রাজনীতিক তত্ত্ব পর্যালোচনার গুরুত্ব

সাধারণভাবে বলা হয় যে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান তত্ত্বগত হয়ে থাকে। ডেভিড ইস্টন-এর অভিমত অনুসারে যাবতীয় পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই হল তত্ত্বভিত্তিক। রাজনীতিক সমস্যাদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তত্ত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের স্বার্থেও একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গঠন করা একান্তভাবে অপরিহার্য বিবেচিত হয়। একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁদের ভাবনা-চিন্তাকে ব্যক্ত করেন। রাজনীতিক ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা-চেতনার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। তা ছাড়া মানুষের রাজনীতিক জীবন এবং পরিবেশেরও উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে। এবং এই সবের স্বাভাবিক ফল হিসাবে রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। রাজনীতিক তত্ত্বের ইতিহাসের গোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরে আদর্শস্থাপনকারী তত্ত্বসমূহের অবিসংবাদিত প্রাধান্য ছিল। কালক্রমে রাজনীতিক তত্ত্বের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে আগ্রহে ভাটা পড়ে। রাজনীতিক তত্ত্বের জনপ্রিয়তায় অবক্ষয়ের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তারপর রাজনীতিক চিন্তাধারার ইতিহাসে আবার রাজনীতিক তত্ত্বের জনপ্রিয়তার পুনরাবির্ভাব ঘটে। হেল্ড (David Held)-এর অভিমত অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে রাজনীতিক তত্ত্বের প্রতি আগ্রহের পুনরুত্থান ঘটে। রাজনীতিক তত্ত্বের পুনরুত্থানের পিছনে মূলত তিনটি কারণের ক্রিয়ার কথা সাধারণভাবে বলা হয়। এই কারণগুলি হল: (১) যুদ্ধোত্তর সহমত ভেঙ্গে যায়, (২) ফলশ্রুতি হিসাবে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সংঘাতের সৃষ্টি হয়, এবং (৩) মানববিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের পরিবর্তন, বিশেষতঃ রাজনীতিক তত্ত্বচিন্তায় নবজাগরণ। পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের আগমন ঘটেছে। উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক তত্ত্বের পর্যালোচনার গুরুত্ব সহজেই প্রতিপন্ন হয়। রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশ, বিবর্তন এবং প্রকৃতি ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।


রাজনীতিক তত্ত্বের অর্থ

‘রাষ্ট্রতত্ত্ব’ বা রাজনীতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই অংশমাত্র। রাষ্ট্রতত্ত্ব বলতে সাধারণভাবে বোঝায় রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা বা সমস্যাদি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। তবে রাষ্ট্রতত্ত্ব কাকে বলে এবং এর প্রকৃতি ও ভূমিকা কি এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। এই মতপার্থক্যের কারণ হল এই যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যে যার রাজনীতিক মতাদর্শ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনীতিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।

