কল্পনা ও সৃষ্টিশক্তির বিস্তারে ও বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ তুলনাহীন। সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে এমন কোনও শাখা নেই যা তাঁর প্রতিভার দানে সমৃদ্ধ হয় নি। আমরা যদি শুধু তার কাব্যসাধনার সুদীর্ঘ ইতিহাসটিই স্মরণ করি, তা হলেও তার নতুন নতুন পরীক্ষায় নিজেকে অতিক্রম করবার ক্লান্তিহীন প্রয়াসে, চৈতন্যের নব নব বিচিত্র দিগন্তের প্রকাশে বিস্মিত ও মুগ্ধ না হয়ে পারি না। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনা তার নিজস্ব বিপুল প্রাণশক্তিতে বিভিন্ন ভাবগত স্তর ও ভাবপরিবর্তনানুযায়ী ছন্দোরীতি ও বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গির পথ বেয়ে পরিণতির ঐশ্বর্যে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এই পরিণতির বিভিন্ন স্তরগুলাের ভিত্তিতে আমরা রবীন্দ্র-কাব্যসাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নিতে পারি। প্রথম পর্বে পাই ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২)। তাকে কোনও কোনও সমালােচক ‘উন্মেষপর্ব’ রূপে চিহ্নিত করেছেন, কেউ কেউ ‘হৃদয়-অরণ্য’ নাম দিয়েছেন। এই যুগে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে কবি নিজের নিভৃতচারী হৃদয়ের রােমান্টিক বিষাদ, অনির্দেশ্য ভাবব্যাকুলতা, একাকিত্বের অরণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আত্মকেন্দ্রিক দুঃখবেদনাতেই নিমজ্জিত হতে চেয়েছেন—
‘আর কিছু নয়।
নিরালার এ হৃদয়
শুধু এক সহচর চায়।
তুই দুঃখে তুই কাছে আয়।’
তবু এই বিষাদমন্থর, হৃদয়-অরণ্যে ব্যাকুল পথান্বেষণের তাঁর শিল্পব্যক্তিত্বের কৈশাের-কল্পনা যে ক্রমশ অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা থেকে আত্ম-আবিষ্কার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তা আমরা লক্ষ্য করি। ‘সন্ধ্যাসংগীত এর গােধূলি ছায়াচ্ছন্ন বিষাদের জগৎ থেকে কবি প্রভাত-সংগীত’-এর আলােকোজ্জ্বল জগতে এসে নিজের হৃদয় বিস্তারের আনন্দে গেয়ে উঠলেন—
‘হৃদয় আজি মাের কেমনে গেল খুলি।
ধরার আছে যত মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মাের হাসিছে গলাগলি।’
‘প্রভাত সংগীত’-এর পর্যায়ে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভিজ্ঞতার সংঘাতে যেভাবে কবি ‘সন্ধ্যা- সংগীত-এর হৃদয়-অরণ্য থেকে মুক্ত প্রাণের উল্লাসময় জগতে উত্তীর্ণ হলেন, জীবনস্মৃতি তৈ কবি তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সদর স্ট্রীটের বাড়িতে থাকতেন, সেখানেই- “একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবাস্তর হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্য সর্বত্র তরঙ্গিত আমাদের হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলাকএকেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্বারের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটির মতােই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।” ‘প্রভাত সংগীত’-এর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি ত কবির কাব্যজীবনের নতুন জাগরণেরই রূপক।
