অথবা, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবন চিত্রিত হয়েছে – আলোচনা কর

উত্তর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [১৮৬১-১৯৪১] রচনার বাংলা ছোটোগল্প প্রথম পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে; পেয়েছে শিল্পীরাই জীবনদৃষ্টি এক অনাবিষ্কৃত পূর্ব জগতে প্রথম প্রবেশাধিকার। রবীন্দ্রনাথের হাতেই সর্বপ্রথম বাংলা ছোটোগল্পের সার্থক প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। তিনিই ছোটোগল্পের সার্থক সৃষ্টিকার। শুধু শিল্প সৃষ্টি হিসেবেই নয় বাঙালির বাস্তব জীবনের আশা- আকাঙ্ক্ষার, আনন্দবেদনার, দুঃখদুর্দশার প্রতিচ্ছবি হিসেবে গল্পগুচ্ছ বাঙালির এক উজ্জ্বল সাহিত্য সম্পদ। আমাদের এই ব্যাহত তুচ্ছ ও আপাত অকিঞ্চিৎকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুজল ভাবঘন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথই প্রথম আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে গল্প গুচ্ছ সেসব ধারণ করে বাঙালি পাঠকের দৃষ্টি সম্মুখে মেলে ধরেছেন।

সময়ের ব্যবধানে রবীন্দ্র ছোটোগল্পের শিল্পরীতির পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটেছে। প্রকাশকাল এবং চরিত্রবিকাশের লক্ষণের দিক থেকে রবীন্দ্র ছোটোগল্পকে ৩টি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- ক. ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত গল্পসমূহ [১৮৯১-১৯০০]; খ. বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১ম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী গল্পসমূহ [১৯০১- ১৯১৩] এবং গ. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর গল্পসমূহ [১৯১৪-১৯৩৩]।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গল্পগুচ্ছ”-এর প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলো গ্রামকেন্দ্রিক- পরিচর্যা হিসেবে প্রকৃতির নিবিড় ব্যবহার করেছেন। ২য় পর্বের গল্পগুলো শহর অভিমুখী; এ পর্যায়ের গল্পে আবেগী পরিচর্যার পরিবর্তে লেখক বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যা বেছে নিয়েছেন মানুষের হৃদয় সংকট বুঝাতে। এসব গল্পে মনন বিশ্লেষণের দিক দৃষ্টি দিয়েছেন লেখক। ৩য় পর্যায়ে গল্পগুলো আধুনিক জীবনযন্ত্রণার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। ৩য় পর্বের গল্পগুলোকে টেকনিক প্রধান গল্প বলা যায়। সেই নতুন টেকনিকের হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক মূল সমস্যা এর প্রধান বিষয়বস্তু হয়েছে। তবে তিন জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মধ্যবিত্ত সমাজ এবং মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে অভিজাত শ্রেণির হলেও নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ নিয়ে তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা কম নয়। বিভিন্ন গল্পগুলোতে আমরা এসমস্ত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আনন্দ-বেদনার চিত্র প্রত্যক্ষ করি। যেমন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টার মধ্যবিত্ত নাগরিক চরিত্র। সে গ্রামে এসে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। পল্লির জীবনের সাথে সে মিশতে পারে না। মধ্যবিত্ত নাগরিক মানসিকতার জন্য। নিঃসঙ্গতা হেতু অদ্ভুত এক জটিলতা সৃষ্টি হয় তার মনোজগতে। উলাপুর গ্রামের গৃহহীন-উন্মীলিত বালিকা রতনের নিঃসঙ্গ হৃদয়ের সাথে পোস্টমাস্টারের নিঃসঙ্গ হৃদয়ের একটা মিলন ঘটে। বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে এটি পল্লিকেন্দ্রিক এবং নগর থেকে আগত মানুষের হৃদয় সংকট, নিঃসঙ্গতা চিত্রিত হয়েছে। একটি হৃদয় আর একটি হৃদয়কে মানবিক দিক থেকে স্পর্শ করলেও সামাজিক বাস্তবতার কারণে সেটি মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। এ গল্পে পোস্টমাস্টার এবং রতনের নিঃসঙ্গতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দু’জনের বাস্তবতাও দু’ধরনের। পোস্টমাস্টার মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক জীবনের অধিবাসী। তার পরিবার রয়েছে, রয়েছে সামাজিক মর্যাদা অন্যদিকে রতনের অর্থনৈতিক অবস্থান শূন্য। পরিবার এবং সামাজিক আশ্রয়বিহীন সে। পোস্টমাস্টারের ভাবনা তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া, তার নাগরিক অবস্থানে ফিরে যাওয়া আর রতনের ভাবনা একটি পরিবারে প্রবেশ করা, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা। তাই রতন পোস্টমাস্টারের পরিবারকে নিজের পরিবার বলে মনে করেছে কল্পনায়। এবং সেজন্যই রতন পোস্টমাস্টার এর সাথে তাদের বাড়িতে যেতে চেয়েছে।

