু’টি রাজনীতিক দল হল রক্ষণশীল দল এবং শ্রমিক দল। এই দু’টি রাজনীতিক দলের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে ব্যাপক মতৈক্য বর্তমান। এতদ্সত্ত্বেও ব্রিটেনে এই দু’টি রাজনীতিক দলের পৃথক অস্তিত্ব আছে। কারণ কতকগুলি ক্ষেত্রে ঐকমত্য সত্ত্বেও অন্য কতকগুলি ক্ষেত্রে এদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। এবং এই মতপার্থক্যও গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর থেকেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ব্রিটেনের রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য আছে। বস্তুত রাজনীতিক মতাদর্শ ব্যতিরেকে কোন রাজনীতিক অবস্থার অস্তিত্ব অসম্ভব। সবল হোক বা দুর্বল হোক প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ থাকবে। অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থামাত্রেই মতাদর্শভিত্তিক হতে বাধ্য।
(গ) মতপার্থক্য মানে মতাদর্শের অবসান নয়: রাজনীতিক মতাদর্শের অর্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি বা মতানৈক্য থাকতে পারে। এবং বাস্তবে এ রকম মতপার্থক্য আছেও। কিন্তু এই মতপার্থক্য মতাদর্শের অবসানের সূচক নয়। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থা বর্তমান। কিন্তু এই সমস্ত দেশের উদারনীতিক ব্যবস্থা সমজাতীয় নয়। উদারনীতিবাদের অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এই সমস্ত দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে উদারনীতিবাদের অবসান ঘটেছে। আবার মার্কসবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে দুনিয়া জুড়ে মতবিরোধের শেষ নেই। এতদসত্ত্বেও এ কথা বলা যায় না যে মার্কসবাদ মৃত।
(ঘ) মার্কসবাদীদের সমালোচনা: মতাদর্শ সম্পর্কে মার্কসবাদীদের মতামত ভিন্ন প্রকৃতির। মার্কসবাদ অনুসারে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী থাকলে, বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থ থাকবে। বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থের অস্তিত্বের জন্য শ্ৰেণী-সংঘাত আটকানো যাবে না। এই অবস্থায় অনিবার্যভাবে এক-একটি শ্রেণী স্বার্থকে কেন্দ্র করে এক একটি মতাদর্শের আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটবে। বস্তুত প্রতিটি শ্রেণী তার ও পৃথক শ্রেণীস্বার্থের ভিত্তিতে এক একটি মতাদর্শের সৃষ্টি হয়। সুতরাং মতাদর্শ হল শ্রেণীকেন্দ্রিক বিষয়। এবং শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজে মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত ধারণা অলীক প্রতিপন্ন হয়। মার্কসবাদী সমালোচকদের অভিমত অনুসারে মতাদর্শের অবসানের বিষয়টি হল আসলে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের হাতে একটি হাতিয়ার বিশেষ। এ হাতিয়ার হল বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের সৃষ্টি এবং মার্কসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যই একে সৃষ্টি করা হয়েছে।
(ঙ) উগ্র মতবাদের অবসান ঘটেছে: সমালোচকরা স্বীকার করেন যে কিছু উগ্র বা জঙ্গী মতাদর্শের অবসান ঘটেছে বা ঘটছে। আবার কোন মতবাদের কেবল জঙ্গী অংশটুকুর অবসান ঘটেছে। কিন্তু যে সমস্ত মতাদর্শ পারস্পরিক সমঝোতা ও কার্যকর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ক্রিয়াশীল সেই সমস্ত মতাদর্শের অবসান ঘটে নি বা ঘটতে পারে না। কারণ সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থার বিকাশের স্বার্থে এই সমস্ত মতাদর্শের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। মানবসভ্যতার সুস্থ অস্তিত্বের স্বার্থে মতাদর্শের অস্তিত্ব অপরিহার্য।
উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে মতাদর্শের অবসান সম্পর্কিত ধারণাকে মেনে নেওয়া যায় না। এই ধারণার মাধ্যমে প্রকৃত পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রচেষ্টা বিভ্রান্তিমূলক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্তমানে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সকল দেশের উদারনীতিবাদ অভিন্ন প্রকৃতির নয়। উদারনীতিবাদের অর্থ ব্যাখ্যা ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক মতানৈক্য আছে। এ ক্ষেত্রে মতানৈক্যের এই ব্যাপকতা মতাদর্শের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে প্রতিপন্ন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শের কার্যকর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ, উদারনীতিবাদ, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি মতাদর্শের গুরুত্বের কথা অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হলে রাজনীতিক মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। অন্যথায় তা অসম্ভব।
Leave a comment