‘তত্ত্ব’ কাকে বলে? এই প্রসঙ্গে প্রথমে তত্ত্ব শব্দটির অর্থ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। বস্তুত বিভিন্ন অর্থে ‘তত্ত্ব’ শব্দটির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তবে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণাটি নিয়েই আলোচনা করা দরকার। গ্রীক শব্দ ‘Theoria’ থেকে ইংরেজী ‘Theory’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্ব হল সম্যকভাবে কেন্দ্রীভূত মানসিক দৃষ্টিপাত বা মনোযোগ। কোন বিষয় চিন্তা-ভাবনার সুবাদে এ ধরনের মনোযোগের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের মনোযোগের উদ্দেশ্য হল সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া বা বিষয়টিকে অধিগত করা। তত্ত্বের দ্বারা কোন কার্যকলাপ বা প্রয়োগ প্রকাশিত হয় না। তত্ত্বের দ্বারা কোন বিষয়ে চিন্তা ব্যক্ত হয়। আরনল্ড ব্রেখট (Arnold Brecht) -এর অভিমত অনুসারে ‘তত্ত্ব’ হল কোন প্রস্তাব বা বহু প্রস্তাবের সমন্বয় বিশেষ। সরাসরি পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় বা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত নয় এ রকম তথ্যাদি বা আন্তঃসম্পর্ক (data or interrelations) বিষয়ক ব্যাখ্যা। ব্রেখট সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় অর্থেই ‘তত্ত্ব’ কথাটির অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যাপক অর্থে তত্ত্ব বলতে কোন বিষয়ে কোন একজন চিন্তাবিদের সমগ্র বক্তব্য বা শিক্ষাদান (teaching)-কে বোঝায়। এর মধ্যে ঘটনার বিবরণ, চিন্তাবিদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ইতিহাস সম্পর্কিত তাঁর ধ্যান-ধারণা, তাঁর মূল্যবোধ ও বিচার-বিবেচনা এবং উদ্দেশ্য, নিয়ম-নীতি ও প্রণালী সম্পর্কিত তাঁর প্রস্তাবসমূহ বর্তমান থাকে। সংকীর্ণ অর্থে তত্ত্ব হল মূলত বা অন্তত প্রাথমিকভাবে ব্যাখ্যামূলক চিন্তা-ভাবনা। ব্রেখট International Encyclopedia of the Social Sciences গ্রন্থে বলেছেন: “A theory is a proposition or set of propositions designed to explain something with reference to data or interrelations not directly observed or not otherwise manifest.” ইস্টন (David Easton)-এর মতানুসারে কোন রকম সর্বজনীন ধারণা (generalization) -কে তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। সাধারণত সংশ্লিষ্ট ধারণার মাধ্যমে বহু ক্রিয়াকলাপ ব্যক্ত হয়ে থাকে।

কিছু আনুষঙ্গিক ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বের অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তত্ত্ব ও কর্ম স্বতন্ত্র। কর্মের মাধ্যমে আমরা শিক্ষা পাই; এ কথা ঠিক। কিন্তু কর্মের পিছনে কিছু ভিত্তি থাকে। চিন্তা-ভাবনা কর্মের ভিত্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। তত্ত্বের মধ্যে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো বর্তমান থাকে। কর্মের মধ্যে এরকম কোন কাঠামো থাকে না। তত্ত্ব বলতে কেবলমাত্র বিবরণকে বোঝায় না। কারণ বিবরণ হল চিন্তা-ভাবনার অংশমাত্র। তত্ত্বের অন্যান্য অংশগুলি হল উদ্ভাবন, নির্ধারণ, বৃদ্ধিসাধন এবং কোন বাহ্যবিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও কাঠামো স্থিরীকরণ। তত্ত্বকে প্রমাণার্থ প্রকল্প (hypothesis) বলা যায় না। প্রমাণসাপেক্ষ প্রকল্প বলতে কোন ঘটনার সম্ভাব্য অনুমানকে বোঝায়। তত্ত্বের নিশ্চয়তা প্রমাণ সাপেক্ষ প্রকল্পের মধ্যে অনুপস্থিত। আবার ‘তত্ত্বকে ‘দর্শন’ বলা যায় না। কারণ তত্ত্ব হল বিশেষ বিষয় সম্পর্কিত, কিন্তু দর্শন হল সর্ববিষয়ক। তেমনি আবার ‘তত্ত্ব’কে ‘মনন’ (thought) বলা যায় না। কারণ এ হল মনন সম্পর্কিত মনন; সমগ্ৰটাই মনন নয়। তবে ‘তত্ত্ব’ ও ‘যুক্তি’র মধ্যে সাদৃশ্য বর্তমান। কারণ উভয়ই বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করা হয়। তবে তত্ত্ব যুক্তিকে অতিক্রম করে যায়; বিজ্ঞানকেও ছাড়িয়ে যায়।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল ডয়েটস (Karl Deutsch) তত্ত্বের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী তত্ত্ব বিচ্ছিন্ন পরিসংখ্যানকে সম্পর্কিত, সু-শৃঙ্খলিত ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে; প্রাসঙ্গিক বিষয়কে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে, কোন বাহ্য বস্তুর হারিয়ে যাওয়া বিষয়কে তুলে ধরে এবং দৃষ্টিগোচর ঘটনাসমূহের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎবাণী করে। এদিক থেকে বিচার করলে তত্ত্ব হল কর্ম বা প্রয়োগের পথনির্দেশ। প্রমাণসাপেক্ষ প্রকল্পকে তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে এবং নিছক বিবরণের সঙ্গে অনেক কিছু সংযোজন করে। দর্শনের একটি অংশ হিসাবে তত্ত্ব কোন একটি বিষয়কে এমনভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, যার ফলে যুক্তি ও দৃষ্টি উভয়েরই প্রয়োজন পূরণ হয়।

