রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয়ের কারণ:

রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় বলতে প্রকৃতপক্ষে সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্বের অবনয়নকে বোঝায়। সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্ব (political theory) রাজনীতিক দর্শন (political philosophy)-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাচীন রাজনীতিক আলোচনায় রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাজনীতিক দর্শনের মধ্যে তেমন কোন সীমারেখা ছিল না। অর্থাৎ সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্ব হল দর্শনকেন্দ্রিক। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকের মতে এই দর্শনকেন্দ্রিক রাজনীতিক তত্ত্বের উপযোগিতা হ্রাস পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইস্টন, কোব্যান (Alfred Cobban ) প্রমুখ সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, তাঁরা মূল্যবোধ সম্পর্কিত তত্ত্বের বিরোধী। ইস্টন কিন্তু তা নন। ইস্টনেরও মুখ্য লক্ষ্য হল অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠন করা। কিন্তু মূল্যবোধকে তিনি একেবারে অস্বীকার করেন নি। তবে ইস্টনও এই অভিমত পোষণ করেন যে মূল্যবোধ সম্পর্কিত রাজনীতিক তত্ত্ব অবনয়নের মুখে পড়েছে।

ইস্টন ও কোবান রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু পিটার লাসলেট (Peter Laslett) ও রবার্ট ডাল-এর অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্তেব অপমৃত্যু ঘটেছে। অপর কিছু চিন্তাবিদের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্ত্ব দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মার্কস ও মিলের পর, বলা যেতে পারে অধ্যাপক ল্যাস্কির পর আর কোন রাজনীতিক দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে ডেভিড ইস্টন বলেছেন যে সাধারণত সামাজিক অস্থিরতা ও পরিবর্তনের পরিমণ্ডলে রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশে বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তনের অধ্যায়ে বিশ্ববন্দিত গ্রীক রাষ্ট্রদার্শনিকদের আবির্ভাব ঘটেছে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ড যখন ধর্মীয় ও রাজনীতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জীর্ণ তখনই বিখ্যাত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদার্শনিকদের লেখনী সক্রিয় হয়েছে। একই কথা অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংঘাত ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মৌলিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর কোন দেশেই উল্লেখযোগ্য নতুন কোন রাজনীতিক দর্শনের উদ্ভব বা বিকাশ ঘটেনি। এ বিষয়ে ইস্টন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর The Decline of Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন। “Contemporary political thought lives parasitically on ideas a century old and, what is more discouraging, we see little prospect of the development of new political synthesis.”

ইস্টনের অভিমত অনুযায়ী আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মূল্যবোধের সম্পর্কের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবোধের নতুন ধারণা গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহী বা উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। সমকালীন চাহিদা মাফিক মূল্যবোধের পুনর্গঠন, রাজনীতিক আচার-আচরণের একটি সুসংবদ্ধ মতবাদ গঠন, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের যুগোপযোগী ভূমিকা নির্ধারণ প্রভৃতি রাজনীতিক তাত্ত্বিকদের সাবেকি দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে পরিগণিত হয়। আধুনিককালের রাজনীতিক তত্ত্ববিদদের উৎসাহ ও আগ্রহ এদিক থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন মুখী হয়েছে। অথচ আধুনিক অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ্রা স্ব স্ব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সাবেকি দায়িত্ব ও ভূমিকাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা সুসংবদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী অনুসন্ধান ও গবেষণা কর্মের মাধ্যমে স্ব স্ব সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই বিষয়টিকে অবহেলা করেছেন।