‘ছবি ও গান’-এর কবিতাগুলি বিভিন্ন খণ্ডচিত্রগুলির মধ্য দিয়ে বাতায়নবাসী কবিমনের নিজের পূজার বর্ণসম্ভার নিয়ে দূর থেকে জগৎ ও জীবনের সৌন্দর্য দেখতে ও তাদের এক-একটা তুলির আঁচড়ে রাখতে চেয়েছে। “এমনি….করিয়া নিজের মনের কল্পনাপরিবেষ্টিত ছবিগুলি গড়িয়া তুলিতে ভারি ভালাে লাগিত।” ‘কড়ি ও কোমল’-এর ভূমিকায় কবি নিজেই বলেছেনঃ এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে—
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,’-
যা ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে আর একভাবে প্রকাশ পেয়েছে—
‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।’
‘কড়ি ও কোমল’-রচনার অব্যবহিত পূর্বে এক পারিবারিক দুর্ঘটনায় শােকতপ্ত কবিচিত্তে একটা বড়াে দরের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল বলে মনে হয়। ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “শােকের আঘাত কবিচিত্তে এমন একটি নির্লিপ্ততা আনিয়া দিল যাহাতে দৃষ্টির আত্মপরতা দূর হইয়া সংসারের ছবি উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হইয়া ফুটিল, এই নিরবলেপ স্বচ্ছদৃষ্টিই ‘কড়ি ও কোমলে’র রহস্য।” ‘কড়ি ও কোমল’-এ ইন্দ্রিয়চেতনায় বর্ণাঢ্য প্রেম, প্রকৃতিচেতনা এবং বাইরের জগতের রূপশ্বের্যের প্রতি কবিহৃদয়ের প্রবল অনুরাগ অনেকটা পরিমাণেই রসনিটোল সংহত রূপ লাভ করেছে; নিম্নোদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলােতে ‘কড়ি ও কোমল’-এর সৌন্দর্যচেতনা যেভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে তা আমরা লক্ষ্য করতে পারি—
‘ফেলাে গাে বসন ফেলাে। ঘুচাও অঞ্চল।
পরাে শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুর বালিকার বেশ কিরণ বসন।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা
বিচিত্র বিশ্বের মতাে দাঁড়াও একেলা।’
এই পর্ব-সম্বন্ধে সমালােচকের ভাষায় বলতে পারা যায়, ‘সন্ধ্যাসংগীত’-এ ‘গােধূলি-বিষাদ, ‘প্রভাত সংগীত’-এ নবজাগরণের ‘আনন্দ-কাকলী’, ‘ছবি ও গান’-এ গভীর অনুভূতির সহিত নিঃসম্পর্কে রঙ ও সুরের খেলা এবং ‘কড়ি ও কোমল’-এ প্রধানতঃ রূপবিহুলতার মধ্য দিয়া সূক্ষ্মতর অনুভূতির উন্মেষ কবি-মানসের অগ্রগতির স্তরগুলিকে সূচিত করে।
দ্বিতীয় পর্বের ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সােনার তরী’ (১৮৯৩), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬) প্রভৃতি কাব্যগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের ‘নিঃসন্দিগ্ধ স্বরূপ বিকাশ’, ‘পূর্ণ আত্মােপলব্ধির পদক্ষেপ’ লক্ষণীয়। মানসী’র কোনও কোনও কবিতাতে দেখি, কবিচেতনা দ্বিধা ও সংশয়ে এখনও কুষ্ঠিত, প্রকৃতি ও প্রেমে তার অন্বিষ্ট পূর্ণতার আদর্শকে খুঁজে না পেয়ে কবিচিত্ত বিষাদ-ব্যাকুল—
‘আপন প্রাণের গোপন বাসনা
টুটিয়া দেখাতে চাহিরে
হৃদয় বেদনা হৃদয়েই থাকে,
ভাষা থেকে যায় বাহিরে।
শুধু কথার উপরে কথা,
নিষ্ফল ব্যাকুলতা।
বুঝিতে বােঝাতে দিন চলে যায়,
ব্যথা থেকে যায় ব্যথা।’
কিন্তু এ সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করি, কবিহৃদয় জীবন ও জগতের পূর্ণতর আদর্শের দিকে ক্রমশঃ অগ্রসর হচ্ছে- ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটিতে কবির ব্যক্তি-হৃদয়ের প্রেমানুভূতিতে নিখিল বিশ্বচেতনা এসে মিলিত হয়েছে।