রাজনীতিক তত্ত্বের অর্থ: রাজনীতিক তত্ত্ব হল এক ধরনের তত্ত্ব। এই তত্ত্ব রাজনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কিত। রাজনীতিক তত্ত্ব রাজনীতিক বিষয়াদির বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কিত। বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিক তত্ত্বের ধারণা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

রাষ্ট্রব্যবস্থার পরে রাজনীতিক তত্ত্বের সৃষ্টি: রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাজনীতিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত এক বিশেষ ধরনের চিন্তা-ভাবনাকে রাজনীতিক তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক ভাবনা-চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি গড়ে উঠার মাধ্যমে। এই কারণে অনেকের অভিমত হল যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা যতটা প্রাচীন, রাজনীতিক তত্ত্ব ততটা প্রাচীন নয়। রাজনীতিক তত্ত্ব বলতে যে বিশেষভাবে সুসংবদ্ধ চিন্তা-ভাবনাকে বোঝান হয়, তা রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম থেকেই প্রকাশ পেতে পারে না। বরং এটাই স্বাভাবিক যে দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাগত নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরই মানুষ সুচিন্তিতভাবে রাজনীতিক তত্ত্বের অনুশীলনে মনোনিবেশ করেছে।

রাষ্ট্রতত্ত্বের অর্থ: প্রচলিত ধারণা অনুসারে বলা যেতে পারে যে রাজনীতিক দর্শনের আলোচনাই হল রাষ্ট্রতত্ত্ব। রাজনীতিক মূল্যবোধের ধারণা এই ধরনের আলোচনার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। সাধারণত পরম্পরাগত রাজনীতিক তত্ত্বগুলি (Traditional Political Theories)-র মধ্যে এই রকম মূল্যবোধযুক্ত আলোচনা দেখা যায়। রাজনীতিক মৌলিক ধারণা এবং প্রধান আলোচ্য বিষয়সমূহ রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজনীতিক বিষয় সম্পর্কিত কতকগুলি সাধারণ নীতিকে সূত্রবদ্ধ করা হয়। তাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ এবং রাজনীতিক সংস্কৃতি, রাজনীতিক অংশগ্রহণ, রাজনীতিক নিয়োগ, অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক জীব হিসাবে মানুষ এবং রাজনীতিক প্রণালীসমূহ রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই রাষ্ট্রতত্ত্বে একই সঙ্গে আদর্শ স্থাপনকারী রাজনীতিক তত্ত্ব (Normative Political Theory) ও অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব (Empirical Theory) বর্তমান থাকে। রাজনীতিক কার্যকলাপের তত্ত্বগত কাঠামো সম্পর্কিত আলোচনা হল মূল্যমানযুক্ত। এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার বাস্তব ক্রিয়াকলাপের পর্যালোচনা হল অভিজ্ঞতাবাদী।

ব্যবহারিক রাজনীতি এবং রাজনীতিক তত্ত্ব: রাজনীতিক তত্ত্বানুশীলন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার জন্য প্রথমেই রাজনীতিক ভাবনা-চিন্তার দু’টি দিক উল্লেখ করা দরকার। এই দু’টি দিক হল : ব্যবহারিক দিক ও তত্ত্বগত দিক। এক ধরনের রাজনীতিক চিত্তা হল বাস্তব জীবনের উপযোগী রাজনীতিক কাঠামো ও ব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা; যেমন, বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের ভাবনা-চিন্তা। ইতিহাসে বিভিন্ন রাজত্ব ও শাসনব্যবস্থার অন্তর্গত এ রকম বহু ব্যবহারিক ভাবনা-চিন্তার উদাহরণ আছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে সংবিধান রচনার মাধ্যমে যে সমস্ত রাজনীতিক কাঠামো বা ব্যবস্থাদি গড়ে তোলা হয়, তাকেও ব্যবহারিক রাজনীতিক ভাবনা-চিন্তার নজির হিসাবে গ্রহণ করা যায়। এই ব্যবহারিক রাষ্ট্র চিন্তা থেকে তত্ত্বগত চিন্তার জগৎ পৃথক। একে কেতাবী রাষ্ট্র-চিন্তা বলা হয়। রাজনীতিক তত্ত্ব বলতে মূলত এই কেতাবী রাষ্ট্র-চিত্তাকে বোঝান হয়।

