বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে রাজনীতিক মতাদর্শের কথাও বলা হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের অভিব্যক্তি ঘটে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় রাজনীতিক মতাদর্শের উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিবাদের রূপান্তরের কথা বলা হয়। তা ছাড়া রাজনীতিক বিশ্বায়নের অভিব্যক্তি হিসাবে বেসরকারী সংগঠনসমূহের (NGO’s) উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার; জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকাগত পরিবর্তন প্রভৃতির কথা বলা হয়।
রাজনীতিক বিশ্বায়নের অভিব্যক্তি ঘটেছে আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের মধ্যে। এই সমস্ত সংগঠনের কার্যকলাপ জাতির সীমারেখাকে ছাড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংগঠনের এক্তিয়ার একক রাষ্ট্রের সীমারেখাকে অতিক্রম করে বহু রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত। বর্তমান বিশ্বে বহু ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বর্তমান। এগুলির অধিকাংশই গঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO), ইউরোপীয়ান ইকনমিক কমিউনিটি (EEC), বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের সংগঠন (OECD), ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেসন (WTO), ন্যাটো (NATO) প্রভৃতি। তত্ত্বগত বিচারে জাতি-রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের সার্বভৌমিকতাকে বিসর্জন না দিয়েও আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের মাধ্যমে সুসংহত ও সংগঠিতভাবে কোন বিষয়ে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে পারে। জাতি-রাষ্ট্রের সীমাতিক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ জাতি রাষ্ট্রসমূহের উপর তাদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে পারে।
আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় অ-রাষ্ট্রীয় ও বাজার-ভিত্তিক ক্রিয়াকারীদের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রাজনীতিক বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে আন্তরাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের উপর জোর দেওয়া হয়। স্বভাবতই রাজনীতিক বিশ্বায়ন আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন থেকে স্বতন্ত্র থাকে। রাজনীতিক বিশ্বায়নের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি আদর্শবাদী অঙ্গীকার বর্তমান। তা ছাড়া এর মধ্যে এক ধরনের বিশ্ব-সরকারের ধারণার অস্তিত্বও অস্বীকার করা যায় না। বিশ্ব-রাষ্ট্রের বিষয়টি এখনও অতি দূরবর্তী একটি ধারণাগত বিষয় মাত্র। নিকট ভবিষ্যতে এর বাস্তবায়নের আশা অলীক। তবে বিশ্ব নাগরিক সমাজের ধারণাগত বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। আন্তর্জাতিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ, বেসরকারী সংগঠনসমূহ (NGOs), আন্তর্জাতিক করপোরেশনসমূহ প্রভৃতির মাধ্যমে বিশ্ব নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এদিক থেকে বিচার করলে আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ধারণার থেকে রাজনীতিক বিশ্বায়নের ধারণা পশ্চাদ্বর্তী।
রাজনীতিক বিশ্বায়ন বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরে বিরূপ ভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের ঘটনা। রাষ্ট্র সব সময়ই মানবসভ্যতার সঙ্গী নয়। রাষ্ট্র ছাড়াই মানুষের সমাজব্যবস্থা আবর্তিত হয়েছে অনেক কাল ধরে। বিগত কিছু শতাব্দী আগে নতুন এক ধরনের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। নিজস্ব বিশিষ্টতার সুবাদে পূর্ববর্তী অন্য সকল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানকে অপসারিত করে, রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার জায়গা করে নিয়েছে। রাষ্ট্র সব সময় ছিল না; এক সময় আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং এমন ভাবনা একেবারে অমূলক হবে না যে, ভবিষ্যতে কোন এক সময় কর্তৃত্বমূলক রাজনীতিক ক্রিয়াকারী হিসাবে রাষ্ট্র তার প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশে হারিয়ে ফেলবে। এমন কথাও সম্পূর্ণরূপে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এক সময় পৃথিবীর বুকে রাষ্ট্র আর থাকবে না। রাষ্ট্রের এই না থাকাটা হবে এক যুগান্তরকারী রাজনীতিক পরিবর্তন। এক শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া এই নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
রাজনীতিক বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সংকীর্ণ করে তুলতে পারে এবং অধিকতর শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বলপ্রয়োগের বিষয়টি রাষ্ট্রের একচেটিয়া। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাটি বহুলাংশে তার কার্যকারিতা হারাতে পারে। কারণ আধুনিককালে মানুষজন এমন অনেক সমস্যাদির সম্মুখীন হয়, যা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র সমাধান করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পরিবেশ দুষণ, মাদকাশক্তি, প্রযুক্তিগত প্রকৌশলসমূহের আবিষ্কার, বাণিজ্যিক শক্তির বিকাশ প্রভৃতি। মহাকাশে ওজন স্তরে ছিদ্র হওয়ার কারণে সম্ভাব্য সংকটের আশঙ্কার মোকাবিলা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম শক্তির মাধ্যমে সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মার্কিন নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে কোন সার্বভৌম রাষ্ট্র এককভাবে সাবেকি অর্থে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না। বিশ্বায়িত রাষ্ট্রসমূহের কাছে যুদ্ধ বিদ্যমানতার সহায়ক নয়। এই সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধ কোন কার্যকর উপায় নয়; আন্তর্জাতিক সংযোগ-সম্পর্ক সংরক্ষণের সহায়ক নয়। স্বভাবতই রাজনীতিক বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে বিভিন্ন ক্রিয়াকারীর মধ্যে বিকীর্ণ করে। তার ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষিয়মান হয় রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য্য ও সামর্থ্য সীমায়িত হয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিংসাত্মক সংঘাত হ্রাস পায়।