ডেভিড ইস্টনের মতানুসারে যে কোন তত্ত্বের উচিত মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাবলীরও পর্যালোচনা করা। মূল্যবোধের মত ঘটনাবলীর উপরও গুরুত্ব আরোপ করতে হলে অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তিটি সুসংবদ্ধ ও সুদৃঢ় হওয়া দরকার। ইস্টনের অভিযোগ হল রাজনীতিক তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতিক তত্ত্ব অধিকতর দর্শনমূলক ও অনুমানভিত্তিক। মানব সভ্যতার ইতিহাসের জ্ঞান ও সমকালীন রাজনীতিক পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের সম্যক পর্যালোচনার উপর রাজনীতিক তত্ত্ব ভিত্তিশীল নয়। অন্যান্য আচরণবাদীদের মত ইস্টন মূল্যবোধের তত্ত্বের (value theory) বিরোধিতা করেননি; তবে অন্যান্য আচরণবাদীদের মত তিনি হেতুমূলক মতবাদের (causal theory) উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইস্টন মূল্যবোধমূলক মতবাদের গুরুত্বকে স্বীকার করেও অনুশোচনা করেছেন যে, সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক রচনাসমূহে মূল্যবোধমূলক মতবাদেরও অবক্ষয় ঘটেছে।

রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় – অ্যালফ্রেড কোব্যান অ্যালফ্রেড কোব্যান : তাঁর Ethics and the Decline of Political Theory শীর্ষক এক রচনায় রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কোব্যানের উল্লিখিত রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে গোউল্ড ও থাসবি (Gould and Thursby) সম্পাদিত Contemporary Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে। ডেভিড ইস্টনের মত কোব্যানও বিশ্বাস করেন যে রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ঘটেছে। এবং রাজনীতিক তত্ত্বের অস্তিত্ব অব্যাহত থাকবে কিনা সে বিষয়ে কোব্যান সন্দিহান।

কোব্যানের অভিমত অনুযায়ী পশ্চিমে আড়াই হাজার বছরের অধিককাল ধরে বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত ছিল। এই সময় মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। একে অপরের উপর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সুবাদে উভয়েরই পরিবর্তন ও পরিমার্জন ঘটছিল। কিন্তু এ ধরনের কোন সংশ্লেষণ বা সমন্বয় আধুনিককালের রাজনীতিক তত্ত্বে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিছু কাল ধরে এই প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। কোব্যানের মতানুসারে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে।

রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশের ধারায় সাময়িক বিরতি বা ফাঁক অতীতেও দেখা গেছে। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের রচনার মাধ্যমে গ্রীক রাজনীতিক মতাদর্শ তুঙ্গীভূত হয়। পরবর্তীকালে রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নতা ব্যাহত হয়। তবে অনেকের অভিমত অনুসারে স্বাভাবিক আইনের তত্ত্ব এবং আইনশাস্ত্র সম্পর্কিত রোমান ধারণা রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশের ধারাকে মোটামুটি ভাবে অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কোব্যানের মতানুসারে রোমান সাম্রাজ্যের তুঙ্গী অবস্থায় রাজনীতিক তত্ত্ব সুনিশ্চিতভাবে অনুপস্থিত ছিল। কোব্যান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, আধুনিককালে রাজনীতিক তত্ত্বের অবস্থা রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন আকাঙ্ক্ষাও তিনি প্রকাশ করেছেন যে, এ রকম অবস্থা সুদীর্ঘকাল অব্যাহত থাকলে রাজনীতিক চিন্তার ধারা অচিরেই পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়।

আধুনিককালে রাজনীতিক চিন্তাধারার পথে প্রতিবন্ধকতা করে এমন কিছু বিষয়কে কোব্যান চিহ্নিত করেছেন। এ বিষয়গুলি হল: (১) রাষ্ট্রের ক্রিয়াকর্মের পরিধির অবাধ সম্প্রসারণ, (২) সমাজের সকল ক্রিয়াকর্মের উপর আমলাতন্ত্রের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ এবং (৩) ব্যাপক আকারে সামরিক সংগঠনের সৃষ্টি। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোব্যান বলেছেন যে, পশ্চিমী দেশগুলিতে বা কমিউনিস্ট দেশগুলিতে সামরিক শক্তি অসামরিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পারেনি। এ কথা ঠিক। কিন্তু তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, রোমান সৈন্যবাহিনীও দীর্ঘকাল মোটামুটি গুটিয়েই রেখেছিল।