ব্যবহারিক রাজনীতি ও রাজনীতিক তত্ত্বের সম্পর্ক: সুশিক্ষিত, মননশীল ও গবেষকমানুষের ভাবনা চিন্তাই হল কেতাবী ভাবনা-চিন্তা। এঁরা রাজনীতিক কাঠামো ও ব্যবস্থাবলীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। তবে ব্যবহারিক রাজনীতির সঙ্গে রাজনীতিক তত্ত্ব আলোচনার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ব্যবহারিক রাজনীতি তত্ত্বচিন্তাকে প্রভাবিত করে, আবার তত্ত্বচিন্তাও ব্যবহারিক রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করে। লেনিন (V.I Lenin) ১৯১৭ সালের সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সফল রূপকার হিসাবে পরিচিত। তিনি তাঁর গ্রন্থে বাস্তব রাজনীতির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। তাঁর অনেক তত্ত্ব পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন। তত্ত্ব ও প্রয়োগের মিলনের উদাহরণ যে-কোন যুগে পাওয়া যাবে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিকদের কর্ম ও চিন্তা অনুধাবন করলে। রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনার তাত্ত্বিক দিকটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত (১) এক ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা হল নিতান্ত বিমূর্ত বা কাল্পনিক। যেমন, গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো ও তাঁর অভিভাবক শাসকের তত্ত্ব বা রুশোর সাধারণ ইচ্ছার তত্ত্ব। (২) আর এক ধরনের গবেষক বা চিন্তানায়ক আছেন যাঁরা রাজনীতিক প্রশ্নাবলীর যথাসম্ভব বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পক্ষপাতী। যেমন, অ্যারিস্টটলের আইন ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত তত্ত্ব, মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতিক তত্ত্ব বলতে কাল্পনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উভয় ধরনের চিন্তা-বিশ্লেষণকে বোঝান হয়।

স্যাবাইন: স্যাবাইন (Sabine) -এর মতানুসারে, ‘ব্যবহারিক রাজনীতির অংশ হিসাবে রাজনীতিক তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে” (“Theories of Politics are themselves a part of Politics.”)। রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনীতিক ব্যবস্থাদি গড়ে উঠার মাধ্যমে রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনা বা রাষ্ট্রাদর্শ প্রকাশ পায়। কিন্তু ব্যবহারিক চিন্তা-ভাবনা রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনার একটি দিক মাত্র। রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনার তত্ত্বগত দিকটিকে ব্যবহারিক রাজনীতির অংশমাত্র বললে ভুল হবে। স্যাবাইন তাঁর History of Political Theory শীর্ষক গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন যে, তাঁর উপরিউক্ত ধারণাটি সঠিক নয়। তত্ত্ব ও প্রয়োগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাই সুবিদিত। তবে এই সম্পর্কের অর্থ এই নয় যে তত্ত্ব প্রয়োগেরই অংশমাত্র। সম্পর্কটি পারস্পরিক ও দ্বান্দ্বিক। ব্যবহারিক রাজনীতি থেকে রাজনীতিক তত্ত্ব গড়ে উঠতে পারে, আবার কোন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত রাজনীতিক তত্ত্বের প্রভাবে ব্যবহারিক রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটতে পারে। উদারনীতি, মার্কসবাদ বা গণতান্ত্রিক সমাজবাদ—প্রতিটি রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই উভয়বিধ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। উল্লিখিত মতবাদগুলি বিশেষ বিশেষ সামাজিক ও রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে। আবার এগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে উৎকর্ষ লাভ করেছে এবং ব্যবহারিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। স্যাবাইনের মতানুসারে ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক তত্ত্ব বলতে রাজনীতি সম্পর্কিত যে কোন বিষয় বা রাজনীতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক যে কোন বিষয়কে বোঝায়। সংকীর্ণ অর্থে রাজনীতিক তত্ত্ব হল রাজনীতিক সমস্যাদি সম্পর্কিত শৃঙ্খলিত অনুসন্ধান।

ডেভিড হেল্ড-এর মতানুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব হল রাজনীতিক জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা ও সর্বজনীন সিদ্ধান্তসমূহের এক কাঠামো। রাজনীতিক তত্ত্বের মধ্যে থাকে রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি বিষয়ক বক্তব্য, মতাদর্শ ও অনুমানসমূহ এবং মানুষের রাজনীতিক সামর্থ্য সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা। হেল্ড বলেছেন: ” (Political theory is a network of concepts and generalizations about political life involving ideas, assumptions and statements about the nature, purpose and key features of government, state and society and about the political capabilities of human beings.”