‘মানসী’র কবিতাগুলির শব্দযােজনায়, ছন্দোবিন্যাসে পরিণতির চিহ্ন স্পষ্ট, তার ছন্দশিল্পকলা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পূর্ববর্তী কড়ি ও কোমল-এর বিশেষ মিল পাওয়া যাবে না। আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নতুন শক্তি দিতে পেরেছি। মানসীতৈেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিল।”
‘সোনার তরী’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা রচিত হয়েছে উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের পল্লীপ্রকৃতির কোলে বসে। ফলে এই কাব্যে পল্লীপ্রকৃতির একটা বিশেষ রূপ ধরা রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম ব্যাখ্যাতা অজিত চক্রবর্তী বলেন, “এই যে বাংলাদেশের গ্রাম্য জীবনযাত্রার সুখদুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটিতে লাগিল, ইহাতে দেখিবে কবির রচনা ব্যক্তিত্বের বন্ধন ছাড়াইয়া বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করিল। অনুভূতিগুলির প্রকাশ ব্যক্তিগত না হইয়া বিশ্বের হইয়া উঠিল।” অতঃপর পদ্মার উন্মুক্ত প্রকৃতির সাহচর্যে, পদ্মলালিত মানবজীবনের সুখ-দুঃখের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে কবিমানস সমৃদ্ধ হল, এক বৃহত্তর জীবনবােধে তিনি স্থিত হলেন। একটা পত্রে তিনি তার এই সময়ের অভিজ্ঞতা-সম্বন্ধে বলেছেন, “আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলছিল এই সময়কার প্রবর্তনা বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলােকের মধ্যে নিত্যকার অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা।” জীবনের পূর্ণতার উপলব্ধিতে উদ্দীপিত কবিহৃদয় মানবজীবনের সকল খণ্ড অভিজ্ঞতার মধ্যে বৃহত্তর অখণ্ড প্রাণলীলা অনুভব করল, ‘সোনার তরী’ ও ‘চিত্রা’র কবিতাগুলােতে সেই জীবনােপলব্ধির ঐশ্বর্যই সঞ্চিত হয়েছে। জীবন ও প্রকৃতির গভীর সম্বন্ধ চেতনার ঐশ্বর্যে এদের কবিতাগুলাে সমৃদ্ধ। সােনার তরী কাব্যের ‘বসুন্ধরা’ কবিতা কবির মৃত্তিকামমতা, ছন্দ ও চিত্রকরের সম্পদে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘চিত্রা’র প্রথম কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনার বৈশিষ্ট্য চিত্র ও সঙ্গীতের অপরূপ ঐশ্বর্যে অভিব্যক্ত ঃ যে সৌন্দর্য জগতের বহু বিচিত্ররূপে বিলসিত—
‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।
অযুত আলােকে ঝলসিছ নীল গগনে,
আকুল পুলকে উলসিছ ফুল কাননে,
দ্যুলােকে ভূলােকে বিলসিছ চল চরণে
তুমি চঞ্চলগামিনী।’
এই সৌন্দর্যলক্ষ্মীই আবার—
‘অন্তর মাঝে শুধু তুমি একা একাকী
তুমি অন্তরব্যাপিনী।’
বাহির অন্তরের এই নিগুঢ় সমন্বয়ে অন্তরের সৌন্দর্যধ্যান ও বাইরে সৌন্দর্যদৃষ্টি সম্মিলিত হয়েই ‘চিত্রা’র কবিতাগুলােতে গীতিকবিতার অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা বিরাট সত্তার অনুভূতি থেকেই জীবনদেবতার পরিকল্পনার উদ্ভব চিত্রার ‘অন্তর্যামী’ কবিতাটিতে আমরা তাই লক্ষ্য করি। ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘উর্বশী’ একটি অসাধারণ কবিতা। অজিত চক্রবর্তী বলেছেন, “উর্বশীর ন্যায় সৌন্দর্যবােধের এমন পরিপূর্ণ প্রকাশ সমগ্র য়ুরােপীয় সাহিত্যে কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। যে সৌন্দর্য সমস্ত প্রয়ােজনের বাইরে সে আপনাতে আপনি একটি সত্তা।” এমন কি অধ্যাপক টমসনও বলেন, ‘Urbasi is perhaps the greatest lyric in all Bengali literature and probably the most unalloyed and perfect worship of beauty which the world literature contain.’ ‘চিত্রা’র বিজয়িনী’র কবিতাটিতে দেহগত রূপবর্ণনার মধ্যে দেহাতীত, বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের যে ব্যঞ্জনা ফুটেছে তার কোন তুলনা মিলবে না। এই পর্বের শেষ গুরুত্বপূর্ণ কাব্য চৈতালি তেই কবির একটা যুগের সাহিত্য-সাধনার শেষ হয়। এই কাব্যটির নামকরণ খুব তাৎপর্যপূর্ণ, চৈতালি’, অর্থাৎ চৈত্রমাসে সংগৃহীত বছরের শেষ ফসল। এর সনেট-জাতীয় কবিতাগুলির মধ্যে একদিকে যৌবন ও সৌন্দর্যের বসন্তচঞ্চল জীবন থেকে বিদায় গ্রহণের প্রস্তুতির বিষাদ, আর অন্যদিকে কবিমানসে অধ্যাত্ম চেতনার আসন্ন আবির্ভাবের আভাষ অভিব্যক্ত।
রােমান্টিক কল্পনা ও বিশিষ্ট জীবনদর্শন, বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলনাকুতি, জীবনদেবতার লীলাচেতনা, প্রেমভাবনার ‘উন্নয়ন’-এ ‘স্বাতন্ত্র্য-সমুজ্জ্বল’, ‘সােনার তরী’ ‘চিত্রা’ পর্বের কবিতাগুলি আর নৈবেদ্য- খেয়া-গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মভাবপূর্ণ কবিতার মধ্যে অন্তর্বর্তী পর্বের রচনা হিসাবে ‘কথা’ (১৯০০) ‘কাহিনী’ (১৯০০) ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) প্রভৃতি কাব্যগুলিকে গ্রহণ করতে পারি। কথা ও কাহিনী’তে কবির দেশের ইতিহাসের মানস-পরিক্রমা, প্রাচীন ঐতিহ্য- কীর্তির উদাত্ত প্রশস্তি কাহিনীর দ্রুতচারিতায় এক বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি লাভ করেছে। এই পর্বের কবিতাগুলি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, একসময়ে গিয়ে পড়েছিলুম ইতিহাসের রাজ্যে। সেই সময়ে এই বহির্দুষ্টির প্রেরণা কাব্যে ও নাট্যে ভীড় করে এসেছিল ইতিহাসের সঞ্চয় নিয়ে। এমনি করে এই সময়ে আমার কাব্যে একটা মহল তৈরি হয়ে উঠেছে যার দৃশ্য জেগেছে। ছবিতে, যার রস নেমেছে কাহিনীতে, যার রূপের আভাস দিয়েছে নাটকীয়তায়। ‘কল্পনা’র কোনও কোনও কবিতায় কালিদাসের অপূর্ব চিত্র-সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে—
‘দূরে বহুদূরে,
স্বপ্নলােকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছি কবে সিপ্রানদীপারে
মাের পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।’
‘ক্ষণিকা’ রবীন্দ্রনাথের একটা বিচিত্র অভিনব সৃষ্টি। কথ্যভাষার প্রয়ােগে এই কাব্যের ছন্দ ও ভাষাভঙ্গি স্বচ্ছতােয়া নদীর মতই গতি পেয়ে সজীব হয়ে উঠেছে।
অতঃপর চতুর্থ পর্বে কবি আধ্যাত্মিক ভাবনার জগতে এক বিচিত্র মুক্তির স্বাদ পেলেন। তার জীবনদেবতা-কল্পনার মধ্যে যে অন্তরের আভাষ ছিল, তাই এবার প্রত্যক্ষ প্রেরণারূপে এই পর্বের কাব্য ‘খেয়া’ (১৯০৬), ‘নৈবেদ্য’ (১৯০৯), ‘গীতাঞ্জলি’ প্রভৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল, জীবনদেবতা এই পর্বে বিশ্বদেবতায় রূপান্তরিত হলেন। সােনার তরী-চিত্রা’য় প্রেম-সৌন্দর্যের জগৎ থেকে এই পর্যায়ে অপরূপ অসীমের নিকট আত্মনিবেদনের আধ্যাত্মিক আকৃতির জগতে এসে উত্তীর্ণ হলেন। ‘নৈবেদ্য’র প্রথম কবিতাটিতে কবি বিশ্বদেবতার উদ্দেশ্যে তার আত্মার নম্র নিবেদন জানিয়েছেন—
‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,
দাঁড়াব তােমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর হে ভুবনেশ্বর
দাঁড়াব তােমারি সম্মুখে।
তােমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে,
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তােমারি সম্মুখে।’
“নৈবেদ্য’র স্তবকবন্ধে রচিত এই গানগুলােতে বিশ্বদেবতাকে আবাহন করবার আকৃতি রূপ পেয়েছে, আর সনেটগুলােতে প্রাচীন ভারতবর্ষের পবিত্র ঋষিদের তপস্যালব্ধ জীবনাদর্শের অনুপ্রেরণায় বর্তমানের সকল কলুষ ভীরুতা হীনতার গ্লানি প্রকাশ করেছেন।
‘খেয়া’য় ‘গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মচিন্তার আভাস আরও পরিস্ফুট। ‘খেয়া’ নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ- খেয়া নৌকা নদীর এক তটপ্রান্তে থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি দেয়। তেমনি কবির ‘সােনার তরী-চিত্রা’র প্রেম-সৌন্দর্যের জগৎ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মজগতে যাত্রা ‘খেয়া’র বিভিন্ন কবিতায় ব্যঞ্জিত হয়েছে। খেয়া কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ চিত্রকল্পগুলাের মধ্যে একটা বিষাদ ও উদাস ভাবের ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়বেচাকেনা, হাটের শেষ, দিনান্তের দৃশ্য, কাশের বন, শূন্য নদীর তীর, ঘাট, সন্ধ্যাপ্রদীপ, স্তব্ধ অন্ধকার, শূন্য ঘর। কবি যে বাইরের বিচিত্র সৌন্দর্য জগৎ থেকে ঘুরে ফিরে এসেছে, তার পরিচয় তার আকাঙ্ক্ষাতেই মেলে ও তিনি খেয়া’র কবিতাগুলােতে বারবার বলেছেন, এখন কেবল একটি পেলেই বাঁচি একতারা একটি আর ফুলবনের একটি কুসুমই তার প্রয়ােজন, এখন তাঁকে আবার ক্ষীণ আলােকে মাঠের পথে একাকী চলতে হবে।
‘এখন তােমায় তারার ক্ষীণালােকে
চলতে হবে মাঠের পথে একা
গিরি কানন পড়বে কি আর চোখে,
কুটিরগুলি যাবে কি আর দেখা।’
অবশ্য দু-একটি কবিতায় সােনার-তরী চিত্রা যুগের ভাবের অনুকরণ মেলে। গীতাঞ্জলিতে কবির এই অধ্যাত্মচেতনার আত্মনিবেদন সম্পূর্ণ হল, ঈশ্বর-চেতনায় কবির হৃদয় কূলে কূলে পূর্ণ হয়ে উঠল—
‘প্রভাত-আলাের ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।
এই তােমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।
তােমারি মুখ ঐ নুয়েছে – মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তােমারি চরণ।’
‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘মহুয়া’ (১৯২৫) পঞ্চম পর্বের এই কাব্যগুলিতে কবিমানসের নতুন দিক-পরিবর্তন লক্ষণীয়। বলাকায় কবির ভাবকল্পনা নতুন মােড় নিয়েছে। পূর্ববর্তী অধ্যাত্মপর্বে কবির মন যে ভাবে ঈশ্বরানুভূতিতে মগ্ন ছিল ‘বলাকা’য় তা’ আবার ফিরে এলাে মানব-জীবন-পথে। অবশ্য তারও পূর্বে তিনি ছিলেন মানব-জীবন-পথেই, কিন্তু তার সঙ্গে এবারের পার্থক্য সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “মানসী হইতে ক্ষণিকা পর্যন্ত কবির যে রূপ রসের জগৎ—প্রকৃতি ও মানবের সৌন্দর্য প্রেমের জগৎসে জগৎ হইতে বলাকার জগৎ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। পূর্বের জগৎ প্রত্যক্ষ অনুভূতির জগৎ, ধরণী ও মানব জীবনের রূপচেতনার অকপট, প্রত্যক্ষ প্রকাশের অনাবিল রসেচ্ছল জগৎ—একান্তভাবে কাব্যের জগৎ; আর বলাকার জগৎ, প্রকৃতি ও মানবের সত্যকার গভীর রহস্য ও তাহাদের রূপরসের প্রকৃত তত্ত্বানুভূতির জগৎ—বিশেষভাবে কাব্যদর্শনের জগৎ।