কোব্যান কমিউনিস্ট দেশগুলির অবস্থা আলাদা ভাবে আলোচনা করেছেন। এই সমস্ত দেশে সর্বশক্তিমান কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত। পার্টির সাংগঠনিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে অল্পসংখ্যক ব্যক্তির শাসন কায়েম হয়। পার্টির প্রধানের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। পার্টির প্রধান অতি আমলা’ (super-bureaucrat) হিসাবে প্রতিপন্ন হন। পার্টির মধ্যে দমন-পীড়নের একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। পার্টির লাইনে আসতে অরাজী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয়। এই দলীয় সংগঠন বা ব্যবস্থা সামরিক সংগঠন বা ব্যবস্থার থেকে কম শক্তিশালী নয়। তবে পটভূমিগত পার্থক্য অনস্বীকার্য।

রাজনীতিক তত্ত্বগত অবস্থার বিচারে গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় পরিস্থিতি, কোব্যানের মতানুসারে একবারে আলাদা নয়। পশ্চিমী দুনিয়ায় প্রাধান্যকারী রাজনীতিক মতাদর্শ হল ‘গণতন্ত্র’। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই রাজনীতিক ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই রাজনীতিক ধারণাকে পরিশীলিত করার কোন চেষ্টা করা হয়নি। গণতন্ত্রের তেমন কোন রাজনীতিক তাত্ত্বিকের দেখা মেলেনি। স্বভাবতই এই সময় গণতন্ত্র কোন সজীব রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি; বিকাশ ঘটেছে জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতি রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের। এ প্রসঙ্গে কোব্যান বলেছেন: “Coins can remain valid currency even when they are worn quite smooth. Political ideas need periodical recoining if they are to retain their value.”

সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কিছু কিছু চিন্তাবিদ চর্চা ও অনুশীলন করেছেন। সমকালীন রাজনীতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। কোব্যান এ ক্ষেত্রে রাসেল (Bertrand Russell), কার (E.H. Carr), ল্যাসওয়েল (Harold Lasswell), মরগেনথাউ (Hans Morgenthau) প্রমুখ রাজনীতিক চিন্তাবিদের নাম করেছেন। কিন্তু এই সমস্ত আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখেছেন এবং প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁরা ন্যায়-নীতি সম্পর্কিত মূল্যবোধকে রাজনীতিক আলোচনার বাইরে রেখেছেন। তারফলে স্বাভাবিকভাবে রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে কোব্যান মন্তব্য করেছেন: “The wretched individual atoms of which society is composed are massed together, hurled violently about, disintegrated by power, which they did not create and cannot control.”

পরবর্তীকালে কোব্যান রাজনীতিক তত্ত্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত তাঁর হতাশাপূর্ণ বক্তব্য কিছুটা বদলেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। অন্তত বর্তমান দুনিয়ার একটি অংশ সম্পর্কে এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যায়। পশ্চিমী দেশগুলিতে সরকারী ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র এখনও সর্বগ্রাসী প্রাধান্যমূলক অবস্থায় উপনীত হতে পারেনি। রাজনীতিক দলসমূহ এখনও আমাদের প্রভু হয়ে উঠেনি। রাজনীতিক দল ও আমলারা এখনও গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে জনস্বার্থের অনুগামী। কোব্যান মন্তব্য করেছেন: “Bureaucracy is not yet the major reality of government in any Western country, nor are pretorian guards or political parties yet our master rather than our servants.”

কোব্যানের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক তত্ত্বের আধুনিক অবক্ষয়ের পিছনে অন্যতম বড় কারণ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের অভাব। অতীতের প্রত্যেক স্বনামধন্য রাষ্ট্রদার্শনিক মাথায় কোন বাস্তব উদ্দেশ্য নিয়ে এবং প্রকৃত রাজনীতিক আচরণকে প্রভাবিত করার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিক বিষয়াদির অনুশীলন করেছেন এবং সে বিষয়ে বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। কোব্যান এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে বার্ক, বোম, মিল, মন্টেস্কু, হবস্, লক্, রুশো, স্পিনোজা প্রমুখ বিশিষ্ট রাষ্ট্রদার্শনিকদের নাম করেছেন। কোব্যান বলেছেন: “(There is) some inherent misdirection in contemporary thinking about politics.”

