অথবা, ‘গল্পগুচ্ছ’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতি চেতনার স্বরূপ আলোচনা বা বিশ্লেষণ কর
উত্তর : জীবন থেকে প্রকৃতিকে বাদ দিলে জীবনের স্বরূপটাকে খণ্ডিত করা হয়, বাস্তবের চিত্র সম্পূর্ণ পরিস্ফুটন হতে পারে না। প্রকৃতি সম্পর্কে যথার্থ সংবেদনশীল শিল্পী, ছোটোগল্পের শ্রেষ্ঠ রূপকার রবীন্ নাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১] তাঁর অধিকাংশ ছোটোগল্পে মানবজীনের সাথে প্রকৃতিকে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর বেশিরভাগ ছোটোগল্পের পটভূমি প্রবহমান মানবজীবনের পটভূমি। আর সেই সাথে তা বিশ্ব প্রকৃতির পটভূমিকায় প্রসারিত। প্রকৃতির মধ্যে যে চিরন্তনতা, নিত্য পরিবর্তনশীলতা ও নিত্যনবীনতা বর্তমান তা রবীন্দ্রগল্প খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতির জীবনের এই বৈচিত্র্য-নবীনতা রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনেও পেতে চেয়েছেন। এখন আমরা নির্বাচিত ছোটোগল্পগুলোতে প্রকৃতি ও মানব মনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের স্বরূপটি আলোচনার প্রয়াস পাব।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র গল্পগুলোর পরিচর্যার (Treatment) এর ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি গল্পগুলোর মধ্যে প্রকৃতিকে ব্যক্তরূপে ব্যবহার করলেও প্রকৃতি অনেকখানি অব্যক্তের মধ্যে প্রসারিত। ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী, বর্ণনা ইঙ্গিতবহুল এবং সমস্তটা মিলিয়ে প্রকৃতি অনন্যসাধারণ গুরুত্ব নিয়ে গল্পগুলোতে বিরাজমান। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে যেমন ছোটোগল্পের বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি প্রকৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রকৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথের দুটি রূপ দেখতে পাই। প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলো বিষয় ও আঙ্গিকের সাথে প্রকৃতি ও মানুষ একাকার হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে প্রকৃতি শুধু পটভূমি নয় একেবারে গল্পের প্রধান অঙ্গ হয়ে, কোথাও বা চরিত্র হয়ে আবার কোথাও বা চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিলেমিশে গিয়ে গল্পগুলোতে অবস্থান করছে। এখানে মানুষের জীবনলীলাকে প্রকৃতির সঙ্গে এক করে দেখেছেন এবং প্রকৃতির কোনো তত্ত্ব নয়, কোনো শিক্ষাগুরু নয় সহজ জীবনের প্রতীক রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রকৃতি ব্যথাহত জীবনের স্বাতন্ত্র্য ক্ষেত্র।
দ্বিতীয় পর্যায়ে গল্পকারের প্রকৃতি ব্যবহার অনেকখানি কমে এসেছে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ পর্যায়ে রূপক ও উপমার আশ্রয় নিয়েছেন এবং পল্লি প্রকৃতি ও পল্লি মানুষ আর গল্পকারের সামনে নেই। কথা বলতে বলতে প্রিয়জনের স্মৃতির মতো প্রকৃতি প্রসঙ্গ এসে গেছে কথার মধ্যে।
নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন গল্পের আলোকে তাঁর প্রকৃতি ব্যবহার দেখানো হলো:
পোস্টমাস্টার : গল্পটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। এ গল্পে প্রকৃতির কাছে এসে চরিত্রগুলো যতটা প্রকাশিত হয়েছে বাস্তবে গল্পে ততটা প্রকাশ পায়নি। চরিত্রগুলো প্রকৃতিকে আবেষ্টন করে আছে। প্রকৃতিই যেন এখানে প্রধান চরিত্র। পোস্টমাস্টার যখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে চলে যাবার কথা প্রকাশ করল তখন রতনের করুণ হৃদয় বেদনাকে তুলে ধরার জন্য প্রকৃতির ব্যবহারই যথেষ্ট ছিল-
“মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”- এ যেন রতনেরই অন্ত বেদনার স্বরূপ নির্দেশক। রতনের চোখের জলের পরিবর্তে এখানে ‘ঘরের ফুটো চাল বেয়ে বৃষ্টির জল শিল্প সুষমার দিক থেকে যেমন অভিনব তেমন সার্থক। এরপর বিদায়কালে পোস্টমাস্টারের মন যখন রতনের জন্য ব্যথিত তখন-
“বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারদিকে ছলছল করিতে লাগিল তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- একটি গ্রাম্য সামান্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল।”
আবার প্রকৃতি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল- “জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী, পৃথিবীতে কে কাহার।” রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ব্যবহার না করলে এত সুন্দরভাবে পোস্টমাস্টার ও রতনের মর্মবেদনা ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। (কিন্তু পালে তখন বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদী কূলের শ্মশান দেখা যাইতেছে।)
একরাত্রি : ঝড়ের মধ্য দিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই জীবনের কোনো নতুন পদক্ষেপের সূচনা হয়। একরাত্রি গল্পের নায়কের জীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হয়েছিল-
“তাহার পরদিন বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হইল। যত রাত্রি হইতে লাগিল বৃষ্টি এবং ঝড়ের বেগ বাড়িতে লাগিল। প্রথম পূর্ব দিক হইতে বাতাস বহিতেছিল, ক্রমে উত্তর এবং উত্তর পূর্ব দিয়া বহিতে লাগিল।”
সেই ঝড় সামান্য এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের তুচ্ছ জীবন থেকে নায়ককে মুক্তিদান করে এক অনির্বচনীয় সৌভাগ্যের তটে পৌঁছে দিয়েছে- হোক তা একটি মাত্র রাতের জন্য, সেই ঝড়ের রাতে নায়ক তার বয়সের প্রণয়িনীকে পাশে পেয়ে অনন্ত আনন্দের আস্বাদ লাভ করে এক নতুন জন্মের তীরে উপনীত হয়েছে।
জীবিত ও মৃত : এই গল্পে কাদম্বিনী যখন শ্মশানে গিয়ে জীবন লাভ করল তখন ইতোমধ্যেই মানব জগতের সকলেই তাকে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু প্রকৃতির স্নেহ স্পর্শে সে অনুভব করেছে পৃথিবীর নৈকট্য এবং আত্মীয়তা। তারপর মনে হলো-
“যমালয় বুঝি এইরূপ চিরনির্জন এবং চির অন্ধকার। …তাহার পর যখন মুক্ত দ্বার দিয়া হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাদলার বাতাস দিল এবং বর্ষার ভেকের ডাক কানে প্রবেশ করলি। … একবার বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল; সম্মুখে পুষ্করিণী, বটগাছ, বৃহৎ মাঠ এবং সুদূর তরুশ্রেণি এক পলকে চোখে পড়ে।”
অবশ্যই এই নিকট সংস্পর্শের অনুভূতি তার মনে স্থায়ী হতে পারেনি। তাই মানুষের মধ্যে থেকেও তার মনে হয়েছে- “তখন আমি আর বাঁচিয়া নাই আমি মরিয়া আছি।”
