উত্তর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [১৮৬১-১৯৪১] রচনার আশ্রয়েই বাংলা ছোটোগল্প প্রথম পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে; পেয়েছে শিল্পীর জীবনদৃষ্টি এক অনাবিষ্কৃত পূর্ব জগতে প্রথম প্রবেশাধিকার। রবীন্দ্রনাথের হাতেই সর্বপ্রথম বাংলা ছোটোগল্পের সার্থক প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। তিনিই ছোটোগল্পের সার্থক সৃষ্টিকার। শুধু শিল্প সৃষ্টি হিসেবেই নয় বাঙালির বাস্তব জীবনের আশা- আকাঙ্ক্ষার, আনন্দবেদনার, দুঃখদুর্দশার প্রতিচ্ছবি হিসেবে গল্পগুচ্ছ বাঙালির এক উজ্জ্বল সাহিত্য সম্পদ। আমাদের এই ব্যাহত তুচ্ছ ও আপাত অকিঞ্চিৎকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুজল ভাবঘন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথই প্রথম আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে গল্পগুচ্ছ সেসব ধারণ করে বাঙালি পাঠকের দৃষ্টি সম্মুখে মেলে ধরেছেন।
সময়ের ব্যবধানে রবীন্দ্র ছোটোগল্পের শিল্পরীতির পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটেছে- তেমনি নারী চরিত্রগুলোও বিকাশ- পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এসব বিচেনায় গল্পগুলোকে ৩টি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- ক. ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত গল্পসমূহ [১৮৯১-১৯০০]; খ. বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১ম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী গল্পসমূহ [১৯০১-১৯১৩] এবং গ. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর গল্পসমূহ [১৯১৪-১৯৩৩]।
১ম পর্যায় (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী কাল): এই পর্যায়ের গল্পগুলো পদ্মাতীরে সাধারণ মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে রচিত। এই সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে আবেগ, অভিমান, আত্মবলিদান প্রাধান্য পেয়েছে। এতে মৌল বিষয় ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের নিবিড়-আত্মিক সম্পর্ক, মানব হৃদয়ের রহস্য উন্মোচন। এখানে রবীন্দ্রনাথ সংগীত ও সাংকেতিক মূর্ছনায় গল্পের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গল্পের প্রধান বিষয় নয়। এ পর্বের গল্পের নারীরা চিরায়ত নারী সত্তায় উজ্জীবিত। এরা যুক্তিশীলতা ও মননশীলতার চেয়ে হৃদয়াবেগকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এক্ষেত্রে নারীরা আকাঙ্ক্ষা করে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিঃসঙ্গতার মধ্যে পতিত হয়েছে। অথচ নিঃসঙ্গতা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেনি। এই পর্যায়ে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কঙ্কাল’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘সুভা’, ‘মহামায়া’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘শাস্তি’, ‘সমাপ্তি’, ‘নিশীথে’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘দিদি’, ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নিম্নে এই পর্বের নারী চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করা হলো :
পোস্টমাস্টার : ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পল্লিকেন্দ্রিক মানুষের হৃদয় সংকট দেখানো হয়েছে। রতন এবং ‘পোস্টমাস্টার’ উভয়ই নিঃসঙ্গ ছিল তাই তাদের মধ্যে হৃদয়গতভাবে মিলন ঘটে। রতনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ছিল কল্পনার মধ্য দিয়ে পোস্টমাস্টারের সাথে মিশে যাওয়া । কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি বলেই আশা ভঙ্গে বেদনায় জর্জরিত হয়েছে তার হৃদয়। রতন পোস্টমাস্টারের সাথে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আবেদন করলে পোস্টমাস্টার তার জবাবে বলেন, “সে কী করে হবে।” পোস্টমাস্টারের এই ছোট উক্তিটি রতনের জীবনে নিয়ে আসে চরম ব্যর্থতা । । লেখক রতনের নারী হৃদয়ের যে কান্না তা প্রকাশ করেছেন প্রকৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে। । যেমন-
“মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের, জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”
এখানে রতনের হৃদয়ের অন্তর্বেদনার স্বরূপ নির্দেশিত হয়েছে।
কঙ্কাল: একজন বিধবা নারীর প্রণয়ের আকাঙ্ক্ষা দাম্পত্য জীবনের আকাঙ্ক্ষা কীভাবে সামাজিক বিধি, নিয়মরীতি দ্বারা অবদমিত হয় তারই ভাষা তৈরি করেছেন কঙ্কালের মধ্য দিয়ে। কনকচাঁপা পরিপূর্ণ যৌবনা। নিটোল দেহ তার, বড় বড় টানা দুটি কালো চোখ ছিল তার, রাঙা ঠোঁট ছিল তার। যৌবনের কঠিন কোমল পরিপূর্ণ নিটোল দেহ যেন প্রতিদিন বিকশিত হতো। তার মধ্যে জৈবিক ও সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে নিঃসঙ্গ জীবনে একজন পুরুষকে কামনা করতো কিন্তু বাস্তবে কোনো পুরুষের সাথে তার বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। আপন সৌন্দর্যে কনকচাঁপা অনেক পুরুষকে জয় করতে পারে। কিন্তু সামাজিকতা তার জীবনে সে সুযোগ আসতে দেয়নি। অনিবার্য কারণে শশিশেখর নামের একজন ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কনকচাঁপার। কনকচাঁপার সাথে শশিশেখরের হৃদয়গত যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, সামাজিক বাস্তবতার কারণে সে সম্পর্ক পরাজিত হয়-হয় অবহেলিত। অবহেলা সেই পরাজয় কনকচাঁপাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
“আমি একটি বারাসী শাড়ি পরিলাম; যতগুলি গহনা সিন্দুকে তোলা ছিল সবগুলি বাহির করিয়া পরিলাম; সিঁথিতে বড় করিয়া সিঁদুর দিলাম। আমার সেই বকুলতলায় বিছানা পাতিলাম….. জ্যোৎস্না যখন অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল, এই তরুপল্লব এবং আকাশ এবং আজন্মকালের ঘরদুয়ার লইয়া পৃথিবী যখন আমার চারদিক হইতে মায়ার মতো মিলাইয়া যাইতে লাগিল, তখন আমি নেত্র নির্মীলন করিয়া হাসিলাম।”
কনকচাঁপা নারীগতভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তার মধ্যে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল কিন্তু প্রথাগত সমাজ তার সে প্রত্যাশাপূরণে বাধার সৃষ্টি করে।
দেনাপাওনাঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা কীভাবে শোষিত হচ্ছিল তারই চিত্র এ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। পণ প্রথার কুফল নিরীহ নারী নিরুপমার জীবনকে বিষময় করে তোলে নিরুপমার মনেও নারী জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন- “আমি কি কেবলি একটা টাকার থলি যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম।” অবশ্যই নিরুপমা নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু সেই নির্যাতনের মধ্যেও আপনা দরিদ্র পিতাকে সে যে পণের টাকা শোধ করতে দেয়নি এতেই তার নারী জীবনের মর্যাদা সংক্রান্ত প্রশ্নটি অন্তত অপরাজিত মহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
নারীর মূল্য সম্পর্কে প্রাচীন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে দুটি গল্পে অত্যন্ত স্পষ্টরূপে। ‘সম্পত্তি’ সমর্পণ এর মধ্যে স্ত্রীর চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশ্নে যখন বাপের সঙ্গে বৃন্দাবন কুণ্ডের বিচ্ছেদ ঘটল তখন গ্রামবাসী বৃন্দাবনের নিন্দা করে বলেছিল “সামান্য একটা বউয়ের জন্য বাপের সহিত বিবাদ করা কেবল একালেই সম্ভব।”
শাস্তি : ‘শাস্তি’ গল্পে চন্দরার মধ্যে লেখক এক মর্যাদা সচেতন নারীকে তুলে ধরেছেন, পুরুষের স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে এক জীবন্ত প্রতিবাদ চন্দরা। সে ফাঁসির রজ্জুকে স্বেচ্ছায় আপন গলায় ধারণ করেছে এটাও একটা বিদ্রোহ, বিদ্রোহ তার স্বার্থপর স্বামীর মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে। প্রথম থেকেই চন্দরা নিজের মূল্য বিধি সম্পর্কে সচেতন, মানুষ হিসেবে তার স্বামীর চেয়ে তার অধিকার কোনো অংশে যে কম এটা সে স্বীকার করে না। তার স্বামী কাজের অছিলায় যখন বাইরে রাত কাটাতে শুরু করেছে তখন সেও “পাড়া পর্যটন করিয়া আসিয়া কাশী মজুমদারের মেজো ছেলেটির প্রচুর ব্যাখ্যা করিতে লাগিল।” চন্দরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির আকাঙ্ক্ষা বা আকুতি বাংলা সাহিত্যে প্রথম তুলে ধরেছেন।