প্লেটো-অ্যারিস্টটলের সময় থেকে মিল বা মার্কস পর্যন্ত রাজনীতিক তত্ত্ব ছিল মূলত ন্যায়-নীতির অংশ বিশেষ। যথোপযুক্ত সামাজিক বিন্যাস গড়ে তোলার ব্যাপারে অতীতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত অঙ্গীকার ছিল। যা নীতিগতভাবে তাঁরা যথার্থ বলে বিবেচনা করতেন তা প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতেন। সমকালীন রাজনীতিক চিন্তাবিরা রাজনীতিক জীবনের তৎকালীন তথ্যাদির থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতেন না। আগেকার দিনের রাজনীতিক চিন্তাবিদদের ক্রিয়াকর্ম ছিল উদ্দেশ্যমূলক। তাঁরা সমাজের পুনর্গঠন বা পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এসব কিছু অনুপস্থিত। অতীতের রাষ্ট্রদার্শনিকদের সম্পর্কে কোব্যান মন্তব্য করেছেন। “They wrote to condemn or support existing institutions, to justify a political system or persuade their fellow citizens to change it because, in the last resort, they were concerned with the aims, the purposes of political society.” এ ক্ষেত্রে কোব্যানের যৌক্তিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভার্মা (S. P. Varma) তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Cobban would attribute the change in the outlook of political thinkers from passionate commitment to a purpose or an ideal to cold and abstract analysis of political phenomenon in a ‘value free’ unbiassed, objective manner- to the influence of the historical approach, on the one side, and the cultivation of what is regarded as the ‘scientific attitude’ on the other.”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে বিজ্ঞানের উপাদান আছে। একথা ঠিক। সুতরাং অন্যান্য বাহ্য উপাদানসমূহের মত রাজনীতিক বাহ্য উপাদানসমূহেরও বিজ্ঞানসম্মত উপায়পদ্ধতিতে বিচার-বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আজকাল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে সকল পন্থা-পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে অনুসরণ করা সম্ভব ও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের স্মরণ রাখা উচিত যে তাঁদের এমন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, যার জবাব দেওয়া প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পন্থা-পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক পন্থা-পদ্ধতিতে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানার্জন সম্ভব। কিন্তু ঔচিত্য অনৌচিত্যের ভিত্তিতে বিচার-বিবেচনার উপাদান বৈজ্ঞানিক পন্থা-পদ্ধতির সুবাদে পাওয়া যায় না। অথচ রাজনীতিক তত্ত্বের মধ্যে এই বিচার-বিবেচনার বোধ একান্তভাবে অভিপ্রেত। কোব্যানের অভিমত অনুযায়ী ন্যায়-নীতি বা মূল্যবোধ সম্পর্কিত নিস্পৃহতা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে সম্ভব, কিন্তু রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই নিস্পৃহতা অসম্ভব এবং অনেকাংশে অনভিপ্রেত। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহ চমকে দেওয়ার মত প্রযুক্তিগত হাতিয়ার সরবরাহ করতে পারে। এই সমস্ত প্রযুক্তি কোন একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু এই প্রযুক্তিগত পথে কোথায় যেতে হবে তা বোঝা যায় না, বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য এই পথ ব্যবহার করা যায় না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পন্থাপদ্ধতি লক্ষ্য নির্দেশ বা উপায় নির্ধারণ করতে পারে না। কেবল তত্ত্বই এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। কোব্যান অভিযোগ করেছেন যে, যৌক্তিক দৃষ্টবাদীরা এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা রাজনীতিক দর্শনকে হত্যা করেছে, রাজনীতিক দর্শন মৃত। কোব্যান মন্তব্য করেছেন: “(Science) can give us guidance of the greatest possible importance in achieving the objects we want to achieve it cannot help us to decide what objects should be, or even what they are.”