গল্পটির মধ্যে মানুষের জীবনের উপর প্রকৃতির প্রভাব ব্যর্থ, মানবজীবনের বাহির দরজায় প্রকৃতি এই গল্পে সাধারণভাবে পটভূমিকা হয়ে রয়েছে। আবার কাদম্বিনীর সই যোগমায়ার স্বামী শ্রীপতি যেদিন রাণীহাট থেকে কাদম্বিনীর মৃত্যুসংবাদ বহন করে বাড়ি ফিরে এল সেদিন- “মুষলধারে বৃষ্টিতে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতেছে।” এবং কাদম্বিনী যখন সইয়ের বাড়ি ত্যাগ করেছে তখনো অবিশ্রাম বৃষ্টি হচ্ছিল। এরপর কাদম্বিনী রাণীহাটে আত্মহত্যার পরও সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি হচ্ছিল। সস্তা গল্পটি এইভাবে বর্ষার সুরে বাঁধা।
সমাপ্তি : গল্পের কিশোরী নায়িকা মৃন্ময়ী যৌবনবতী রমণীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এই জীবন সত্যকে রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব কৌশলে প্রকৃতি বর্ণনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন। সংসারের সাথে মৃন্ময়ীর মিলনের একটি আশ্চর্য সুন্দর উপমা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন-
“তরুর সহিত শাখা-প্রশাখার যেরূপ মিল সমস্ত ঘরকন্না তেমনি পরস্পর অখণ্ড সম্মিলিত হইয়া গেল।”
এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ মাটির কন্যা মৃন্ময়ীকে প্রকৃতির সাথে একাকার করে গড়ে তুলেছেন-
“মেঘ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। ভাদ্র মাসের পূর্ণ নদী ফুলিয়া ফুলিয়া নৌকা দোলাইতে লাগিল, মৃন্ময়ী সমস্ত শরীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইয়া আসিল; আচল পাতিয়া সে নৌকার মধ্যে শয়ন করিল এবং এই দুরন্ত বালিকা নদী-দোলায় প্রকৃতির স্নেহপালিত শান্ত শিশুটির মতো অকাতরে ঘুমাইতে লাগিল।”
মেঘ ও রৌদ্র: গল্পে গিরিবালা ও শশিভূষণের প্রেম প্রকৃতির নির্বিকার উদাসীনতার মাঝে মানবজীবনের ক্ষণিক ঘটনা বিক্ষোপের প্রতিতুলনা। প্রকৃতি পটভূমি এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গিরিবালা শেষ যেদিন আমসত্ত্ব, কেয়াখয়ের আর জারক নেবুর উপঢোকন আঁচলে বেঁধে শশিভূষণের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে, তখন তার বাবা তাকে নিষেধ করেছে। তারপর আর শশিদার সাথে দেখা হলো না অথচ প্রকৃতির নিয়মে বৃষ্টি পড়তে লাগল, বকুল ফুল ঝরতে লাগল, গাছ ভরে পেঁকে উঠল পেয়ারা, শুধু নেই গিরিবালার ছিন্নপ্রায় চারুপাঠখানি।
ক্ষুধিত পাষাণ: গল্পে পাগলা মেহের আলীর চিৎকার ‘তফাৎ যাও’ আকাশে বাতাসে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেঁথে গেছে মানুষের মনে। মানুষের অতৃপ্ত বাসনা, অচরিতার্থ প্রবৃত্তি প্রকৃতিকে পাষাণ গৃহে ক্ষোদিত হয়ে আত্মরক্ষা করে তার অদৃশ্য সম্মোহনী শক্তি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে এবং রাত্রির স্তব্ধতায় তা রূপ ধারণ করে।
অতিথি : প্রকৃতি মানব মনের নিগূঢ় সম্পর্ক নিয়ে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অতিথি’ গল্পটি। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির চিরচঞ্চল নির্লিপ্ততাকে রূপ দিয়েেেছন তারাপদ চরিত্রে। তারাপদ বহুস্থানে, বহু মানুষের স্নেহ বন্ধনে ক্ষণিকের জন্য আবদ্ধ হয়েছে কিন্তু কোনো বন্ধনই তাকে দীর্ঘকাল বেঁধে রাখতে পারেনি। প্রকৃতির উদার বক্ষপুটে সে সর্বত্রচারী, বন্ধনমুক্ত প্রকৃতি প্রেমিকা। সে যেন প্রকৃতির মতো নির্লিপ্ত ও রহস্যময়। তাই প্রকৃতির সমান্তরাল তারাপদ মানব সংসারের স্নেহ পিঞ্জরে ধরা না দিয়ে মুক্ত প্রকৃতির মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায়।