প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক তত্ত্বের অর্থ-সম্পর্কিত আলোচনায় ‘দর্শনের সঙ্গে তত্ত্বের’ এবং ‘তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের’ পারস্পরিক সম্পর্কটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। আলোচ্য অধ্যায়ের অন্তর্গত বিভিন্ন রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনা ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে অবহিত থাকতে হবে।

রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজনীতিক বিষয় সম্পর্কিত কতকগুলি সাধারণ নীতিকে সূত্রবদ্ধ করা হয়। তাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ এবং রাজনীতিক সংস্কৃতি, রাজনীতিক অংশগ্রহণ, রাজনীতিক নিয়োগ, অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক জীব হিসাবে মানুষ এবং রাজনীতিক প্ৰণালীসমূহ রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই রাষ্ট্রতত্ত্বে একই সঙ্গে আদর্শ স্থাপনকারী ও অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব বর্তমান থাকে। রাজনীতিক কার্যকলাপের তত্ত্বগত কাঠামো সম্পর্কিত আলোচনা মূল্যমানযুক্ত। আর রাজনীতিক ব্যবস্থার বাস্তব ক্রিয়াকলাপের পর্যালোচনা অভিজ্ঞতাবাদী।

কোকার ও ইস্টন: অনেকের মতানুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব হল সাধারণ অনুমান ও সিদ্ধান্তসমূহ। এই সমস্ত অনুমান ও সিদ্ধান্ত গড়ে উঠে মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা সংগৃহীত তথ্যাদির ভিত্তিতে। কোকার (Francis Coker)- এর মতানুসারে সরকার, তার সংগঠন ও কার্যাবলীকে মানুষের স্থায়ী প্রয়োজন, ইচ্ছা এবং মতামতের মূল্যায়নের তথ্য হিসাবে গণ্য করা হলে রাজনীতিক তত্ত্বের সৃষ্টি হয়। ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, সাধারণভাবে রাজনীতিক দর্শন বা রাজনীতিক মূল্যবোধের আলোচনাই রাজনীতিক তত্ত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়। তিনি রাজনীতিক তত্ত্বকে মূল্যবোধজনিত তত্ত্ব (value theory) হিসাবে অভিহিত করেছেন। আবার তিনি বিভিন্ন রাজনীতিক ঘটনার সম্পর্ক নির্ধারণ সম্পর্কিত হেতুবাদ (causal theory)- এর কথা বলেছেন।

ভাববাদীদের রাষ্ট্রতত্ত্ব: প্লেটো, কাণ্ট, হেগেল, গ্রীণ প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আদর্শ রাষ্ট্র ও সুন্দর জীবনের প্রতিষ্ঠা। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্‌গণ রাষ্ট্র ও রাজনীতিক জীবনের ক্ষেত্রে সর্বজনীন মূল্যবোধ নির্ধারণ করতেন। তারপর সেই মূল্যবোধের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র, আইন, অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে দার্শনিক তত্ত্ব গড়ে তুলতেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্লেটোর ‘দার্শনিক রাজা’ (Philosopher King)-র তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্লেটো এই তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। অ্যারিস্টটলও আদর্শ সমাজ সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। ভাববাদীরা রাষ্ট্র ও রাজনীতিক জীবনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কতকগুলি পূর্বসিদ্ধান্তের দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। তাঁরা বাস্তব অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেন নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বর্তমান ছিল।