পোস্টমাস্টার রতনের সাথে তার পরিবারের কথা বললেও সবসময় একটা ব্যবধান রেখে চলেছে। পোস্টমাস্টারের অসুস্থতার সময় রতন তার ঘরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল, কিন্তু সেরে উঠার পরই তার সে অধিকার লুপ্ত হয়। তা খুবই ভয়াবহ হয়ে রতনের বুকে বিধেছিল।

“রোগসেবা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রতন দ্বারের বাহিরে আবার তাহার স্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু পূর্ববৎ আর তাহাকে ডাক পড়ে না। মাঝে মাঝে দেখে… রতন যখন আহবান প্রত্যাশা করিয়া বসিয়া আছে, তিনি তখন অধীর চিত্তে তাহার দরখাস্তের উত্তর প্রতীক্ষা করিতেছেন।”

পোস্টমাস্টারের বদলির দরখাস্ত না-মঞ্জুর হলে সে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বদলির আদেশ আসে কলকাতা থেকে। পোস্টমাস্টারের বাড়ি ফিরে যাবার কথা শুনে বালিকা রতন হৃদয়ে গভীর ক্ষত অনুভব করে। সে বেঁচে থাকার অবলম্বন পোস্টমাস্টারকে কেন্দ্র করে সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। পোস্টমাস্টারের ফিরে যাবার কথা শুনে সে নিস্তব্ধ হয়ে যায়-

“অনেক্ষণ আর কেহ কোন কথা কহিল না। মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”

রতন পোস্টমাস্টারের সাথে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আবেদন করে। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার জন্য তাকে নেয়া সম্ভব নয় বলে সে হেসেছে। বালিকা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল- “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?” পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে।” ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বোঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না।”

এ গল্পে লেখক মধ্যবিত্ত নাগরিক মানসিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। পোস্টমাস্টারের মধ্য দিয়ে আর সমাজ, পরিবার উন্মুলিতা বা আশ্রয়হীন একজন বালিকা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়াস বর্ণনা করেছেন রতনের মধ্য দিয়ে। পোস্টমাস্টার বাস্তব কারণে কলকাতার বাড়িতে ফিরে গেল আর রতন সেই উলাপুর গ্রামেই নিরাশ্রয়তার মধ্যেই পড়ে রইল।

