ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক ন্যায়:
রাজনীতিক ন্যায়ের ধারণা সাধারণত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক ন্যায় বলতে সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক সম্পর্কসমূহের এক পুনর্বিন্যাসকে বোঝায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সম্পর্কিত ঘোষণা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই ঘোষণায় রাজনীতিক ন্যায় ও সাম্যের কথা বলা হয়েছে। এই ঘোষণার ১ ধারা অনুসারে জন্মগতভাবে সকলে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সকলে সমান (“All human beings are born free and equal in dignity and rights. They are endowed with reason and conscience and should act towards one another in a spirit of brotherhood.”)। রাজনীতিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে দেশের রাজনীতিক জীবনে জনসাধারণের স্বাধীন ও সঙ্গত অংশগ্রহণকে বোঝায়। অর্থাৎ রাজনীতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে। এবং সরকারী চাকরী বা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন রকম কৃত্রিম বৈষম্যমূলক বাধানিষেধ থাকবে না। দেশের জনসাধারণই সমকালীন পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আর্থ-রাজনীতিক উদ্দেশ্যের বিচারে সমাজের সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করবে।
রাজনীতিক ন্যায়ের উদারনীতিক ধারণা:
রাজনীতিক ন্যায়-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির অধিকারসমূহের ভোগ সুরক্ষিত থাকে। ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক ন্যায়-ধারণার মধ্যে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাও বর্তমান থাকে। রাজনীতিক ন্যায়ের মধ্যে অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের কথা যেমন আছে, তেমনি প্রতিবাদের অধিকার এবং সহনশীলতার দায়িত্বের ধারণাও আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক ন্যায় বলতে সামগ্রিক অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণকে বোঝায়। উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিক ন্যায়ের অর্থ হল ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সাম্য এবং সরকারী চাকরী বা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সাম্য। এদিক থেকে বিচার করলে রাজনীতিক অধিকার ও সাম্যের ধারণার সঙ্গে রাজনীতিক ন্যায়ের ধারণা সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে জনগণই হল রাজনীতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস। এবং এই রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে জনগণের প্রতিনিধিরা। জনসাধারণের ইচ্ছার ভিত্তিতে রাজনীতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের শাসকগোষ্ঠী জনমতের অনুগামী হবে। এ সবই হল রাজনীতিক ন্যায়ের দাবি। এবং উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই এই সমস্ত দাবির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অধিকারসমূহের স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তার ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সম্যক বিকাশ ঘটে। এবং নাগরিক হিসাবে ব্যক্তি জনসম্প্রদায়ের রাজনীতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারে। জোহরী এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…the notion of political justice requires that the state must protect and preserve certain valuable rights of the individual so that he may develop his personality as a citizen and thereby contribute his share to the welfare of the community.”
রাজনীতিক ন্যায় ও রাজনীতিক সাম্য:
রাজনীতিক ন্যায়ের মূল কথা রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনীতিক সাম্যের মধ্যেই নিহিত আছে। রাষ্ট্রের ভিতরে ব্যক্তি ও শ্রেণীভেদে রাজনীতিক অধিকারের ক্ষেত্রে তারতম্য থাকলে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনীতিক হতাশা দেখা দিতে বাধ্য। রাজনীতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের বহু ও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এতদসত্ত্বেও বিদ্যমান রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে বৈষম্য জনসাধারণের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। রাজনীতিক ন্যায় বলতে সকল ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত রাজনীতিক সাম্যের কথা বলা হয় না। কতকগুলি রাজনীতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু নিয়ম নীতি থাকতে পারে এবং এই সমস্ত নিয়ম-নীতি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। এর ফলে রাজনীতিক ন্যায় লঙ্ঘিত হয় না। কতকগুলি রাজনীতিক অধিকার ভোগের উপর কিছু প্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, ভোটাধিকার অর্জনের জন্য ন্যূনতম একটি বয়সে উপনীত হতে হয়। তেমনি আবার কিছু রাজনীতিক পদে আসীন হওয়ার জন্যও ন্যূনতম একটি বয়সে উপনীত হতে হয়। এই সমস্ত বিধিব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক এবং রাজনীতিক ন্যায়ের বিরোধী বলা যায় না।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া:
বিশেষ এক নির্দিষ্ট অর্থে রাজনীতিক ন্যায় বলতে সমকালীন ন্যায়বিচারের ধারণা অনুসারে বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিক প্রক্রিয়া ও রাজনীতিক অধিকারের পুনর্বিন্যস্ত করার ব্যবস্থাকে বোঝায়। প্রকৃত প্রস্তাবে এর অর্থ হল জনসম্প্রদায়ের রাজনীতিক জীবনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠাসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করা। এই সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশবাসীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব ঘটে এবং স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। রাজনীতিক ন্যায়ের দাবি অনুসারে বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষিত হবে। এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আইনসভা গঠিত হবে। তা ছাড়া আরও বলা হয় যে, আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকার আইনানুসারে আচরণ করবে এবং কখনই স্বৈরাচারী হবে না। অর্থাৎ রাজনীতিক ন্যায়-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
স্বাধীনতার অধিকার:
রাজনীতিক ন্যায়-ধারণা অনুসারে চিন্তা ও বাক্যের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা হয়। সরকার এবং তার কার্যাবলী ও নীতিসমূহের সমালোচনা করার অধিকার জনসাধারণের থাকবে। জনসাধারণ সরকারের ত্রুটিপূর্ণ কাজকর্মের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করতে পারবে এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। সংঘ-সমিতি গঠন করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা জনসাধারণের থাকবে। বিদ্যাধর মহাজন তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Whether there is political justice in a state or not can be judged from four principles : integrity, predictability, flexibility and acceptability.”
ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ের ধারণা:
রাজনীতিক ন্যায়বিচারের তাত্ত্বিক ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের কতকগুলি বিধি-ব্যবস্থার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় নাগরিকদের জন্য সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এই ন্যায় বিচারের লক্ষ্য সংবিধানের ৩৮ ধারায় ব্যক্ত হয়েছে। তা ছাড়া সামাজিক ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যতার বিলোপ (১৭ ধারা) ও অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা (৩৩০–৩৪২ ধারা); আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সমান কাজের জন্য সমান ও যথাযথ মজুরী এবং সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি; রাজনীতিক ক্ষেত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি (৩২৬ ধারা); প্রস্তাবনায় চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি; মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগের ব্যবস্থা; সংবিধানের ১৯ ধারায় ছটি স্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
Leave a comment