রাজনীতিক বিশ্বায়নের সুবাদে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিবিধ ভূমিকা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কাঁধে তুলে নেয়। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে বাঁধা পড়ে যায়। বহুবিধ বিষয়ের বিস্তৃত এলাকায় রাজনীতি ও নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে, মান স্থির করে এবং নিয়মকানুন কার্যকর করে বিভিন্ন সংগঠন। এদের মধ্যে সরকারি-বে-সরকারি, আভস্তরীণ আন্তর্জাতিক প্রভৃতি নানা রকম সংগঠন বর্তমান। এ রকম পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বভাবতই হ্রাস পায়। আইনের অনুশাসন তখন স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনীতিক বিশ্বায়নের ফলশ্রুতি হিসাবে আইনের অনুশাসন বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিণত হয়। বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকারীর জন্য এ সবের সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকারীরাই এগুলিকে কার্যকর করে।
বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া এবং বিশ্বায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা সংরক্ষণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার প্রতিকূলতার পরিণামে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্র অনেকাংশে পরিকল্পিতভাবে নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্ব আন্তঃসরকারী সংগঠনসমূহের (IGOS Intergovernmental Organizations) হাতে ন্যস্ত করতে পারে। এ রকম আন্তঃসরকারী সংগঠনের উদাহরণ হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union)-এর কথা বলা যায়। সাধারণত কিছু সুবিধা আদায়ের জন্য বা বিদ্যমান কিছু সমস্যার অপনোদনের জন্য রাষ্ট্র তার সার্বভৌম কর্তৃত্বকে কতকাংশে পরিহার করতে পিছপা হয় না। তবে রূঢ় স্বার্থচিন্তার তাড়নায় রাষ্ট্র অনিচ্ছাসহকারে সচেতনভাবে তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতাকে কতকাংশে হাতছাড়া করে। আবার অন্য কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অসচেতনভাবে তার সার্বভৌম কর্তৃত্ব হারায়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা হয় যে, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থার বিকাশ ও ব্যাপক বিস্তারের কারণে বিভিন্ন সাবেকি ক্ষেত্রসমূহ রাষ্ট্রের আইনী কর্তৃত্বের উপর প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারণ ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা ও নিয়মকানুনকে স্বীকার বা মান্য করে না। আধুনিককালে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে অতি উন্নত প্রযুক্তি-প্রকৌশলের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তামূলক বিধিনিষেধ, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি অনায়াসে উপেক্ষা করা হয়। এমন কথাও বলা হয় যে, নিকট ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিন মুদ্রাব্যবস্থা কায়েম হবে। তারফলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে পড়বে। টাকা ছাপানো, কর আদায়, আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার এই সমস্ত তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে বৈদ্যুতিন মুদ্রা ব্যবস্থা থাবা বসাবে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া রাষ্ট্রীয় রাজনীতির উপর থেকে অস্পষ্টতা অস্বচ্ছতার আবরণকে অপসারিত করে এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সতর্ক সমীক্ষার কাছে উন্মুক্ত করে। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে অধুনা সংযোগ-সম্পর্ক বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের কার্যকলাপের উপর বিভিন্ন সংগঠনের নজরদারি আটকানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষে লুকিয়ে কিছু করা এখন এক রকম অসম্ভব। বেসরকারি সংগঠনসমূহ (NGOs Non Governmental Organisations): যেমন রেডক্রস (Red Cross), গ্রীনপিস (Greenpeace) প্রভৃতি এবং আন্তঃসরকারী সংগঠনসমূহ (IGOs Intergovernmental Organisations ) : যেমন— সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO-United Nations Organisation:), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) প্রভৃতি সার্বভৌম রাষ্ট্রের কার্যকলাপের উপর নজরদারি করে। এ প্রসঙ্গে ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ (Amnesty International) এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ (Transparency International)-এর ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া ‘আন্তর্জাতিক ফৌজদারী খাদালত’ (International Criminal Court)-এর ভূমিকার কথাও বলা দরকার। এই আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করা যায়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনসমূহকে কার্যকর করার বিষয়টিও এই আদালতের আওতায় আসে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে দায়-দায়িত্ব বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের অবক্ষয় ঘটেছে। নিজের রাজ্যসীমার মধ্যেও কোন রাষ্ট্র সর্বাংশে স্বাধীনভাবে কার্য সম্পাদনে সক্ষম নয়। রাষ্ট্রকে এখন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ভূমিকা পালন করতে হয়। বিশ্বায়িত দুনিয়ার উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখেই রাষ্ট্রকে তার ভূমিকা পালন করতে হয়।