‘একরাত্রি’ গল্পের নামহীন [সেকেন্ড মাস্টার] নায়ক আর • সুরবালা প্রতিবেশী- এ চরিত্রটিও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। সুরবালার সাথে এক সঙ্গে পাঠশালায় পড়া এবং বউ বউ খেলা ছিল তাদের দৈনন্দিন কাজ। গ্রামের এক ব্যক্তির দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে নায়ক ভাবল জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া শিখে আদালতের নাজির বা হেডক্লার্ক হওয়া। কিন্তু কলকাতায় এসে জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন করে রাজনীতির সাথে সক্রিয় হয়ে উঠে। এ সময় সুরবালার বাবা এবং নায়কের বাবা তাদের বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু নায়ক তাতে সম্মতি না দিলে তার বিয়ে হয় উকিল রামলোচন বাবুর সাথে। কিন্তু দেশের কাজে ব্যস্ত, রাজনৈতিক আদর্শে বুদবুদ থাকায় তার তখন সুরবালার কথা মনেই আসেনি। বাপ মারা গেছে-সুতরাং মা এবং দুই ভগ্নির দ্বায়িত্ব এসে পড়ে তার ঘাড়ে। অগত্যা দেশজননীকে ছেড়ে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়। অবশেষে এক ভাঙা স্কুলের এক সেকেন্ড মাস্টার হিসেবে তার কর্মজীবন আরম্ভ করেন। ছাত্রদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে গিয়ে সূচনাতেই তিনি বাধাগ্রস্ত হন। নিঃসঙ্গ শূন্যমনে মানুষটির একা দিনকাটে স্কুলেরই একটা খোড়ো ঘরের আস্তানায়। ঘটনাচক্রে এই স্কুলের পাশেই আবার সরকারি উকিল রামলোচন বাবু তার ছোটোবেলার বউ বউ খেলার সাথী সুরবালার সাথে বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করছে। একদিন রামলোচন বাবুর বাসায় গিয়ে গল্প করতে করতে তার কানে এলো, পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু, একটি চুড়ির টুংটাং, কাপড়ের একটু শব্দ এবং জানালার ফাঁকে দুটি চোখের কৌতূহলভরা দৃষ্টির অনুভূতি। গল্পের ভাষায় :

“তৎক্ষণাৎ দুইখানি চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল- বিশ্বাস, সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো চোখের তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টনটন করিয়া উঠিল।”

‘একরাত্রি’ গল্পে ভাঙা স্কুলের যে সেকেন্ড মাস্টারকে দেখি তার বুকভরা স্বপ্ন ভাঙা স্কুলের মতোই ভেঙে গিয়েছিল। জীবনে সে না হতে পেরেছে বড় কিছু না হতে পেরেছে আদর্শের প্রচারক। নিজের ভুলের জন্য ছোটোবেলায় বউ বউ খেলার সুরবালাকে সে চিরতরে হারিয়েছে। পরিণতিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি দুজন দুজনার সাথে দেখা হলেও অদের বুকভরা হাহাকার বিনিময় ছাড়া কোন কথা বিনিময় হয়নি। যেমন-

“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল – ঝড় থামিয়া গেল, জল নামিয়া গেল- সুরবালা কোনো কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল। আমি এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।”

‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পেও আমরা নিবারণ চক্রবর্তী নামে একটি মধ্যবিত্ত চরিত্রের সন্ধান পায়। নিবারণের সংসার ছিল সাধারণ মানের- তার সংসারে তেমন কোনো অভাব ছিল না- অভাব ছিল শুধু একটা সন্তানের। তারপরেও স্ত্রী হরসুন্দরীর প্রতি তার কোনো অনুযোগ নেই। বলা যায় একে-অপরের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। আমরা দেখি স্বামীর মঙ্গল কামনায় হরসুন্দরী নিবারণকে আরেকটি বিয়ে দিতে উদ্যত হয় : “আমাদের তো ছেলেপুলে কিছুই হইল না, তুমি আর একটি বিবাহ করো।”