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বলাকা কবিতাগুলি রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘বলাকা’র কবিতাগুলিতে গতিতত্ত্বকেই কাব্যসত্য করে তুলেছেন। কাব্যরচনার অল্প পূর্বেই কবি য়ুরােপ ভ্রমণ করে সমকালের ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় ও ভবিষ্যতের আভাস পেয়ে এসেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, উদ্দাম ঝড়ের বেগে চলতে না পারলে জীবন সংগ্রামে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই তাঁর কাব্যে শােনা গেল গতিবাদের সুর। কেউ কেউ মনে করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ফরাসী মনীষী বার্গসর Elan Vital তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই গতিবাদের প্রেরণা লাভ করেছেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ উক্ত গতিবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েও থাকতে পারেন, কিন্তু উভয়ের দর্শনে পার্থক্যও রয়েছে! রবীন্দ্রনাথের গতিপথ অপরিণামী নয়। তা ছাড়া বাল্যাবধি উপনিষদের মন্ত্রে। দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথের নিকট ‘চরৈবেতি’ তত্ত্বও অজ্ঞাত ছিল না। তার প্রভাত সংগীতে’র নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায় সেই পরিণামী গতিবাদের পরিচয়ও আমরা পেয়েছি।” ‘বলাকা’র ঝড়ের খেয়া কবিতায় কবি বলেন, “মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে……তবে ঘর-ছাড়া সবে, অন্তরের কী আশ্বাস রবে।” এবং ‘বলাকা’ পর্বের আরও অন্য বহু কবিতায় গতিবাদের একটা সার্থক পরিণতির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত করে গেছেন। অতএব রবীন্দ্রনাথের গতিবাদে যে একটা স্বাতন্ত্রের পরিচয় রয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কবি তাঁর নতুন উপলব্ধি-অনুযায়ী তার প্রকাশের ভাষা ও ছন্দকেও নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন। ‘বলাকা’র ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চরণ-বিন্যাসের অসমতা ও আঠার মাত্রার পয়ারের একটি চরণের পর্বগুলাে ভেঙ্গে, কখনও একটিমাত্র পর্বেও একটি চরণ গঠিত হয়েছে। আবেগের তরঙ্গোচ্ছাস এবং সংকোচনই চরণগুলাের পরিমাপকে নিয়ন্ত্রিত করে- “বলাকা’র অনিয়মিত, অসম ছন্দবিন্যাসে, ঝড়-খাওয়া মনের বিসর্পিত আন্দোলনে, উহার চিন্তাধারার তট হইতে তটান্তরে প্রহত ভাবতরঙ্গের অস্থির গতি ও দূরব্যাপী বিস্তার, উহার সমাধান-অন্বেষণ ও আত্মানুসন্ধানের সংশয়াকুল পদক্ষেপ যেন আপন প্রতিচ্ছবি মুদ্রিত করিয়াছে।’
‘বলাকা’ এবং ‘পূরবী’র মধ্যবর্তীকালে রচিত ‘পলাতকা’ য় কবির মর্তপ্রীতি সহজ সরল কথনভঙ্গিতে অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘পূরবী’তে সৌন্দর্যবােধ ও যৌবন স্মৃতিচারণায় আবেগের সঙ্গে আসন্ন বিদায়ের করুণ সুর ও পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা মিলিত হয়ে গীতিকবিতার অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। ‘পূরবী’তে একদিকে পাই মৃত্তিকামমতার আবেগ—