রাজনীতিক তত্ত্ব এবং রাজনীতিক দর্শন: রাজনীতিক তত্ত্ব সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে জানার জন্য তত্ত্ব ও দর্শনের সম্পর্কটি অনুধাবন করা দরকার। কেতাবী বা তত্ত্বগত রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে দার্শনিক উপলব্ধি ও দার্শনিক বিচারের সুদৃঢ় যোগসূত্র পরিলক্ষিত হয়। দার্শনিক উপলব্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনা গুরুত্ব অর্জন করে। দর্শন বলতে সত্যানুসন্ধানের বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়। দার্শনিক আলোচনার অর্থ হল কোন ‘ধারণা’ বা ‘বিশ্বাস’-এর বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত বিচার-ভাষ্য বা মূল্যায়ন। তাত্ত্বিক আলোচনা বলতে সাধারণত কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে বোঝায়। দর্শন ন্যায্যতা বা সত্যের অনুসন্ধান করে। আর তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে উত্থাপন করে। বস্তুত দর্শন ও তত্ত্বের মধ্যে কোন অনপনেয় ব্যবধান নেই। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। ন্যায্যতা বা সত্যের অনুসন্ধান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে হতে পারে। তেমনি আবার যে-কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তি হিসাবে সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির কাজ করে। বস্তুত কোন রাজনীতিক তত্ত্বকে তার দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া বোঝা যায় না। অর্থাৎ বিশিষ্ট দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কোন রাজনীতিক তত্ত্বই গুরুত্ব পায় না। যেমন, জার্মান দার্শনিক হেগেল-এর রাষ্ট্রতত্ত্ব তাঁর ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তেমনি কার্ল মার্কস-এর শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে অর্থবহ হয়। যে-কোন রাজনীতিক তত্ত্ব অনুধাবনের স্বার্থে সেই তত্ত্বের স্রষ্টা বা মুখ্য রূপকারদের কালগত ও শিক্ষাগত পরিবেশ-সঞ্জাত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ বিচার-বিবেচনা করা দরকার। যে-কোন রাজনীতিক তত্ত্বের যে সুসংবদ্ধ রূপ থাকে তার অনেকটাই হল সেই তত্ত্বের ভিত্তিস্বরূপ কোন বিশিষ্ট দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিরই অবদান। ভাববাদ, বস্তুবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, রহস্যবাদ, দৃষ্টবাদ বা বিজ্ঞানবাদ, ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষবাদ প্রভৃতি কোন-না-কোন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রাজনীতিক তত্ত্বের মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করে আসছে। এই কারণে অনেকে সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাজনীতিক দর্শনকে সমার্থবোধক হিসাবে বিবেচনা করতেন। প্লেটো-অ্যারিস্টটল এবং রুশো, মিল প্রমুখ। বিশিষ্ট দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্ব পরিপুষ্ট হয়েছে।

প্রাচীন রাজনীতিক আলোচনা: প্রাচীনকালের রাজনীতিক আলোচনায় রাজনীতিক তত্ত্ব ছিল রাজনীতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাজনীতিক দর্শনের মধ্যে কোন সীমারেখা টানা হয়নি। প্লেটো রাজনীতিক জ্ঞান অর্জনের জন্য রাজনীতিক দর্শনকে দেখেছেন। মূল্যবোধের উপস্থাপনই ছিল প্রাচীনকালের রাজনীতিক আলোচনার মূল বিষয়। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও মূলত আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার চিন্তা-ভাবনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তবে তাঁর লেখায় অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পাওয়া যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে রাজনীতিক বিজ্ঞান ও রাজনীতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্যের কথা ভাবা হত না। রাজনীতিক দর্শনই তখন রাজনীতিক বিজ্ঞান হিসাবে বিবেচিত হত। রাজনীতিক তথ্য বা ঘটনাকে রাজনীতিক মূল্যবোধ থেকে পৃথক করার কোন উদ্যোগ এই সময় পরিলক্ষিত হয় না। এই ধারা ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

হ্যাকার (Andrew Hacker) রাজনীতিক তত্ত্বের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: (Political theory is) a combination of a disinterested search for the principles of good state and good society on the one hand and disinterested search for knowledge of political and social reality on the other.” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিধান (Political Science Dictionary) রাজনীতিক তত্ত্বের এক সুদীর্ঘ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তদনুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব হল: “A body of thought that seeks to evaluate, explain and predict political phenomena. As a subfield of Political Science, it is concerned with political ideas, values and concepts, and the explanation of prediction of political behaviour. In this broad sense, it has two main branches; one is political philosophy or normative theory, with its value, analytic, historical and speculative concerns. The other is empirical theory, with its efforts to explain, predict, guide, research and organise knowledge through the formulation of abstract models, and scientifically testable propositions.”