প্রস্তাবটা শুনে নিবারণ বাবু বিভিন্ন কারণে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু হরসুন্দরীও স্বামীর জন্য কিছু করতে ব্যাকুল- এ চিন্তায় সেও রাত-দিন নিবারণের পিছনে লেগে থাকত। একসময় তামাক খেতে খেতে নিবারণ সন্তান পরিবৃত একটি সুখময় গৃহের কল্পনা করে। একদিন সেই হরসুন্দরীর কাছে উত্থাপন করে: “বুড়াবয়সে একটি কচি খুকিকে বিবাহ করিয়া আমি মানুষ করিতে পারিব না।” পরবর্তীতে শৈলবালার সাথে তার বিয়ে হয়। গল্পের ভাষায়: “একটি নোলক পরা অশ্রুভরা ছোটখাটো মেয়ের সাহিত নিবারণের বিবাহ হইল, তাহার নাম শৈলবালা। নিবারণ ভাবিল নামটি বড়ো মিষ্ট এবং মুখখানিও বেশ ঢলোঢলো । ” বিয়ের পরে নিবারণ শরীর খারাপের নামে ছোটো বউয়ের ঘরে আত্মগোপন করে এবং লুকিয়ে লুডুলুডু খেলে, গাউন পরা কাচের পুতুল , গোপনে একশিশি এসেন্স বা মিষ্টিদ্রব্য এনে ছোট বউয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে । এসময় হরসুন্দরী তার নিজের অবস্থান আবিষ্কার করে। সে বুঝতে পারে সংসারের সমস্ত কাজ করতে হবে তাকে এবং তারা (নিবারণ এবং শৈলবালা) দুজন মিলে সারাদিন শিশুর মতো আচরণ করবে। হরসুন্দরী সংসারের কোনো কাজ শৈলবালাকে করতে দেয় না । এমনকি কোনো কাজে হাত দিলেও নিবারণ বাবু কষ্ট পায়। হরসুন্দরী তার নিজের সমস্ত গহনা শৈলবালাকে দিয়ে দেয়। এদিকে শৈলবালার বিভিন্ন আবদার মিটাতে বা শখের বশে নিবারণ বাবু তাকে গোপনে অনেক কিছু কিনে দেয়। তার আবদার মিটাতে গিয়ে অবশেষে নিবারণ বাবু ম্যাকমোরান কোম্পানির ক্যাশ তহবিলেও গোপনে হাত প্রদান করে। তার এ অপকর্ম ধরা পড়লে কোম্পানির মালিক তাকে আড়াই হাজার টাকা পূরণের জন্য দুদিন সময় বেঁধে দেয়। হাতটানের টাকা পূরণের জন্য নিবারণ বাবু হরসুন্দরীর কাছে হাত পাতে কিন্তু ততদিনে সে গহনার মালিক হয়েছে শৈলবালা। সে কিছুতেই বিপদের সময় সে গহনা নিবারণকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। গল্পের ভাষায়: “হরসুন্দরী হতবুদ্ধি স্বামীকে কহিল, “তালা ভাঙিয়া ফেলো না।” শৈলবালা প্রশান্তমুখে বলিল, “তাহা হইলে আমি গলায় দড়ি দিয়া মরিব।” শৈলবালা তার সিন্দুকের চাবি পুকুরে নিক্ষেপ করে। অবশেষে নিবারণ তার পৈতৃক বাড়ি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসে অন্তঃসত্ত্বা শৈলবালা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পরিণতিতে অন্তঃসত্ত্বা শৈলবালা মৃত্যুবরণ করে- যা সব পাঠককে ছুঁয়ে যায়। নিবারণ বাবু বুড়ো বয়সে বিয়ে করে অন্তর্দ্বন্দ্বে যেমন ভোগে- তেমনি সমস্যার সাথে মোকাবিলা করে। গল্পের শুরুটা হয়েছে যেখান থেকে গল্পের পরিসমাপ্তিতে মনে হয় গল্পটি সেখানেই রয়ে গেছে। গল্পের ভাষায়:

“একদিন গভীর রাত্রে সমস্ত শহর যখন নিদ্রিত নিবারণ ধীরে ধীরে হরসুন্দরীর নিভৃত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। নীরবে সেই পুরাতন নিয়ম-মত সেই পুরাতন শয্যার দক্ষিণ অংশগ্রহণ করিয়া শয়ন করিল।”