মহামায়া : ‘মহামায়া’ গল্পে মহামায়া পুরুষশাসিত সমাজে হিন্দুধর্মের প্রথা সহমরণের শিকার। তবে সে সাহসী ও সতী, তাইতো ভাইয়ের সামনেই বলেছিল, “আমি তোমার ঘরেই যাইব; অপেক্ষা করিও” এবং হৃদয়ের ভালোবাসার টানে অবশেষে রাজীবের ঘরে গিয়েছিল কিন্তু ভীতু রাজীবলোচনের প্রতি চরম বিদ্রোহ প্রকাশ করে চিরদিনের মতো গৃহ ত্যাগও করেছে। যদিও এখানে মহামায়ার হৃদয়ের বলিষ্ঠভাব প্রকাশ না পেয়ে হৃদয়ের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তথাপি তার নীরব প্রতিবাদ পুরুষের ভীরুতাকে কটাক্ষ করেছে।”
‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের হরসুন্দরী এক হিসেবে মহামায়া সমগোত্রীয়া। নারীর তীব্র আত্ম-অহমিকা, মহামায়ার মধ্যে যেমন তেমনি হরসুন্দরীর মধ্যেও। স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা হরসুন্দরীর মনে সেই দীপ্ত অহমিকার জন্ম দিয়েছে যার তেজে স্বচ্ছন্দের সে সংসারে সতিন নিয়ে আসার প্রস্তাব পর্যন্ত স্বামীকে দিতে পেরেছে।
সুভা : ‘সুভা’ গল্পে লেখক আমাদের সাহিত্যে মানুষের মনোরাজ্যের একটি নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেছেন। মূক বালিকা সুভার বেদনা সংসারে কোথাও এতটুকু করুণা সহানুভূতির স্পর্শ সিঞ্চিত হয়নি। আমাদের দৈনান্দিন জীবনের ভাষা থেকে বঞ্চিত হয়ে সুভা তার নিঃসঙ্গ জীবনের প্রকৃতির কাছে আশ্রয় নেয়। “প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়” নানা স্বার্থপরতা ও সমাজচিন্তা নিয়ে ব্যস্ত মানুষ তাকে বুঝতে পারে না। কেননা ভাষাবিহীনাকে বুঝতে গেলে যে হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয়- সেই হৃদয় সম্পদের অধিকারী আমরা অনেকেই নয়। তাই তো সুভাকে বাদ দিয়ে তার স্বামী” “চক্ষু এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়া এক ভাষা বিশিষ্ট কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল।”
জীবিত ও মৃত : ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কাদম্বিনী কতকগুলো অন্ধ কুসংস্কারের বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে নিজের প্রত্যক্ষ জীবনকেও সত্য বলে ভাবতে পারছিল না। শ্মশানে গিয়ে আবার সে কাদম্বিনী বেঁচে উঠল সেটা কোনো ভৌতিক মায়া-মরীচিকার ব্যাপার নয় অত্যন্ত সত্য। সই যোগমায়ার বাড়িতে এসেও কাদম্বিনী “সইয়ের সঙ্গে মিশিতে পারিল না- মাঝে যেন মৃত্যুর ব্যবধান।”
কাদম্বিনী বাস্তবিকই বেঁচে থাকে কিন্তু তার অন্ধবিশ্বাসের কাছে সে মৃত এবং তার ধারণায় সে এখন তার প্রেতাত্মা। শেষ পর্যায়ে কাদম্বিনী মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেল এবং প্রমাণ করলো ‘সে মরে নাই।’ কাদম্বিনীর মধ্যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ছিল কিন্তু এই সমাজ, এই সমাজের মানুষ তাকে বাঁচতে দেয়নি।
দিদি: নারী মাত্রেই পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে আত্মসমর্পণ করবে- এর তুমুল প্রতিবাদ ‘দিদি’ গল্প। এই গল্পের শশীর মধ্যে নারী ব্যক্তিত্বের বিশেষ একটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়। গিরিবালার মতোই স্বামীর বিরুদ্ধে হলেও আপন মর্যাদা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দিদি গল্পের শশী। ন্যায়ের সপক্ষে নারীর আত্মচেতনা এই গল্পে লক্ষ্য করা যায়।
এই পর্বের গল্পগুলোর মধ্যে ‘নষ্টনীড়ে’ নারী স্বাতন্ত্র্য কিছুটা হলেও চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গ্রামকেন্দ্রিক জীবন ছেড়ে শহরকেন্দ্রিক জীবনে পা দিয়েছে। চারুলতা হাজার বছরের সনাতন স্বামী আইডিয়াকে ভেঙে পরপুরুষের সঙ্গে নিষিদ্ধ সম্পর্কে উপনীত হলেও লেখক অমলকে বিলেতে পাঠিয়ে সমাজের মুখ রক্ষা করেছেন। এই গল্পে পুরুষের চেয়ে নারীর চাওয়াপাওয়া অনেক অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের এ পর্যায়ের গল্পগুলোতে নারী চরিত্রগুলো নিজেকে ব্যক্ত করার চেয়ে প্রচ্ছন্ন রাখতেই বেশি উদগ্রীব। ‘একরাত্রি’ গল্পের