অথবা, ইসলামে গণতন্ত্র
উপস্থাপনাঃ “Islam is a Universal religion.” ইসলাম একটি শাশ্বত জীবনব্যবস্থা। মানব জীবনের সকল বিষয়ে এটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয় গণতন্ত্র সম্পর্কেও ইসলাম সুনির্দিষ্ট ধারণা দিয়েছে। গণতন্ত্র একটি শাসন পদ্ধতির নাম। জনগণের সমর্থনে জনগণের ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয় এ শাসনব্যবস্থা।
ইসলামের পরিচয়ঃ ‘ইসলাম’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশসমূহ মেনে সেগুলোর আনুগত্য করাই ইসলাম। আল্লাহর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই হলো ইসলামের মূলভিত্তি। অন্য কথায় আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করলে তার স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত হয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “তুমি কি জান না যে, আল্লাহর জন্যই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আধিপত্য।” (সূরা বাকারা ১০৭)
গণতন্ত্রের পরিচয়ঃ গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো – Democracy। এটি গ্রীক শব্দ Demos ও Kratia থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Demos অর্থ জনগণ এবং Kratia অর্থ শাসন বা কর্তৃত্ব। সুতরাং Democracy বা গণতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো জনগণের শাসন।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-
ক. অধ্যাপক শেলী বলেন- Democracy is government in which everyone has a share অর্থাৎ, গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে সকলের অংশগ্রহণ রয়েছে।
খ. C. F. Strong -এর মতে, শাসিতের সক্রিয় সম্মতির ওপর যে সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলে।
গ. আব্রাহাম লিংকন বলেন- Democracy is a government of the people by the people and for the people. অর্থাৎ, জনগণের কল্যাণের জন্য জনসাধারণ কর্তৃক পরিচালিত ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাই হলো গণতন্ত্র।
মোট কথা, জীবনের সর্বস্তরে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের নাম ‘গণতন্ত্র’। যেমন— প্রাণ ছাড়া প্রাণী হয় না, জনমত তথা জনগণের সার্বভৌমত্ব ছাড়াও তেমনি গণতন্ত্র হয় না। এটাই গণতন্ত্রের মূলভিত্তি।
ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যঃ ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে বিশ্বাস, আদর্শ ও নীতিগতভাবে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
বিশ্বাসগত পার্থক্যঃ
১. গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হলো ‘জনমত’ আর ইসলামের মূলভিত্তি হলো আল্লাহর অভিপ্রায়।
২. সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার প্রতি সমর্থনের নাম গণতন্ত্র, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম।
৩. গণতন্ত্রে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ, কিন্তু ইসলামে সকল ক্ষমতার উৎস আল্লাহ।
৪. গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ, ইসলামে সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা।
৫. গণতান্ত্রিক বিশ্বাস, মানব রচিত সংবিধানেই রয়েছে মানবতার মুক্তি, আর ইসলামী বিশ্বাস হলো আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধানেই রয়েছে মানবতার মুক্তি।
আদর্শ ও নীতিগত পার্থক্যঃ
১. গণতন্ত্রে মত প্রকাশে ভোটদান ও নির্বাচনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত। ইসলামে এসব অধিকার স্বীকৃত হলেও যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে গুণীজনেরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হবেন।
২. উত্তরাধিকার ও প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষে কোনো পার্থক্য গণতন্ত্রে নেই, কিন্তু ইসলামে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
৩. পরম সহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের এক বিশেষ আদর্শ। নৈতিকতার কোনো বালাই গণতন্ত্রে নেই। যেমন- জরায়ুর স্বাধীনতা, সমকামিতা, কোনো মতামতকেই বর্জন করতে বাধ্য নয় গণতন্ত্র। কিন্তু ইসলামে শাশ্বত আদর্শ ও নৈতিক মানসম্পন্ন পরমত সমাদৃত। অনৈতিক পরমত ইসলামে সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়।
৪. গণতন্ত্রে গরিষ্ঠের সমর্থন সকল বৈধতার মানদণ্ড, কিন্তু ইসলামে শাশ্বত বা প্রত্যাদিষ্ট বিধান গরিষ্ঠের সমর্থন ছাড়াই বৈধ।
৫. গণতন্ত্রে মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকার্য নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু ইসলামে আল্লাহ প্রদত্ত আইন দ্বারা বিচারকার্য নিয়ন্ত্রিত।
৬. গণতান্ত্রিক বিশ্বাসে ধর্ম অবশ্যই রাজনীতি বর্জিত। পক্ষান্তরে ইসলামী বিশ্বাসে মানুষের প্রথম উপাধি ‘খলিফা’, প্রতিনিধি। কাজেই ইসলাম ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য।
৪. গণতন্ত্রের প্রসারঃ সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যুর পর বিশ্ব আজ ইসলাম ও গণতন্ত্র এ দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আজকে গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হয়- প্রত্যক্ষ নির্বাচন, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহিমূলক সরকার, স্বাধীনতা, প্রগতি ইত্যাদিকে। গণতন্ত্র ক্ষমতায়নের মোহে সাধারণের অহংবোধ জাগ্রত করে এবং স্বাধীনতার নামে সামষ্টিক স্বেচ্ছাচারিতাকে বৈধ জ্ঞান করতে শেখায়। প্রগতি ও মুক্ত চিন্তার নামে মূলত সাধারণের অহংকেই প্রতিষ্ঠা করে। তাই সর্বত্রই আজ জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। প্রসারিত হচ্ছে গণতন্ত্রের দিগন্ত।
৫. ইসলামী গণতন্ত্রঃ ইসলামের মূলভিত্তি হলো আল্লাহর ইচ্ছা বা অভিমত, অন্যদিকে গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হলো জনগণের ইচ্ছা বা জনমত। দর্শনের বিচারে ইসলামী গণতন্ত্রকে একটি যৌগ দর্শন বিবেচনা করলে বুঝতে হবে এ দর্শনে ইসলামের মৌলিকত্ব এবং গণতন্ত্রের মৌলিকত্ব সমভাবে বিপন্ন হয়েছে। কেননা গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব হলো জনগণের, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব গণতন্ত্র স্বীকার করে না। অপরপক্ষে ইসলামে সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। জনমত দ্বারা ইসলাম প্রভাবিত হতে পারে না। তাই প্রচলিত গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
উপসংহারঃ নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বিজয় মানেই গণমানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বিসর্জিত। গণতন্ত্র নৈতিকতার দ্বন্দ্বকে মোহগ্রস্ত গরিষ্ঠের দাবির মুখে বিসর্জন দিয়ে সভ্যতাকে কৌশলে অনাচারগ্রস্থ করে। তবে ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র একটি মতবাদের নাম। অন্যদিকে ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থা একটি ধর্মের নাম। তাই এ দুটির মধ্যে তুলনা চলে না।
Leave a comment