আচরণবাদীদের রাষ্ট্রতত্ত্ব – আচরণবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গী: রাজনীতিক আলোচনার ক্ষেত্রে এই ধারার পরিবর্তন ঘটে সাম্প্রতিককালের আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে। আচরণবাদীরা সত্যানুসন্ধানের কাজকেই রাজনীতিক তত্ত্বের লক্ষ্য হিসাবে মনে করেন। তাঁরা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার উপর জোর দেন। আচরণবাদীদের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতিক তাত্ত্বিক সত্যানুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করবেন। দর্শন ও মূল্যবোধের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মুক্ত করার ব্যাপারে এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অতিমাত্রায় আন্তরিক। তাঁরা দর্শনমূলক রাজনীতিক আলোচনার পরিবর্তে মূল্যবোধ-বর্জিত বৈজ্ঞানিক আলোচনার পক্ষপাতী।

অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব: বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আবির্ভাব ঘটে। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনাকে মূল্যমান-নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের মতে তত্ত্ব ও গবেষণা পরস্পর নির্ভরশীল। তাঁরা অভিজ্ঞতাবাদী (empirical) গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে তাত্ত্বিক বিষয়াদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতে চান। অর্থাৎ এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রতত্ত্বের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য রাজনীতিক জ্ঞান লাভের কথা বলেন। এঁদের অভিমত অনুসারে বিশ্বাসযোগ্য রাজনীতিক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলার উদ্দেশ্যে রাজনীতিক তত্ত্ব গঠন করা দরকার।

ডেভিড ইস্টন: আচরণবাদী রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রসঙ্গে ডেভিড ইস্টন-এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত তাঁর The Political System শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। ইস্টনের মতানুসারে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব ও তথ্য পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রনৈতিক গবেষণার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক অনুমানের মাধ্যমে রাজনীতিক তথ্যাদি জোগাড় করা হয়। তথ্য ব্যতিরেকে তত্ত্ব কল্পনাবিলাসে পরিণত হয়। রাষ্ট্রনৈতিক তথ্য ছাড়া রাষ্ট্রনীতিক তত্ত্ব অবাস্তব হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়া রাষ্ট্রনৈতিক তথ্যাদি ঘটনাসমূহের শুষ্ক সংকলন হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাই হল রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রতত্ত্ব রাজনীতিক আচার-আচরণের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মূল্যবোধাত্মক আলোচনাই চূড়ান্ত নয়। সেই মূল্যবোধে উপনীত হওয়ার পথ অনুসন্ধান করাও দরকার। ইস্টনের অভিমত অনুসারে বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনার প্রয়োজনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্য একটি সার্বজনীন তত্ত্ব বা সাধারণ তত্ত্ব (general theory) গঠন করা দরকার। রাজনীতিক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তিনি তত্ত্ব গঠনের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। রাজনীতিক ঘটনাবলী প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য জ্ঞান সংগ্রহের স্বার্থে সুসংবদ্ধ তত্ত্ব গড়ে তোলা বিশেষভাবে দরকার। অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব (empirical theory) গড়ে তোলাই হল ইস্টনের আসল উদ্দেশ্য। তবে মূল্যবোধকে তিনি সার্বিকভাবে অগ্রাহ্য করেননি।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক তত্ত্বের ধারণাগত মৌলিক দিকগুলিকে সংক্ষেপে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।

(ক) রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনার এলাকা রাজনীতিক বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। নাগরিকদের রাজনীতিক জীবন, তাদের রাজনীতিক আচার-আচরণ, রাজনীতিক মতাদর্শসমূহ, তাদের সরকার ও সরকারের কার্যাবলীসমূহ প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহে রাজনীতিক তত্ত্বের পরিধি প্রসারিত।

(খ) রাজনীতিক বিষয়াদির মধ্যে রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি সীমাবদ্ধ। এতদসত্ত্বেও ঐতিহাসিক, সামাজিক, আর্থনীতিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, বাস্তুবিদ্যা প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক তত্ত্বে রাজনীতিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়।