‘যাই ফিরে যাই মাটির বুকে,
যাই চলে যাই মুক্তিসুখে,
ইটের শিকল ফেলে দিই টুটে;
আজ ধরণী আপন হাতে
অন্ন দিলেন আমার পাতে
ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে।’
অন্যদিকে জীবনের আসন্ন অন্তিম লগ্নটির পটভূমিতে কবির বিদায় গ্রহণের প্রস্তুতির বিষাদ—
‘এবারের মতাে করে শেষ
প্রাণে যদি পেয়ে থাক চরমের পরম উদ্দেশ;
………
যদি রাত্রি তার
খুলে দেয় নীরবের দ্বার,
নিয়ে যায় নিঃশব্দ সংকেত ধীরে ধীরে সকল
বাণীর শেষ সাগর সংগমতীর্থতীরে,
সেই শতদল হতে যদি গন্ধ পেয়ে থাকে তার ;
মানসরসে যাহা শেষ বর্ষ শেষ নমস্কার।’
কবির প্রৌঢ় বয়সের রচনা ‘মহুয়া’য় আমরা এক অপূর্ব, দ্বিতীয় যৌবনের রক্তরাগ লক্ষ্য করি এখানে প্রেমের প্রবল প্রাণশক্তি সংকীর্ণ প্রাত্যহিকতায়, আরামের পঙ্কশয্যায় মলিন ও কলুষ নয়, বীর্যে, মহৎ কর্তব্যবােধে, বিশ্বচেতনায় ও অনন্ত গতিপ্রেরণায় উদ্দীপিত এবং উজ্জ্বল।
ষষ্ঠ পর্বের ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষসপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬), ‘শ্যামলী’ (১৯৩৭) প্রভৃতি কাব্যগুলিকে এক নতুন দুঃসাহসিক কাব্যকলার পরীক্ষায় রবীন্দ্র-কবিমানসের দীপ্ত আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করি। নিজের তৃপ্তিবিহীন কবিত্বের দুর্নিবার প্রেরণায় কবি বার বার নিজের কীর্তিকেই অতিক্রম করেছেন। তার আগে বলাকায় তিনি মুক্তকে প্রবহমাণ পয়ার ছন্দে নতুন পরীক্ষা করেছিলেন, আর এই পর্বে গদ্য-ছন্দের অভিনব প্রকরণে আধুনিক বাঙলা কবিতার বিপুল সম্ভাবনাই উন্মােচিত হল। ‘পুনশ্চ’-য় এই গদ্য কবিতার প্রথম সূত্রপাত হল, এখানেই কবি গদ্যছন্দের আঙ্গিকটি প্রথম সুস্পষ্টভাবে নির্মাণ করেন। ‘পুনশ্চ’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ শুধু ছন্দেই অভিনবত্ব সৃষ্টি করেন নি, তার কবিতার বিষয়বস্তু এবং পরিবেষণেও অনেকটা নতুনত্ব এনেছে। অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস বলেন, “এর অনেকগুলি কবিতায় কবি সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনাকে কাব্যের বিষয়ীভূত করতে চেয়েছেন—যার বাইরে আছে ক্ষুদ্র কাহিনী, সর্বত্র বিজড়িত আছে কবিমানসের সহানুভূতি। রবীন্দ্রনাথের যে কবিমানস অতুলনীয় ছােটগল্পগুলির সৃষ্টি করেছে, তাই গদ্যছন্দের সুবিস্তৃত বাহন অবলম্বন করে সহজেই কাব্যের ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বাস্তবতার মধ্যে বিচরণ করেছে। কিন্তু বলা বাহুল্য, এগুলি কাব্যাকারে ছােট গল্প হয় নি,…কাব্যরূপ বিচার করে বলা যায়, কবি এগুলিকে কাব্যই করতে চেয়েছেন, গল্প নয়।”
‘সোনার তরী’ ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটির পৃথিবীকে জীবনের গভীরে আবাহন করে নেবার আবেগের উষ্ণতার তুলনায় ‘পত্রপুটে’র এই অংশের পৃথিবী বন্দনার শান্ত, গভীর সুর, আবেগােচ্ছাসের পরিবর্তে দার্শনিকতার স্বাতন্ত্র সহজেই কাব্য-পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ পর্যায়ের কবিতাগুলি-সম্বন্ধে ডাঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেন, “কিন্তু এই কবিতাগুলিতে তীব্র হৃদয়াবেগের প্রাধান্য নাই, কল্পনার উদ্দীপনা কিংবা পঞ্চমরাগে ঝঙ্কারও নাই। এই চিত্তের উদগ্র কামনার দীপ্তি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতায় বরাবরই অনুপস্থিত। কয়েকটি কবিতায় প্রেমক্লিষ্ট চিরন্তন সমস্যার অভিঘাত সুস্পষ্ট। অথচ মােটামুটিভাবে এই কবিতাগুলিতে সহজ, মৃদু ও শান্ত প্রেমের আকস্মিক অথচ অবিনশ্বর পরিচয়ই বিচিত্র রেখায়, চিরন্তন রহস্যের স্তিমিত উচ্ছলতায় দীপ্তিলাভ করিয়াছে। উদ্বেলিত উচ্ছসিত আবেগ সর্বত্রই যেন সহজ আয়াসে সংযত।”