সুরবালা, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন, ‘কঙ্কাল’ গল্পের কনকচাঁপা ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের হরসুন্দরী, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের গিরিবালা প্রভৃতি গল্পে তাদের নারী ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে অধিকার আদায় করে নিতে পারেনি। তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এই পর্যায়ের যে সবকটি চরিত্রই অবদমিত হয়েছে • তা. নয় এই পর্যায়ের বেশকিছু চরিত্র ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয় পর্যায় (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তরকাল) : ‘হালদার গোষ্ঠী’ (১৮৯৪) থেকে ‘ল্যাবরেটরি’ (১৯৪০) পর্যন্ত মোট আঠারোটি গল্প এ পর্যায়ে রচিত। এর প্রায় অধিকাংশগুলো সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত। এতে কলকাতাকেন্দ্রিক নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র রূপায়িত হয়েছে। এ পর্বে রবীন্দ্রনাথ রোম্যান্টিকতার মোহময় জগৎ ছেড়ে পা রেখেছেন, বাস্তবের কঠিন মাটিতে। এখানে হৃদয়াবেগের চেয়ে মনোবিকলন, গতির চেয়ে বিকৃতি এবং গীতময়তার চেয়ে বিশ্লেষণ সমধিক স্থান পেয়েছে।
গল্পগুচ্ছের এ পর্যায়ের চরিত্রগুলো শাহুরিক উচ্চ শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক, সংস্কারমুক্ত, বাস্তববাদী এবং আত্মসচেতন। অনেক বেশি মননশীলতা ও ব্যক্তিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং অতি আধুনিক। পুরুষ চরিত্র থেকে এ পর্বের নারী চরিত্রগুলো অনেক বেশি সক্রিয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ‘এবং প্রথম পর্যায়ের আবেগকে পরিহার করে যুক্তির কাছাকাছি এসেছে এক্ষেত্রে নারী চরিত্রগুলোকে হৃদয়গতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং সব নারীই প্রথাগত কাঠামো থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের গল্পগুলোকে নারী চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. স্ত্রীর পত্র, বোষ্টমী, হৈমন্তী, পয়লানম্বর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে নারী চরিত্রগুলো সংগ্রাম করেছে এবং প্রথাগত সমাজ থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
২. ল্যাবরেটরি, রবিবার, শেষকথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে নারী চরিত্রগুলো সংগ্রাম করেছে এবং জয়ী হয়েছে। নিচে এ পর্যায়ের গল্পগুলোর নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করা হলো:
বিশ শতকের নারী ব্যক্তিত্বের প্রথম প্রতিবাদ ‘স্ত্রীর পত্র’। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের মধ্যে যে চরিত্রটি নারী ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও স্পষ্ট তাহলো ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের নায়িকা মৃণাল। পনেরো বছরে পত্নী জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক গ্লানি স্বীকার করে অনেক দুঃখকষ্ট সয়ে মৃণাল বুঝেছে যে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ পত্নীতে নয়, নারীত্বে। তার চিঠিতে স্বামীর প্রতি সম্বোধন ছিল তোমার। অর্থাৎ তার অভিযোগ ও বিদ্রোহ শুদ্ স্বামীর প্রতি ছিল না, ছিল তৎকালীন স্বার্থপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের প্রতি। মৃণালের ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। মৃণালের শিক্ষা মেধা বুদ্ধিবৃত্তি ছিল উচ্চস্তরের ফলে, হৃদয়বৃত্তিকে পদদলিত করে ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে গতানুগতিক স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ঘর করা সম্ভব হয়নি, অপরপক্ষে বিন্দু নামটির মধ্য দিয়েই তার অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীর অবস্থান জটিল সেটা মৃণাল চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং বিন্দু চরিত্রটি সেটাকে আরো একটুখানি অগ্রগতি সাধন করেছে। বিন্দু মৃণালের চেতনায় জ্বেলে দিয়েছে মুক্তির আলো। নারী জাতির প্রতি অমানবিক আচরণে জ্বলে উঠেছে মৃণাল আপন সত্তায়। মৃণালের বড়জা বিন্দুর বড় বোন একটি প্রথাগত চরিত্র। বিন্দুকে আমরা দেখেছি আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে, মৃণাল তাঁকে আশ্রয় দিতে চায় কিন্তু মৃণাল ব্যর্থ হয় এখানেই বিন্দুর চরিত্রের ট্র্যাজেডি।