মধ্যবর্তিনী: এই গল্পে লেখক কাহিনির গ্রন্থি বন্ধনে প্রকৃতির সহায়তা নিয়েছেন অতি সার্থকভাবেই। গল্পে প্রকৃতির ভূমিকা যে অমোঘ নিয়তির ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে হরসুন্দরী যেদিন রোগশয্যা ছেড়ে দুর্বল শরীরে উঠে বসেছে সেদিন-
“বসন্তকালে দক্ষিণের হাওয়া দিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং উষ্ণ নিশীথের চন্দ্রালোক ও সীমান্তিনীদের উন্মুক্ত শয়নকক্ষে নিঃশব্দ পদ সঞ্চারে প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছে।”
শান্তি : এই গল্পের শুরুতেই আমরা প্রকৃতির মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত পাই। যেদিন থেকে ঘটনা শুরু সেদিন ‘দুই প্রহরের সময় খুব একটানায় অত্যন্ত কইয়া দিয়াছে। এই গল্পে রাধার মৃত্যুদৃশ্য বড় শোচনীয়-অত্যন্ত করুণ দুখিরাম-হিদামের দুঃখের সংসারে এই মৃত্যু যে কোনো আঘাতের চেয়ে বেশি। এই মৃত্যু বর্ণনার ঠিক পর পরই গল্পকথক দেখিয়েছেন যে-
“বাহিরে তখন পরিপূর্ণ শান্তি! রাখালবালক গোরু লইয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিতেছে। পরপারের চরে যাহারা নূতনপকু ধান কাটিতে গিয়াছিল তাহারা পাঁচ সাতজনে এক একটি ছোটো নৌকায় এ পারে ফিরিয়া পরিশ্রমের পুরস্কার দুই চারি আটি ধান মাথায় লইয়া প্রায় সকলেই নিজ নিজ ঘরে অসিয়া পৌছিয়াছে।”
প্রকৃতি আদৌ মনোযোগ দেয়নি ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরার প্রতি। হতভাগিনী চন্দরাকে যখন সেশনে চালান দেওয়া হলো তখন এক দিকে যেমন পৃথিবীর কাজ কারবারে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি, তেমনি কোনো তার ছাপ পড়েনি।-
“ইতোমধ্যে চাষাবাদ, হাটবাজার, হাসিকান্না পৃথিবীর সমস্ত কাজ চলিতে লাগিল এবং পূর্ব বৎসরের মতো নবীন ধান্যক্ষেত্রে শ্রাবণের অবিরল বৃষ্টিধারা বর্ষিত হইতে লাগিল।”
নষ্টনীড় : গল্পটির মধ্যে চারুলতার জীবনেও কোনো এক বিশেষ হৃদয় বেদনার ক্ষণে প্রিয় সখীর মতো প্রকৃতি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। যেমন-
“তখন সন্ধ্যা; বারান্দার টব হইতে জুঁই ফুলের গন্ধ আসিতেছিল। ছিন্ন মেঘের ভিতর দিয়া স্নিগ্ধ আকাশে তারা দেখা যাইতেছিল। আজ চারু চুল বাঁধে নাই, কাপড় ছাড়ে নাই, জানালার কাছে অন্ধকারে বসিয়া আছে; মৃদু বাতাসে আস্তে আস্তে তাহার খোলা চুল উড়িতেছে এবং তাহার চোখ দিয়া এমন ঝরঝর করিয়া কেন জল বাহিয়া যাইতেছে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছে না।”
স্ত্রীর পত্র: এই গল্পে মৃণাল সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এ গল্পে প্রকৃতি প্রায় অনুপস্থিত। মাত্র একবার প্রকৃতির ব্যবহার করা হয়েছে মনোবিশ্লেষণে-
“উত্তর দিকের পাঁচিলের গায়ে নর্দমার ধারে কোন গতিকে একটা গাব গাছ জন্মেছে, যেদিন দেখতুম সেই গাবের গাছে নতুন পাতাগুলি রাঙ্গা টকটকে হয়ে উঠেছে, সেদিন জানতুম ধরাতলে বসন্ত এসেছে।”
রবীন্দ্রগল্পে মানবজীবনের সাথে বিশ্বপ্রকৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। প্রকৃতির পটভূমিকায় মানবজীবনের আলেখ্য তিনি তুলে ধরেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির পটভূমিকাতে মানবজীবনের তুচ্ছ ঘটনা-বিক্ষোভের অকিঞ্চিৎকরতাকে রবীন্দ্রনাথ বারে বারেই স্পষ্ট করে তুলেছেন। প্রকৃতির উদাসীন বৃহৎ পটভূমিতে মানবজীবনের ছোটোখাটো, সুখদুঃখের কোনো মূল্য নেই। সত্য হলো জীবনের চিরন্তন প্রবাহ।
Leave a comment