দর্শনকেন্দ্রিক রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় – ডেভিড ইস্টন:

ডেভিড ইস্টন প্রমুখ অত্যাধুনিক চিন্তাবিদদের মতানুসারে প্রাক্-ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শনকেন্দ্রিক রাষ্ট্রতত্ত্বের উপযোগিতা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দর্শনকেন্দ্রিক রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয়ের বিভিন্ন কারণ নির্দেশ করে থাকেন। ইস্টন এই গুরুত্বহানির চারটি কারণ নির্দেশ করেছেন। এই চারটি কারণ হল

  • (১) ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা,
  • (২) ঘটনা ও তথ্যের উপর অতিমাত্রায় ঝোঁক,
  • (৩) বিজ্ঞান ও তথ্যের মধ্যে সম্পর্কজনিত বিভ্রান্তি, এবং
  • (৪) নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ।

ভারমা (S.P. Varma) তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “David Easton ascribes the ‘poverty’, ‘improverishment and ‘decline of political theory’ to contemporary political scientists: (a) living ‘parasitically on ideas a century old’, and (b) failing to develop a new political synthesis.”

(১) ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা – ঐতিহাসিকতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা যদি আগেকার ভাববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাদি আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তা হলে সমকালীন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, তাদের কার্যাবলী, রাজনীতিক আচার-আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে নতুন রাজনীতিক মূল্যবোধ বা তত্ত্বের উদ্ভব হতে পারে না। সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্বের গবেষক ও আলোচকরা প্রাচীনকালের রাজনীতিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। তাঁরা অতীতের প্রচলিত মূল্যবোধের আলোচনায় সামগ্রিকভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন। এই সমস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নতুন কোন রাজনীতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। রাজনীতিক লক্ষ্যের পুনর্বিন্যাসের কাজে মূল্যবোধের ইতিহাসকে পরিমার্জিত করা হয়নি। তার ফলে মূল্যবোধ সম্পর্কিত রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয় সূচীত হয়েছে। ডেভিড ইস্টন, ডানিং Dunning), স্যাবাইন (Sabine), লিন্ডসে (Lindsay), ম্যাকইলওয়েন (Melliwaine) প্রমুখ সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেছেন। ইস্টনের অভিযোগ অনুযায়ী এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অতীতের রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের আলোচনার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং সময় ব্যয় করেছেন। নতুন মূল্যবোধের মতবাদ গড়ে তোলা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারে এদের মধ্যে আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বরং তাঁরা অতীতের ও বর্তমানের রাজনীতিক মূল্যবোধসমূহের বিকাশ ব্যাখ্যার এবং এই সমস্ত মূল্যবোধের অর্থ, অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য সম্পর্কিত তথ্যাদি সমন্বিত করার ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী ও উৎসাহী। ডেভিড ইস্টন সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক তত্ত্ববিদদের চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। এই চারটি শ্রেণী হল

  • (ক) প্রতিষ্ঠানবাদী (Institutionalists), 

  • (খ) মিথষ্ক্রিয়াবাদী (Interactionists), 

  • (গ) বস্তুবাদী (Materialists) এবং 

  • (ঘ) সাম্প্রতিক মূল্যবোধবাদী।

এই সমস্ত সাম্প্রতিককালের সকল রাজনীতিক লেখকদের ‘ইতিহাসবাদী’ (historicists) বলে অভিযুক্ত করেছেন। এই সমস্ত ইতিহাসবিদ রাজনীতিক তত্ত্ববিদরা রাজনীতিক উদ্দেশ্যসমূহের সম্ভাব্য গঠনমূলক পুনর্মূল্যায়নের ব্যাপারে নিজেদের চিন্তাভাবনাকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের ইতিহাসকে উপায় হিসাবে ব্যবহার করেননি। তাঁরা কেবলমাত্র বিশেষ মূল্যবোধ বা ব্যবস্থার মতাদর্শ সৃষ্টিকারী বাস্তব অবস্থা অনুধাবনের উপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের ভূমিকা ঐতিহাসিকদের সঙ্গে খাপ খায়, কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে অনভিপ্রেত।