অবশ্য এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে নিবারণ চক্রবর্তীর মধবিত্তসুলভ আচরণ এবং তার জীবনযন্ত্রণার ইতিহাস।

‘অপরিচিতা’ গল্পের প্রধান চরিত্র অনুপম- সেও মধ্যবিত্ত চরিত্রের প্রতিনিধি। গল্পের কথক অনুপম বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের যুদ্ধসংলগ্ন সময়ের সেই বাঙালি যুবক, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর উপাধি অর্জন করেও ব্যক্তিত্বরহিত, পরিবারতন্ত্রের কাছে অসহায় পুতুলমাত্র। তাকে দেখলে আজো মনে হয়, সে যেন মায়ের কোলসংলগ্ন শিশুমাত্র। অনুপমের মামা অনুপমদের সংসারকে শাসন ও শোষণ করেছেন দারুণ দক্ষতায়। এই শাসনকে ধরে রাখতে তিনি ভাগ্নের বিয়ে গরিব ঘরে দিতে চান। আবার একই সাথে আশা রাখেন অর্থপ্রাপ্তির যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। যে বেহাই বাড়িতে আসলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য বাঁধা হুকায় তামাক দিলে অসম্মান বোধ করবে না। অনুপমের মামা আত্মীয়তা রাখতে চান তবে যথার্থ সম্মান না দিয়ে। চরিত্রের এই বৈপরীত্যই তাঁর শোষণের চিত্র তুলে ধরে। অনুপমের পিতার মৃত্যুর পর তার মামা সংসারের অভিভাবক হন। নিজের আধিপত্যকে ধরে রাখতে চান চিরজীবন। এ কারণে টাকা বা ধনসম্পত্তির ওপর আসক্তি থাকলেও ধনীর কন্যা তার পছন্দ নয়। কারণ ধনীর কন্যা অনুগত হবার সম্ভাবনা কম। তিনি এমন ঘরের মেয়ে চান যে মেয়ে এ বাড়িতে মাথা হেঁট করে চলবে।

তারই বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক নিয়ে নারীর চরম অবমাননাকালে শম্ভুনাথ সেনের কন্যা-সম্প্রদানে অসম্মতি গল্পটির শীর্ষ মুহূর্ত। বিবাহের পূর্বে অনুপমের মামা কন্যার গহনা স্যাকরা দিয়ে পরীক্ষা করতে চাইলে এ বিষয়ে শম্ভুনাথ অনুপমের সিদ্ধান্ত জানতে চান। তখন অনুপমের নির্বিকারত্ব জানিয়ে দেয় এ বিষয়ে অনুপমের কিছু বলার নেই। কাজেই বিয়ে ভাঙার পর অনুপমের আর কিছু বলার থাকে না। গল্পের কথক অনুপম বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের যুদ্ধসংলগ্ন সময়ের সেই বাঙালি যুবক, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর উপাধি অর্জন করেও ব্যক্তিত্বরহিত, পরিবারতন্ত্রের কাছে অসহায় পুতুলমাত্র। সে তার নিজের সম্পর্কে বলেছে এভাবে: “মস্ত বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে ফিরাইয়া দিয়াছে। এত বড়ো সৎপাত্রের কপালে এত বড়ো কলঙ্কের দাড় নষ্ট গ্রহ এত আলো জ্বালাইয়া, বাজনা বাজাইয়া, সমারোহ করিয়া আঁকিয়া দিল?” মূলত ‘অপরিচিতা’ মনস্তাপে ভেঙেপড়া মধ্যবিত্তসুলভ এক ব্যক্তিত্বহীন যুবকের স্বীকারোক্তির গল্প, তার পাপস্খলনের অকপট কথামালা।