অন্ত্যপর্বের কাব্যধারায় পাই ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৮), ‘আকাশপ্রদীপ’ (১৯৩৯), ‘সেঁজুতি’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’, ‘রােগশয্যায়’ (১৯৪১), ‘আরােগ্য’ (১৯৪১) ও ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১)। ‘প্রান্তিকে’র অবসন্ন চেতনার গােধুলিবেলার পটভূমিতে কবি জীবনের পরম সত্য অন্নেষণ করেছেন; নিজের দেহের ব্যাধিযন্ত্রণা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানব-সভ্যতার শােচনীয় দুর্গতির পটে কবির জীবনের গভীর মূল্যবোেধ ‘রােগশয্যা’, ‘আরােগ্য’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলাে শ্লোকের মত কঠিন, সংহত রূপে হীরকদ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। রােগজীর্ণ দেহের যন্ত্রণার দহনের মধ্য দিয়েই তিনি শুচিশুদ্ধ জীবনপ্রত্যয়ে স্থিত হন।
তার বার্ধক্য, জীবনের শেষ লগ্নে কৃপণা প্রকৃতি তাকে ইন্দ্রিয়শক্তিগুলাে থেকে বঞ্চিত করেছে, তবু কবি তাঁর রােগজীর্ণ বার্ধক্যগ্রস্ত দেহের সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সবরকম অলংকারবর্জিত, নিরাভরণ ভঙ্গিতে, মন্ত্রোচ্চারণের গাম্ভীর্যে, গভীরতম চৈতন্যের উপলব্ধির কঠিন শুচিতায় মানবাত্মার অপরাজেয় মহিমাকে ঘােষণা করে যান—
‘যদি মােরে পঙ্গু কর, যদি মােরে কর অন্ধ প্রায়,
যদি বা প্রচ্ছন্ন কর নিঃশক্তির প্রদোষাচ্ছায়ায়,
বাঁধ বার্ধক্য জালে, তবু ভাঙা মন্দির বেদিতে
প্রতিমা অক্ষুন্ন রবে সগৌরবে, তারে কেড়ে নিতে
শক্তি নাই তব।’
উপনিষদের অসীমের চেতনা কবির স্বকীয় জীবনােপলব্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই পর্যায়ে চৈতন্যভাস্বর, প্রজ্ঞাগম্ভীর আধুনিক গীতিকবিতার চরম উৎকর্ষকেই প্রকাশিত করেছে, মৃত্যুর পূর্বে রচিত তার শেষ দুটি কবিতায়ও আমরা তা দেখি। রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যপর্বের কাব্যগুলি-বিষয়ে অধ্যাপক, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যসমূহে এক প্রশান্ত নিরাসক্ত মন লইয়া সমস্ত মােহবন্ধন ও মায়াবিভ্রম ছিন্ন করিয়া, তাহার ব্যক্তিজীবনের সমস্ত অর্জিত সম্পদ এমন কি অহংবােধকে বিসর্জন দিয়া অস্তিত্বের পরম সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে; সমস্ত পরিচয় ও বিশিষ্ট চিহ্ন-বর্জিত এক চেতনাবিন্দুরুপে জ্যোতিঃসমুদ্রের মহাসঙ্গমতীর্থে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘদিনের কাব্যসাধনায়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে, ছন্দ, প্রকাশভঙ্গি তথা আঙ্গিকের বিভিন্ন পরীক্ষায় আধুনিক বাঙলা কবিতার গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য নির্মাণ করেছেন এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তার যােগ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
Leave a comment