সফিস্ট ও সক্রেটিসদের থেকে শুরু করে হেগেল ও মার্কস পর্যন্ত, দু’হাজার বছরের অধিককাল ধরে রাজনীতিক চিন্তাবিদ্রা বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্নসমূহের উত্তর অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়েছেন। এই সমস্ত উদ্যোগের উদ্দেশ্য হল সমাজের জন্য কতকগুলি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করা। কেবলমাত্র বিগত বিংশশতাব্দীতে ডেভিড ইস্টন স্পষ্টত প্রতিপন্ন করেছেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ঐতিহাসিকদের ভূমিকা পালন করেছেন; সমকালীন সামাজিক সমস্যাদির সমাধানে আত্মনিয়োগ করেননি। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দু-একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এঁরা হলেন বার্কার, ল্যাস্কি প্রমুখ। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। ডেভিড ইস্টন তাঁর The Decline of Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “This kind of historical analysis has played a major part in destroying the species of mental activity that has prevailed in literate civilizations and which emerges out of universal human needs.”

(২) ঘটনা ও তথ্যের প্রতি অতিমাত্রায় ঝোক – তথ্য-সর্বস্বতা: সাম্প্রতিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকগণ ঘটনা ও তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তাই তাঁরা নতুন কোন রাষ্ট্রনীতিক তত্ত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংগৃহীত তথ্যাদিকে ব্যবহার করতে পারেননি। কিন্তু কেবল তথ্য সংগ্রহ করলেই তত্ত্ব গড়ে উঠতে পারে না। অথচ তত্ত্ব ব্যতিরেকে তথ্য হল অর্থহীন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষকরা অর্থবহ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। ডেভিড ইস্টন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “… theory without facts may be a well-piloted ship with an unsound keel. But where preoccupation with fact-gathering syphons away energy from seeing the facts. in their theoretical significance, then the uttimate value of factual research itself may well be lost.”

ডেভিড ইস্টনের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সুদীর্ঘকাল ধরে ঘটনাবলী ও তথ্যাদির প্রতি অতিমাত্রায় ঝোঁক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই বিংশ শতাব্দীতেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই প্রবণতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনমত, নির্বাচনী আচরণ, সংসদীয় নেতৃত্ব প্রভৃতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে জটিল প্রকৃতির বিভিন্ন উপায়-পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু তাঁরা তাঁদের গবেষণামূলক সমীক্ষাসমূহকে কোন তাত্ত্বিক মান বা মাত্রা প্রদান করতে পারেননি। তথ্য-সর্বস্ব এই অবস্থায় তাত্ত্বিক আলোচনা প্রবল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থাটিকে ইস্টন বলেছেন: “Theoretical mal-nutrition and surfeit of facts.”

(৩) বিজ্ঞান ও তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্কিত বিভ্রান্তি – বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই তত্ত্ব গড়ে উঠে না: প্রচলিত ধারণা হল বিজ্ঞান ও তত্ত্ব এক। বাস্তবে তা সঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ এবং গবেষণার ভিত্তিতে তত্ত্ব সৃষ্টি সমার্থক নয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কোন বিষয়ে তথ্য আহরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেন বটে, কিন্তু ঘটনার পিছনে যে সকল কারণ ক্রিয়াশীল থাকে সেগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। এই কারণে ইস্টন তাত্ত্বিক অনুমান (theoretical hypothesis)-কে ভিত্তি করে তথ্য আহরণের কথা বলেছেন। কোন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই গবেষণার মাধ্যমে তত্ত্ব গড়ে উঠবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞান ও তত্ত্বকে নিয়ে ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রচলিত আছে। সমার্থকভাবে প্রয়োগ করা হলেও, বিজ্ঞান ও তত্ত্বের সমার্থক প্রয়োগ বিভ্রান্তিকর। মনে রাখা দরকার যে, তত্ত্ব বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে যেতে পারে। গবেষণার কাজে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা ঠিক। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা মানেই নতুন একটি তত্ত্বের উদ্ভব এমন কথা বোঝায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সাধারণত তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং সংগৃহীত তথ্যাদির আলোকে বিভিন্ন রাজনীতিক কাঠামো ও প্রক্রিয়াসমূহের উন্নয়নের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এই উদ্যোগ সম্যকভাবে বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে। কিন্তু এই পথে আপনা-আপনি কোন তত্ত্বের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। তারজন্য রাজনীতিক জীবনের মুখ্য পরিবর্তনীয়সমূহকে চিহ্নিত করা দরকার এবং সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনীয়সমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা দরকার।