এছাড়া ‘কঙ্কাল’ গল্পের শশিশেখর তার মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার জন্যই বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়েছে অপূর্ব সুন্দরী কনকচাঁপাকে; তাছাড়া বিয়ের পরও বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ‘হৈমন্তী’ গল্পের অপু; “মেঘ ও রৌদ্র” গল্পের শশিভূষণও তার স্ত্রী গিরিবালাকে যোগ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে ‘সমাপ্তি’ গল্পের অপূর্ব রায়ই মধ্যবিত্ত চরিত্র হিসেবে ব্যতিক্রমী- সে গ্রাম্য বালিকা মৃন্ময়ীকে যোগ্য সম্মান দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গল্পগুচ্ছে” নারীরই প্রাধান্য, নারীরই কেন্দ্রীয় অধিষ্ঠান- তবে নারীগুলো সবই মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘ভিখারিণী’র কমল থেকে ‘মুসলমানীর গল্প’-এর কমলা পর্যন্ত বিষাদে-বেদনায়, আঘাতে-অপঘাতে, বিদ্রোহে-ব্যক্তিত্বে, প্রেমে-অপ্রেমে বিচিত্রধর্মী নারীর অবয়ব অঙ্কিত। নারী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সনাতন ধারণা ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বিশ শতকের প্রারম্ভকাল থেকেই সম্ভবত তাঁর নারীভাবনা আধুনিক ইতিবাচক পথ খুঁজে নিয়েছে। সবুজপত্র যুগের এবং অন্তপর্বের গল্পে মহিমময়ী নারীপ্রতিমা সৃজনে স্বকাল- নিষ্ঠ রবীন্দ্রপ্রতিভা ভবিষ্যৎ-প্রসারী। রক্ষণশীল সমাজ ও ধর্ম শাসিত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম (বোষ্টমী) নারীর প্রতি সামাজিক লাঞ্ছনা ও অবহেলার বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীর বিদ্রোহ (স্ত্রীর পত্র) গতানুগতিক প্রেম ধারণার বিরুদ্ধে আধুনিক নারী সত্তার জাগরণ (পয়লানম্বর) বিধবা নারীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম (ল্যাবরেটরি) প্রভৃতি বহুমাত্রিক ব্যক্তিবিদ্রোহ ৩য় পর্বের গল্পে বিশ্ব প্রসারী জীবনবোধে উজ্জ্বল ।

বিশ শতকের নারী ব্যক্তিত্বের প্রথম প্রতিবাদ ‘স্ত্রীর পত্র’।। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের মধ্যে যে চরিত্রটি নারী ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও স্পষ্ট তাহলো ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের নায়িকা মৃণাল। পনের বছরে পত্নী জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক গ্লানি স্বীকার করে অনেক দুঃখকষ্ট সয়ে মৃণাল বুঝেছে যে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ পত্নীতে নয়, নারীত্বে। তার চিঠিতে স্বামীর প্রতি সম্বোধন ছিল তোমার। অর্থাৎ তার অভিযোগ ও বিদ্রোহ শুধু স্বামীর প্রতি ছিল না, ছিল তৎকালীন স্বার্থপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের প্রতি। মৃণালের ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। মৃণালের শিক্ষা মেধা বুদ্ধিবৃত্তি ছিল উচ্চস্তরের ফলে হৃদয়বৃত্তিকে পদদলিত করে ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে গতানুগতিক স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ঘর করা সম্ভব হয়নি অপরপক্ষে বিন্দু নামটির মধ্য দিয়েই তার অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীর অবস্থান জটিল সেটা মৃণাল চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং বিন্দু চরিত্রটি সেটাকে আরো একটুখানি অগ্রগতি সাধন করেছে। বিন্দু মৃণালের চেতনায় জ্বেলে দিয়েছে মুক্তির আলো। নারী জাতির প্রতি অমানবিক আচরণে জ্বলে উঠেছে মৃণাল আপন সত্তায়।