রাজনীতিক বিশ্বায়নের মূল্যায়ন
বিরুদ্ধবাদীরা রাজনীতিক বিশ্বায়নের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী রাজনীতিক বিশ্বায়ন বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজনের সৃষ্টি করে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হীনবল করে। রাজনীতিক বিশ্বায়ন শান্তি ও রাজনীতিক অংশগ্রহণের সহায়ক নয়। এ প্রসঙ্গে বিবিধ যুক্তির অবতারণা করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হলে, রাষ্ট্রসমূহ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকাসমূহ বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সমর্থকদের সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনসমূহের সুবাদে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং যুদ্ধের সমর্থনসূচক যাবতীয় যুক্তি অপসারিত হয়। বিপরীতক্রমে বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে, জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক যোগাযোগ বা বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে; নতুন নতুন সহিংস সংগঠনসমূহ গড়ে উঠার পথ প্রশস্ত হয়।
ক্ষমতা বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠানসমূহের হাতে এলে, প্রতিনিধিত্ব এবং গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ হীনবল হয়ে পড়বে। কারণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নগারিক সমাজের থেকে দূরবর্তী থাকবে, নাগরিকদের আশা আকাঙ্ক্ষার কাঙ্খিত প্রতিফলন ঘটবে না এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য ও সুযোগ নাগরিকদের হাতে থাকবে না। এ রকম পরিস্থিতির চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্বজনীন ‘অনুদারনীতিবাদ’ (Illiberalism) মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আধুনিক কালের উদারনীতিক গণতন্ত্র প্রজাতন্ত্রবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ ব্যক্তিমাত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে নিজের নিজের প্রতিনিধিদের পছন্দ করতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে গঠিত হয় না। এই সমস্ত সংগঠন সাধারণত সদস্যরাষ্ট্রসমূহের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ এদের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকে না। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ওনীল তাঁর Essentials of Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…while one may land the work of Greenpeace or the World Wildlife Fund, it is instructive to note that these organisations are not subject to popular democratic control nor necessarily more transparent than states themselves. This raises the concern of a ‘democratic deficit’, an idea first raised with regard to the EU.”
রাজনীতিক বিশ্বায়নের সমর্থকদের অভিমত অনুযায়ী বিশ্বায়িত দুনিয়ায় হিংসা ও বলপ্রয়োগের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। বিরুদ্ধবাদীরা এ কথা স্বীকার বা সমর্থন করেন না। সমালোচকদের মতানুসারে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরবর্তী পর্যায়েও হিংসা এবং বলপ্রয়োগ থাকবে; তবে আকারে প্রকারে পরবর্তিত হবে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে রাষ্ট্র যখন প্রথম আবির্ভূত হয়, তখনও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবাদে নতুন সংগঠনের সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন সংগঠনসমূহ জঙ্গী প্রকৃতির আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকারীদের সৃষ্টি করে। সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকারীরা বহুলাংশে আধুনিক রাষ্ট্রের একেবারে বিপরীত। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীসমূহ বিশেষভাবে বিকেন্দ্রীকৃত এবং পরিবর্তনশীল। তাদের নির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক এলাকা নেই। তারা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। এই সমস্ত সংগঠন বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও আনুষঙ্গিক অন্যবিধ সাহায্য-সহযোগিতা সংগ্রহে সমর্থ। নানা দিক দিয়ে অন্যান্য অ-রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহের অল্পবিস্তর সাদৃশ্য বর্তমান। কিন্তু বেসরকারী সংগঠন (NGOs Nongovernmental Organizations) এবং বহুজাতিক করপোরেশনসমূহের (MNCs-Multinational Corporations) সঙ্গে উল্লিখিত সংগঠনসমূহের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। আলোচ্য সংগঠনসমূহ তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য শক্তি সংগ্রহ ও প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। তারা এমনভাবে বলপ্রয়োগ করে যে, সাফল্যের সঙ্গে তার মোকাবিলা করা রাষ্ট্র বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকারীর পক্ষে সম্ভব হয় না। এ রকম সংগঠনের উদাহরণ হিসাবে অপরাধমূলক বিশ্বায়িত সংগঠন না সন্ত্রাসবাদী সংগঠনসমূহের কথা বলা যায়।
Leave a comment