মেরিয়াম, ল্যাসওয়েল, সাইমন, ফ্রেডারিক প্রমুখ কয়েক জনের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আগ্রহ সচেতনভাবে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানের আলোচনা থেকে প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্যের আলোচনায়। এ ক্ষেত্রে সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য। রাজনীতির আলোচনায় উপযুক্ত একটি ধারাণগত কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে আগ্রহের ও উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রক্রিয়া (process) ও প্রেষণা ( motivation) -র আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ; প্রতিষ্ঠানের আলোচনার থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু এ পথে রাজনীতিক তত্ত্ব গড়ে উঠতে পারে না। ভার্মা (S. P. Varma) তাঁর Mode Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “The beheviouralists have unanimously advocated the importance of what is, but they have hardly cared to find out why or how what it is. Here comes the role of theory.”

(৪) নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ – মূল্যবোধহীনতা: নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদে রাজনীতিক গবেষণাকে পুরোপুরি মূল্যমান-নিরপেক্ষ করার চেষ্টা করা হয়। রাজনীতিক ঘটনার পর্যালোচনায় মূল্যবোধকে পরিহার করার কথা বলা হয়। ওয়েবার (Max Weber) রাজনীতিক মূল্যবোধের আওতা থেকে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণাকে মুক্ত করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। হিউম (Hume)-এর মতবাদেই এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেওয়ার বিষয়টিকে অনেকে সমর্থন করেন না। ম্যানহেইম (Karl Mannheim) -এর অভিমত অনুসারে মানুষের ব্যক্তিত্বের অপরিহার্য একটি অংশ হল মূল্যবোধ। একে পরিহার করা সহজ নয়। ইস্টন কিন্তু মূল্যবোধ সম্পর্কিত আলোচনাকে পুরোপুরি পরিহারের পক্ষপাতী নন। তাঁর মতানুসারে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহের প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি মূল্যবোধের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তা হলে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের অবনয়ন আটকান যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মূল্যবোধ কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করেন না; মূল্যবোধ গড়ে তোলেনও। কোন সমাজবিজ্ঞানী সমকালীন সামাজিক সমস্যাসমূহের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে ইস্টনের বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভার্মা বলেছেন: “If a social scientist carried on his research in an environment which was hermatically sealed from all value influences, there was always the danger that he might spend his time in dealing with problems which hardly had any relevance for society.” ইস্টনের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সমাজের আশু সমস্যাদি এবং উদ্ভূত সামাজিক প্রয়োজনসমূহের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহ দেখাতে হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি বাস্তবধর্মী মূল্যবোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উদ্যোগী হতে হবে। ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System, An Inquiry into the State of Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Creative political theory in the past was engaged in the task of attempting to organize for each age its own conceptions of its own needs of linking knowledge of political facts to political goals.” ভার্মা (S. P. Varma) তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “In Easton’s view it is not only the neglect of the value theory as a creative activity, and its substitution by ‘historicism’, but also the indifference to causal, or systematic, empirically oriented, theory about political behaviour, which has led to the decline of political theory.”

(৫) পরিবর্তিত অবস্থা: অ্যালফ্রেড কোব্যান প্রমুখ লেখকের মতানুসারে আমলাতন্ত্রের গুরুত্বের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সামরিক বাহিনীর ভূমিকার তাৎপর্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের ব্যাপক বিস্তার প্রভৃতি কারণে রাজনীতির পরিধি অতিমাত্রায় প্রসারিত হয়েছে। আবার রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা ও পরস্পর বিরোধী মতামত সৃষ্টি–এই সমস্ত কারণে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্ব নষ্ট হয়েছে।

(৬) এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যহীনতাও অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। 

(৭) রাজনীতিক তত্ত্বের অবক্ষয়ের কারণ হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে পাশ্চাত্যে তাৎপর্যপূর্ণ কোন রাজনীতিক পরিবর্তনের অভাব, সামাজিক বিজ্ঞানে দৃষ্টিবাদের প্রভাব প্রভৃতির কথাও বলা হয়।