‘পয়লা নম্বর’ গতানুগতিক প্রেম ধারণার বিরুদ্ধে আধুনিক নারী সত্তার জাগরণ এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। নাতিদীর্ঘ আট বছরের দাম্পত্যজীবনে প্রাপ্তির হিসেবে অনিলার জীবন যে নিষ্ফল তা বলাই বাহুল্য। গল্পে অনিলা অনেক দুঃখে সেই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল, তার দুপাশে ছিল মাথা ঠুকবার দেয়াল। একপাশে নিজের স্বামী, আর একপাশে সিতাংশুমৌলি। জীবনের চোরাগলিতে কোনো দেয়ালের আঁচড়ই সে লাগতে দেয়নি কারো গায়ে। সে স্বামী এবং পুরুষের পার্থক্য প্রায় অনুভব করেছে। অবশেষে স্বামী সংসার উপেক্ষা করে উভয়কে একই বানীর চিঠির দ্বারা অনুশাসন করে গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র একটা আঘাত হেনেছে এই চিঠির মাধ্যমে, “আমি চললুম। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করো না, করলেও খুঁজে পাবে না।”

আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব বিজ্ঞান নির্ভরশীলতার উপর নির্ভর করে এ কথাই যেন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে। তাছাড়া ব্যক্তিত্বের তুঙ্গশিখরে একটি নারী এবং একটি পুরুষ উল্কার মতো জ্বলছে এই গল্পের সর্বাঙ্গ জুড়ে- সে জ্বালা আধুনিকতার উদভ্রান্তিতে অগ্নিদগ্ধ। নন্দকিশোরের সাধনা-মন্দির ছিল এক বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরি, সে তার উপার্জিত অর্থের অধিকাংশ এই ল্যাবরেটরির প্রয়োজনেই ব্যয় করে। বৈজ্ঞানিক সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্য সে বিশাল একটি বাড়িও তৈরি করে। সোহিনী নামের একজন মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয় এবং সে বিয়ে করে। নন্দকিশোর তাকে নিজের বিজ্ঞানব্রত-সাধনার সঙ্গিনী এবং নিজের আদর্শের একান্ত অনুরাগিণী করে নিয়েছিল সোহিনীকে। নিজের স্ত্রীকে সে নিজের বিদ্যেয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। নন্দকিশোর মারা যায় প্রৌঢ় বয়সে এক দুঃসাহসিক বৈজ্ঞানিক অপঘাতে। নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর স্বামীর ল্যাবরেটরিই হয়ে ওঠে সোহিনীর পূজা-মন্দির। এই ল্যাবরেটরিকে সে বিজ্ঞানমন্দির হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্বামীর আদর্শকেই গ্রহণ করেছিল। তাই সে স্পষ্ট জানিয়েছে:

“মানবো না আপনার কার্যকারণের অমোঘ বিধান যদি আমার ল্যাবরেটরির উপর কারো হাত পড়ে। আমি পাঞ্জাবের মেয়ে, আমার হাতে ছুরি খেলে সহজে। আমি খুন করতে পারি, তা সে আমার নিজের মেয়ে হোক, আমার জামাই-পদের উমেদার হোক।”

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের মূল বিষয়বস্তু বিজ্ঞান নির্ভরতার মধ্য দিয়ে মানব কল্যাণ। ব্যক্তিত্বের বোধ এ গল্পের ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে সোহিনীর কাছে। এ গল্পে লেখক বিংশ শতাব্দীর মানুষের বিজ্ঞান নির্ভরতার চিত্র তুলে ধরেছেন।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গল্পগুচ্ছ”-এ মধ্যবিত্ত জীবন চিত্রিত হয়েছে। তবে মধ্যবিত্ত পুরুষ চরিত্র অপেক্ষা মধ্যবিত্ত নারী চরিত্রেরই বিকাশই রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোতে প্রধান হয়ে উঠেছে। ক্রমে ক্রমে অত্যন্ত সুচারুরূপে নারী চরিত্রের ঔজ্জ্বল্যতা ছড়িয়েছেন। স্বাধীনচেতা ও মুক্ত স্বাতন্ত্র্য নারী মহিমা প্রকাশ পায়।