রবীন্দ্রনাথ তার ব্যক্তিসত্তার মধ্য দিয়ে একজন সমাজ পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তৎকালীন উনিশ শতকে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের সংস্কারাচ্ছন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপটকে ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর জীবন প্রবাহের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। হৈমন্তী হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের নিষ্ঠুর যৌতুক প্রথার শিকার। তার সামগ্রিক কার্যকলাপে আদর্শ মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, নৈতিকতা সত্যতা সর্বোপরি ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়- যা তাকে ব্যতিক্রমী ও স্বাতন্ত্র্য নারীরূপে চিহ্নিত করে। হৈমন্তী নারী চরিত্র হিসেবে বেশি বাস্তববাদী। এখানে রবীন্দ্রনাথ রক্ষণশীল সমাজপ্রথার বিরুদ্ধে নারীর নীরব প্রতিবাদ শিল্পিত করে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
ব্যক্তিগত বোধ নয়, ধর্ম নয় তার ঊর্ধ্বে উঠে এসে নারী কিছু করতে চায়; তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের মধ্য দিয়ে। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ পর্যায়ে লেখা হওয়া সত্ত্বেও তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। একমুখী পতিভক্তি স্মৃতি লালিত্য বৈধব্য, প্রেমের মুক্তি বিষয়ক সনাতন মূল্যবোধর বিরুদ্ধে আধুনিক নারী ব্যক্তি মহিমায় ভাস্বর এই গল্প। নারীত্বের একজন যোগ্যতম প্রতিনিধি হচ্ছে সোহিনী। সোহিনী চরিত্র কুসংস্কারমুক্ত নির্জন নারীত্বে সমুজ্জ্বল। নীলার সাথে তার ব্যবহার মাতৃত্বজনিত নয়। একে তিনি ব্যবহার করেছেন আপন ব্যক্তিত্বের অস্ত্ররূপে। ল্যাবরেটরি রক্ষার জন্য সে আধুনিক সতীধর্ম পালন করেছে আপন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। সোহিনীর ভাষায় জীবনে আমার স্বামীর ল্যাবরেটরি ছিল একমাত্র আনন্দ। সোহিনীর চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে সতীত্ব অপেক্ষা পুণ্যতর হচ্ছে আদর্শ। কোনো নারী সতী না হলেও মনুষত্বের ঐশ্বর্যে ভূষিত হতে পারে। মোটকথা, নারী ব্যক্তিত্বের পাশ্চাত্য প্রভাব এখানে লক্ষণীয়।
‘রবিবার’ গল্পে বিভা চরিত্রটি আধুনিকতার শিক্ষিতা, আপন স্বাধীন চেতনায় ব্যক্তিত্বময়ী, দৃঢ়চেতা এবং ভারতীয় সম্ভ্রম এবং স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। তাই বিভা কখনো নিজের বিশ্বাস ভেঙ্গে অভিকের নাস্তিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। তাই তো তার কণ্ঠে শোনা যায়।
“যা পারিনে তার দুঃখ রইল আমার চিরদিন যতটুকু দিতে পারি তার সুখ থেকে কেন আমাকে বঞ্চিত করবে। ” এতে তাঁর স্বাধীনচেতা ও মুক্ত স্বাতন্ত্র্য নারী মহিমা প্রকাশ পায়।
‘শেষ কথা’ গল্পটিতে রবিবার ও ল্যাবরেটরি গল্পের মতো নারীর জয় ঘোষণা করা হয়েছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুর্জোয়া সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে এবং তার সংকটকে ঠিকই বুঝেছিলেন এবং শুধু তাই না পাশ্চাত্যের সংকট যে প্রাচ্যের তুলনীয় তীব্র তাও বুঝেছিলেন। । সেই বোধে শিক্ষিত ও শিল্পিত প্রকাশ ব্যক্তিত্বময়ী নারী বিদ্রোহ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা হলো বুর্জোয়া সমাজের প্রতিনিধি কিন্তু তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রচলিত সমাজের বিরুদ্ধে নারীরা নীরব প্রতিবাদ করেছে। কখনো এ প্রতিবাদ হয়েছে সরব কখনো নীরব। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি রেনেসাঁসের অগ্রদূত হয়ে তার সাহসী কলমে তার প্রাণ চাঞ্চল্য পাহাড়ি স্রোতের মতো দুর্বার হয়ে উঠেছে। তিনি ক্রমে ক্রমে অত্যন্ত সুচারুরূপে নারী চরিত্রের ঔজ্জ্বল্যতা ছড়িয়েছেন।
Leave a comment