(গ) রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনায় বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ বা অনুসরণ করা হয়। যে কোন রাজনীতিক বাহ্য বিষয় সম্পর্কে বিবরণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। 

(ঘ) রাজনীতিক তত্ত্ব নির্দেশমূলক এবং ব্যাখ্যামূলক উভয় ধরনের। 

(ঙ) মননমূলক বিদ্যা হিসাবে রাজনীতিক তত্ত্ব রাজনীতিক বাহ্য বিষয়াদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, মূল্যায়ন করে এবং ভবিষ্যৎবাণী করে। এই প্রতিক্রিয়ার সুবাদে রাজনীতিক তত্ত্বে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ সাপেক্ষ মডেল তৈরী হয় এবং মানবিক আচার-আচরণ সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। 

(চ) চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতিক তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল উন্নত সমাজে এক উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই পথে রাজনীতিক তত্ত্ব বিভিন্ন প্রক্রিয়া পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো গড়ে তোলে। এগুলি ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত এবং যুক্তির বিচারে উত্তীর্ণ।

সংক্ষেপে বলা যায় যে, রাজনীতিক তত্ত্ব হল রাজনীতিক ব্যবস্থার বিষয়াদি সম্পর্কিত একটি উপরিদৃশ্য। রাজনীতিক বিষয়াদি বলতে কি বোঝায় তারই সংক্ষিপ্ত, প্রতীকী ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রকাশ ও রাজনীতিক তত্ত্ব। রাজনীতিক কার্যকলাপের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ফলাফলের আনুমানিক যুক্তিসঙ্গত ও সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হল রাজনীতিক তত্ত্ব। রাজনীতিক তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল রাজনীতিক বিষয়াদিতে শৃঙ্খলা সুসঙ্গতি নিয়ে আসা এবং অর্থবহ করে তোলা। রাজনীতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণমূলক, ব্যাখ্যামূলক এবং প্রতিপাদমূলক।

রাজনীতিক তত্ত্বের প্রকৃতি: রাজনীতিক তত্ত্বের অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। রাজনীতিক তত্ত্বের অর্থ প্রসঙ্গে মতপার্থক্য বর্তমান। স্বভাবতই রাজনীতিক তত্ত্বের প্রকৃতি প্রসঙ্গেও সহমতের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেকের অভিমত অনুযায়ী বহু ও বিভিন্ন চিন্তাবিদের চিন্তাভাবনার ফসল হল রাজনীতিক তত্ত্ব। কিন্তু এ ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ সে ক্ষেত্রে রাজনীতিক তত্ত্ব (Political theory) ও রাজনীতিক চিন্তাধারা (Political Thought)-এর মধ্যে কোন রকম পার্থক্য থাকে না।

অনেকে আবার রাজনীতিক তত্ত্বকে রাজনীতিক দর্শনের সমগোত্রীয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। রাজনীতিক দর্শনের একটি অংশ হল রাজনীতিক তত্ত্ব। এ কথা ঠিক। রাজনীতিক দর্শন যদি সমগ্র হয়, তা হলে রাজনীতিক তত্ত্ব তার অংশমাত্র। অংশকে কখনই সমগ্র হিসাবে বিবেচনা করা যায় না।

আধুনিককালের চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকে বিজ্ঞানকে রাজনীতিক তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা শাস্ত্রটিকে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ নামে অভিহিত করার পক্ষপাতী। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাজনীতির বিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাজনীতির ইতিহাস, রাজনীতির সংস্কৃতি, এমনকি রাজনীতির দর্শন বলা যায় না। কিন্তু রাজনীতিক তত্ত্ব এ সমস্ত কিছুর সমাহার।

সাধারণত রাজনীতিক তত্ত্বকে রাজনীতির সঙ্গে সমার্থক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। তারফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। এ পার্থক্য হল তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য। একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে পারে বা রাষ্ট্রদার্শনিক হতে পারে বা রাজনীতিক তাত্ত্বিক হতে পারে, বা রাজনীতিবিদ হতে পারে। কিন্তু কোন ব্যক্তি একাধারে সবকিছু হতে পারে না। তবে কদাচিৎ একই ব্যক্তিকে দুটি বা তিনটি ভূমিকায় দেখা যায়।